“ওয়ালাকুমুসসালাম” - উত্তাল মার্চ – প্রথম পর্ব
“ভিনদেশী মুক্তিবাহিনী” আমরা তোমাদের ভুলব না – উত্তাল মার্চ – দ্বিতীয় পর্ব
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ কোটি বাঙ্গালীর পাশা পাশি অবদান রেখেছিলেন অনেক বিদেশী বন্ধুরা।
লিয়ার লেভিন, একজন মার্কিন চিত্রগ্রাহক ও চলচিত্র নির্মাতা। কিন্তু মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তিনি এক ইতিহাস ।মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের জীবনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েও তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের বিরল সব চিত্র। তার ঋণ কেনো দিনই শোধ করতে পারবে না বাংলাদেশ। আবেগাপ্লুত অথচ গর্বের সঙ্গে তিনি বলেন, আমি গর্ববোধ করছি যে আমি একটি জাতির জন্মক্ষণের সাক্ষী হতে পেরেছি।’মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালির কথা, সংগ্রামের কথা স্মরণ করে তিনি আরো বলেন, বাঙালিদের এই লড়াই আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।’৭১-এর সেই সময়কে চাক্ষুষ দেখতে পাচ্ছি। আমার মনে পড়ছে এই শিল্পীরা সেসময় কিরকম অসম সাহসের সঙ্গে রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ছুটে বেড়িয়েছে। আজও ঘুমের মধ্যে সেই সব বীর যোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা আমার ভাষা না জেনেই কিভাবে সাহায্য করেছে এবং একই সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। তাদের এ ভালোবাসাই আমাকে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে কাজ করতে সাহায্য করেছিল। লেভিন বলেন, মুক্তির গানের সেলুলয়েডের ফিতাগুলো প্রায় ৩০ বছর আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল।
ডা. রোনাল্ড জোসেফ গাস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ছুরি-কাচি ওষধপত্র ও সার্জারির বিভিন্ন জিনিস পত্র নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়ান এক মানব প্রেমী, অকুতোভয় মার্কিন চিকিৎসক ডা. রোনাল্ড জোসেফ গাষ্ট। 'সৃষ্টিকর্তা আমাকে পাঠিয়েছেন আমার নিজ সমপ্রদায় এবং পৃথিবীর অন্যান্য সমপ্রদায়ের সাহায্য করার জন্য। এটাই আমার জীবনের একমাত্র মিশন।' এই অসাধারণ উক্তিটির যথার্থতা তিনি তার সারাজীবন ধরে পালন করে গেছেন। বাংলাদেশ প্রেমী এই মানুষটি মুক্তিযুদ্ধ কালীন সময়ে ও তার পরবর্তীতে তার চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের জীবন পাল্টে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালে ডা. গাষ্ট ভারতের লুধিয়ানা ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজ হসপিটালে কাজ করছিলেন। তিনি সে সময় অনেক যুদ্ধ ক্যাম্পে গিয়েছেন এবং অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা দিয়েছেন। বাংলাদেশে এসে ডা. গাষ্ট ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুর্নবাসনে সোহরওয়ার্দী হসপিটালের উল্টোদিকে পুর্নবাসন ক্যাম্প খোলেন তিনি। সোহরাওয়ার্দী হসপিটালের করিডোরে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া শুরু করেন ডা. গাষ্ট।
এডওয়ার্ড মুর কেনেডি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে অবদান রাখা আরেকজন বিদেশীর কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন আমেরিকান সিনেটর এডওয়ার্ড মুর কেনেডি। অনেক কারণেই বিখ্যাত তিনি। টেড কেনেডি নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন- এই আমেরিকান সিনেটর। টেড কেনেডি বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও ইতিহাসের সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেছেন ইতিবাচক ভূমিকা রেখে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয় তার দেশ আমেরিকা। টেড কেনেডি এই বিরুদ্ধ প্রচারণার মধ্যেই ১৯৭১ সালে কলকাতায় শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে আসেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের পাশে জোরালো অবস্থান নেন। একথা এখন বলা হচ্ছে যে আমেরিকার সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের পলিসি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন টেড কেনেডি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় এসে তিনি বলেছিলেন, 'আমেরিকান সরকার যদি আপনাদের স্বীকৃতি নাও দেয়, সারা পৃথিবীর মানুষ আপনাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন।'
যুদ্ধ চলাকালে অসংখ্য মানুষ বাস্তুভিটা হারিয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সীমান্ত পেরিয়ে শরণার্থী হিসেবে ভারতে অবস্থান নেয়। লাখ লাখ মানুষ সে সময় শরাণার্থী হিসেবে সীমান্ত সংলগ্ন ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম, কোচবিহার, পশ্চিম বাংলা, কলকাতা, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিংয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। এ সমস্ত ক্যাম্পে এসে সাহায্য নিয়ে এবং বাস্তব অবস্থা দেখার জন্য টেড কেনেডি পরিদর্শন করতে আসেন। এ সমস্ত ক্যাম্পের যে মারাত্মক দূর্দশা, হতাশা, নারী শিশু বয়স্কদের পুষ্টিহীনতার যে বিশাল চিত্র তিনি দেখেন তা তার মন কে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। এ সমস্ত দূর্দশা চাক্ষুস দেখে তিনি ১৪ আগস্ট লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে এই শরণার্থী সমস্যাকে উল্লেখ করেছিলেন স্মারণকালের সবচেয়ে বড় ভয়াবহ হিউম্যান ট্র্যাজেডি হিসেবে। এছাড়াও তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথেও বাংলাদেশকে সাহায্য করার প্রসঙ্গ নিয়ে বেশ কয়েক বার বৈঠক করেন টেড কেনেডি। শেখ মুজিবকে যুদ্ধের সময় গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পর যখন গোপনে সামরিয় আদালতে তার বিচার কাজ চলছিল সে সময় টেড কেনেডি প্রকাশ্য বলেন, 'আমি মনে করি শেখ মুজিবের একটাই অপরাধ, আর তা হলো নির্বাচনে জেতা।' পরবর্তীতে তার এই মন্তব্য শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু গণতন্ত্রকামী এই মহান মানুষের মৃত্য হয় ২৫ আগস্ট ২০০৯। বাংলাদেশের মানুষ তার অবদানের কথা কখনও ভুলবে না।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতার সংগ্রামের সময় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সৌদি সরাসরি বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলো। পাক বাহিনীর নির্বিচারে হত্যা, খুন, নারী নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালানো-পুড়ানোর মতো কার্যক্রমকে তারা সমর্থন জানিয়েছিলো।আর সেই সময় পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো ভারত, বৃটেন, অষ্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, জাপানসহ অন্যান্য রাষ্ট্র।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার সরাসরি বিরোধীতা করলেও এই দু’দেশের অনেক সচেতন নাগরিক তীব্র বিরোধীতা করে জেল খেটেছেন, কলম ধরেছেন, ক্যামেরা ধরেছেন, প্রতিবাদ করেছেন- তাঁদের এই অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন কৃজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। নেদারল্যান্ডে জন্মগ্রহন অষ্ট্রেলিয়ান এ ডব্লিও ওডারল্যান্ড সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে বীর প্রতীক খেতাব অর্জন করেছেন । ওডারল্যান্ড তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানস্থ ঢাকার বাটা অফিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। আর বাটার হেড অফিস কানাডায়। তিনি যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেন তা জানালেন বাটা স্যুর প্রতিষ্ঠাতা-মালিক-চেয়ারম্যান টম জে বাটা।
ওভারল্যান্ড পাকিদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ-বীভৎস ছবি পাঠান টমের কাছে। টম তা টরন্টোর পত্র-পত্রিকায় সরবারাহ করেন এবং মুক্তিবাহিনীর জন্য ঢাকা অফিস থেকে জুতো সরবরাহ করারও অনুমতি দেন। এভাবেই কানাডার বহুজাতিক কোম্পানী বাটা সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে বিরল ভূমিকা রাখেন।
১৯৭১-এ বিভিন্ন মিডিয়া, টরন্টো ভার্সিটি, এনজিও বিভিন্ন চার্চসহ মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কানাডা সরাসরি সমর্থন দেয়নি। তবে মৌন সমর্থনের দৃষ্টান্তের শেষ নেই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রি পিয়েরে ট্রুডো পার্লামেন্টে পাকিদের বর্বরতার নিন্দা প্রস্তাব এনেছিলেন এবং ত্রাণ পাঠিয়েছিলেন শরণার্থী শিবিরে। যুদ্ধের পরেও কানাডা আশ্রয় দিয়েছে ১৮জন যুদ্ধ শিশুকে। তারা এখন কানাডায় বসবাস করছে। যেমন- বায়ান বি গুড, ল্যারা জারিনা, বাতুন প্রমুখ। জানা গেছে, এদের একজন এখন ক্যানাডীয়ান ইমিগ্রেশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এদের মধ্যে বায়ন গুড ওরফে বাদল তো মা’র খোঁজে মাতৃভূমিতে গিয়েছিলেন। খুঁজলে দেখা যাবে, এভাবে মুক্তিযুদ্ধের অবদানে কানাডা এবং ক্যানাডিয়ানদের ভূমিকা অনেক।
আবার অপরদিকে কেউ কেউ কাউকে ভূয়া ‘বীর প্রতীক’ বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। কেউ কেউ বীরদর্পে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সেজে কৃতিত্ব নিচ্ছে। কেউ বা কল্পকাহিনীকে সত্য বলে চালিয়ে লেখালেখি করছেন। এদেশের শেকড় অনেক শক্ত।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:১৬