শ্রদ্ধেয় লেখক ফরহাদ মজহারের অনেক পরিচয়। বর্তমানে তিনি কোরআন’র ব্যাখ্যার গ্রন্থসমূহ (তাফসীর) বিষয়ে আপত্তি তুলে দাবি করছেন যে কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবেই পড়তে হবে। কোরআন এবং কোরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থ এক জিনিস নয়। তাঁর এ দাবির সাথে আমরা একমত। আরো ভাল লাগল এটা জেনে যে তিনি ফকির-দরবেশ, পীর-আউলিয়া এঁদের ভালবাসেন। এ উপমহাদেশে ইসলামের ভিত তো তাঁরাই (ফকির-দরবেশ, পীর-আউলিয়া) বপন করেছেন, আরবী জানাওয়ালারা নয়। সম্প্রতি তিনি কোরবানি প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন তাঁর সম্পাদিত ’চিন্তা’ পত্রিকায় এবং তাঁর ফেসবুক পাতায়। সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কোরআন প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে নেয়া প্রয়োজন।
কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবে পড়তে গেলে সাধারণ মানুষরা আটকে যাবে। কারণ অনেকেরই আরবী ভাষাজ্ঞান নেই। আবার আরবী ভাষাজ্ঞান থাকলেও লাভ নেই কারণ কোরআন কোন গল্প কিংবা উপন্যাস গ্রন্থ নয় যে পড়ে ফেলে রাখলাম। কোরআন একটি দর্শন। কোরআনের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহের (তাফসীর) সীমাবদ্ধতা আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে ভাষাজ্ঞান কিংবা ব্যাকরণ কিংবা আরো অন্যান্য শাস্ত্রের জ্ঞান থাকলে শুধু হবে না, বোধির উদ্ভাস থাকাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবে পড়তে গেলে শুধু পড়াই হবে আর তর্ক হবে কিন্তু আমাদের জানতে হবে কোরআন কি শুধু পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি এ পবিত্র গ্রন্থটির যে বিস্তৃত দর্শন সেগুলো জানা কিংবা মানার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র নিয়ে রাতদিন মুখস্থ করা কিংবা তর্ক-বিতর্ক করা কোন জ্ঞানীর কাজ নয় কারণ তাতে রোগের কোন চিকিৎসা হবে না। ব্যবস্থাপত্রে কী লেখা আছে সে অনুযায়ী ওষুধ সেবন কিংবা জীবন গড়নটাই জরুরী। কোরআন মহাজ্ঞানীর নিকট হতে মানবজাতির প্রতি একটি জীবন দর্শন। দেহতত্ত্ব আর অধ্যাত্মতত্ত্বের মিশেলে এ রহস্যময় গ্রন্থ। এখানে কোন গল্প নেই। ঘটনার রূপকে আমরা যা দেখি সেগুলোকে যদি গল্প বলে মনে করি তবে তা আমাদেরই জ্ঞানের দৈন্য। এখানে নেই কোন কঠিন-তরল-বায়বীয় পৃথিবী কিংবা সূর্য নামক নক্ষত্র কিংবা চন্দ্র নামক উপগ্রহের বিবরণ। রূপকের চাদর উল্টালেই দেখা যাবে সেসবের আড়ালে কারা জ্বলজ্বল করছে। ঠিক একই ভাবে এ গ্রন্থে যেসব চরিত্রগুলো আছে তারা কি আসলেই রক্ত-মাংসের মানুষ নাকি অন্য কোন অর্থ প্রকাশ করছে সেটাও ভাবতে হবে। এতসব বিষয় নিয়ে এবার আপনি কোরআন নিয়ে বসেন (যারা শুধু ছো-ও-য়া-বে-র উদ্দেশ্যে পাঠ করেন তারা ব্যতীত), দেখবেন আপনি আর এগোতে পারছেন না। একটা আয়াত তো দূরের কথা, একটা শব্দ নিয়েও অনেক চিন্তার অবকাশ আছে এখানে। তাই আগের মহামানবেরা তাঁদের শিষ্যদের পুরো কোরআনের পরিবর্তে শুধু একটি আয়াত দিতেন আমল তথা চিন্তুা করার জন্য। মানবের এক জীবনে পুরো কোরআন আয়ত্ত করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এ এক বিশাল মহাসাগর। এ মহাসাগর সেঁচে একটি একটি বিন্দু এনে মহামানবেরা সাধারণ মানুষদের দিতেন অনুষ্ঠান স্বরূপ যেন তারা এ অনুষ্ঠান সমূহ পালন করার মধ্যে দিয়ে রহস্যের দিকে ধাবিত হয়। তাই নামায, রোযা, হজ্ব, কোরবানি এগুলো সব একেকটি অনুষ্ঠানের নমুনা। কিন্তু হতভাগা মানুষেরা এ অনুষ্ঠানগুলো নিয়েই পড়ে রইল। কারণ অনুষ্ঠান পালন খুব সোজা কিন্তু এগুলোর আড়ালে যে দর্শন তার সন্ধান কাজটি অনেক কষ্টের। আর দর্শন না জানলে মানবের মুক্তি নেই। কোত্থেকে মুক্তি নেই সে বিষয়ে আর যাচ্ছি না।
”ইসলামের কোরবানিঃ 'মনের পশু' তত্ত্ব ও খ্রিস্টধর্ম” নামক লেখাটিতে জনাব ফরহাদ মজহার বাইবেলের প্রসঙ্গ এনেছেন। কোরআনে আছে, হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে মহান আল্লাহ ইঞ্জিল দিয়েছিলেন, বাইবেল নয়। আর তোরাহ, যবুর ও ইঞ্জিল গ্রন্থগুলোকে কোরআন সত্যায়ন করে। এও বলে যে ইহুদী, সাবেঈ ও নাসারা তথা খ্রিস্টানরা যদি এখনো গ্রন্থগুলোর আমল করে সৎকাজ করে তবে তারা মুক্তি পাবে। কোরআনে বলা হয়নি পূর্ববর্তী মতবাদ তথা ধর্মগুলো বাতিল। বরঞ্চ বলা হয়েছে সেগুলো অসম্পূর্ণ ছিল। কোরআন হচ্ছে তোরাহ, যবুর ও ইঞ্জিল সহ আরো যত সত্য গ্রন্থ আছে সবগুলোরই ধারাবাহিকতা। গ্রিক ভাষাটি পৃথিবীর অনেক প্রাচীন একটি ভাষা। কোরআনে বর্ণিত ’ইব্রাহীম’ শব্দটি এসেছে গ্রিক ’আব্রাহাম’ থেকে। আব্রাহাম শব্দটিকে যদি আরো রূপান্তর করি আমরা পাই আব্রাম বা ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ অর্থ যিনি ব্রহ্মকে জানেন আর ব্রহ্ম অর্থ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা। তাই তোরাহ, যবুর ও ইঞ্জিলের কথা কোরআনে থাকবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এখন প্রশ্ন হল মূল তোরাহ, যবুর ও ইঞ্জিল গ্রন্থগুলোর অস্তিত্ব পৃথিবীতে আছে কিনা। মহান আল্লাহ সকল জ্ঞানের আধার। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সহ সব জ্ঞান তাঁর কাছে আছে। তিনি ইঞ্জিলে এক রকম বলবেন আবার পাঁচশত বছর পর কোরআনে আরেক রকম বলবেন, এটা কখনো হতে পারে না। সব সত্য গ্রন্থের মূল সুর একই। হয়ত উপস্থাপন ভিন্ন। তোরাহ, যবুর ও ইঞ্জিল বলে যে গ্রন্থগুলো আমরা এখন দেখছি আসলেই কি সেগুলো ঐ সময়কার অবতীর্ণগুলো? সৎ ও নির্মোহ গবেষকগণের নিকট প্রশ্নটি রাখলাম। প্রশ্ন হল- তোরাহ, যবুর ও ইঞ্জিলের সত্যতার ব্যাপারে যদি সংশয় থাকে তবে কেন জনাব ফরহাদ সেসব গ্রন্থসমূহ থেকে উদ্ধৃতি নিচ্ছেন? আর যদি সংশয় না থাকে তবে কেন সেসব গ্রন্থসমূহের মুখোমুখি কোরআনকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন?
এবার আসি উনার অনুবাদে। তিনি সূরা আস-সাফফাতের ১০২ ক্রমিকের আয়াতটি অনুবাদ করেছেন এভাবে-
”অতঃপর সে যখন পিতার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন ইব্রাহীম তাকে বললঃ বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে জবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ। সে বললঃ পিত! আপনি যে আদেশপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাই করুন। ইনশাল্লাহ, আপনি আমাকে সবুরকারী পাবেন।”
কোরআন যেভাবে অবতীর্ণ হয়েছে সেভাবে পড়তে গেলে উল্লেখিত অনুবাদে ’ইব্রাহীম’ শব্দটি থাকার কথা নয় কারণ আয়াতে ’ইব্রাহীম’ শব্দটি নেই। ইনশাআল্লাহ শব্দটির কি বাংলা নেই? বাংলা হচ্ছে ’যদি আল্লাহর ইচ্ছা থাকে’। সমস্যা হল জনাব ফরহাদ মজহার আয়াতের দর্শন তথা গভীরে না গিয়ে গেলেন ’আদেশ’ আর ’স্বপ্ন’র বির্তকে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কোনটি চাই- দর্শন না বিতর্ক। বিতর্ক অন্য কিছু নিয়ে হতে পারে, ঐশী গ্রন্থ নিয়ে নয়।
ইব্রাহীম আল্লাহর একজন নবী। কোরআনে আছে, হযরত মুসা এবং ঈসার মতো হযরত ইব্রাহীমকেও সহীফা দেয়া হয়েছে যদিও নামোল্লেখ নেই। উল্লেখিত আয়াতটিতে (৩৭:১০২) ’মানাম’ অর্থ হচ্ছে বিছানা/ধ্যান। মানুষের আপন দেহটাই তার বিছানা, এ বিছানায় সে ঘুমায়, ধ্যান করে। মানুষ দু’ভাবে রহস্যলোকে যেতে পারে, এক. হচ্ছে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে আর দ্বিতীয়টি ধ্যানের মাধ্যমে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন সবাই দেখে কিন্তু ধ্যানে সবাই দেখে না। ধ্যানের মাধ্যমে দেখা এত সহজও না। আর ধ্যান করতে গুরু আবশ্যিক। আমি ওদিকে যাচ্ছি না। স্বপ্নে দেখে সাধারণ মানুষরা। নবীগণ মহামানব। তাঁরা দেখেন ধ্যানে। কোরআনে কোথাও নবীদের স্বপ্ন দেখার কথা নেই। স্বপ্নের আরবী আরেকটি। মহান আল্লাহ দয়া না করলে কেউই ধ্যানে পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। নবী-রসূলগণ আল্লাহর মনোনীত। তাঁদের ধ্যান অর্থই হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা। কারণ নবীগণ আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে একটা কথাও বলেন না।
”তিনি (নবী) প্রবৃত্তি (নিজ ইচ্ছামত) হতে কথা বলেন না” (সূরা নজম, আয়াত: ৩)।
জবেহ করা মানে উৎসর্গ করা, বিশুদ্ধ বা পবিত্র করা। প্রত্যেক পিতাই চান তাঁর সন্তান বিশিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছুক। নবীগণও চান তাঁদের শিষ্যরা বিশিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছুক। তবে এখানে ধ্যান সাধনা বলে একটি ব্যাপার আছে যা কষ্টসাধ্য। আর সাধনায় প্রয়োজন ধৈর্য। সেজন্য আয়াতটিতে পুত্র বলছে যে তাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাওয়া যাবে। প্রচলিত আছে পুত্রের পরিবর্তে নাকি মেষ/দুম্বা/ভেড়া কোরবানি হয়েছিল! অথচ কোরআনে এ বিষয়ে কোন ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই।
উপরোক্ত বিষয়টিতে আমাদের জন্য শিক্ষা বা দর্শন কী? মহামানবদের কর্ম আমাদের জন্য ইবাদত। ছাত্রদের কোন বিষয় বুঝানোর জন্য শিক্ষক আগে নিজে কাজটি করেন। নবী ইব্রাহীম তাঁর পুত্র তথা শিষ্যকে পবিত্র ভাবধারার ধারাবাহিকতার স্বার্থে আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করেছেন।
উৎসর্গ কাকে করা হয়েছিল- ইসমাঈল না ইসহাক, আদেশ না স্বপ্ন, এসব ফালতু বিতর্ক তারাই করতে পারে যাদের বোধির উন্মেষ এখনো ঘটেনি।