প্রাক কথনঃ
বাস্তবতার নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে আমি আজ ভীষণ ক্লান্ত। আর তাইত কল্পনার জগতটাকেই বেছে নিয়েছি বেঁচে থাকার প্রেরনা স্বরূপ। আমার যাপিত জীবনের কষ্টগুলো নিতান্তই আমার। আমার গল্পের মাঝে আমাকে খোঁজা অর্থহীন। প্রতিটি মানুষের কিছু নিজস্ব আদর্শ থাকে। আমার আদর্শ আমার লেখার মতই সাদা মাটা। নিজের জীবনের মত নিজের লেখাও অথর্ব স্বরূপের বিন্যাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। আমি জ্ঞানহীন একজন সাধারন মানুষ তাই অন্যকে জ্ঞান দেয়ার মত দুঃসাহস আমার নেই। তবু কেউ যদি আমার কল্পনার জগতে প্রবেশ করে আমার দৃষ্টি দিয়ে জীবনে ক্ষণিকের সুখ খুঁজে ফিরে তবেই আমার লেখালিখির সার্থকতা।
ফকির লালন সাঁই গেয়েছেন;
নিচে পদ্ম চরক বাণে
যুগল মিলন চাঁদ চকোরা।।
সূর্যের সুসঙ্গে কমল
কিরূপে হয় যুগল মিলন।
জানলি না মন হলি কেবল
কামাবেশে মাতোয়ারা।।
স্ত্রী পুংলিঙ্গ ভবে নপুংসক না সম্ভবে
যে লিঙ্গ ব্রহ্মাণ্ড গড়ে
কি দিব তুলনা তারে।
রসিকজনা জানতে পারে
অরসিকে চমৎকারা।।
সামর্থ্যকে পূর্ণ জেনে
বসে আছো সেই গুমানে।
যে রতিতে জন্মে মতি
সে রতির কি আকৃতি।
যারে বলে সুধার পতি
ত্রিলোকের সেই নিহারা।।
শোণিত শুক্র চম্পাকলি
কোন স্বরূপ কাহারা বলি।
ভৃঙ্গরতির করো নিরূপণ
চম্পাকলির অলি যে জন।
গুরু ভেবে কহে লালন
কিসে যাবে তারে ধরা।।
আমি প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় রাস্তার পাশে একটি ভিক্ষুককে বসে থাকতে দেখি। মুখে কিছু বলতে পারেনা শুধু হাতের ইশারায় ভিক্ষা চাওয়াই তার বৈশিষ্ট। চেহারা দেখলে মনে হবে যেন এই মাত্র স্বর্গ হতে কোন দূত, স্বর্গের পবিত্র পানি দিয়ে গোসল করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে; ভিক্ষাবৃত্তি করার জন্য। আমি তাকে মাঝে মাঝে মন চাইলে টাকা দেই, আবার মন না চাইলে দেই না। প্রতিদিন একই ভিক্ষুককে টাকা দেয়া যুক্তিসঙ্গত কিনা ? তেমন দ্বিধা থেকেই হয়ত এমনটা করা হয়। প্রতিদিনের মত সেদিনও অফিসের পথে তাকে দেখতে পেলাম। একবার তার দিকে তাকিয়েই পাশ কেটে চলে যাচ্ছিলাম; এরই মাঝে মনে হল পেছন হতে কেউ যেন আমাকে ডাকল। আমি পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি সে আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করছে কাছে যাওয়ার জন্য। আমি কাছে গিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিলাম। সেও খুসি মনে টাকা তার কপালে ছোঁয়াল। তারপর তার গায়ের পরনের পাঞ্জাবীর পকেটের ভেতর থেকে একটি কাগজ বের করে আমার হাতে দিল। আমি কাগজটি হাতে নিয়ে জানতে চাইলাম এটা কি ? সে আমাকে তার তর্জনীটি আকাশের দিকে দেখিয়ে ইশারা করল। আমি এই ইশারার কোন ব্যাখ্যা না খোঁজার চেষ্টা করে কাগজটি আমার পকেটে ঢুকিয়ে অফিসের পথে রওনা হলাম।
অফিসে কাজের ব্যস্ততার কারনে কাগজটির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। রাতে বাসায় ফিরে কাগজটির কথা মনে পরল। কাগজটি হাতে নিয়ে অনেকটা সময় ধরে নিরীক্ষণ করার পর কিছুটা অনুমান করলাম যে এটা কোন যানবাহনের টিকেট হতে পারে। পরদিন সকালে সেই ভিক্ষুকটির কাছে জেনে নিলেই হবে এটা কি ? এই ভেবে রাতে ঘুমিয়ে পরলাম। অনেক সময় ঘুমের মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। হাত পা অশার হয়ে যায়। মনে হয় কেউ যেন গলা চেপে ধরেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সামান্য চিৎকার করে ওঠার সামর্থ্যটুকু আর অবশিষ্ট থাকেনা। অনেকে বলে থাকেন এটা নাকি ঘুমের ঘোরে বোবায় ধরে মানুষকে। তবে যেই ধরুক না কেন ঘুমের এমন ব্যাঞ্জনা সত্যি ভীতিকর। সেই রাতে আমাকে ঘুমের ঘোরে বোবায় ধরল। যখন প্রান ফিরে পেয়ে জেগে উঠলাম আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। হাতের মুঠোয় একটি কাগজ দেখতে পেয়ে চমকে উঠলাম। সাথে সাথে বিছানা হতে নেমে ভিক্ষুকের দেয়া সেই কাগজটি খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে পেয়ে দুটি কাগজ নিয়ে মেলাবার চেষ্টা করলাম। অবাক হতে হল দুটিতেই লেখার ধরন, কাগজের কোয়ালিটি আর কাগজে ব্যবহৃত কালির বেশ মিল খুঁজে পেয়ে। তবে স্বপ্নে যে কাগজটি পেলাম সেটাকে আমার কাছে অনেকটা টাকা বলেই মনে হল। কিন্তু কোন দেশের টাকা হতে পারে সেটা বোঝা গেলনা। অবশ্য অল্প কিছু দেশ ছাড়া আমি খুব বেশী দেশের টাকার চেহারা চিনিও না।
পরদিন সকালে আর অফিসে গেলাম না। কিন্তু সেই ভিক্ষুকের জন্য ঠিকই বের হলাম বাসা হতে। কিন্তু হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। ভিক্ষুকটিকে কোথাও খুঁজে পেলাম না। তারপর অনেকদিন হয়ে গেল আমি আর সেই ভিক্ষুকটিকে দেখি নাই। একরাতের ঘটনা, আমি কম্পিউটারে লেখালিখি করছি। তখন প্রায় মাঝ রাত। একটি কাককে দেখলাম আমার বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। ভীষণ ভয় পেলাম। বহুদিন হল দিনের বেলাতেই কাক কেন, কোন প্রকার পাখিই দেখিনা সেখানে রাতের বেলা কাক দেখতে পাওয়া অদ্ভুত একটি বিষয়। সাধারনত রাতের বেলা কাক দেখতে পাওয়ার কথা না। এই পৃথিবীর অনেক রহস্যই আজও রহস্য হয়েই রয়েছে । যেখানে বিজ্ঞানীরাই সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়েছেন সেই সব রহস্য ভেদ করতে সেখানে এই রহস্য আমার মত একজন সাধারন মানুষের পক্ষে ভেদ করা সম্ভব নয়। এভাবে বেশ কিছুদিন আমি ঠিক মাঝ রাতেই কাকটিকে আমার বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমি আমার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেও কাকটি ঠিক পলকহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকত। এই সময়গুলোতে আমার স্বপ্নে কিছু ভয়ানক ব্যাপার ঘটে যায়। আমি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতে থাকি একটি সাদা রঙের বিড়ালকে ছুরি দিয়ে জবাই করছি নিজ হাতে, আমার পুরো ঘর পানিতে ডুবে গেছে, সেই পানিতে আমিও ডুবে গেছি, কেউ আমাকে উদ্ধার করতে আসছেনা। একই রকম স্বপ্ন বারবার দেখতে থাকলাম।
আমি অনেক চেষ্টা করেও আমার সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারগুলোকে কোন সমীকরণে ফেলতে পারলাম না। আমার এক বন্ধু আছে নাম কমল। বাড়ি কিশোরগঞ্জ কিন্তু ঢাকাতেই ব্যবসার কারনে থাকা। ওর সাথে পুরো ব্যাপার বিস্তারিত শেয়ার করলাম। ও আমাকে জানাল ওর এক চাচা কিশোরগঞ্জের বড় পীর। তার সাথে আমাকে দেখা করিয়ে দেবে। যদি সেখানে কোন সমাধান পাওয়া যায় তবেই ভাল। কিন্তু কমলের ব্যাবসায়িক ঝামেলার কারনে আমার সাথে ওর আর যাওয়া হলনা। আমি ওর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে একাই রওনা হলাম সেই পীরের সন্ধানে। সাথে নিয়ে নিলাম কাগজ দুটি। বাসে করে কিশোরগঞ্জ যাচ্ছি। আমার পাশের সিটে একটি মহিলা বসেছেন। মহিলা বললে ভুল বলা হবে। একটি মেয়ে বসেছেন। মেয়েটিও আমার মত একাই কিশোরগঞ্জ যাচ্ছে। মেয়েটি আমার দেখা সবচেয়ে কুৎসিত চেহারার একটি মেয়ে আর গায়ের রং ভীষণ ময়লা। পুরো যাত্রা পথে স্বভাবতই কোন কথা হয়নি মেয়েটির সাথে। আমি শুধু বাসের জানালা দিয়ে দূরের ওই আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম । সূর্যটা আমাকে কিছু বলতে চাইল যেন। যাই হোক অবশেষে অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর আমি আমার পীরের সন্ধান পাই। পীরের সামনে একটি বাচ্চা ছেলে মাথা নত করে বসে আছে। পীর তার মাথায় ফুলের ঝাড়ু দিয়ে বাড়ি দিচ্ছেন। আর পীরের পাশে দাড়িয়ে তারই এক খাদেম পীরের মুখে বিড়ি ধরিয়ে দিচ্ছে। প্রায় নব্বই বছরের কাছাকাছি বয়সের এই পীর দেখলাম বেশ আয়েশ করেই বিড়িতে সুখ টান দিচ্ছেন। আমার সমস্যার কথা এইসব দেখে মুহূর্তেই বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেল। আমি সেখান থেকে চলে আসতে চাইলেও পেছন থেকে পীর সাহেব আমাকে উচ্চ স্বরে নাম ধরে ডেকে উঠলেন। আমি প্রথম ধাক্কায় নিজেকে সামলে নিলাম। আমার নাম তার জানার কথা না কিন্তু ইনি আমার নাম জানেন। অতএব নিশ্চয় ইনার ভেতর কিছু পরিমান হলেও আধ্মাতিক কোন শক্তি আছে। তাই আমি নিজের অনিচ্ছা থাকার পরেও এখানকার নিয়ম অনুযায়ী পীরের পায়ের কাছে বসলাম। আর যাই হোক জঙ্গলে বন্দুক ছাড়া গিয়ে বাঘের সাথে লড়াই করা মানায় না।
পীর আমার কোন কথাই না শুনে আমাকে শুধু বললেন, “যাও পথেই তোমার একজন দেবী মায়ের দর্শন হবে। তার কাছেই তুমি তোমার সকল সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে” আমি সেখান থেকে চলে আসছিলাম। কিন্তু পীর সাহেবের খাদেম আমাকে তার প্রভুর জন্য এক প্যাকেট বিড়ি কিনে দিয়ে যেতে বললেন। তিনি নাকি আবার বিড়ি ছাড়া অন্য কিছুই খান না। আমি অগ্যতা খুসি মনেই পীর সাহেবের জন্য এক প্যাকেট বিড়ি কিনে দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। কোন যানবাহন না পেয়ে আমি হেটে হেটে অনেকদূর চলে এলাম। বুঝলাম হেটে ফেরার কারনে পথ ভুল করে ফেলেছি অর্থাৎ আমি হারিয়ে গিয়েছি। যেখানে এসে থামলাম এটাকে ছোট খাটো একটি জঙ্গল বলা যেতে পারে। জঙ্গলের ভেতর একটি ছোট পদ্ম পুকুর। পুকুরে একটি রক্তের মত লাল রঙের পদ্ম ফুল ফুটে রয়েছে। তার পাশেই একটি অশথ গাছের নিচে বসে আছে সেই মেয়েটি। যাকে দেখেছিলাম বাসে আমার পাশের সিটে বসে থাকতে। আমি মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলল দাও তোমার পকেটের কাগজ দুটি দাও। আমি কথা না বাড়িয়ে পকেট থেকে কাগজ দুটি বের করে মেয়েটির হাতে তুলে দিলাম। একটি কাগজ আমাকে ফেরত দিয়ে মেয়েটি আরেকটি কাগজ তার কাছেই রেখে দিল। দেখলাম যেটিকে আমি টিকেট ভেবেছিলাম ঠিক সেই কাগজটি মেয়েটি রেখে দিল। আর টাকার মত কাগজটি আমাকে ফেরত দিয়ে মেয়েটি বলল এটা রেখে দাও সামনে তোমার কাজে লাগবে। এরপর মেয়েটি তার দুহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল খুব শক্ত করে। আমি মেয়েটির এত কাছে চলে এলাম যে তার গরম নিঃশ্বাস আমাকে প্রায় মাতাল করে তুলল। আমি সেই মাদকতায় হারিয়ে গেলাম। মনে হল এতকাল ধরে যে প্রশান্তি খুঁজে ফিরেছি আজ তার সবটুকু স্বর্গীয় সুখ খুঁজে পেয়েছি। বিদ্যুৎ চমকের মত চারদিক আলোকিত হয়ে উঠল মুহূর্তেই। গাছে বসে থাকা কিছু পাখি উড়ে গেল অসীমের মায়ায় হারিয়ে। পুকুরের পদ্ম ফুলটি সাদা রং ধারন করল। সেই সাথে সাদা হয়ে এলো পুকুরের পানি আর পথের ঘাসগুলো।
অল্প কিছুক্ষন পর নিজেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পরিবেশে আবিষ্কার করলাম। কিন্তু পাশে আর মেয়েটিকে দেখতে পেলাম না। আমি যেখানে দাড়িয়ে সেটা যে পৃথিবী নয় এতটুকু নিশ্চিত হওয়া গেল। কারন পৃথিবী হলে মাটি নীল রঙের হতনা, সীমাহীন আকাশ দেখা যেত। কিন্তু এখানে কোন আকাশ দেখতে পেলামনা। বাতাস ভীষণ শীতল। কিন্তু শীত করছেনা সেই বাতাসে বরং স্নিগ্ধ প্রশান্তি পেলাম। আমি কিছুদুর এগিয়ে যেতেই আমাকে কিছু অদ্ভুত আকৃতির প্রাণী এসে ঘিরে ধরল। পৃথিবীর রোবটগুলো দেখতে অনেকটা এই রকমের হয়ে থাকে। আমি সেইসব রোবট জাতীয় প্রাণীদের কাছে বন্দী হয়ে একটি গুহার ভেতর আশ্রয় পেলাম। এখানের সব কটি গুহাই মেঘ দিয়ে গড়া হয়েছে। যেন নীল আকাশের বুকে ভেসে যাওয়া মেঘগুলোই এই অঞ্চলের মাটিতে গড়ে তোলা এক একটি গুহা। আমি গুহার ভেতর পায়চারি করছি এমন সময় কিছু রোবট এসে আমাকে গোসল খানার দিকে নিয়ে গেল। প্রতিটি রোবটের মাথায় দুটি করে ছোট ছোট বেণী গাঁথা রয়েছে। হাত – পা অবিকল মানুষের মতই। কিন্তু চেহারা মানুষের মত নয়। দেহের নীল রঙের ধমনী গুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হয়ত দেহের বর্ণ অত্যাধিক পরিমান সাদা হওয়ার কারনেই এমনটা হয়েছে। পৃথিবীতে যেসব রোবট দেখেছি সেগুলো ইস্পাত দিয়ে তৈরি করা কিন্তু এখানকার রোবট গুলো মানুষের মতই তৈরি করা। ওদের কাছে জানতে চাইলাম এই অঞ্চলের নাম কি ? এখানকার রাজা কে ? ওরা আমাকে জানাল ওদের এই দেশটিকেই স্বর্গ বলা হয়। আর এই দেশে কোন রাজা নেই। যিনি আছেন তারা তাকে দেবী বলে থাকেন নাম লুসিফার। আমাকে গোসল করিয়ে তারা তাদের দেবী লুসিফারের কাছেই নিয়ে যাচ্ছে।
একটি বড় চৌবাচ্চায় শীতল দুধ দিয়ে পূর্ণ করে রাখা হয়েছে। তার উপর ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে হাসনাহেনা ফুল। একটি রোবট আমার শরীর থেকে কাপড় খুলে আমাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলল। আমি লজ্জা পেয়েছি দেখে ওদের ভেতর কোন ভাবাবেগ দেখলাম না। রোবটদের ভাবাবেগ থাকেনা। ওদের খুধা লাগেনা, তৃষ্ণায় পানির প্রয়োজন হয়না। আর তাই প্রাকৃতিক কাজেরও প্রয়োজন হয়না। আমি খুব আয়েশ করে জীবনে প্রথমবার সেই চৌবাচ্চায় গোসল করে নিলাম। গোসল শেষে আমাকে ওদের দেশের পোশাক পরতে দেয়া হল। রেশমি কাপড় দিয়ে তৈরি করা একটি আলখেল্লা জাতীয় পোশাক। পরতে বেশ আরামদায়ক। তবে এখানকার রোবটদের পরনে কিন্তু এমন পোশাক নেই। খুব সম্ভবত মেহমানদের জন্যই রেশমি আলখেল্লার ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। ওদের সবার পরনে নীল রঙের আলখেল্লা। কেউ কেউ আবার গোলাপি রঙের আলখেল্লা পরে রয়েছে। তবে যতটুকু বুঝলাম এখানকার রোবটদের মাঝেও শ্রেণী ভেদ রয়েছে। যারা গোলাপি রঙের আলখেল্লা পরে রয়েছে এরা উচ্চ শ্রেণীর রোবট আর যারা নীল রঙের আলখেল্লা পরে রয়েছে এরা নিম্ন শ্রেণীর রোবট। এই নিম্ন শ্রেণীর রোবটদের কাজই হচ্ছে শুধু দেবী লুসিফারের আগ্যা পালন করা। এখন এরা আমাকে গোসল করিয়ে দেবীর দর্শনে নিয়ে যাবার আগ্যা পালন করছে মাত্র। আমি ওদের পেছনে বেরিয়ে এলাম। বাগানের মাঝে দিয়ে দেবীর গুহার রাস্তা চলে গেছে। আমরা সেই পথেই এগুচ্ছি। বাগানে নানা রঙের ফুল ফুটে রয়েছে গাছে গাছে। কোনটার নামই মনে করতে পারলাম না। তবে এত গাছ থাকার পরেও এখানে কোন পাখি দেখলাম না। দেখলাম না কোন পোকামাকড়। মাঠের ঘাসগুলো যেন চির সবুজ। শিশির বিন্দু জমে রয়েছে ঘাসের উপর। অথচ শীতকাল নয়। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে এখন বসন্ত ঋতু চলছে। একজন রোবট আমাকে জানাল এখানে বারো মাসই বসন্ত ঋতু কিন্তু ঘাসে শিশির জমে, বাতাসে থাকে শীতলতা। দেবী লুসিফারের গুহার কাছে পৌঁছে দেখি এই গুহাটিরও একই গড়ন, মেঘের তৈরি গুহা এছাড়া আর কোন আসবাব নেই গুহায়। এমন ঘর যদি পৃথিবীতে থাকত তবে পরম শান্তিতে ঘুমান যেত। এমন আবহাওয়া আর এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ আর এমন রোবট যদি পৃথিবীতে থাকত তবে পৃথিবীও হত শান্তি পূর্ণ বসবাসের একটি স্থান। এমন জায়গাতে ভ্রমন করতে আসার পরে যদি আবার পৃথিবীর সেই জঞ্জালে ফিরে যেতে হয় তবে আমার মত হতভাগা আর কেউ নেই। ভাবলাম আর হৃদয়ের ভেতর চাপা কষ্ট অনুভব করলাম। আমি শুনতে পেলাম দেবীর মায়া জড়ান কণ্ঠের করুন মিনতি।
এসো, আমার ডানায় ভর করে
আজ তোমাকে নিয়ে যাব প্রিয়,
সুখের সঙ্গোপনে; যেখানে আলেয়ার তীর্থ।
দশটি হাতের মুঠিতে রেখাগুলো অস্পষ্ট,
তারার মালা নিয়ে প্রতীক্ষায় তোমার;
গলায় পরাব বলে প্রিয়তমা,
আজ আমি সেজেছি অনন্তকালের পর।
এসো, আমার অধরের মায়ায় লুকিয়ে
আজ তোমাকে হাসতে শেখাব প্রিয়,
সুখের সঞ্চালনে; যেখানে মৃত্যুও ব্যর্থ।
ওসাইরিস স্বাগতম আমার এই স্বর্গ ভূমিতে। আমি চমকে উঠলাম আমাকে এমন অদ্ভুত এক নামে সম্বোধন করাতে। আমার সাথের রোবট গুলো আমাকে গুহার দরজায় পৌঁছে দিয়েই চলে গেছে। ওদের দেবীর গুহায় প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু যেহেতু আমি এখানকার দেবীর মেহমান হিসেবে আশ্রিত তাই গুহার ভেতর প্রবেশ করলাম। সাধারনত একজন দেবীকে যেভাবে সন্মান জানান উচিত আমি ঠিক সেভাবেই মাথা নত করে সন্মান প্রদর্শন করলাম। দেবী আমাকে পুনরায় ওসাইরিস নামেই সন্মোধন করল। দেখুন দেবী লুসিফার আমিত ওসাইরিস নই যে আপনি আমাকে এই নামে ডাকছেন । আমার কথা শোনার পর দেবীর কণ্ঠে এক লাস্যময়ী হাসির শব্দ ভেসে এলো। সেই শব্দ গুহার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হল কয়েকবার। ওসাইরিস এই স্বর্গে আমাকে সবাই লুসিফার নামেই চেনে কিন্তু জান আমি যে লুসিফার নই। আমি অবাক হলাম দেবীর এমন কথা শুনে। এসো প্রিয়তম আমি তোমাকে আজ তোমার সত্যের মুখোমুখি করব। তুমি নিজেকে ভুলে যেতে পার কিন্তু যে আমি তোমার জন্য অনন্ত কাল ধরে প্রতীক্ষায় রয়েছি কি করে তোমাকে ভুলে যাই বল। আজ সেই সময় এসেছে নিজেকে তোমার বাহুতে সমর্পণ করার।
আমাকে দেবী পাশের আরেকটি কক্ষের ভেতর নিয়ে গেল। এতক্ষন একটি কাপড় দিয়ে পুরো মুখ ঢাকা ছিল বলে আমি খেয়াল করিনি। মুখ থেকে কাপড়টি সরাতেই চূড়ান্ত ভাবে বিস্মিত হলাম। এত সেই মেয়ে যার বাহুর বন্ধনে আমি এই স্বর্গে এসে পৌঁছেছি। অবাক হচ্ছ প্রিয়তম ? এত অল্পতেই নয় তোমাকে এবার যা দেখাব তাতে তোমার আর অবাক হবার কিছুই থাকবেনা। তার আগে স্বর্গের সুধা পান করে নাও। দেবী আমার হাতে একটি কাঁচের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল এটা পান কর। পানিয় ঠিক বলা যাবেনা। মনে হল রক্ত। সেই অমৃত সুধা পান করার পরেও কাঁচের গ্লাসটি লাল হয়ে ছিল। তুমি জান ওসাইরিস তুমি এখন যা পান করলে সেই পানিয় আর কিছুই নয় আমার শরীর থেকে বের করে নেয়া কিছু রক্ত বিন্দু মাত্র। এবার তুমি আমার সাথে অমরত্ব পেলে। এবার আর তোমাকে কেউ আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবেনা কিংবা তুমি চাইলেই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবেনা আর। সামনে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা একটি কফিন উন্মুক্ত করল লুসিফার। কফিনটি পুরো কাঁচের তৈরি। কফিনের ভেতর একটি লাশ। দেবী বলল চিনতে পেরেছ তোমাকে, ওসাইরিস। কফিনের ভেতর অবিকল আমারই মতন একজন ঘুমিয়ে আছে চিরনিদ্রায়। এবার কিছুটা বিশ্বাস ফিরে এল আমার ভেতর। আমি জানতে চাইলাম বিস্তারিত।
ওসাইরিস আমি লুসিফার নই। আমি তোমার স্ত্রী আইসিস। তুমি ছিলে আমার ভাই। কিন্তু আমাদের পিতা-মাতা নুট ও গেবের ইচ্ছায় আমাদের দুজনের মাঝে বিয়ে হয়। আমাকে সেত ভীষণ ভালোবাসত। সেত আমাদের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। তাই সে তোমাকে খুন করল। তারপর তোমাকে পেতে আমি লুসিফারের কাছে মিনতি জানাই। লুসিফার আমাকে তোমার জীবনের বিনিময়ে পেতে চাইল। আমি আমার ভালোবাসার কাছে হেরে গেলাম। তোমার প্রানের বিনিময়ে আমি লুসিফারের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম। লুসিফার আমাকে তার যাদু বিদ্যা ধার দিল তোমাকে জীবিত করে তোলার জন্য। আমি নিজের সেই যাদু ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে তোমার মৃতদেহের সমস্ত বিচ্ছিন অংশগুলো জড়ো করে তোমার মরদেহে পুনরায় প্রাণের সঞ্চালন করি। এরপর তুমি জীবিত হবার পর; তোমার কাছে ফিরে আসার আমার সেই মুখ আর ছিলনা। লুসিফার তখন আমাকে প্রতিনিয়ত ছিঁড়ে ছিঁড়ে ভোগ করছিল। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় যে ভুল আমি করেছিলাম, যার কারনে আজ এতটা কাল আমাকে তোমার প্রতীক্ষায় একাকী কাটিয়ে দিতে হল।
একরাতের কথা লুসিফার প্রতিরাতের মতই আমাকে নিয়ে খেলছিল তার জঘন্য খেলা। আমি আর সহ্য করতে না পেরে লুসিফারের গলায় ছুরি দিয়ে আঘাত করি। লুসিফারের রক্তে আমার পুরো মুখ ভিজে যায়। সেই থেকে আজও আমার মুখ এখনো এমন কুৎসিত হয়েই আছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন আমার রূপের মোহে সমগ্র পৃথিবীর আকাশ লজ্জায় লাল হয়ে যেত। সেই আমি লুসিফারের অভিসপ্ত রক্তে ধৌত হয়ে আজ সবচেয়ে কুৎসিত রূপ ধারন করেছি। লুসিফার জীবিত থাকা অবস্থায় আমি তার কাছ থেকে সকল প্রকার যাদু বিদ্যা শিখে নিয়েছিলাম। সেই যাদু দিয়ে আমি আমার এই স্বর্গভূমি গড়ে তুলি শুধু তোমার জন্য ওসাইরিস। আর নিজেকে আড়াল করে রাখার জন্য নিজেকেই লুসিফার বলে পরিচয় দেই। এই কফিনে যাকে দেখতে পাচ্ছ সে তুমি নও। এই সেই লুসিফার যাকে আমি যাদু করে তোমার রূপ দিয়ে রেখেছি। আর তুমি জীবিত হয়ে আছো লুসিফারের শরীর নিয়ে। আমার বিশ্বাস ছিল একদিন তুমি ফিরে আসবে আমার কাছে আর আমরা এই স্বর্গে আমাদের নতুন সুখের সংসার সাজাব। দেখ তুমি ফিরে এসেছ। আমি জানতে চাইলাম তাহলে আমার শরীরে যে আত্মার বসবাস সেটা কার; আমার নাকি লুসিফারের ? দেখ ওসাইরিস আমি শুধু শরীর বিদ্যার যাদুই শিখেছি। আত্মার অধিকারিণী আমি নই। হতে পারে তোমার ভেতর তোমার নিজের আত্মাই রয়েছে। অথবা লুসিফারের আত্মাও হতে পারে। এই একটি জায়গায় আইসিস হেরে গেছে। তোমার আইসিস আত্মার কাছে অপারগ আমার প্রানপ্রিয়। আমাকে তুমি ক্ষমা কর।
যদি বলি আমি তোমার ওসাইরিস নই। আমিই লুসিফার। আমার শরীরের ভেতর যে আত্মার বসবাস সেটা লুসিফারের তবে তুমি সত্যি হেরে গেছ আইসিস। আইসিসের চোখে অশ্রু চলে এলো। আইসিস আমার পায়ের কাছে কান্নায় লুটিয়ে পরল। আমি বললাম আইসিস তুমি ভুল করেছ। আমার প্রতীক্ষায় এভাবে অনন্তকাল প্রতীক্ষায় থেকে। তুমি ভুল করলে তোমার শরীরের রক্ত আমাকে পান করতে দিয়ে। এখন আমি অমর হয়ে গেলাম আইসিস। আমি তোমার ওসাইরিস নই। আমি লুসিফার। আমি নিজেও বুঝিনাই আমি সেই লুসিফার। আমিই সেই সেত যে তোমকে পাবার জন্য খুন করেছিল তোমার স্বামী ওসাইরিসকে। হ্যাঁ চেয়ে দেখ আইসিস আমি সেই সেত। আমিই লুসিফার। আমার কারনেই পৃথিবীতে আজ এত রক্তপাত। এত মানুষের টাকার পেছনে ছোটা। এই আমার কারনেই পৃথিবীর মেয়েগুলো প্রতিনিয়ত তাদের শরীর দিয়ে আমাকে তুষ্ট করছে। যেভাবে তোমাকে আমি ভোগ করেছিলাম তোমার স্বামীকে হত্যা করে ঠিক সেভাবেই আমি পৃথিবীতে আজও ভোগ করে চলেছি অগনিত মেয়েদেরকে। ধন্যবাদ তোমাকে আইসিস। আজ তোমার কারনেই পুনরায় আমি আমার স্বর্গ ফিরে পেলাম। এবার তবে শেষবারের মত আমার প্রনয়লীলায় মাতিয়ে তোমাকে স্বর্গের সুখ নিদ্রায় ঘুম পারাব।
আমাকে তুমি মারতে পারবেনা লুসিফার। তুমি কি ভুলে গেলে আমার রক্ত পান করে তুমি অমর হলে । আমিওত অমর লুসিফার, আমাকে তুমি মৃত্যু যন্ত্রণা আর ভোগ করাতে পারবেনা। আমি ক্ষণিকের জন্য আইসিসের প্রেম মোহিত হয়ে পরলাম। আইসিস আমাকে তার প্রনয়ের জালে বেধে ফেলল। শুরু হল দুটি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি ভালোবাসার দ্বৈরথ। স্বর্গের ভূমিতে বৃষ্টি নেমে এলো। বৃষ্টির সুরে ছন্দিত হল দুটি শরীর। আমার মাথার ভেতর প্রনয়ের ঠিক অন্তিম মুহূর্তে শূন্যতা অনুভূত হল। আমি টের পেলাম আমার আলখেল্লার ভেতর গুঁজে রাখা সেই কাগজটি; যেটা ছিল টাকার মত খুব সুকৌশলে সেটা আইসিস তার কাছে নিয়ে নিল। মানুষ তার প্রনয়ের ঠিক অন্তিম মুহূর্তে মস্তিষ্কে যে শূন্যতা অনুভব করে, সেই বিদ্যাই কাজে লাগিয়ে আইসিস আমাকে হারিয়ে দিল। আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটি যুদ্ধের ময়দানে। যেখানে দুটি পক্ষের মাঝে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হচ্ছে। রক্তাক্ত বিভীষিকাময় সেই যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজেকে অসহায় মনে হতে লাগল প্রচণ্ড ভাবে। আমি ভাবলাম এর চেয়ে ঢের ভাল হত যদি আইসিসের স্বর্গে আইসিসের সাথেই নতুন করে সংসার গড়া হত। কিন্তু আমাকে ফিরতে হল আমার পৃথিবীর এই সংসারে যেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে কেউ। যার ভালোবাসার কাছে আমি দ্বায়বদ্ধ।