-বুঝলি শিহাব, ডলির হাসবেন্ডটা একটা পিশাচ। হালার ভিতরে কোন ইমোশন নাই। এমন সুন্দরী একটা বউরে কেউ এমনে মাইর ধর করে নাকি? আমি হইলেত হালায় এমন পরীর মতন বউরে শোকেসে সাঁজায় রাখতাম!
-চল হালারে সাইজ দেই!
-চল!
ছোট বেলায় খুব শখ করে নাচ শিখেছিলো ডলি। ভেবেছিলো একসময় নৃত্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মধ্যবিত্তদের আর কিছু হোক না হোক; রক্ষণশীলতা প্রচন্ড রকম ভাবে কাজ করে। পরিবারের বাঁধা আপত্তি অগ্রাহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারপরতো হুট করে একদিন বিয়েই হয়ে গেল।
রাতুল যখন অফিসে থাকে, তখন ভীষণ নিঃসঙ্গতায় পেয়ে বসে ডলিকে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে ঘরের ভেতর নেচে নেচে মনের অধরা সাধ পূর্ণ করে সে। প্রতিদিনের মতো আজকের দুপুরটাও তার মাতাল নাচে মত্য হয়ে উঠেছে। নাচতে নাচতে শাড়ির আঁচল মেলে ধরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় সে। নিজের শরীরের প্রতি অহংকার বোধ হয়। রূপ-লাবণ্য, শারীরিক গঠনগত সৌন্দর্য কোন কিছুরই কমতি নেই। অথচ বিয়ের পর থেকে একদিনের জন্যেও রাতুলের মনে তার কোন প্রভাবই সে বিস্তার করতে পারেনি। কপালের ক্ষতটা থেকে রক্ত ঝরছে। ভেবেছিলো কখনই আর কাঁদবে না কিন্তু চোখের বাঁধ ভেঙে অশ্রু নেমে আসে।
হঠাত! কলিং বেলের শব্দ। এই সময় কে হতে পারে? রাতুলের অফিস থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়। এই সময় তাই রাতুলের ফেরার কোন কারণই নেই। তাহলে জনিও হতে পারে। জনি তাদের পাশের বাড়িতেই থাকে। বিকেল বেলায় মাঝে মাঝে ছাঁদে উঠলে জনির সাথে কথা হয় ডলির। এভাবেই ছাঁদের আলাপচারিতায় অল্প কদিনের মধ্যেই দুজনের মধ্যে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। দরজা খুলতেই হাসি মুখে জনি ফুলের তোরাটা এগিয়ে দেয়।
-হ্যাপি বার্থ ডে!
-থ্যাংক্স! এসো ভেতরে এসো।
-কপাল কাটলে কেমন করে?
-বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলাম।
-মিথ্যে কথা বলনা। পিশাচটা মেরেছে?
-জনি প্লীজ! বাদ দাও। কফি খাবে?
-এই দুপুর বেলা কফি খাবো!
-ভাত খাবে?
-না, এখন ভাত খাব না।
-তাহলে কি খাবে বল?
-কিছুই খাব না। তোমার সাথে শুধু গল্প করতে এসেছি। তুমি বসতো।
-জনি, তুমি কি আমার নাচ দেখবে?
আমার খুব শখ, আমি খুব করে নাচব। সবাই আমার নাচ দেখে মুগ্ধ হবে। অজস্র করতালিতে ভরে উঠবে চারিদিক। কিন্তু জান আমার সেই শখ কোন দিন পূরণ হবে না। আজ তুমি আমার সেই শখ পূর্ণ করে দাও। আমি তোমার সামনে নাচব। তুমি আমার নাচ দেখে মুগ্ধ হবে। দেখবে জনি আমার নাচ?
জনিকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শাড়ি খুলে ফেলে পাগলের মতো নাচতে শুরু করে দেয় ডলি।
-কিরে সেলিম এইটা কি চা বানায়ছিস?
-কেন মামা কি হইছে?
-চায়ে কি দুধ দেস নাই! তুই জানস না চায়ের মধ্যে বেশি কইরা দুধ না দিলে; সেই চা খাইয়া আমি কোন মজা পাইনা।
-মামা চায়ের মজা দিয়া কি করবেন? আমাগর জনি মিয়াঁ যে ইদানীং চা না; কফি খাওন শুরু করছে হেই খবর কি রাহেন?
-মানে?
-মানে কিছুনা! তয় জনি ভাইয়ের লগে ডলি আপার মেলামেশাটা খুব বেশি ভাল ঠেকতাছেনা।
-চিন্তা করিসনা। জনিরে হালকা একটা ডলা দিয়া দিলেই সব ঠিক হইয়া যাইব।
-না মামা মনে হয়না। পানি অনেক দূর গড়াইছে। এইতো একটু আগেও জনি মিয়াঁরে দেখলাম ডলি আপার বাসার দিকে যাইতে। হাতে আবার একটা ফুলের তোরাও আছিল।
-কি কস!
-হ মামা। মামা কি একটা সিগারেট দিমু আপনারে?
-হুম!
-মামা মনে লয় চিন্তার মইধ্যে পইরা গেলেন?
-হুম! জনিরেতো খুব ভাল করেই চিনি। হালায় একটা লুইচ্চা। ভাবতেছি দুইটারে একলগে কেমনে সাইজ দেওন যায়?
-ডলি আপারে সাইজ দিবেন কেন মামা?
-আরে ধুর ডলিকে নারে গাধা। জনির সাথে ঐ রাতুলরেও একটা সাইজ দেওন লাগব। নাইলে হালায় ঠিক হইব না। ডলির মতো একটা মেয়ে চোখের সামনে এমন হইয়া যাইব সেইটা মানা যায়না। ডলি সুখে থাকলেই আমার সুখ।
-মামা আপনে ডলি আপারে কেন বিয়া করলেন না?
-ধুর হালায়। ডলিরে আমি ভালোবাসি ঠিকই। কিন্তু সেইটা প্রেম নারে। অরে আসলে আমি খুব শ্রদ্ধা করি। অনেকটা ধর দেবীর আরাধনা করার মতো। দেবী সেই, যারে মনে খুব ইচ্ছা করে সামনে বসাইয়া পূজা-অর্চনা করতে।
হঠাত! পেছন থেকে পিঠে হাত রেখে শিহাব জানতে চাইল কিরে কার পূজা-অর্চনা করবি? তুই কি হিন্দু ধর্ম গ্রহন করলি নাকিরে?
-ডলির কথাই কইতাছিলাম। আর হালায়! তুই চল চল বইলা আমারে এতক্ষণ বসায় রাইখা কোথায় গেছিলি?
-দোস্ত তোর ভাবীর কয়েকদিন ধইরা খুব জ্বর। অর মাথায় একটু পানি ঢাইলা দিয়া আসলাম।
-আরে বেকুব আগে বলবি না; কি আশ্চর্য! যা বাসায় যা। আমিও বাসায় যাই। সন্ধ্যায় আয়া পরিস। রাতুল রাতে যখন অফিস থিকা ফিরব; তখন কেমনে কি করুম; প্ল্যান করুমনে দুইজনে মিলা। সেলিম দে, আরেকটা সিগারেট দে; টানতে টানতে যাই।
অনেকবার মোবাইলে ট্রাই করেও জনিকে পাওয়া গেল না। জনির মোবাইল বন্ধ। ডলি বার বার স্টেশনের গেটের দিকে তাকাচ্ছে। এই বুঝি জনি চলে এলো। এদিকে ট্রেনও প্রায় ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে। কিন্তু পুরো স্টেশনে জনির আসার কোন চিহ্নই নেই। জীবনের এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয়। রাতুলের প্রতি কোনরূপ ভালোবাসা না থাকলেও, মানুষটাকে এখন আর ঠকান যাবেনা। ঝরে যাওয়া শিউলি ফুল আজ মানুষের হাতের স্পর্শ লেগে ময়লা হয়ে গেছে।
ট্রেনের গতি ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। প্রকৃতিও আজ বড় বেশি বেরসিক খেলা খেলছে। যখন নাচের সব মুদ্রা বিসর্জন দিতে হচ্ছে, তখন তার চুলগুলো বাইরের মৃদু বাতাসের অবাধ্যতায় নাচছে। জানালার গ্লাসটা বন্ধ করে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায় ডলি। রাতের অন্ধকার আকাশটাকে আজ তার খুব আপন বলে মনে হচ্ছে। এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার আকাশে ঝিলমিল তারাদের কোলাহলে চাঁদের আলো শোভা পায়না। বড় বেশি বেমানান!
উৎসর্গঃ শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় সোহানী আপু, অপূর্ণ ভ্রাতা এবং বড় ভাই সেলিম আনোয়ার আপনাদের প্রতি এই অধমের রইল চির দিনের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।