”পাঠ করুন আপনার রবের নামের সাথে” [সূরা আলাক্ব, আয়াত: ১]।
মনে হচ্ছে খুব ছোট্ট একটি আয়াত অথচ কী বিশাল রহস্য নিয়ে আয়াতটি জ্বলজ্বল করছে তা আমরা অনেকেই জানি না। অধিকাংশ কোরআন ব্যাখ্যাকারগণ খুব দায়সারা ভাবে আয়াতটির ব্যাখ্যা লিখে মনে মনে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। আমি কারো দোষ দেবো না কারণ যার যতটুকু জ্ঞান তিনি ততটুকুই লিখবেন। তবে একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না আর তা হলো অনেক ঐতিহাসিক লিখেছেন ফেরেশতাদের প্রধান জিবরাঈল (আ.) যখন আয়াতটি মহানবী (সা.) এর কাছে হস্তান্তর করলেন এরপর নাকি মহানবী (সা.) ভয় পেয়েছিলেন! নবী যদি ভয় পান তো আমাদের কী অবস্থা হবে? আর ফেরেশতারা হচ্ছেন আদেশ পালনকারী মাত্র। আবার মানুষ হচ্ছে মহান আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সেরা এক জাতি এবং সেখানে নবীগণের মর্যাদা তো আরো অনেক উপরে এবং সেখানে মহানবী (সা.) এর তো কোন তুলনাই চলে না। অথচ আমাদের শেখানো হলো নবী (সা.) নাকি ভয় পেয়েছিলেন! কোন পিতা যদি তার অবুঝ সন্তানকে ভয় লাগিয়ে কোন কিছু থেকে বারণ করতে চান অথবা কোন কিছু শেখাতে চান তবে আগে তিনি নিজে ভয় পাওয়ার অভিনয়টি করেন। তাতে সন্তানটিও প্রভাবিত হয়। অন্ধকারের মানুষগুলোকে আলোর সন্ধান দেয়ার জন্য মহান আল্লাহ মহানবী (সা.) কে যে জিনিসটি দিয়েছিলেন তা ছিলো ঐ সময়কার মানুষদের কাছে একেবারে নতুন তাই মহানবী (সা.) বাহানা তথা ভয় পাওয়ার ভান ধরেছিলেন যেন মা খাদিজা (রা.) আগ্রহান্বিত হন। তার মানে এই নয় যে তিনি (সা.) ভয় পেয়েছিলেন। সেমতে মহান আল্লাহ কোরআনে বলছেন,
”আহ্বান করুন আপনার রবের পথের দিকে হিকমতের সাথে” [সূরা নাহল, আয়াত: ১২৫]।
এক হাদীসে নবী করিম (সা.) বলেছেন, ”আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন এবং আমার নূর থেকে বাকি সবকিছু সৃজন করেছেন” [হাদীস নং ১৮, ১ম খন্ড, আল মুসান্নাফ-আবদুর রাজ্জাক (রহ.) এবং মাদারেজুন নবুওয়াত-২য় খন্ড পৃষ্ঠা ২৬, মূল: শায়েখ আবদুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী (র.), অনুবাদ: মাওলানা মুমিনুল হক, হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদিয়া, ভুঁইগড়, নারায়ণগঞ্জ]। যাঁর নূর মোবারক থেকে সবকিছু সৃজন হয়েছে আর তিনি নাকি ভয় পেয়েছিলেন! যে হাদীসটি আমি উল্লেখ করলাম অনেক আধুনিক চিন্তাবিদেরা হাদীসটিকে জাল কিংবা দুর্বলের কাতারে ফেলতে চান। শুধু তাই নয় যেসব হাদীসে আধ্যাত্মিকতা কিংবা মহানবী (সা.) এর উচ্চ মর্যাদা প্রতিফলিত হয়েছে তারা সেসব হাদীস সমূহকে খুব ভয় পান নইলে নবী ভয় পান তা তো প্রমাণ করা যাবে না। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার আর তা হলো মানুষের অন্তর থেকে নবী (সা.) এর প্রতি আন্তরিকতা সরিয়ে দেয়া। আমি আর ওদিকে যাবো না কারণ আমার আলোচ্য বিষয় সেটি নয়।
বলা হয়েছে, পাঠ করুন বা পড়ুন। যদিও পুরো কোরআন মহানবী (সা.) এর উপর নাযিল হয়েছিলো কিন্তু কোরআন একটি সর্বজনীন গ্রন্থ। সুতরাং পাঠ করো বা পড়ো আমাকেও বলা হচ্ছে। ভালো কথা। কিন্তু কোত্থকে পাঠ করবো? যেমন আমরা বই-পুস্তক দেখে পাঠ করি, ছোট বাচ্চাকে ’অ’ অক্ষরটি বইতে দেখিয়ে আমরা তারপর বলি পড়ো ’অ’। কিন্তু জিবরাঈল (আ.) তো কোন গ্রন্থ নিয়ে আসেননি যে তা দেখে দেখে মহানবী (সা.) পাঠ করবেন। আরেকটি কথা এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবে এসে যায় আর তা হলো আল্লাহ সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞানী, সর্বশ্রোতা হবার পরেও তাঁর কোরআন বান্দাদের কাছে পাঠাতে গিয়ে দু’টি মাধ্যম কেন গ্রহণ করলেন? জিবরাঈল (আ.) এক মাধ্যম এবং তার পরের মাধ্যম মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে আল্লাহর কোরআন কেন পাবো? সরাসরি আল্লাহর পবিত্র বাণী আল্লাহ কি পাঠাতে পারতেন না? অবশ্যই পারতেন। এ দু’টি উসিলা তথা জিবরাঈল (আ.) ও মহানবী (সা.) এর মাধ্যমে কোরআন পাঠাবার মধ্যে একটি গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে। কী সেই রহস্য? এটাই মহান আল্লাহর রীতি। তিনি সরাসরি কোন কিছু পাঠাবেন না বা দেবেন না এবং তাঁকে পেতে চাইলেও সরাসরি পাওয়া যাবে না। একটি মাধ্যম লাগবেই। অনেকে যুক্তি দিতে পারেন সেই মাধ্যমটি হল নামায। আমি বলব, নামায পড়তে হলে আগে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। ওযু হচ্ছে বাহ্যিক পবিত্রতা। ভেতরের পবিত্রতা তবে কীভাবে আয়ত্ত করব? ভেতরের পবিত্রতা কী? একটি ফাঁপা বাঁশের ভেতরে ময়লা-আবর্জনা ঢুকিয়ে দু’পাশ বন্ধ করে এবার ভাল ভাবে ধুয়ে ফেলুন তো। পবিত্র হবে? মোটেই না কারণ ভেতরে তো তার অপবিত্রতা রয়েই গেছে। আগে ওগুলো ভাল ভাবে ঝেড়ে ফেলে দিন। সুতরাং ভেতরে অপশক্তির অপবিত্রতা রেখে বাইরে আপনি যতই ওযু-কালাম করেন না কেন কোন লাভ নেই। আগে ভেতরটা নির্মল করুন। এখন এ ভেতরটা কীভাবে স্বচ্ছ করা যায়? ভেতরটা পরিষ্কার করতে হলে তো আগে ভেতরে ঢুকতে হবে। আপনার সে যোগ্যতা নেই। যাঁর কাছে এ ভেতরে ঢোকার শক্তি আছে তাঁর কাছে আপনাকে যেতে হবে। তাঁরা কারা? তাঁরা আল্লাহরই বান্দা তবে রহমত তথা করুণাপ্রাপ্ত। তাঁরা নবী কিংবা রসূল রূপে এসেছিলেন, এখন আসছেন এবং আসবেন আওলিয়া তথা মুর্শিদ রূপে (যেহেতু নবুয়তের দ্বার এখন বন্ধ)। আর তাঁরা মহান আল্লাহর পবিত্র বাণী আয়ত্ত করেই আসেন এবং তারপর আমাদের আয়ত্ত করার শিক্ষাটি দেন। আমার প্রশ্ন ছিল কোত্থকে পাঠ করবো। তার আগে আমাকে জানতে হবে মহানবী (সা.) কোত্থকে পাঠ করেছিলেন। জিবরাঈল (আ.) থেকে? তাহলে আসুন দেখা যাক কে কার থেকে পাঠ করেছেন।
হযরত জাবীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা.), ইবনে আব্বাস (রা.) এবং আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বর্ণিত হাদীসে নবী করিম (সা.) বলেন, ”আমি হলাম জ্ঞানের শহর আর আলী (হযরত আলী রা.) হল সেই (জ্ঞানের) শহরের প্রবেশদ্বার” [বাগ্মীতার শিখর (Peak of Eloquence)-নাহজুল বালাগা: হযরত আলী (রা.) এর বক্তৃতা এবং পত্রের সংকলন, অধ্যায় ২১৭ (২০৯ নং বক্তৃতা), ১ম খন্ড (পৃ.৬১৭), মূল: শরীফ আল রাযী, ইংরেজি অনুবাদ: আসকারি জাফরি, ইসলামিক সেমিনারি পাবলিকেশান্স, পাকিস্তান এবং তাফসীরে মাযহারী, ১০ম খ-, পৃষ্ঠা ৪৪১, মূল: হযরত মাওলানা কাযী ছানাউল্লাহ্ পানিপথী (রহ.), সম্পাদনা-মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ, হাকিমাবাদ খানকায়ে মোজাদ্দেদীয়া, ভুঁইগড়, নারায়ণগঞ্জ]। ইসলামের চতুর্থ খলীফা এবং অধ্যাত্মজগতের গুরু হযরত আলী (রা.) বলেন, ”আসমানি কিতাব সমূহের তত্ত্বজ্ঞান সব একত্রিত হয়েছে কোরআনে, আর কোরআনের সার হচ্ছে সূরা ফাতিহা, আর সূরা ফাতিহার সার হচ্ছে বিসমিল্লাহ, আর যা আছে বিসমিল্লাহতে তা আছে ’বা’ (বি ইসমি) তে (’বা’ আরবী বর্ণমালার দ্বিতীয় বর্ণ), আর যা আছে ’বা’ তে তা আছে ’বা’-এর নিচের ফোঁটা-তে এবং আমিই হলাম সেই ফোঁটা যা আছে ’বা’-এর নিচে। যদি আমি বিসমিল্লাহ’র ’বা’-এর ব্যাখ্যা লিখতাম তবে তার পৃষ্ঠার সংখ্যা এত হত যে সত্তুরটি উটও তা বহন করতে সক্ষম হত না” [সূত্র: ১. ইয়ানবী আল মুয়াদ্দা ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ৮১-৮২, মূল: হাফিজ সুলাইমান ইবনে ইবরাহীম কুন্দুজি আল হানাফি, প্রকাশনায়: মু’আসসাসাত আল আলামি লিল মাতবু’আত, বৈরুত, লেবানন, ২. এহইয়াউ উলুমিদ্দীন-২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৪, মূল: হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রহ.), অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, মদীনা পাবলিকেশান্স, ঢাকা, ৩. তুর্কি সাহিত্যে অধ্যাত্মবাদের সূত্রপাত (Early Mystics in Turkish Literature), পৃষ্ঠা ৩৫৮, মূল: মেহমেত ফুয়াত কপরুলু, অনুবাদ: গেরি লেইসার ও রবার্ট ডাঙ্কফ, প্রকাশনায়: রুটলেজ, অক্সন, ইংল্যান্ড এবং ৪. মুসলিম স্টাডিজ, ১ম খন্ড পৃষ্ঠা ২৬৫, মূল: ইগনেক গোল্ডিজার, সম্পাদনা: এস. এম. স্টার্ন, অনুবাদ: সি. আর. বারবার, প্রকাশনায়: স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক প্রেস, আলবানি, নিউইয়র্ক]। দেখার বিষয় হল ’জ্ঞান শহরের প্রবেশদ্বারের’ (হযরত আলী রা.) সীমা যদি এই হয় তো যিনি ’জ্ঞানের শহর’ (মহানবী সা.) তাঁর সীমা কোথায় তা আর আশা করি বুঝিয়ে বলতে হবে না। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে জিবরাঈল (আ.) মহানবী (সা.) কে পাঠ করাতে আসেননি এসেছেন সংযোগ সাধন করতে। আল্লাহ বলছেন,
”নিশ্চয় উহা একটি স্পষ্ট সংযোগ এবং একটি স্পষ্ট কোরআন ব্যতীত অন্য কিছু নয়” [সূরা ইয়া-সিন, আয়াত: ৬৯]।
আরবী জিকির এর বাংলা হচ্ছে আল্লাহর স্মরণ বা আল্লাহর সাথে সংযোগ। এ সংযোগ যখন ভাষায় স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় তখন তা কোরআন হয়ে যায়। আরো সহজ করে বলতে গেলে বলা যায় কোরআন অর্থ পাঠ বা ঘোষণা। আল্লাহর সাথে সংযোগউত্তর এ পাঠ যখন মহানবী (সা.) এর পবিত্র মুখ থেকে মানুষের নিকট প্রচার হয় তখন তা আল্লাহর মহিমান্বিত বাণী হয়ে যায়। আল্লাহর সাথে সংযোগ কীভাবে? কোরআনে আল্লাহ বলছেন,
”বস্তুত এ হচ্ছে কোরআন মাজিদ, লৌহের মধ্যে হেফাযতপ্রাপ্ত” [সূরা বুরূজ, আয়াত: ২১-২২]।
’লৌহ’ শব্দের অর্থ স্মৃতিফলক। যেহেতু কোরআন এ স্মৃতিফলকে সংরক্ষিত সুতরাং এটি একটি রহস্যময় স্মৃতিফলক। সুতরাং লাওহে মাহফুযের সাথে সংযোগের অপর নামই হল কোরআন। এখন কথা হল মহানবী (সা.) পাঠ করেছেন আল্লাহর সাথে সংযোগ সাধন করে। আমরা কীভাবে পাঠ করব? যেহেতু আমাকেও বলা হচ্ছে পাঠ করতে। উপায় একটাই আর তা হল আমাকেও সংযোগ সাধন করতে হবে। কীভাবে? একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আশা করি বুঝা যাবে। বাঘ, বাঘের ছবি এবং চিড়িয়াখানার বাঘ। তিনটি তিন রকম। বাঘ বলতে আমরা বুঝি একটি হিংস্র প্রাণী। বাঘের ছবি দেখে আমরা বাঘ সম্পর্কে একটি ধারণা পাই। আর চিড়িয়াখানায় বাঘ দেখে বুঝতে পারি বাঘ আসলে কী। কোরআন বলতে আমরা বুঝি একটি গ্রন্থ। ছাপার অক্ষরে দেখে আমরা একটি ধারণা পাই। কিন্তু অক্ষরগুলো কোত্থেকে এলো সেটি আর আমরা বলতে পারি না। আল্লাহ বলছেন,
”নিশ্চয় উহা অবশ্য সম্মানিত একটি কোরআন, সুরক্ষিত আছে একটি কিতাবের মধ্যে” [সূরা ওয়াকেয়া, আয়াত: ৭৭-৭৮]।
কিতাব এবং কোরআন এক জিনিস নয়। কিতাব বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি গ্রন্থ। কিন্তু কিতাবের অর্থ ব্যাপক। কোরআন কখনো কিতাব নয়, কিতাবের অংশবিশেষ মাত্র। অর্থাৎ কিতাবের জ্ঞানকে পরিচিত করে দেবার জন্য কিছু কথার সমষ্টি। সকল আসমানী ধর্মগ্রন্থ কিতাবের অংশমাত্র। আবার কোরআনের ভাষা আরবী হলেও কিতাবের ভাষা আরবী নয়। কোরআন নাযিল হয়েছিল মহানবী (সা.) এর উপর এবং নবী (সা.) এর ভাষা আরবী বিধায় কোরআনও আরবীতে যেভাবে তওরাত নাযিল হয়েছিল মুসা নবী (আ.) এর ভাষায়, যবুর নাযিল হয়েছিল দাউদ নবী (আ.) এর ভাষায় এবং ইঞ্জিল নাযিল হয়েছিল ঈসা নবী (আ.) এর ভাষায়। এখন কিতাবের ভাষা কিংবা আর কোন ব্যাখ্যা আমি এখানে আর দেবো না। অধ্যাত্মজ্ঞানে নিজেকে আলোকিত করুন তারপর বুঝবেন কিতাব আসলে কী কিংবা কিতাবের ভাষা কোনটি। এ কিতাবের জ্ঞান যাঁর অর্জিত হয়েছে একমাত্র তাঁরাই বলতে পারেন কোরআন নয়, কোরআনের কোন সূরাও নয়, সূরা শুরুর আগে যে তাসমিয়া (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম) সেটিও নয়, তাসমিয়া যে অক্ষর দিয়ে শুরু (’বা’) শুধু সেই অক্ষরটির ব্যাখ্যা লিখে সত্তুরটি উট বোঝাই করে দিতে পারেন। শুধু একটি অক্ষরের ব্যাখ্যা লিখলে এ অবস্থা আর যদি পুরো কোরআনের ব্যাখ্যা লিখতে যান তখন অবস্থাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! সেমতে আল্লাহ বলছেন,
”এবং যদি গাছপালার যা কিছু পৃথিবীতে আছে তা কলম হয়ে যেত আর সমুদ্র (যদি কালি হয়) এরপরে সাত সমুদ্রও এর সাথে যোগ করে দেয়া হত (তারপরও) আল্লাহর মহিমান্বিত বাণী (এর ব্যাখ্যা) লিখে শেষ করা যাবে না” [সূরা লুক্বমান, আয়াত: ২৭]।
সুতরাং পাঠ করতে হলে কিতাব থেকেই পাঠ করতে হবে এবং এ কিতাবের জ্ঞান যতক্ষণ না আপনার অর্জিত হচ্ছে ততক্ষণ আপনি পাঠ করার যোগ্য নন। কিন্তু আমরা দেখি লোকজন অহরহ কোরআন পাঠ করছে। কারণ তাদের শিখিয়ে দেয়া হয়েছে এতে অনেক ছোওয়াব। ছোওয়াব অর্জন করে করে তারা বেহেশতে চলে যেতে পারবে! অথচ কেউ বলছে না কোথা থেকে পাঠ করতে হবে। যদি যেখান থেকে পাঠ করতে বলা হয়েছে সেখান থেকে পাঠ করত তবে মানবতার পৃথিবীতে আর এত অশান্তি থাকত না। কারণ যদি আপনি সংযোগ সাধন করে কোরআন পড়তেন আপনি হতভম্ব হয়ে যেতেন যে এ আমি কী পড়ছি। এহইয়াউ উলুমিদ্দীন গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে, ”হযরত আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) এক রাতে সাহাবীদেরকে নিয়ে নামায পড়লেন এবং সমস্ত রাত একই আয়াত বারবার পাঠ করলেন। … আবু সোলায়মান দারানী বলেন, আমি এক আয়াত পাঠ করি এবং চার পাঁচ রাত এতেই অতিবাহিত হয়ে যায়। … জনৈক বুযুর্গ সূরা হুদেই ছয় মাস কাটিয়ে দেন।” [এহইয়াউ উলুমিদ্দীন-২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৪-৩৫, মূল: হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রহ.), অনুবাদ: মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, মদীনা পাবলিকেশান্স, ঢাকা]। আর আমরা দু’ থেকে তিন ঘন্টায় বিভিন্ন নামের খতমে পুরো কোরআন খতম করতে গিয়ে আসলে যে নিজেরাই খতম হয়ে যাচ্ছি সে খবর আর রাখি না! বলছিলাম সংযোগ সাধনের কথা। পাঠ করতে হলে আমাকেও সংযোগ সাধন করতে হবে। সংযোগ তিনিই করিয়ে দিতে পারেন যাঁর সাথে সংযোগ আছে। যেহেতু মহান আল্লাহ এখনো পৃথিবী থেকে কোরআন উঠিয়ে নেননি তাই এ কোরআনের সংযোগ দেবার মত বান্দারাও আছেন। আমাদের কাজ হল তাঁদের খুঁজে বের করা। বিশুদ্ধ পানি আপনার কাছে হেঁটে হেঁটে আসবে না কারণ তার আপনাকে দরকার নেই কিন্তু বিশুদ্ধ পানি আপনারই প্রয়োজন নইলে আপনার জীবন বিপন্ন হবে। সুতরাং কে কার কাছে যাবে? বিশুদ্ধ পানি ব্যতীত আপনার জীবন যেমন বিপন্ন হবে তেমনি কোরআনের জ্ঞান ব্যতীত আপনার আধ্যাত্মিক জীবনেও বিপর্যয় নেমে আসবে এবং মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকা ব্যর্থ হয়ে যাবে।
আয়াতটির পরের অংশ ’আপনার রবের নামের সাথে’। অর্থাৎ পাঠ করতে বলা হচ্ছে রবের নামের সাথে। আল্লাহ এখানে ’আল্লাহর নামের সাথে’ না বলে ’রবের নামের সাথে’ বললেন। কোরআনের প্রত্যেক সূরা (সূরা তওবা ব্যতীত) শুরুর আগে বলতে হয় ’বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থাৎ আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু। অথচ এ সূরাটি অর্থাৎ সূরা আলাক্ব শুরু করলাম ’আল্লাহর নামের সাথে …’ বলে কিন্তু প্রথম আয়াতে আমাকে বলা হচ্ছে ’পাঠ করো তোমার রবের নামের সাথে’। কেন? আল্লাহ তো ’পাঠ করো আল্লাহর নামের সাথে’ বলতে পারতেন। কেন ’রবের নামের সাথে’ বললেন? রব কে? বলা হয় এ সূরাটিই প্রথম নাযিল হয়েছিল। যদি তাই হয় তাহলে আল্লাহ এখানে ’আল্লাহ’ না বলে ’রব’ বললেন কেন? এবার আসুন কোরআনের প্রথম সূরা সূরা ফাতিহা’র প্রথম আয়াতে-
”প্রতিষ্ঠিত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি জগতসমূহের রব”।
প্রশংসা ’আল্লাহর’ যিনি ’রব’। আল্লাহ নামটি জগৎময় সবাই শুনতে পাবে কিন্তু রবের পরিচয় সবাই পাবে না। আল্লাহ নামটি আদি, একক, অনন্তময় এবং সর্বজনীন। এ নামে দ্বিতীয় কেউ আজ পর্যন্ত পরিচিত হতে পারেনি, এখনো পারছে না এবং ভবিষ্যতেও পারবে না। কিন্তু আমরা জানি অনেক গর্দভ নিজেদের ’রব’ বলে দাবী করেছিল। এ একবিংশ শতাব্দীতেও অনেকে নিজেকে নিজের অজান্তেই রব বলে মনে করছে বা রবের সাথে অংশীবাদে নেমেছে- কেউ দু’আনা অর্থের গরমে, কেউ তার প্রতি বিপুল জনসমর্থনের গরমে, কেউ এবাদতে অন্যের চিন্তায় মগ্ন হয়ে, কেউ বিপরীত লিঙ্গকে সবকিছু মনে করে, কেউ রাশি রাশি অস্ত্র-বোমার মালিক হয়ে, কেউ নিজের ভেতরে বিভিন্ন নামের মূর্তি (যেমন- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা ইত্যাদি) বানিয়ে আবার কেউ জড় পদার্থের আরাধনায় যেয়ে ইত্যাদি। কিন্তু মহান আল্লাহ বলছেন ’পাঠ করো তোমার রবের নামের সাথে’ অর্থাৎ আল্লাহ এখানে ইঙ্গিত দিচ্ছেন আগে রবের পরিচয় জেনে নাও তারপর পাঠ করো। রবের পরিচয় জানতে ব্যর্থ হলে পাঠ করার কোন সার্থকতা থাকে না। সুতরাং পাঠ করা এবং রবের পরিচয় জানার মধ্যে একটি গূঢ় সম্পর্ক আছে। কারণ রবের পরিচয় জানতে হলেও সংযোগ সাধন করতে হবে। ’রব’ নামটির রহস্য আরো ব্যাপক এবং বিস্তৃত আর এ বিষয়ে লিখতে গেলে আমাকে একটি গ্রন্থ রচনায় হাত দিতে হবে। আবার সব কথা সেখানে লেখাও যাবে না। কেননা কাদেরীয়া তরীকার উদ্ভাবক বড়পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বলেছেন, ”মহান রবের গূঢ় রহস্যগুলো প্রকাশ করা কুফরী” [সিররুল আসরার, মূল: গাউসুল আ’যম হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.), অনুবাদ: মুহাম্মদ আবদুল মজিদ, পৃষ্ঠা-১৮, প্রকাশ-২০১২, সনজরী পাবলিকেশন, ঢাকা]। ’নামের সাথে’ বাক্যটির আরবী হল ’বিসমি’ (ইক্বরা বিসমি)। আর ’বিসমি’-এর প্রথম অক্ষর হল ’বা’। ’বিসমি’ শব্দটিকে ভাঙ্গলে হয় বি ইসম। ইসম অর্থ নাম বা গুণাবলী। গুণাবলী কার? রবের। আর ’বা’-এর ব্যাপারে উল্লেখ তো করলামই। সুতরাং বুঝতে পারছেন কেন ’রব’ নামটির রহস্য আরো ব্যাপক এবং বিস্তৃত।
এখানে আরেকটি বিষয় না বললে নয় আর তা হল, আয়াতটিতে বলা হয়েছে ’পাঠ করো তোমার রবের নামের সাথে’ বলা হয়নি ’তোমাদের রবের নামের সাথে’। কারণ সবার রব একই হবে না। অন্য ধর্মাবলম্বীদের কথা বাদ দিলাম যারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী বলে নিজেদের দাবী করছে দেখুনতো তারা সবাই একই জায়গায় আছে কিনা। রব তো একজনই তাহলে সবার তো এক জায়গাতেই থাকার কথা, এতগুলো দল তবে কেন হল? কে বানালো এতগুলো দল? বুঝা যাচ্ছে দাবীতে সবাই আল্লাহকে মানে ’রাব্বুল আ’লামিন’ (অর্থাৎ জগতসমূহের রব) হিসেবে কিন্তু ভেতরে নিজেকেই ভাবছে রব!
অনেকেই আয়াতটি (সূরা আলাক্ব, আয়াত: ১) পাঠ করে শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে চায়। কেউ বাংলা মাধ্যম, কেউ ইংরেজি মাধ্যম, আবার কেউ আরবী মাধ্যম। আয়াতটিতে কি কোন মাধ্যমের কথা বলা হয়েছে? শিক্ষার গুরুত্ব ঠিক আছে। কিন্তু কোন শিক্ষা? বুঝতে পেরেছেন কি?