সন্ধ্যায় সাজগোজ করিয়া মিথিলা অপুর ঘরে প্রবেশ করিল। অপু এতক্ষণ তাহার গল্প রচনা করিতে গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া রহিয়াছিল কিন্তু মিথিলাকে দেখিতে পাইয়া তাহার প্রচণ্ড রাগ হইল। সে ভাবিতেছিল এইক্ষণে একটা কল্পলোকের বিষয় লইয়া গল্প রচনা করিবে কিন্তু মিথিলার এহেন সাজগোজ দেখিয়া তাহার মন হইতে কল্পলোকের সকল কল্পনা হাওয়ায় মিলাইয়াগিয়া বাস্তব জগতের কোন মেনকার কথা স্মরনে আসিল। রাত্রি যাপনের প্রাককালেই তাহার ধ্যান ভাঙিয়া পঞ্চ ইন্দ্রিয় সজাগ হইয়া যাওয়াতে ভীষণ রাগ অনুভব করিল সে। কিন্তু মিথিলা ভাবিল যে তাহার মোহে অপুর ধ্যান ভাঙিয়াছে। সারাদিনের অপেক্ষার যাতনা তাহার স্বামীর বাহুর বন্ধনে এইবার সে মিটাইয়া লইবে। মিথিলা পেছন হইতে তাহার স্বামীকে আলিঙ্গন করিয়া কানের নিকট মুখ লইয়া মৃদু কণ্ঠে একটু আদর করিতে কহিল। অপু সেই চতুরতা বুঝিতে পারিয়া অবজ্ঞা ভরিয়া স্ত্রীর পাণে একবার চাহিয়া পুনরায় তাহার গল্প রচনায় মনোনিবেশ করিল। উহাতে মিথিলা মনে মনে ভীষণ অপমান বোধ করিয়া বিছানায় ঘুমাইতে চলিয়াগেল। কিন্তু স্বামী বিরহে কাতর হইয়া পাশ ফিরিয়া শুইয়া থাকিয়া নীরবে পদযুগল নাচাইতে থাকিল। আর অপু নিবিষ্ট চিত্তে তাহার গল্প রচনা করিয়া রাত্রি পার করিতে থাকিল যথারীতি;
বাড়ির উত্তরের দীঘির জলে কাহার যেন মুখ ভাসিয়া উঠিতে দেখিতে পাইল অপু। দীঘির জল হইতে উঠিয়া আসিল এক নারী মূর্তি। ভেজা শাড়ির ভাঁজে শরীরের প্রতিটি ভাজ তির্যক ভঙ্গিতে ফুটিয়া রহিয়াছে। সেইদিকে দৃষ্টি পরিতেই মনের মধ্যে মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলিল। কি নাম তোমার শুধাইল অপু। লাজুক হাসিয়া নারী মূর্তি কহিল তাহার নাম অধরা। ঈশ্বরের কৃপায় দীঘিতে জন্মিয়া থাকা পদ্ম ফুল হইতে তাহার নারীরূপে নতুন জীবন প্রাপ্তি হইয়াছে। এই কথা শুনিয়া অপু দীঘিতে কোন পদ্ম ফুল দেখিতে না পাইয়া বিচলিত হইয়া পড়িল। অপুর মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া অধরা হাসিয়া কহিল যে পদ্ম তুমি খুঁজিতেছ তাহা তোমার সম্মুখেই দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। চাইলেই হাতে তুলিয়া লইয়া তাহার সৌন্দর্য তুমি উপভোগ করিতে পারিবে। এই বলিয়া অধরা হাঁটিয়া চলিল। অপু তাহার চলিয়া যাইবার পাণে মুগ্ধ হইয়া চাহিয়া রহিল।
সূর্যের আলোয় আকাশ পরিষ্কার হইবার আগেই মিথিলা তাহার পিত্রালয়ের উদ্দেশ্যে সংসারধর্ম ছাড়িয়া যাত্রা করিল। যাইবার কালে একখানা পত্র লিখিয়া রাখিয়া গেল। সকালে ঘুম হইতে উঠিয়া অপু পত্র পড়িয়া স্ত্রীর বিরহে কাতর না হইয়া বরং ভীষণ খুশি হইল এই ভাবিয়া যে আজ হইতে তাহার গল্প রচনা করিতে আর কোন বাঁধা থাকিলনা। তাহার স্ত্রী তাহাকে আর বিন্দুপরিমান জ্বালাতন করিবেনা ভাবিয়া আনন্দে তাহার মন নাচিয়া উঠিল। দিনের কতক অংশ একাকী আনন্দে কাটিলেও একলা রাত্রি যাপন করিতে তাহার মন ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া উঠিল। বিন্দু বিন্দু বিষাদ আসিয়া তাহার মনকে ভরাক্রান্ত করিয়া তুলিতে লাগিল। কিছুতেই ঘুম আসিতেছেনা। রাত্রি যতই বাড়িতেছে তাহার মনে হইতে লাগিল কেহ যেন তাহাকে দীঘির নিকট ডাকিতেছে। অগ্যতা দরজা খুলিয়া দীঘির কাছে গিয়া দাঁড়াইল। ক্ষানিক সময় দাঁড়াইয়া থাকিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিয়া তাহার গল্পের অবশিষ্ট রচনা করিতে আরম্ভ করিল;
অধরা ভেজা শরীর লইয়াই অপুর ঘরে প্রবেশ করিল। অপুও তাহার পেছন পেছন ঘরে প্রবেশ করিল। আলমিরা হইতে মিথিলার একখানা শাড়ি বাহির করিয়া তাহাকে পরিতে দিয়া সে বাহির হইয়া আসিল। ফিরিয়া আসিয়া বিছানায় অধরার স্থলে যেন সে তাহার স্ত্রী মিথিলাকে দেখিতে পাইল। ঠিক এইভাবে বিবাহের প্রথম রাত্রিতে মিথিলা বিছানায় ঘোমটা টানিয়া বসিয়াছিল। অপু তাহার ঘোমটা সরাইয়া কহিল তুমি ঠিক এইভাবে চিরকাল আমার মনে পদ্ম ফুলের মতন ফুটিয়া থাকিবে। আমি তোমার চরনে আমার জলকেলি করিয়া ফিরিব। অধরা অপুকে দুইবাহুর বন্ধনে তাহার বুকের সাথে জড়াইয়া লইয়া কহিল এতটুকু শুনিবার লাগিয়াইত আমাকে পদ্ম হইতে নারী রূপ ধারন করিতে হইয়াছে। তুমি দেখিয়া লও প্রাণ ভরিয়া প্রিয়তমা আমি তোমার পদ্ম হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছি চিরদিনের ত্বরে। তুমি তোমার সাধ মতন জলকেলি করিয়া লও। তোমার এই পদ্মকে তোমার হাতে তুলিয়া লইয়া পূর্ণ হইতে দাও।
অপু তাহার গল্পের শেষটা আর কিছুতেই করিতে পারিলনা। বিছানার পাণে চাহিয়া তাহার কেবলই মিথিলাকে মনে পড়িল। মিথিলাকে সে কতবার কত অবজ্ঞা করিয়াইনা ফিরাইয়া দিয়াছিল। অথচ একদা কত ভালোবাসিয়াইনা তাহাকে স্ত্রী করিয়া ঘরে তুলিয়া আনিয়াছিল। কিন্তু গল্পের নেশা তাহাকে চরম ভাবে পাইয়া বসিয়াছিল। এইক্ষণে মিথিলা থাকিলে তাহাকে পেছন হইতে আলিঙ্গন করিয়া কানের নিকট মুখ লইয়া মৃদু কণ্ঠে একটু আদর করিতে কহিত। নাহ ! ঢের অবজ্ঞা করা হইয়াগিয়াছে। কালই যাইয়া তাহার স্ত্রীকে বাড়িতে ফিরাইয়া লইয়া আসিবে বলিয়া মনস্থির করিল অপু।
দুপুর হইয়া আসিয়াছে। মিথিলা জানালার পাশে বসিয়া থাকিয়া বিকালের অপেক্ষায় প্রহর গুনিতেছে। আকাশে উড়িয়া চলা পাখিগুলো সবটাই তাহার চেনা হইয়া গিয়াছে। ঐযে সাদা রঙের যে পাখিটা উড়িয়া গিয়া নিরুদ্দেশ হইল উহার নাম স্বপ্ন। আর ওইতো কালো রঙের যে পাখিটা উড়িয়া আসিতেছে উহার নাম মিথিলা রাখিয়াছে শূন্য। কিন্তু অনেক দিন ধরিয়া দেখিয়াও মেঘগুলোকে আজও তাহার চেনা হইলনা। মেঘের মতই যদি মিথিলার জীবনটা রূপ বদলাইত তাহা হইলে কতইনা রঙিন হইত তাহার জীবন। ভাবিতে ভাবিতে উদাস দৃষ্টি লইয়া ফুটপাথে জমিয়া ওঠা হকারদের পাণে তাকাইল সে। ভাবিল মধ্যের যে বুড়ো মতন লোকটা শার্ট নিয়া বসিয়াছে তাহার নিকট হইতে ওই বাদামী রঙের শার্টটা কিনিয়া আনিবে। এমন একটা শার্ট অপুর পরিবার খুব শখ। এরই মধ্যে পেছনে অপু আসিয়া দাঁড়াইল। মিথিলাকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করিয়া পেছন হইতে আলিঙ্গন করিয়া কানের নিকট মুখ লইয়া মৃদু কণ্ঠে অপু কহিল আজকে তোমারে বড় বেশি আদর করিতে মন চাহিতেছে। আমারে তোমার আপন করিয়া বুকে জড়াইয়া লও প্রিয়তমা।