somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিল্পচর্চা গুয়ানতানামো’র সংগীত-হাতিয়ার

১৯ শে জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৩:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুনিয়াজোড়া জনপ্রিয় যুক্তরাষ্ট্রের ভারি বাজনাওয়ালা (হেভি মেটাল) গায়কদল ‘মেটালিকা’র গায়ক জেমস হেটফিল্ড- এই গায়ক জানিয়েছেন ‘জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে তার গান ব্যবহৃত হওয়ায় তিনি গর্বিত।’
-------------------------------------------------------------

আধুনিক ‍দুনিয়াদারির নেতৃত্বে থাকা যুক্তরাষ্ট্র প্রমাণ করেছে যে, সংগীত শুধু জীবনের ভাষা-ই নয়, একই সাথে মরন-যন্ত্রনার ও স্বাদ দিতে পারে সংগীত।

মে, ২০০৩; সেদিন গুয়ানতানামোর ডেল্টা বন্দিশালায় আটক রুহাল আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নেয়া হয়েছিলো গান শোনানোর জন্য! একজন সামরিক পুলিশ এসে আহমেদকে তুলে নিয়ে গেলেন জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে, তখনো আহমেদের জানা ছিল না যে ওই কক্ষে আজ তার জন্য অপেক্ষা করছে সংগীতায়োজন- নিত্যকার নির্যাতনের নির্ঘন্টে আজ নতুন মাত্রা পাবে। জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষের মেঝেতে লাগানো লোহার রিং এর সাথে তার পা আটকে দেয়া হলো, হাত দুটো একসাথে পিছমোড়া করে বেধে মেঝেতে লাগানো রিং এর সাথে জুড়ে দেয়া হলো। ওই অবস্থায় দাড়িয়ে থাকা সম্ভব না, আবার বসে পড়াও অসম্ভব এবং হাটু মুড়ে থাকাও সম্ভব না। আর এভাবে কিছুক্ষন থাকলে পরেই খিচুনি শুরু হয়ে যায়। এরকম নির্যাতনের সাথে ভালোই পরিচয় ছিলো তার, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহীনির জিজ্ঞাসাবাদের ‘মানসম্মত পরিচালন প্রক্রিয়ার’ অংশ এটা, বন্দি অবস্থায় প্রতিদিনের একটা বড় অংশ আহমেদদের এভাবেই কাটতো। এভাবে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে একটা প্রশ্নই বারবার করা হয়েছিল- তিনি এবং তার বন্ধু ২০০১ এর শরতে আফগানিস্তানে কি করছিলেন?

সেদিনও একই প্রশ্ন অপেক্ষা করছে সেটা জানতেন তিনি। কিন্তু যা জানতেন না তা হলো- ছিয়াশি বর্গফুটের কক্ষটিতে সেদিন একটা দশাসই আকারের সাউন্ড বক্স ছিলো, ওপরে একটা সিডি প্লেয়ার। একজন সৈনিক ঢুকে প্লেয়ারে একটা সিডি ঢুকালো, প্লেয়ার চালু করে সর্বোচ্চ স্বরে উঠালো, এবং দরজা বন্ধ করে চলে গেলো। সিডিটা ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে র্যানপ গায়ক এমিনেম-এর। আহমদ বলছেন, ‘আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কি হচ্ছে। ভাবলাম, ওরা সাউন্ড বক্সের কথা ভুলে গেছে।’ সৈনিকটি যখন আবার ফিরলো আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সে তাকালো ঠিকই আমার দিকে কিন্তু কিছু বললো না।

এরপর থেকে যতদিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নেয়া হতো, বারবারই নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো সংগীত। প্রতিদিন নিশ্চয় এমিনেম নয়। কোনোদিন রেইজ এগেইনস্ট দ্য মেশিনের রক গান আবার কখনো অন্য কোনো গায়কদলের ভারী বাজনাওয়ালা (হেভি মেটাল) গান ইত্যাদি। স্বরের মাত্রা ছিলো কানফাটানো, এভাবে তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা গান শুনতে বাধ্য করা হতো, ওই ছিয়াশি বর্গফুটের কক্ষে- না দাড়ানো না বসা অবস্থায়। কখনো এক নাগাড়ে কয়েক দিন ওভাবে রাখা হতো। প্রায়ই তার মুখের ঠিক সামনে ফ্লাশলাইট জ্বালিয়ে রাখা হতো। বাদবাকি অন্ধকার। তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, এবং কানের ঠিক কাছে চরম উচ্চস্বরে বাজছে ভারী বাজনাওয়ালা গান। আবার কখনো কক্ষের তাপমাত্রা একেবারেই কমিয়ে দেয়া হতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রন করে। কনকনে বরফ ঠান্ডা, অন্ধকার, চোখের সামনে উজ্জ্বল বাতি, কানের কাছে কানফাটানো রক এন রোল! অসহ্য যন্ত্রনায় খিচুনি খেতে খেতে এভাবে আর কাদের কবে সংগীত উপভোগ করতে হয়েছে? গুয়ানতানামো ছাড়া?

অবশ্যে এরকম চরম সংগীতায়োজন না হলেও সংগীত হামলার আরো কিছু দৃষ্টান্ত আছে, যুক্তরাষ্ট্রের তরফেই। পানামার শাসন ম্যানুয়েল নরিগো যখন ১৯৮৯ সালে পানামাস্থ ভ্যাটিক্যান দূতাবাসে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাহীনি দূতাবাসে কয়েক দিন ধরে বোমা হামলার পাশাপাশি আরেক ধরনের হামলা চালিয়েছিল। রাস্তায় সাজোয়া গাড়ি ও আকাশে কপ্টার থেকে উচ্চস্বরে রক এন রোল হামলা করেছিল দূতাবাস লক্ষ্য করে। আবার যেমন ১৯৯৩ সালে টেক্সাসে একটি খামার বাড়ীতে আশ্রয় নেয়া একটা গোষ্ঠীকে বের করে আনার জন্য লাউড স্পিকারে সংগীত হামলা করেছিল। ন্যান্সি সিনাত্রা’র বাজার পাওয়া গান- দিজ বুটস ওয়ার মেইড ফর ওয়াকিং বাজিয়েছিল এফবআই এজেন্টরা। উদ্দেশ্য পরিস্কার- খামারবাড়ী থেকে বেরুবে না বলে পন করা ওই ভিন্নমতালম্বি নাগরিক গোষ্ঠীটিকে নৈতিকভাবে দুর্বল করে তোলা।

পাঠক! জানাচ্ছিলাম গুয়ানতানামোর সংগীত আয়োজনের কথা। রুহাল আহমেদ- সংগীত নির্যাতনের শিকার অগুনতি বন্দিদের একজন মাত্র। আহমেদের পরিবার মূলত বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে যুক্তরাজ্যে যায়। এখন তাদের বাস দেশটির বার্মিংহামের কাছের ছোট্ট শহরে- টিপটন। তিন বন্ধু ছিলেন গুয়ানতানামোয়। ছাড়া পাবার পর সংবাদ মাধ্যমে পরিচিত হয়েছেন টিপটন থ্রি নামে। ২০০১ এর সেপ্টেম্বরে কুড়ি বছর বয়সী আহমেদ আর দুই বন্ধু পাকিস্তানে গিয়েছিলেন এক বিয়েতে। ততদিনে ওদিকে আফগানিস্তানে শুরু হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারি। রোমান্ঞের তালাশে তিনি বন্ধু সীমান্ত পার হয়ে ঢুকে পড়েছিলেন আফগানিস্তানে। পাকিস্তানে ফেরার সময় যুক্তরাষ্ট্রের দালাল উত্তরাঞ্চলীয় জোট তাদের আটকে দেয়। তারা তিনজন ইংরেজিভাষী এবং মুসলিম, অথচ যুক্তরাষ্ট্র কিংবা তার মিত্র কিংবা তাদের দালালদের কারো হয়ে আসেন নি ২০০১ এর আফগানিস্তান; সুতরাং আল কায়দা না হয়ে উপায় নাই! তাদের দখলদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়। ২০০২ এর শুরুতে তাদের ডেল্টা বন্দিশালায় ঢোকানো হয়। ছাড়া পান ২০০৪ এর মার্চে। আহমদের বয়স এখন আটাশ।

টিপটনের নিম্নশ্রেনীর আবাসিক এলাকায় নিজের বাড়ির আঙিনায় দাড়িয়ে তিনি জার্মানির বিখ্যাত ম্যাগাজিন ডার স্পিগেলের প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আমি যখন লোকজনকে বলি সংগীতও জুলুম হতে পারে তখন তারা ভাবে আমার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। লোকজনকে এতো আনন্দ দেয় যে শিল্প সেটা আবার কিভাবে জুলুম হয়? কিন্তু আমার কথা সত্য। আপনি স্বাভাবিক জুলুম সামলে নিতে পারেন, কিন্তু সংগীতের জুলুম সহ্য করা সম্ভব না। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা যা শুনতে চেয়েছে তার সবই আমি তাদের বলেছি; যে আমি বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সাথে দেখা করেছি, আমি তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানি। আমি শুধু তাদের বলছিলাম গান থামাতে।’ শুধু গুয়ানতানামোয় না, আফগানিস্তান ইরাক সহ সারা দুনিয়াজুড়ে সিআইএ’র গোপন বন্দিশালাগুলোতে এমন সব শিল্প-অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। পানিতে চুবিয়ে রেখে, ঘুমাতে না দিয়ে, কাঠের ছোট্ট বাক্সে ঢুকিয়ে, কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে সর্বোচ্চ স্বরে রক এন রোল এবং হেভি মেটাল গান শুনতে বাধ্য করা হয়েছে বন্দিদের; যেমন বি গিজ গায়কদলের গান ‘স্যাটারডে নাইট ফিভার’।

যেসব গায়ক বা গায়কদলের গান জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে তাদের খুব কমই এযাবত আপত্তি জানিয়েছেন। সবমিলিয়ে বিষয়টি জানাজানি হবার পর অবশ্য দেশটির ওইসব রক গায়কদের মোটেই বিচলিত মনে হয়নি। বরং অনেককেই মনে হয়েছে যে তারা বিষয়টি গুরুত্ব দেয়ার মতো কিছু মনে করেন না। শুধু একটা গায়কদল- রক গোষ্ঠী রেইজ এগেইনস্ট দ্য মেশিন এর পক্ষে গায়ক টম মোরেলো তাদের তীব্র প্রতিবাদের কথা জানিয়েছেন। অন্যদিকে রক গায়ক ট্রেন্ট রেজনর ও কান্ট্রি সং গায়ক রোজানে ক্যাশ আপত্তি জানিয়েছেন এবং জানতে চেয়েছেন ঠিক কিভাবে তাদের গানকে নির্যাতনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেকেই আবার তাদের গর্বের কথা জানিয়েছেন। যেমন দুনিয়াজোড়া জনপ্রিয় যুক্তরাষ্ট্রের ভারি বাজনাওয়ালা (হেভি মেটাল) গায়কদল ‘মেটালিকা’র গায়ক জেমস হেটফিল্ড- এই গায়ক জানিয়েছেন ‘জুলুমের হাতিয়ার হিসাবে তার গান ব্যবহৃত হওয়ায় তিনি গর্বিত।’ তবে আরো যাদের গান ব্যবহৃত হয়েছে তাদের অধিকাংশ গায়ক এবং গায়কদল এখনো চুপচাপ। যেমন; এসি/ডিসি, ব্রিটনি স্পিয়ার্স ও নেইল ডায়মন্ড সহ অনেকে।
--------------------------------------------------------------------------------

শিল্পচর্চায় আরো আগ্রহ যাদের আছে
তারা এইখানে ক্লিক করতে পারেন
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১০ সন্ধ্যা ৬:১২
১৭টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আত্মপোলব্ধি......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৫১

আত্মপোলব্ধি......

একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !

লিখেছেন হাসানুর, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:৩২



হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।

লিখেছেন তানভির জুমার, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৩৩

আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?

লিখেছেন রাজীব, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৪২

ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।

আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×