দিনটি ছিলো রবিবার; ১৯১৭ সালের ১৩ই অক্টোবর। তিন তরুণ মেষপালক শিশুর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, অলৌকিক কিছু প্রত্যক্ষ করার আশায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ জড়ো হয় ফাতিমা কভা ডা ইরিয়া সংলগ্ন মাঠে। মানুষের মাঝে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আত্মপ্রকাশ করেন ফাতিমা মতান্তরে কুমারী মা মেরী।
উৎসুক মানুষের একাংশ
মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হলো। অকস্মাৎ বৃষ্টি থেমে গিয়ে মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করল। বৃষ্টিতে ভেজা চারদিকের পরিবেশ, কর্দ্মাক্ত মাঠ, এমনকি উপস্থিত মানুষের ভিজে যাওয়া পোশাক পর্যন্ত মুহূর্তে শুকিয়ে গেলো। হঠাৎ করে আকাশে ঘূর্ণয়নরত গোলাকার তির্যক বর্ণীল রশ্মির বলয় প্রতিফলিত হলো। এই সময় সূর্য স্থির হয়ে পড়ে তার নিজ কক্ষপথে। ধীরে ধীরে মেঘের সাথে আড়াআড়ি ভাবে ছেয়ে যেতে লাগলো সেই রশ্মি। প্রত্যক্ষদর্শীরা ভাবল এটা বুঝি বিশ্বের সমাপ্তির কোন ভয়ানক চিহ্ন।
একই স্থানে দৃশ্যত আধুনিক সময়ের তোলা একটি ছবি। বলা হয় যে, প্রতি বছর একই দিনে একই স্থানে আকাশে এমন রশ্মির আবির্ভাব ঘটে।
প্রায় দশ মিনিট সময় ধরে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী বহু পত্রপত্রিকায় এই নিয়ে রিপোর্ট করা হয়।
পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট
বিশ্বাসীদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ঐ শিশুত্রয় এই ঘটনার জন্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলো ১৯১৭ সালের ১৩ই জুলাইতে একবার, তারপর ১৯শে আগস্ট এবং সবশেষে ১৩ই সেপ্টেম্বর। ১৯৩০ সালের ১৩ই অক্টোবর রোমান ক্যাথলিক চার্চ থেকে এই অলৌকিক ঘটনাকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বিশ্বাসীদের কাছে যা, দেবী ফাতিমা বলে পরিচিত। এই ঘটনা মূলত খ্যাতি অর্জন করে এর গোপনীয়তা, ভাববাদ এবং ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হওয়ার কারণে।
ছবির বামে জাসিন্টা মারটো ও ডানে বড় বোন কাজিন লুসিয়া ডস সান্টস
লুসিয়া ডস সান্টস, জাসিন্টা মারটো ও ফ্রান্সিস্কো মারটো তিন তরুণ পর্তুগীজ মেষপালক দাবী করল যে তাদের কাছে ফাতিমা দেখা দিয়েছেন। ঝিলিমিলি জল ভরা স্ফটিক পানপাত্রের তুলনায় স্বচ্ছ, সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল আলোক রশ্মির মাঝে তারা ফাতিমাকে দেখতে পেলো। তিনি তাদেরকে ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য শিক্ষা দান করেন। শিক্ষা দান করেন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার জন্য। ফাতিমা তাদের ক্ষতিপূরণের বদলে পাপীদের মাপ মোচনের জন্য ক্ষমাশীল হয়ে আক্ষেপ করতে বলেন। ফাতিমা তাদের কাছে তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী করে যান এবং বলে যান যেন তিনটি বিষয় গোপন করে রাখা হয়।
কিন্তু শিশুত্রয় যখন তাদের পরিবারের কাছে ফাতিমার এই ঘটনা সম্পর্কে জানায়, তখন এই ঘটনা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায়। ধর্মীয় কারণে সংঘাত হওয়ার আশংকায় তাদেরকে জেলখানায় বন্দী করা হয়। কিন্তু তারা ফাতিমার কাছে দেয়া অঙ্গীকার অনুযায়ী কিছুতেই সেই তিনটি গোপন ভবিষ্যদ্বাণী জানাতে তাদের অপারগতা জানালে; তাদেরকে উত্তপ্ত তেলের পাত্রে ডুবিয়ে হত্যার হুমকী প্রদান করা হয়। তাদের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। শত অত্যাচার, নিপীড়ন সহ্য করার পরেও তবু তারা তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে অবিচল থাকে। একসময় তারা ফাতিমার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে। এই সময় ফাতিমা তাদের কাছে দেখা দিয়ে আশ্বস্ত করেন যে, তিনি তার পরিচয় নিয়ে মানুষের মাঝে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আত্মপ্রকাশ করবেন। তারপর নির্ধারিত দিনে যখন সেই অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হয় তখন সবার মাঝে বিশ্বাস স্থাপন হয়। মুক্ত করে দেয়া হয় ফাতিমার বর প্রাপ্ত শিশুত্রয়কে।
জাসিন্টা মারটোর ভাই ফ্রান্সিস্কো মারটো
১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জার মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে জাসিন্টা ও ফ্রান্সিস্কো। এই সময় ফাতিমা পুনরায় তাদেরকে দেখা দিয়ে খুব শীঘ্রই স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার প্রতি আশ্বস্ত করে যান। ফ্রান্সিস্কো চরম অসুস্থার সময়গুলোতে চার্চে পড়ে থেকে প্রার্থনায় মগ্ন থাকে। অনেক চেষ্টা করা হয় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করানোর জন্য। কিন্তু কিছুতেই সে রাজী হয় না তার চিকিৎসার জন্য। অবশেষে দেখতে দেখতে তার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে জাসিন্টাকে চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু হাসপাতাল পরিবর্তন করেও যখন কোন উপায় হলো না; তখন চিকিৎসার এক পর্যায় পাঁজরে পুঁজ জমে যাওয়ার কারণে পাঁজরের দুটি হাড় কেটে ফেলতে হয়। এর কিছুদিন পর সেও মারা যায়। মৃত্যুর সময় তাদের উভয়ের বয়স ছিলো মাত্র দশ বছর। দীর্ঘদিন অন্ধ থাকা অবস্থায় লুসিয়া ৯৯ বছর বয়সে মারা যান ২০০৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী। পর্তুগীজে এই দিনটিকে শোকদিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ফাতিমার কাছে দেয়া প্রতীজ্ঞা অনুযায়ী, লুসিয়া তিনটি ভবিষ্যদ্বাণী পৃথক পৃথক তিনটি খামে ভরে লিপিবদ্ধ করে রাখে। যার সম্পর্কে লুসিয়া ছাড়া আর কেউ জানত না। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণেই মূলত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত খামগুলো খুলে পড়া হবে না। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে নির্ধারিত দুটি ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হলে দুটি খাম খুলে সবাইকে তা জানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু লুসিয়া আজ আর বেঁচে নেই। কিন্তু এখনও বন্ধ অবস্থায় রয়ে গেছে তৃতীয় খামটি। যার সত্যতা প্রকাশিত হওয়ার অপেক্ষায় খামটিকে সিল গালা করে রাখা হয়েছে। ভ্যাটিকান থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, শেষ ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে যখন যিনি পোপ হবেন তিনি ব্যাতীত আর কেউ জানবেনা। শুধুমাত্র নির্ধারিত সময় সত্যতা প্রকাশ পেলেই; সেই খাম খুলে জানিয়ে দেয়া হবে ভবিষ্যদ্বাণীটি সম্পর্কে।
প্রথম ভবিষ্যদ্বাণীটি ছিলো পৃথিবীতেই মানুষের নরকের স্বাদ পাওয়াকে কেন্দ্র করে আর দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীটি ছিলো নরকের পর পৃথিবীর মানুষের স্বর্গের সোপান খুঁজে পাওয়াকে কেন্দ্র করে। যার ব্যাখ্যা দেয়া হয় এইভাবে যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর মানুষ নরকের স্বাদ ভোগ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মানুষের মুক্তি লাভ হয়। খৃষ্টান ধর্ম স্বর্গের বার্তা নিয়ে মানুষের মাঝে দ্যূতি ছড়াতে থাকে। সবশেষ ভবিষ্যদ্বাণীটি সম্পর্কে যদিও এখনও কিছু জানা যায়নি তবু ধারণা দেয়া হয় যে, মানুষ পুনরায় শেষবারের মতো ভয়ানক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হবে এবং তাতে পৃথিবী থেকে একদিন সব ধর্মকর্ম বিলীন হয়ে যাবে। সংঘটিত হবে মহাপ্রলয়। রয়ে যাবে শুধু স্বর্গ আর নরকের হিসাব নিকাশ করার নির্ধারিত দিন।
দেবী ফাতিমার চার্চ
যদিও এখানে খৃষ্টান ধর্মকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বলা হয় যে, লুসিয়া আসলে ফাতিমা নামের যাকে দেখেছে আসলে সে ছিলো যীশুর কুমারী মা মেরী। পরবর্তীতে জানা যায় যে, লুসিয়া সেই ঘটনার সময় যীশুর প্রতিচ্ছায়াও দেখতে পেয়েছিলো। কিন্তু বিজ্ঞান এই ঘটনাকে ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ করে। মানুষের মাঝে ভ্রম সৃষ্টি করা হয়েছিলো বলে দাবী করে। কারণ বৃষ্টির পর স্বাভাবিক ভাবেই রোদ্র উজ্জ্বল পরিষ্কার আকাশে মেঘের ছায়ায় রংধনু জ্যোতি ছড়ায়। হতে পারে; কারাগারে তাদেরকে বন্দী করে নির্যাতন করে তাদেরকে দিয়ে এই মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াতে বাধ্য করা হয়। এইজন্য তিনটি শিশুকে বেছেই নেয়া হয় যেন মানুষের মাঝে খুব সহজেই বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। আর ফাতিমা অর্থাৎ নবী তনয়া ফাতেমা (রাঃ) নাম দেয়া হয় ইসলাম ধর্মকে আঘাত করার জন্য সেই সাথে পরবর্তীতে ফাতিমার স্থলে নামকরণ করা হয় যীশুর কুমারী মা মেরীর নামে যেন একই সাথে খৃষ্টান ধর্মকেও আঘাত করা যায়। তাছাড়া অনেক পন্ডিতদের মতে, প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খৃষ্টানদের উপর নয় বরং হিটলার হত্যাকান্ড চালিয়েছিলো ইহুদীদের উপর। তাই হিটলারের পরাজয় ছিলো মূলত ইহুদীদের জন্য মুক্তির উপায় এবং পরবর্তীতে ইহুদীদের বিস্তার লাভ করতে থাকে খুব দ্রুতই। ইসলাম ধর্ম এবং আদি বাইবেল অনুযায়ী কেয়ামতের পূর্বে এই ইহুদীদের বিরুদ্ধেই মুসলমান ও খৃষ্টানদের মিলিত যুদ্ধ সংঘটিত হবে। যা শেষ ক্রুসেড নামেও অভিহীত হয়ে থাকে। ক্রুসেড বলতে মূলত ধর্মীয় যুদ্ধকেই বোঝায়। যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ধর্মীয় যুদ্ধ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় তাহলে সেটা ভুল হবে। কারণ এই যুদ্ধ হয়েইছিলো সাম্রাজ্য আর আধিপত্য বিস্তারের জন্য। আর ইহুদী নিধন ছিলো একটা অংশ বিশেষ ছাড়া অন্য কিছুই নয়। কিন্তু যাই হোক সেটা খৃষ্টান নিধন ছিলো না। অথচ খুব চতুরতার সাথেই এটি খৃষ্টানদের বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়।
এই ঘটনা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক থাকলেও; একটি জায়গায় এসে সব তর্ক বিতর্ক থেমে যায়। শিশু অবস্থায় তাদের ফাতিমার সাক্ষাৎ প্রাপ্তি এবং এই ঘটনার কারণে তাদের উপর কারাগারে হয়ে যাওয়া অমানুষিক নির্যাতন এবং কাঙ্ক্ষিত দিনে সেই অলৌকিক ঘটনা ঘটে যাওয়া এবং তিনটি ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা প্রকাশিত হওয়া আদৌ কি কোন গভীর ষড়যন্ত্র নাকি সত্যি কোন ঈশ্বর প্রদত্ত অলৌকিক ঘটনা।