“ওয়ালাকুমুসসালাম” - উত্তাল মার্চ – প্রথম পর্ব
১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত ছাড়াও সে সময়কার অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নও এগিয়ে আসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। ভারতের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে সব প্রকার নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করে। এ সময় তারা বঙ্গোপসাগরে নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রেরণ করে।
পাকিস্তানের মিত্র রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের প্রশ্নে শুরম্নতে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। কিন্তু মার্কিন পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞের চিত্র ফুটে ওঠে। বাংলাদেশের জন্য তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে ভারতের বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত রবি শঙ্করের উদ্যোগে আমেরিকার মেডিসন স্কয়ারে আয়োজন করা হয় 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' নামে এক বিশাল ব্যান্ড সঙ্গীতের অনুষ্ঠান, যেখানে বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড তারকা জর্জ হ্যারিসন সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এক পর্যায়ে মার্কিন যুদ্ধরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণও সভা, র্যা লি এবং শ্লোগানের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে মার্কিন সরকারকে বাধ্য করে।
যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজন করেছিলেন অসাধারণ সেই আসরের। অনেকেরই হয়তো জানা নেই ঠিক মাস দেড়েক পর ১৮ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের কেনিংটন ওভালে হয়েছিলো এমনই আরেকটি রক কনসার্ট। আর সেটার উদ্দেশ্যও ছিলো বাংলাদেশের জন্য তহবিল সংগ্রহ।
‘গুডবাই সামার’ নাম দিয়ে এই কনসার্টের টিকেট ধরা হয়েছিলো দেড় পাউন্ড। বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট লেখা ছিলো বাংলাদেশের শরণার্থীদের কথা। এসবের মধ্যে আলাদা করে বলতেই হয় রড স্টুয়ার্টের কথা। চিতা বাঘের সঙ্গে মিলিয়ে হলুদ ফোঁটা কাটা জ্যাকেট আর প্যান্ট পড়ে গান গেয়েছেন তিনি। এক পর্যায়ে জ্যাকেটটি খুলে দেন নিলামে বিক্রি করতে। আর সে বাবদ ৫০০ পাউন্ড যোগ হয় তহবিলে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের অবদানও অনস্বীকার্য। এদের মধ্যে ভুটানের নাম আমাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের সারিতে ভারতের পরই যোগ দেয় ভুটান, যা বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করেছে।
বাংলাদেশে যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ চলছিল, তখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দও নিরব ছিলেন না। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি বন্ধুরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রশ্নে একযোগে কাজ করেছে। যুদ্ধ শুরু হলে তা নিয়ে জাতিসংঘে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয় এবং প্রস্তাব উঠে যুদ্ধবিরতির। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে একাধিকবার ভোটো প্রদান করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। কারণ যুদ্ধে সে সময় পাকিস্তানের পরাজয় ছিল সময়ের ব্যাপার। ব্রিটেন এবং ফ্রান্সও ভোট দানে বিরত থাকে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জানবাজী রেখে চীন শাসিত তিব্বতের একদল সাহসী তিব্বতি মানুষও লড়েছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার পর প্রথম যে বিদেশী বাহিনীটি এতে বাংলাদেশের পক্ষে অংশ নিতে কাজ শুরু করে সেটি হচ্ছে এসএফএফ। আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে নয়, ভারতের সহযোগিতায় তাদের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে তিব্বতি গেরিলারা।
১৯৫৯ সালে বিপর্যয়ের মুখে চীনা শাসনের বিরুদ্ধে তিব্বতিদের নিজেদের লড়াই এর স্বাধীনতাকামীদের নেতা ও ধর্মগুরু দালাইলামা’কে দলবলসহ ভারতে চলে আসতে সাহায্য করে এ গেরিলারা। গেরিলারা নিজেরাও অনেকে আশ্রয় নেন ভারতে।
১৯৬২ সালে তাদের নিয়ে গঠিত হয় একটি রেজিমেন্ট- স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স বা এসএফএফ। উত্তর প্রদেশের দেরাদুন-এর কাছে অবস্থিত ছিল এর সদর দফতর।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসএফএফ। কিন্তু তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ইতিহাস আজ পর্যন্ত আড়ালে পড়ে আছে। বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের স্বাধীন দেশ পেয়েছে। কিন্তু ওই তিব্বতিরা আজও ভারতে ‘আশ্রিত’। যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ভারতেও কোনো স্বীকৃতি মিলেনি এ দেশহীন মানুষদের।
আর সব যুদ্ধে যেমন হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তিব্বতিদের শত্রু-মিত্রের হিসাব-নিকাশ পাল্টে গিয়েছিল সব। কথা ছিল চীনা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসএফএফ’কে সাহায্য করবে ভারতীয় সরকার। কিন্তু কূটনৈতিক আলোচনার মধ্যে চীন-ভারত যুদ্ধ খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ায় মাতৃভূমির দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়া হয়নি তিব্বতিদের।
পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের ‘র’ বা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইয়েংর পরামর্শ অনুযায়ী তিব্বতিদের এক বিশেষ অভিযানে নামানোর উদ্যোগ নেয় দেশটির সরকার। ভারতের প্রস্তাবের পর ব্রিগেডিয়ার রাতুক নগোয়ানের ভাষায়, তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের দিল্লিস্থ সদর-দফতর থেকে গেরিলাদের বলা হয় ‘এ যুদ্ধে যাবার কোনো বিকল্প নেই’।
ব্রিগেডিয়ার রাতুক এনগোয়ান এক সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন, ‘‘যদিও গেরিলা যুদ্ধে চীনের বিরুদ্ধে লড়ার কথা ছিল আমাদের, কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় আমাদের প্রথম প্রধান শত্রু হলো মিজোরা। তিব্বতিদের যেমন ভারত প্রশিক্ষণ দিয়েছে, মিজো যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে পাকিস্তান।’’
প্রসঙ্গত, ভারত শাসিত সাতবোন অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী গেরিলাদের তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান ভূখণ্ডে বিশেষত পার্বত্য এলাকায় আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ সহযোগিতা দিত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি। মিজো যোদ্ধারা তখন স্বাধীন মিজোরাম দেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত।
ব্রিগেডিয়ার রাতুকের বিবরণ থেকে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রাম সীমান্তবর্তী মিজোরামের দেমাগিরি ঘাঁটিতে মোতায়েন হবার পর পাকিস্তানের বাহিনীর বিরুদ্ধে নয়- তিব্বতি কমান্ডোরা প্রথম ও প্রধান লড়াইটা করেছে মিজো গেরিলাদের বিরুদ্ধেই।
চীনের শাসনের বিরুদ্ধে মাতৃভূমি তিব্বতের অধিকার আদায়ের লড়াই করার জন্যই ভারতের সহযোগিতা নিয়েছিলেন রাতুক আর সহকর্মীরা। কিন্তু ভারতের হয়ে তাদের এমন এক শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথমেই লড়তে হলো, যে মিজো যোদ্ধারাও লড়ছিল মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তিব্বতি গেরিলাদের বিজয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করে।
একাত্তরের নভেম্বর মাসে মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে ঢুকে তিব্বতি বাহিনী পাকিস্তানি ঘাঁটিগুলো জয় করতে শুরু করে। পার্বত্যাঞ্চলে প্রচুর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। প্রধানত বিভিন্ন সেতু ধ্বংস করার কাজ করে তিব্বতি বাহিনী। কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র এবং কাপ্তাই বাঁধে আক্রমণ করে।
যুদ্ধের শেষের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯৭ নম্বর ব্রিগেড ও দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন পার্বত্য পথ ধরে বার্মায় পিছু হটতে চাইলে তিব্বতি বাহিনী সাফল্যের সঙ্গে তাদের প্রতিরোধ করে।
যুদ্ধে এসএফএফ’র মোট ৫৬ জন সদস্য শহীদ হয়। বিগ্রেডিয়ার রাতুকের সম্প্রতি প্রকাশিত স্মৃতিকথা ছাড়াও এ যোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের আংশিক বিবরণী পাওয়া যায় বাহিনীটির আনুষ্ঠানিক কমান্ডার জেনারেল এসএস উবান-এর ‘দি ফ্যান্টমস অফ চিটাগং: ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ’ নামের বইতেও।
যুদ্ধ শেষে ৫৮৪ জন্য যোদ্ধাকে নগদ অর্থ উপহার দেয় ভারত সরকার। কোনো সম্মাননা মেলেনি। আইনগতভাবে প্রকাশ্যে ভারতে আশ্রিত তিব্বতিদের কোনো ‘রাজনৈতিক’ বা ‘সামরিক’ কর্মকাণ্ডে জড়ানো নিষেধ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক ‘ঝামেলা’ এড়াতে ভারত সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিব্বতি এ বাহিনীর পরিচয় দিতো ‘মুক্তি বাহিনী’ হিসেবেই। ‘মুক্তি বাহিনী’র ছদ্মাবরণেই আজো ঢেকে আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যেসব বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ও স্বাধীনতাকামী ব্যাক্তিবর্গ আমাদের সহযোগিতা দিয়েছিলেন, তাঁদের আমাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করা উচিত। তাহলেই আমরা একটি উদার মন মানসিকতাসম্পন্ন জাতি হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারব। এ জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানা প্রয়োজন।