এটা সুউচ্চ হিমালয়ের শীতল মেরু অঞ্চল৷ বৃষ্টি হয় না বললেই চলে৷ দু’পাশের অবিন্যস্ত সারি সারি শৃঙ্গের ধার বেয়ে নেমে এসেছে শুধু পাথর আর পাথর৷ চূর্ণ-বিচূর্ণ শিলাখণ্ড ও ঝুরঝুরে মাটির মধ্যে হারিয়ে গিয়েছে পথ৷ নিচে গভীর খাদ, বয়ে চলেছে স্পিতি নদী৷ অদূরে পাহাড়ের ঢালে খচিত আছে বৌদ্ধ মন্ত্র ‘ওম মণি পদ্মে হুং’৷ আর তারই পাশে মুদ্রিত অক্ষরের মতো উন্নত শৃঙ্গের জানু বেষ্টন করে রয়েছে শিশুদের আঁকা ছবির মতো সমতল ছাদ, চৌকো দেওয়াল উজ্জ্বল বর্ণযুক্ত কতগুলো কুটির নিয়ে তৈরি টাবো গ্রাম৷ গ্রামের নিজস্ব চৌহদ্দির মধ্যে নীল আকাশের দিকে মাথা উঁচিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত ধ্বজাধারী একটি সৌধ ১০২০ বছরের পুরনো বৌদ্ধ মঠ, টাবো মনাস্ট্রি৷
অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ৷ এইসময় তিব্বত ঘেঁষা হিমাচল প্রদেশের এই সীমান্তবর্তী জেলা লাহুল ও স্পিতির ভয়ংকর সৌন্দর্য উপভোগ করার সাধপূরণ করা দুরুহ৷ তবে অনুকূল আবহাওয়া এবং পৃথিবীব্যাপী উষ্ণায়নের প্রভাবে পাথুরে পথ তখনও বরফ পড়ে উঁচু জিপের পক্ষে অনতিক্রম্য হয়ে ওঠেনি৷ গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চললাম ঈপ্সিত লক্ষ্যে৷ কিন্নর জেলার শেষ গ্রাম কল্পা থেকে নাকো হয়ে আমাদের গন্তব্য কাজা৷ সেখানে রাত্রিবাসের পর কুনজুম পাস অতিক্রম করে চন্দ্রতাল দেখে একই দিনে ফিরব মানালি৷ পুরো পথটাই দুর্গম ও রোমাঞ্চকর৷ এক জায়গায় পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ধস নেমে৷ ‘বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন মিলিটারি’-র সাহায্যে ডিনামাইট ফাটিয়ে হারিয়ে যাওয়া একচিলতে মেঠোপথের অনুসন্ধান করছে৷ নাকো থেকে ৮০ কিলোমিটার পথ ৮ ঘণ্টায় অতিক্রম করে যখন টাবো পৌঁছলাম, তখন সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে৷
একসময় এই অঞ্চলটি পশ্চিম তিব্বতি রাজবংশ পুরুং গুগে-র অধীনে ছিল৷ তারও আগে এখানে ঝাং ঝুংরা রাজত্ব করত৷ পুরং গুগ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ই-শেশ-ও’দ ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ লামা৷ তিনি ও তাঁর দুই পুত্র মিলে ৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে মহাযান বৌদ্ধ শাখার অন্তর্গত বজ্রযান সংঘের মত-অবলম্বনে টাবোর এই ধর্মচর্চা কেন্দ্রটি স্থাপন করেন৷ মন্দিরের স্থাপত্যে গ্রিক ও বৌদ্ধ কলার মিলন চোখে পড়ে৷ নান্দনিক সুষমায় মণ্ডিত এর শিল্প গবেষকদের কাছে এক ঐতিহাসিক সন্দর্ভ৷ সংস্কৃত, পালি ও তিব্বতি ভাষায় রচিত বহু প্রাচীন পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি মন্দিরের সংগ্রহশালায় রক্ষিত৷
টাবো গ্রাম বাঁদিকে ফেলে আরও ৩০ কিলোমিটার বন্ধুর পথ পেরিয়ে তবে কাজা৷ ৫০০ মিটার উঠলাম৷ অপেক্ষাকৃত চওড়া এই অধিত্যকায় স্পিতি নদী পলি জমে বিভক্ত হয়েছে একাধিক স্রোতে৷ কাজা পৌঁছতে দিন ফুরল, আকাশে তখন লক্ষ্মীপূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে৷ রুপোলি জ্যোৎস্নায় প্লাবিত হয়েছে পুরো উপত্যকা৷ সে এক অনন্য নৈসর্গিক শোভা৷
কাজা থেকে রওনা হলাম ভোরের আলো ফোটার আগেই৷ আজ আমাদের পাড়ি দিতে হবে ২২০ কিলোমটার পথ, পুরোটাই খাড়া৷ পাহাড়ের জীর্ণ ঢাল, বড়-ছোট পাথর আর তার ওপর আছড়ে পড়া জলপ্রপাতের বেগবতী স্রোতের মধ্য দিয়ে৷ অনতিদূরে আর একটি প্রাচীন গুম্ফা, মনাস্ট্রি৷ সেটি ছুঁয়ে পথ গিয়ে মিশেছে কুনজুমের দিকে৷ এই বৌদ্ধ বিহারের সংলগ্ন পাহাড়ের আনাচে-কানাচে অ্যামোনাইট এবং বেলেমনাইট জীবাশ্মের সন্ধান মেলে৷ ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে হিমাচলের কাংড়া জেলার ডেপুটি কমিশনার ফিলিপ হেনরি এগরটন এই অঞ্চলটি ঘুরে দেখেন৷ তার মুদ্রিত ডায়রি ‘জার্নাল অফ এ ট্যুর স্পিতি’ হল এই অঞ্চলের প্রথম ফোটোগ্রাফি ডকুমেন্ট৷
কুনজমের পথে আর একটু এগিয়ে ভারত-তিববত সীমান্তে ছোট্ট গ্রাম গিঁউ৷ এখানে মিলিটারি ছাউনি আছে৷ গ্রামবাসীর এক নিরালা কুটিরে প্রাতরাশ সারলাম আলুর পরোটা আর ঘন দুধওয়ালা চা-সহযোগে৷ এই অঞ্চলের এথনিক পানীয়, খেলে নেশা হয়৷ যখন কুনজুম পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটায় দশটা৷ আপাদমস্তক মোটা জ্যাকেট ঢেকে গাড়ি থেকে নামলাম৷ মনে হল, পৃথিবীর শিখরে উঠে এসেছি৷ প্রচণ্ড হিমেল হাওয়া যেন সূচ ফোটাচ্ছে গালে আর কপালে৷ স্পিতি ও লাহুলের মধ্যে সংযোগকারী মাউন্টেন পাস এই কুনজুম৷
প্রান্তর পেরিয়ে ওপারে পাহাড়ের ঢালে এসে পড়তেই দেখা দিল গভীর খাদে চন্দ্র নদীর শীর্ণ জলরেখা৷ এখান থেকে ১২ কিমি বিপদসংকুল পথ অতিক্রম করে চন্দ্রতাল (হ্রদ) তীরবর্তী গাড়ি রাখার জায়গা৷ সেখানে থেকে পায়ে হেঁটে আরও দেড় কিমি পথ গেলে হ্রদের নীল জল স্পর্শ করা যাবে৷ হ্রদে পৌঁছনোর প্রায় ৩ কিমি আগে পাহাড়ের অপেক্ষাকৃত নাব্য ঢালে কতগুলো প্রাইভেট টেন্ট রয়েছে৷ পূর্ণিমার রাতটা এখানে কাটালে চাঁদের আলো মাখা হ্রদের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করা যায়৷
বেলা সাড়ে এগারোটায় আমরা হ্রদের কিনারায় এসে পৌঁছলাম৷ দুই পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত গভীর খাদ ভরাট হয়ে এই প্রাকৃতিক হ্রদের সৃষ্টি কয়েক মিলিয়ন বছর আগে৷ একটু দূর থেকে দেখলে আলোকরশ্মির ছটার কারণে জলের যে নীল রংটা বোধ হয়, কাছ থেকে দেখলে সেই জল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও সবুজ৷ হ্রদের অন্য প্রান্তটি পাহাড়ের বাঁকে মিলিয়ে গিয়েছে৷ সেখানে থেকেই একটা জলধারা চন্দ্র নদী লাহুল উপত্যকায় গিয়ে ভাগা নদীর সঙ্গে মিশেছে৷ কথিত আছে, মহাভারতের পাণ্ডবেরা এই হ্রদের তীরে দিন কাটিয়েছিলেন৷ রামভক্ত হনুমান এই হ্রদের জলপান করে তৃষ্ণা নিবারণ করেন৷
চন্দ্রতাল থেকে বাতাল হয়ে গ্রামফু পর্যন্ত পথ অত্যন্ত রূঢ়৷ এবড়ো-খেবড়ো পাথর আর পিচ্ছিল জলস্রোত অতিক্রম করে গ্রামফু পৌঁছলাম সন্ধে ছটায়৷ সেখান থেকে রোটাং পাস অতিক্রম করে৷
কীভাবে যাবেন:
শিমলা থেকে টাটা সুমো জাতীয় উঁচু জিপ ভাড়া করুন দশদিনের জন্য৷ প্রথমে যান সারাহান, সেখান থেকে কল্পা, তারপর নাকো, কাজা হয়ে মানালি৷
কোথায় থাকবেন:
সারাহান আর কল্পায় থাকুন দু’রাত করে এইচপিটিডিসি-র হোটেলে৷
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৫৭