তাগুত শব্দের অর্থ :
তাগুত শব্দের একটি অর্থ করা একেবারে অসম্ভব যেমন জিহাদ বা আলা শব্দের একটি অর্থ করা অসম্ভব। কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় জিহাদ শব্দটিকে বিভিন্ন অর্থে প্রকাশ করা হয়েছে। এর সার্বিক অর্থ বুঝতে হলে তার আগে পরের বাক্য সম্পর্কে এবং যেই পরিস্থিতিতে আয়াতটি নাযিল হয়েছে তাকে সামনে রাখতে হয়। অন্যদিকে সুরা আর রহমানের -“আ-লায়ী রব্বীকুম” শব্দটির অর্থও একটি সাধারন অর্থে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
কোরআনের ...কিছু ভাষা পরিভাষা আছে যেগুলোর সার্বিক অর্থ কেবল মাত্র একটি শব্দে প্রকাশ করা উচিত নয়, এতে কোরআনের মধ্যে বিকৃতি ঘটে। তাগুত শব্দটিও একটি অন্যান্য সাধারন শব্দ। এর একটি অর্থ অনুধাবন করা কঠিন কাজ। কিন্তু আরবি গ্রামার সম্পর্কে কোন ধারণা নেই এমন ব্যক্তিদের জন্য আমরা বিষয়টি একটু অন্যভাবে বর্ননা করতে চাচ্ছি।
তাগুত শব্দটি আরবি তুগইয়ান শব্দের অর্ন্তনিহীত ভাব থেকে নেওয়া হয়েছে। তুগইয়ান শব্দের অর্থ হচ্চে জলচ্ছাস বা বন্যা-প্লাবন ইত্যাদি। বন্যা প্লাবনের কয়েকটি বৈশিষ্ট আছে যেগুলো কে ভালো করে অনুধাবন করতে পারলে তাগুত শব্দের পারিভাষিক অর্থ সহজেই বুঝে এসে যাবে। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার প্রতি ঈমান আনার প্রাথমিক শর্ত হিসেবে এমন এক শক্তিকে অস্বিকার করা বা তার সাথে বিদ্রোহ করার কথা বলেছেন যার অভিব্যক্তি তিনি তেমনি শব্দের মাধ্যমে করেছেন যাকে উপলদ্ধি করতে মানুষের জন্য ডক্টরেট ডিগ্রি বা বড় কোন আল্লামা হবার প্রয়োজন নেই। অনেকে বলেন ঈমান আনতে হলে এই সেই করতে হবে। অথচ কোরআন বলে বেশি কিছু করতে হবে না কেবল তাগুত কে অস্বিকার করে তার সাথে কুফরি করতে হবে। আরবের লোকেরা সবাই তাগুত শব্দটি কে পান্তা ভাতের মতো করেই বুঝতে পারতো। এই কারনে আমরা হাদিস শাস্ত্রের প্রতিটি শাখা তন্ন তন্ন করলেও এমন কোন রেওয়াত খুজে পাবো না যেখানে দেখা যাবে কোন একজনও এমন প্রশ্নও করেছেন যে, ইয়া রাসুলুল্লাহ (স) তাগুত শব্দের অর্থ কি ? এর সাথে বিদ্রোহ করার নমুনাই বা কি ? আপনারাও খুজে দেখুন পান কিনা। আমি চ্যালেঞ্জ করে বললাম যে, এমন কোন রেওয়াত পাওয়া যাবে না।
আমরা অনারব হওয়ার কারনে আরবি ভাষা সম্পর্কে নুন্যতম দখল না থাকায় এই জাতিয় বিষয়কে সহজে উপলদ্ধি করতে পারি না। তাছাড়া বংশ পরস্পরায় ঈমানের অধিকারী হওয়া, আর কিছু ব্যক্তির অন্ধ অনুসরন করে ঈমান বুঝার চেষ্টার কারনে আমাদের ঈমানের দুর্বলতা এতটা প্রকট। আমাদের ঈমানতো এমন যে, আমরা দিবারাত্রি ঈমানের কথা বলে বেড়াচ্ছি, ঈমানকে মজুবুত করার চেষ্টায় অন্যের কাছে দাওয়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, অন্যদিকে,সেই আমরাই তাগুতের তসবিহ গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে তাদের আনুগত্য করছি । ঈমানের জন্য জান দেওয়ার নিয়তে জীবন বিসর্জন দেওয়ার চেষ্টা করছি, অথচ আমার ঈমানকে বিশুদ্ধ করার জন্য নিজের ভিতরে থাকা তাগুতের আনুগত্য অস্বিকার করে তার সাথে বিদ্রোহ করতে ইতস্ত করছি বা বিভিন্ন বাহানা বাজিকরে বেড়াচ্ছি।
ভালো করে বুঝে রাখুন। আলো আসলে যেমন অন্ধকার থাকার কোন সুযোগ নেই। ঠিক তেমনি পরিপূর্ণ ঈমান আনার ঘোষনা দিলে তাগুতের অস্তিত্ব্য মেনে নেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। নিজের ভিতরের তাগুতকে লালন করা, বাইরের তাগুতের আনুগত্যের অধিনে জীবন যাপন করার সাথে ঈমান বা ঈমানের চিহ্নের পর্যন্ত কোন সম্পর্ক নেই। এটা একেবারে অসম্ভব। পৃথিবীর কোন কিতাব বা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গরাও যদি আপনাকে আশ্বস্ত করে তাতেও আপনার ঈমানের কোন মুল্য নেই। কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষনার পরে কারো ইজতেহাদ তো দুরে থাক, এই নিয়ে মতবিরোধ করার চিন্তা করাও কুফরি এতে কোন সন্দেহ নেই।
একবার ভাবুন তো জলচ্ছাস কাকে বলে ? জলচ্ছাসের কারনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। আমি জানি যে, আপনারা আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন এই ভেবে যে, ব্যাচারা কথা এত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে কেন। আসলে কিছু কথা এমন আছে যা বুঝতে হলে কিছু উমপাম দেওয়া অত্যান্ত জরুরী। পানিকে যে শক্তি নিজের সিমার বাইরে এসে তার আসল দায়িত্ব্য ও কর্তব্যের সিমার বাইরে নিয়ে যায় আমরা তাকে প্লাবন বা বন্যা বলি। বন্যার সময় নদীর পানি তার সিমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে জন জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। মানুষ তখন চাইলেও সহজেই স্বাভাবিক জীবনে চলতে পারে না, এ কারনে আল্লাহ তায়ালা তাগুতের সংঙ্গা প্রদানে এমনি এক শব্দ চয়ন করেছেন। যেখানে মানুষ গাড়ি চালানোর কথা ছিল সেখানে নৌকা চালাতে হয়। বাইরের কাজ ভিতরে করতে হয়, আর ভিতরের কাজ বাইরে করত হয়। মোট কথা জন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স¤পূর্ণ বিপরিত মুখে চলতে বাধ্য হয়। এই সীমা রেখা পার করার পেছনে পানির কোন হাত নেই। যেই শক্তির কারনে পানি তার সীমা থেকে বের হয়ে যায় তাকেই তুগইয়ান বলে। এবার বুঝুন তাগুত শব্দটি নির্বাচনের সময় আল্লাহ রব্বুল আলামী কেন এত দারুন শব্দ নির্বাচন করেছেন।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝলাম যে, তুগইয়ান যেমন পানিকে তার সিমার বাইরে নিয়ে যায় বা যেতে বাধ্য করে মানব সমাজের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনে, তেমনি তাগুতও মানুষকে তার সিমার বাইরে যেতে বাধ্য করে যার ফলশ্রুতিতে মানব জীবনেও এক ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি হয়। তাগুতে এই সাদা মাটা অর্থ সামনে রেখে আমরা পরবর্তি পর্বে কোরআনের আয়াত দিয়ে এই তাগুত শব্দটির পারিভাষিক অর্থ এবং কোন কোন পর্যায়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাগুতের বর্ননা দিয়েছেন সেটাও দেখবো ইনাশায়াল্লাহ। আল্লাহ বব্বুল আলামীন আমাদের কে বুঝার তৌফিক দান করুন। (চলবে)