এটা কি ঠিক যে আপনার সব সিনেমাই কোনো চিত্রনাট্য ছাড়াই নির্মিত?
হ্যাঁ, তা ঠিক। যখন আমরা কোনো সিনেমা নিয়ে কাজ করতে শুরু করি, তখন আমার কাছে তৈরী অথবা সমাপ্ত কোনো গল্প থাকে না। মূলত, আমার সময় থাকে না, ফলে গল্পটি আপনা-আপনিই এগুতে থাকে, যখন আমি গল্পের ছবিগুলো আঁকা শুরু করি। বস্তুত, সিনেমার কাজ ততক্ষণে শুরু হয়ে যায়, যদিও তখনও আমি গল্পের ছবিগুলো আঁকতে থাকি। আমরা কখনোই জানতাম না যে আসলেই গল্পটি কোথায় গিয়ে শেষ হবে, অথচ সিনেমার কাজ চালিয়ে যেতাম, যেভাবে তা এগিয়ে যেত। এটা অবশ্যই এ্যানিমেশন সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে বিপদজ্জনক এবং চাইতাম যে তা ভিন্ন হোক, কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আমি ওভাবেই কাজ করি এবং বাকিরা সদয় থাকার ফলে আমার এই প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে বাধ্য হত।
কিন্তু, যতদূর জানি, এই কাজটি সফলভাবে সম্পাদন করার জন্য গল্পের চরিত্রগুলোর প্রতি গভীর আত্ননিবিষ্টতা খুবই জরুরী।
আমার কাছে গল্পের চরিত্রগুলোর প্রতি গভীর আত্মনিবিষ্টতার চেয়ে সিনেমার কাঙ্খিত দৈর্ঘ্যই মূখ্য। কত সময় ধরে আমরা সিনেমাটি বানাব? তা কী দুই ঘন্টার হবে, না কী তিন ঘন্টার? সেটাই মূখ্য সমস্যা। আমি এই ব্যাপারে সব সময়ই আমার প্রযোজকের সাথে তর্ক করি আর সে স্বভাবতই বলে, যদি আমি চাই তবে সে পরবর্তী এক বছরের জন্যও তা বাড়াতে রাজি। যদিও তার কোনো ইচ্ছেই নেই আমাকে বাড়তি একটি বছর দেবার, কিন্তু, সে এটা করে আমাকে চমকে দেবার জন্য এবং ব্যাপারটি আমাকে কাজে ফিরে আসতে উসকে দেয়। তাছাড়া আমি নিজেও চাই না বছর ধরে নিজের কাজের দাসে পরিণত হতে, যার জন্য আসলেই অতটা সময় প্রয়োজন নেই, আর সে এমন বলার পর স্বাভাবিকভাবেই আমি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও পূর্বের চেয়ে দ্রুত গতিতে কাজে ফিরে আসি। সিনেমা নির্দেশনার ব্যাপারে আমি আরেকটি নীতি অনুসরণ করি, তা হলো, আমার সহকর্মীদের তৈরী সব কিছুই ভালভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করি। এমন কী সেগুলো যদি আমার সিনেমার পটভূমির সাথে নাও যায়, ছুঁড়ে ফেলি না, বরং চেষ্টা করি কীভাবে তার সদ্ব্যবহার করা যায়।
সুতরাং বলা যেতে পারে,একটি চরিত্র যখন সৃষ্টি করা হয়,সেটা ততক্ষণ অব্দি বাদ দেয়া হয় না, যতক্ষণ পর্যন্ত না সিনেমা শেষ হয়?
আসলে চরিত্রগুলো বারবার তাদের সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার পুনরাবৃত্তির ফলে জন্ম নেয়, আর তাদের সীমারেখা আমার মাথার মধ্যে থাকে। মূলতঃ, আমি নিজেও একটি চরিত্র হয়ে পড়ি এবং সেই চরিত্র হিসেবে গল্পের লোকেশনগুলো বারবার, অসংখ্যবার ঘুরে ঘুরে দেখি এবং কেবলমাত্র তারপরই চরিত্রগুলো আঁকা শুরু করি। কিন্তু, ঘোরার কাজটি তখনও অসংখ্যবার করতেই থাকি এবং কেবলমাত্র শেষ মুহূর্তের পূর্বে গিয়ে থামি।
চরিত্রের সাথে আপনার এই ব্যক্তিগত সংযুক্তি থেকে কীভাবে আপনি আপনার অধিকাংশ সিনেমারই প্রধান চরিত্র বালিকা, বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর অনেক বেশি জটিল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, আপাতত শুধু এই বলতে চাই, কারণ আমি নারীদের অনেক বেশি ভালবাসি (হাসিসহ)।
আপনার পূর্বের সিনেমারগুলোর প্রধান নারী চরিত্রের চেয়ে ‘স্পিরিটেড এ্যাওয়ে’ এর প্রধান নারী চরিত্র ‘চিহিরো’ অপেক্ষাকৃত ভিন্ন ধরনের। এখানে তাকে অবশ্যই কম সাহসী মনে হয় এবং আমরা তার প্রেরণা বা অতীত সম্পর্কে বেশি কিছু জানতে পারি না।
আমি চিহিরো চরিত্রটি এভাবে সৃষ্টি করতে চাইনি, কারণ জাপানে এই ধরনের অসংখ্য বালিকা বর্তমান, যারা তাদের সুখি করার জন্য তাদের পিতা-মাতার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার বিষয়ে একেবারেই সহানুভূতিহীন। সিনেমার একটি দৃশ্য চিহিরো তার বাবার ডাকে সাড়া দেয় না এবং যখন তার বাবা দ্বিতীয়বারের জন্য ডাকে, কেবল তখনই সাড়া দেয়। আমার অনেক সহকর্মীই আমাকে এই ব্যাপারটি দুইবারের পরিবর্তে তিনবার করার জন্য বলেছিল, কেন না আজকালকার বালিকারা এমনই, তারা তাদের পিতা-মাতার ডাকে তড়িৎ সাড়া দেয় না। এই উপলব্ধি থেকে আমি সিনেমাটি বানানোর সিদ্ধান্ত নিই যে,‘দশ বছরের বালিকা’-এই বিশেষ শ্রেণীর শিশুদের জন্য কোনো সিনেমা বানানো হয়নি, আর তা আমার গোচরে আসে এক বন্ধুর কন্যাকে দেখে, যে তার বয়সি শিশুর জন্য এমন কোনো সিনেমা নেই, যা সরাসরি তার সাথে কথা বলতে সক্ষম। বালিকারা অবশ্যই তাদের বয়সি চরিত্র সম্বলিত সিনেমাগুলো দেখে, কিন্তু, তারা কখনোই নিজেদের তাদের সাথে মেলায় না, কেন না এই চরিত্রগুলো কল্পিত, যা কোনোভাবেই তাদের সাথে সম্পর্কিত নয়।
‘স্পিরিটেড এ্যাওয়ে’ দ্বারা আমি তাদের এই বলতে চেয়েছি, ‘চিন্তা করো না, শেষ পর্যন্ত গিয়ে সব ঠিক হয়ে যাবে, যেখানে তোমার জন্য কিছু রয়েছে’, যা কেবল সিনেমাতেই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও বর্তমান, আর সে জন্য আমার এমন একজন হিরোইন প্রয়োজন ছিল, যে নিতান্তই সাধারণ বালিকা, যে উড়তে কিংবা অসম্ভব কিছু করে দেখাতে পারে না বরং আর দশটা বালিকার মতই সাধারণ, যাকে জাপানের যে কোনো স্থানে সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। যতবার আমি চিহিরো চরিত্র ও তার কাজকর্ম নিয়ে আঁকতে বসেছি, ততবার ভেবেছি যে, আমার বন্ধুর কন্যাটি কিংবা তার বন্ধুরা কাজটি করতে পারবে তো,আর সেটাই ছিল প্রতিটি দৃশ্যে চিহিরোর কাছ থেকে আমার প্রধান চাওয়া, যখন আমি তাকে কোনো কাজ অথবা সমস্যার সামনে দাঁড় করিয়েছি, কারণ এই সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠার মাধ্যমেই ছোট্ট জাপানী বালিকাটি হয়ে উঠে সক্ষম মানুষ। সিনেমাটি তৈরী করতে আমার তিন বছর লেগেছে, ততদিনে আমার বন্ধুর কন্যাটি দশ অতিক্রম করে তের-তে পদার্পণ করেছে, কিন্তু, সে এখনও সিনেমাটি পছন্দ করে, আর বিষয়টি আমাকে দারুণ সুখি করেছে।
যেহেতু আপনি বলেছেন, যখন কোনো গল্পের চরিত্রগুলো আঁকা শুরু করেন, তখন আপনি জানেন না যে গল্পটি কোথায় গিয়ে শেষ হবে। সেক্ষেত্রে এমন কোনো পন্থা বা বিন্যাস আছে কি, যা আপনি অবলম্বন করেন গল্পের সমাপ্তিতে পৌঁছানোর জন্য?
হ্যাঁ,আভ্যন্তরীণ এক ধরনের সাম্যতা রয়েছে, যা গল্প নিজেই দাবী করে, আর আমাকে তা সাহায্য করে গল্পের সমাপ্তিতে পৌঁছাতে। যেমন, স্পিরিটেড এ্যওয়েতে ১৪১৫টি বিভিন্ন ধরনের শট আছে, অথচ যখন কাজটি শুরু করি তখন ১২০০টির মতো শট নেব ধারণা করেছিলাম, কিন্তু, সিনেমাটি নিজেই আমাকে জানিয়ে দিল, না, এটাতে ১২০০ এর অধিক শট থাকবে। বস্তুত, এ আমি নই যে সিনেমা বানায় বরং সিনেমা নিজেই নিজেকে বানায়,আর আমার তাকে অনুসরণ করা ছাড়া উপায় থাকে না।
আমরা আপনার কাজে বিভিন্ন বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি দেখতে পাই, যা স্পিরিটেড এ্যওয়েতেও বর্তমান, বিষেশষত নস্টালজিয়ার মতো বিষয়। কীভাবে আপনি আপনার পূর্বের কাজগুলোর সাপেক্ষে এই সিনেমাটিকে দেখবেন?
এটা একটি কঠিন প্রশ্ন। আমি জানি যে, নস্টালজিয়া বিষয়টি বহুবার এসেছে আর সেটা কেবলমাত্র বড়দের বিষয় নয়। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ তার জীবনে বিশেষ সময়ের জন্য নস্টালজিয়া অনুভব করতে পারে, কিন্তু, আমার মনে হয় শিশুরাও নস্টালজিয়া অনুভব করতে সক্ষম। এটা মানবতার সবচেয়ে বেশি গৃহীত অনুভূতি, এবং সেই বিশেষ অনুভব যা আমাদের মানুষ হিসেবে পরিগণিত করে তোলে, যাকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা মুশকিল। যখন আমি তারকোভস্কির নস্টালজিয়া দেখেছিলাম, উপলব্ধি করেছিলাম যে, নস্টালজিয়া মূলত শ্বাশ্বত। যদিও ‘নস্টালজিয়া’ শব্দটি আমরা জাপানে ব্যবহার করি, কিন্তু, এটা জাপানীজ শব্দ নয়। সত্য বলতে, বিদেশী ভাষা বলতে না পারলেও সিনেমাটি আমি ভালভাবেই বুঝেছিলাম, যার অর্থ এই দাঁড়ায়, নস্টালজিয়া এমন একটি বিষয় যা আমরা সবাই ভাগাভাগি করি। যখন তুমি বেঁচে থাকবে, তখন জীবন থেকে কিছু না কিছু হারাবে, আর এটাই জীবনের বাস্তবতা, সুতরাং, নস্টালজিয়া আমাদের সবার জন্যই খুব স্বাভাবিক।
আপনার পূর্বের সিনেমাগুলো তুলনায় স্পিরিটেড এ্যাওয়ের যে বিষয়টি আমাকে চমকে দেয়, তা হলো লেখকের প্রকৃত স্বাধীনতা। এটা এমন অনুভব যে, আপনি সিনেমা ও এর কাহিনীকে যেখানে খুশি নিয়ে যেতে পারেন, এমন কী যুক্তি স্বাধীনতার উর্ধ্বেও।
যুক্তি মস্তিষ্কের সামনের অংশ ব্যবহার করে, এই যা। কিন্তু, আপনি যুক্তি দিয়ে সিনেমা বানাতে পারবেন না, কিংবা আপনি যদি অন্যভাবে দেখেন, তবে প্রত্যেকেই যুক্তি দিয়ে সিনেমা বানাতে সক্ষম, আর আমার উদ্দেশ্য ছিল যুক্তি ব্যবহার না করা। আমি আমার চেতনার গভীরে খুব ভালভাবেই খনন করতে চেষ্ট করি আর এই প্রক্রিয়ার এক পর্যায়ে ঢাকনাটি খুলে যায় এবং বিভিন্ন চিন্তা ও দর্শন মুক্তি পায়, যা দিয়ে আমি আমার সিনেমা বানানো শুরু করি। কিন্তু, ঢাকনাটা হয়তবা পুরোপুরি না খোলাই উত্তম, কেন না যদি আপনি আপনার অবচতেনকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হোন, তবে আপনার পক্ষে সামাজিক অথবা পারিবারিক জীবন-যাপন কষ্টকর হয়ে পড়বে।
আমার বিশ্বাস, আমরা যা অনুভব করি, মানুষের মস্তিষ্ক তার অধিক জানে বা গ্রহণ করে। আমার মস্তিস্কের সামনের অংশ আমাকে এই সংকেত দেয় না যে, দর্শকের কথা বিবেচনা করে একটি দৃশ্য কীভাবে পরিচালনা করব। উদাহরণ স্বরুপ বলা যেতে পারে, আমার কাছে সিনেমাটির সমাপ্তি দৃশ্য ছিল সেটা, যে দৃশ্যে চিহিরো একা একাই ট্রেনে চড়ল আর সেখানেই সিনেমাটি আমার কাছে সমাপ্ত মনে হয়েছিল। আমার মনে আছে, প্রথমবার যখন আমি একাই ট্রেনে চড়েছিলাম, তখন আমার অনুভূতি কেমন ছিল। সেই সব অনুভূতি চলমান দৃশ্যে আনার জন্য ট্রেনের জানালা দিয়ে পাহাড়, অরণ্য এই সব দৃশ্যাবলী দেখানো জরুরী ছিল না। অধিকাংশ মানুষই যারা প্রথমবার একা একা ট্রেনে চড়ার স্মৃতি মনে করতে পারে, তারা ট্রেনের বাইরের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলী ছাড়া আর কিছুই স্মরণ করতে পারে না, কারণ তারা সকলেই কেবলমাত্র ট্রেনে চড়ার দিকেই বিশেষভাবে মনোযোগি। সুতরাং, এটা প্রকাশ করা জন্য ট্রেনের বাইরের দৃশ্যাবলীর প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া পূর্ববর্তী দৃশ্যে আমি এমন একটি সিচুয়েশন তৈরী করেছিলাম, যেখানে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং দিগন্ত ডুবে ছিল পানিতে। অথচ কাজটি আমি করেছিলাম সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিজে ট্রেনের দৃশ্যে উপস্থিত হলাম, আর তখন নিজেকে বললাম, ‘কী সৌভাগ্যের যে আমি এটাকে একটি সমুদ্র বানিয়েছি’ (হাসিসহ)! আর এই দৃশ্যে কিছুক্ষণ কাজ করার পরই বুঝতে পারলাম যে,আমি অবচেতনভাবে কাজ করি। সাধারণ যুক্তি ছাড়াই এমন অনেক গভীর বিষয় আছে যা একটি গল্পের সৃষ্টি প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
আপনার কিছু সিনেমা ওয়েস্টার্ন অথবা ইউরোপিয়ান ল্যান্ডসকেপে নির্মিত, যেমন ‘লাপুতা’ কিংবা ‘পর্কো রসো’, অন্যান্যগুলোতে জাপানীজ ল্যান্ডসকেপ। আপনি কীসের উপর ভিত্তি কোনো সিনেমার সেট কী হবে তা নির্ধারণ করেন?
সিনেমাতে ব্যবহারের জন্য আমার কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে অনুমোদিত ল্যান্ডসকেপের ছবি ও পেইন্টিংস আছে, যাদের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে সেই মুহূর্তের উপর, যখন আমরা সিনেমার কাজ শুরু করি। সাধারণত আমি ও আমার প্রয়োজক মিলে বিষয়টি নির্ধারণ করি এবং এটা কেবলমাত্র সেই মুহূর্তের উপরই নির্ভর করে,কারণ যে মুহূর্ত থেকে আমি সিনেমা বানানোর ভাবনা শুরু করি,সেই মুহূর্ত থেকেই নথিপত্র সংগ্রহ করা শুরু করে দিই। আমি আমার সাথে অনেক ব্যাগপত্তর নিয়ে ভ্রমণ শুরু করি, ফলে আমার সংগ্রহে দৈনন্দিন পার্থিব জীবনের অনেক ছবি আছে, যা চিত্রায়ণ করতে চাই। গোসলখানায় একটি সিনেমার সেট নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যেমন স্পিরিটেড এ্যাওয়তে আছে, বিষয়টি এমন যার সম্পর্কে আমি শৈশব থেকেই চিন্তা করে আসছিলাম, যখন আমি নিজেও পাবলিক গোসলখানায় গিয়েছি। কিংবা টটোরোতে, জঙ্গলে সেট নির্ধারণ করার বিষয়টি সিনেমা শুরুর তের বছর পূর্বে থেকেই ভেবে আসছিলাম। অনুরূপভাবে লাপুতাতেও, লোকেশনটি ব্যবহার করার কথা সিনেমাটি শুরুর এক বছর পূর্বেই চিন্তা করেছিলাম। সুতরাং, আমি সবসময় এই ভাবনা ও ছবিগুলো সাথে নিয়ে চলি এবং সিনেমা শুরু করার মুহূর্তে শুধুমাত্র নির্বাচন করি।
অন্যান্য কিছু জাপানীজ এ্যানিমেশন সিনেমা ছাড়া আমরা সবসময় আপনার সিনেমায় পৃথিবীর এই দিক দেখতে পাই, যেখানে দৃঢ়প্রত্যয়, আশা ও মানুষের সদগুণের প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদি বিষয় তুলে ধরা হয়, এসব কি আপনি সচেতেনভাবে আপনার সিনেমায় যুক্ত করেন?
সত্যি বলতে, আমি নৈরাশ্যবাদী মানুষ। কিন্তু, যখন সিনেমা বানাই,আমি চাই না আমার নৈরাশ্য শিশুদের মধ্যে সঞ্চালিত হোক, বরং আমি তাকে আটকে রাখি। আমি মানি না যে, প্রাপ্ত বয়স্করা তাদের পার্থিব দর্শন ছোটদের উপর চাপিয়ে দেবে, কেন না শিশুরা নিজেরাই নিজস্ব দর্শন তৈরী করতে সক্ষম। সুতরাং, তাদের উপর আমাদের দর্শন জোর করে চাপিয়ে দেবার কোনো প্রয়োজন নেই।
সুতরাং, আপনি অনুভব করেন যে আপনার সিনেমাগুলো মূলত শিশুদের জন্যই বানানো?
আমি কখনোই বলিনি যে পর্কো রসো শিশুদের সিনেমা আর আমি নিজেও তা ভাবি না। কিন্তু, পর্কো রসো ছাড়া আমার সব সিনেমাই মূলথ শিশুদের জন্যই বানানো। বড়দের জন্য সিনেমা বানানোর লোক অনেক আছে, সুতরাং বিষয়টি আমি তাদের জন্যই ছেড়ে দেব এবং শিশুদের প্রতি মনোনিবেশ করব।
কিন্তু, লক্ষ লক্ষ প্রাপ্ত বয়স্করা আছে যারা আপনার সিনেমা দেখে এবং যথেষ্ট আনন্দ পায় আপনার কাজ হতে।
বিষয়টি অবশ্যই আমাকে যথেষ্ট আনন্দ দেয়। খুব সাধারণভাবে বললে, আমার ধারণা, একটি সিনেমা যা শিশুদের জন্য বানানো তা যদি যথাযথ অনুরাগের সহিত বানানো যায়, তবে তা বড়দেরও আনন্দ দিতে সক্ষম। বৈপরীত্য সবসময় সত্য নয়। শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্কদের সিনেমার মধ্যে একটিমাত্র পার্থক্য এই যে,শিশুদের জন্য বানানো সিনেমায় নতুন সূচনার জন্য সবসময়ই পুনরায় শুরু করা যায়, কিন্তু, বড়দের সিনেমায় কিছু পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে না, যা ঘটে, তা ঘটেই।
আপনার কি মনে হয়েছে, গল্প বলার বিশেষ ধরণ, যা আপনি করে থাকেন মানুষ হিসেবে আমাদের জন্য তা জরুরী?
আমি কোনো গল্প বলিয়ে নই, বরং একজন মানুষ যে ছবি আঁকে (হাসিসহ)। যাই হোক, আমি গল্পের শক্তিতে বিশ্বাস করি, আর এও বিশ্বাস করি, মানুষের সার্বিক বিকাশে গল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কেন না এটা তার শ্রোতাকে উদ্বুদ্ধ, বিস্ময়াভূত ও অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম।
আপনি কি শিশুতোষ গল্পে ফ্যান্টাসীর প্রয়োজনীয়তা বিশ্বাস করেন?
আমি ফ্যান্টাসীকে কেবলমাত্র কল্পনার অর্থে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। আমরা অবশ্যই দৈনন্দিন বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত থাকব, কিন্তু সেই সাথে হৃদয়, চেতনা এবং কল্পনার বাস্তবতাকেও ছাড় দেব, আর এই বিষয়গুলো আমাদের জীবনে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু, আমাদের অবশ্যই ‘ফ্যান্টাসী’ শব্দটি ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। বর্তমানে জাপানে ফ্যান্টাসী শব্দটি টিভি শো থেকে শুরু করে ভিডিও গেম,সবখানেই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মতো দেদারসে ব্যবহৃত হচ্ছে,অথচ ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি তো প্রকৃত বাস্তবতাকে অস্বীকার করে। আমাদের অবশ্যই কল্পনা শক্তির ব্যাপারে উদার হতে হবে, যা আমাদের বাস্তবতায় প্রয়োজনীয় কিছু বয়ে আনতে সক্ষম। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি একজন মানুষকে বন্দী করে ফেলতে পারে। এটা উভয় সংকটের মতো অবস্থা, যখন আমাকে আমার কাজে কল্পনার জগৎ ও ভার্চুয়াল পৃথিবীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়েছে।
স্পিরিটেড এ্যাওয়ে ও পর্কো রসো, দুই সিনেমাতেই দেখা যায় যে, মানুষ শূকরে রূপান্তরিত হয়েছে। কোথা থেকে আপনার এই এই শূকর প্রীতি এলো?
কারণ, এটা উট কিংবা জিরাফ আকার চেয়ে অনেক বেশি সহজ (হাসিসহ)! আমার ধারণা, আমি যা বলতে চেয়েছি তার সাথে তারা খুব ভালভাবেই মিলে যায়। আর শূকরের আচরণ মানুষের আচরণের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আমি হৃদয় থেকেই শূকর পছন্দ করি, তাদের শক্তিমত্তার জন্য যেমন, তেমনি দুর্বলতার কারণেও। তাছাড়া ভম্বুল পেট নিয়ে তো আমরা শূকরের মতোই দেখতে, আর তারাও আমাদের কাছের।
পিউট্রিড রিভার গড সম্পর্কে বলুন? জাপনীজ মিথোলজিতে এটার কি কোনো ভিত্তি আছে?
না, এটা জাপানীজ মিথোলজি থেকে আসেনি, এসেছে আমার অভিজ্ঞতা থেকে। গ্রামে যেখনে আমি বাস করতাম, কাছেই একটি নদী ছিল। যখন লোকেরা নদী পরিস্কার করত, তখন জলের নিচে কি আছে দেখতে পেতাম, যা ছিল অবিকল পিউট্রিডের মতো। নদীতে একটি বাইসাইকেল ছিল, যার চাকা জলের উপরিভাগ ছুঁয়ে থাকত, ফলে লোকেরা ভাবত যে এটা খুব সহজেই তুলে আনা যাবে। কিন্তু,তা ছিল খুবই কষ্টকর, কেন না দীর্ঘ দিন ধরে নদীর কাদা-মাটি জমে এটা খুব ভারী হয়ে উঠেছিল। যখন তারা নদী পরিস্কার করল, ধীরে ধীরে মাছেরা ফিরে এলো,অর্থাৎ, তখনও সবকিছু হারিয়ে যায়নি। অথচ, নদী থেকে যেসব জিনিস তোলা হয়েছিল, তার গন্ধ ছিল সত্যিই অসহ্যকর, কেন না দীর্ঘদীন ধরে সবাই নদীতে তাদের জিনিপত্তর ফেলে আসছিল, যা ব্যাপারটিকে বাস্তবিক অর্থেই করে তুলেছিল বিশৃঙ্খল।
আপনার সিনেমায় কি এমন কোনো মূল দৃশ্য থাকে যা পুরো সিনেমাটিকে তুলে ধরে?
যেহেতু আমি সেই মানুষ যে কিনা সুনির্দিষ্ট গল্প ছাড়াই কাজ করে, তার কাছে প্রতিটি দৃশ্যই একেকটি মূল দৃশ্য। যেমন, যে দৃশ্যে চিহিরোর বাবা-মা শূকর হয়ে গেল, সেটা ছিল সিনেমাটির সেই মুহূর্তের মূল দৃশ্য, অথচ পরবর্তী দৃশ্য ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর এভাবেই সিনেমাটি চলতে থাকল। কিংবা যে দৃশ্যে চিহিরো কান্না করে, আমি চেয়েছিলাম কান্নার ফোঁটাগুলো অনেক বড় আকারে দেখাতে, অনেকটাই গীজারের সদৃশ, কিন্তু, যেভাবে আমি তা কল্পনা করেছিলাম সেভাবে দৃশ্যায়ন করতে পারিনি। সুতরাং, কোনো মূল দৃশ্য নেই,কেন না প্রতিটি দৃশ্যরই নিজস্ব সমস্যা থাকে, যা চলমান দৃশ্যর উপর প্রতিফলন ঘটায়।
তবে, স্পিরিটেড এ্যাওয়েতে দুটো এমন দৃশ্য আছে যা সিনেমাটির জন্য রূপক। একটি সিনেমার শুরুতেই, গাড়ির পেছনের দৃশ্য, যেখানে চিহিরো আক্রমণাত্মক ছোট্ট বালিকা। অপরটি একদম শেষে, যেখানে সে জীবন বোধে পূর্ণ এক বালিকা, যে সমগ্র পৃথিবীর মোকবিলা করেছে। দৃশ্য দুটো চিহিরোর দুই রূপ, যা তার চারিত্রিক বিকাশের দিক তুলে ধরে।
অন্যান্য সিনেমা বা পরিচালকের ন্যায় আপনার অনুপ্রেরণার উৎস কী?
আমি তৈরী হয়েছিলাম ১৯৫০ এর সিনেমা ও পরিচালক দ্বারা, যখন আমি একাধারে সিনেমা দেখা শুরু করি। সে সময় একজন ফ্রেঞ্চ এ্যানিমেটর আমাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করেন, তিনি ‘পল গ্রিমাল্ট’। আমি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য সিনেমা দেখেছি, কিন্তু, সাধারণত পরিচালকদের নাম মনে রাখতে পারি না, আর আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত এক্ষেত্রে আরও পরিচালকের নাম উল্লেখ করতে না পারার কারণে। অবশ্য আরেকটি সিনেমা আমাকে চূড়ান্তভাবে অনুপ্রাণিত করে,সেটি রাশিয়ান, ‘দ্য স্নো ক্যুইন’। সমসমায়কি এ্যানিমেশন পরিচালক যাদের আমি যথেষ্ট সম্মান করি তাদের মধ্যে ‘ইউরি নসতেইন’ (রাশিয়া) এবং ‘ফ্রেডরিখ বাখ’ (কানাডা) অন্যতম। বিশেষত, নসতেইন সেই পরিচালকদের একজন যে প্রকৃত শিল্পীর সন্মাননা দাবী করে।
আপনার পরবর্তী পরিকল্পনা কি? এখন কি আপনি কোনো কিছু নিয়ে কাজ করছেন?
সম্প্রতি আমরা স্টুডিও ঘিবলি মিউজিয়াম চালু করেছি। হয়ত ‘মিউজিয়াম’ শব্দটি এক্ষেত্রে অতিরিক্ত শোনায়, কেন না এটা অনেকটাই ছোট্ট ঘরের মতো, যেখানে আমার স্টুডিওর কাজ প্রদর্শন করি। এছাড়াও এর মধ্যে একটি থিয়েটার আছে, যেখানে ঘিবলি মিউজিয়ামের জন্য বিশেষভাবে বানানো শর্ট ফিল্মগুলো দেখানো হবে। যেহেতু আমি এই কাজের দায়িত্বে আছি, সেহেতু শর্ট ফিল্মগুলো নিয়ে এখন ব্যস্ত আছি।
এছাড়াও হিরোউকি মরিতা নামের একজন তরুণ পরিচালক নির্দেশিত নতুন একটি সিনেমার তত্ত্বাবধান করছি, যেটা পরবর্তী গ্রীষ্মে জাপানে মুক্তি পাবে। বস্তুত, অন্য পরিচালকের কাজ তত্ত্বাবধান করা খুবই কঠিন, কারণ সে চায় কাজগুলো আমার চেয়ে ভিন্নভাবে করতে, আর এটা সত্যিকার অর্থেই ধৈর্য্য পরীক্ষার মতো ব্যাপার।
জাপানে স্পিরিটেড এ্যাওয়ের অবিশ্বাস্য সাফল্য আপনার কর্ম পদ্ধতিতে কি কোনো পরিবর্তন এনেছে?
না। আসলে আপনি কখনোই জনেন না যে, একটি সিনেমা কী রকম ভুমিকা পালন করবে, সেটা সফল হবে, না কী হবে না, অথবা দর্শককের হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। আমি সবসময় নিজেকে বলি, যাই ঘটুক না কেন, দর্শক বিশাল হোক অথবা ক্ষুদ্র, তা যেন আমার কাজের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে না পারে। তাছাড়া একটি বিশাল সাফল্যের পর কাজের পদ্ধতি বদলে ফেলা, আমার কাছে তা বোকামোই বটে, আর সেই সাথে এও প্রমাণ করে, আমার কাজের পদ্ধতি ঠিকই আছে (হাসিসহ)।
সূত্রঃ http://www.midnighteye.com/interviews/hayao-miyazaki/
ভাষান্তরঃ অরণ্য
ঢাকা, বাংলাদেশ
২৭.০৫.২০১৪