প্রথম খন্ডটি যারা দেখেননি তার ইচ্ছে করলে এখানে ক্লিক করে দেখে নিতে পারেন যাতে আমাদের ক্ষুদ্র আলোচনা বুঝতে সহজ হয়। তাগুতের অর্থ ও তার পজিশান জানার গুরুত্ব্য সম্পর্কে আমরা ইতিপুর্বে সামান্য কিছু ইংগিত দিয়েছি। এবার আমরা তাগুতের শাব্দিক এবং পারিভাষিক অর্থ ও তাৎপর্য জানার গুরুত্ব্য নিয়ে আলোচনা করবো যাতে আমাদের কাছে ব্যাপারটি পরিস্কার হয়ে যায় যে, তাগুত শব্দটির গুরুত্ব্র্য ও তাৎপর্য উপলদ্ধির ওপর স¤পূর্ণ রুপে নির্ভর করে একজন মানুষের ঈমানদার হওয়া বা তার ঈমানের স্বাধ গ্রহণ করার বিষয়টি।
তাগুতের গুরুত্ব্য।
আমি একজন মুবাল্লিখ কে প্রশ্ন করেছিলাম যে, বলুন তো ঈমান আনার প্রথম বা প্রাথমিক শর্ত কোনটি। তিনি অনেকক্ষন ভেবে উত্তর দিলেন যে, কলেমায়ে শাহাদাত পাঠ করতে হবে মনে প্রানে। অর্থ্যাৎ তিনি বুঝাতে চাইলেন, বুঝে শুনে কলেমা পাঠ করতে হবে। আমি বললাম যে, কলেমা তো একটি উত্তম দোয়া। এটি হচ্ছে মুসলমান হওয়ার একটি ফরমের মতো যাতে আপনি শর্তগুলো পড়ে সর্ম্পুন একমত হয়ে তার পরে স্বাক্ষর করছেন। ফরমের ভিতরে কি কি শর্ত দেয়া আছে সেটা ভালো করে না জেনে বা নুন্যতম পক্ষে প্রাথমিক কথাটি না বুঝে কেবল মাত্র স্বাক্ষর করলেই তো আর হলো না।
এক সময় দেখা যাবে যে, যেদিন ফরম ফিলাপ করছেন সেদিনই শর্ত ভংগ করে আপনার চাকুরী হাড়িয়েছেন। দুনিয়ার কোন ব্যক্তির প্রতিষ্টানে চাকুরী হাড়ালে মেজেস পাওয়া যায়, আর সারা জাহানের মালিকের দরবারের চাকুরী হাড়ালে সাথে সাথে কোন মেসেজ পাওয়া যায় না কিন্ত যিনি খোদার বান্দাদের লিষ্ট থেকে খারিজ হয়ে যান তার জীবন ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন আসা শুরু করে। এ সমস্ত লোকদের কথা বার্তা ও চাল চলনে বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দেয়। এসব বাহ্যিক উপসর্গ দেখে সহজেই বলে দেওয়া যায় যে, কে বা কারা খোদার আনুগত্যের বিধান ইসলাম থেকে নিজেদের কে ফারেগ করে নিয়েছেন। যে সকল ব্যাক্তিবর্গরা এমন পোরা কপালের মালিক হয়ে যান তাদের কথা ও কাজে এর সততা ফুটে উঠে।
একটি কথা অত্যান্ত মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখুন যে, পরকালে জান্নাত পাওয়া দুরে থাক, যে কোন ভালো কাজের সওয়াব পাওয়ার হকদার একমাত্র খোদার বান্দারাই, অন্য কথায় যারা গোলামী করার শর্তে চাকুরী গ্রহণ করে থাকেন কেবল মাত্র তারাই যে কোন ভালো কাজের প্রতিদান পাবেন পরকালের দুনিয়ায়। এসব চাকরদের কে আরবিতে বান্দা বা দাস বলা হয়। এই সব দাসরা যেসব শর্ত মেনে চলার ওয়াদা করে খোদার গোলামীর খাতায় নাম লেখান সেই ফরমটি হচ্ছে কলেমা। এই ফরমের ভিতরে অত্যান্ত সুক্ষèতার সাথে সকল শর্তগুলো কে অর্ন্তভুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়ে কোরআনের অসংখ্য আয়াত আছে। আমরা সামনের দিকে তার বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয় যে, একজন কাফেরও কি ভালো কাজের কোন প্রতিদান পাবে না ? উত্তর হচ্ছে দুনিয়ায় কোন কাফের যদি উত্তম, কল্যাণকর কোন কাজ করে তাহলে তাকে এর প্রতিদানে দুনিয়াতেই কিছুটা দেওয়া হয় এতে তারা দুনিয়াকে আরো ভালো করে আস্বাধন করতে পারে। অন্যদিকে সারাদিন আল্লাহর গোলামী করেও একজন ব্যক্তি অনাকাংখীত মুসিবতে পড়তে পারেন, দুনিয়ার জীবনে সামান্য সুযোগ সুবিধা পেতে পারেন কিন্তু আখেরাতে তার অবস্থার সর্ম্পুন বিপরিত চিত্র চিত্রায়িত হবে। সেখানে কেবল মাত্র তার দুনিয়ার আমল গুলো কে মুল্যায়ন করা হবে। এই ক্ষেত্রে কে কোন বংশের, সে সৈয়দ আর কে পাঠান বা আওলাদে রাসূল, সেসব কোন মাপকাঠির খাতায় পড়বে না। এটাও গনায় ধরা হবে না যে, তিনি প্রথিবীতে ধনী অথবা গরিব ছিলেন কিনা।
আল্লাহর গোলাম হওয়া ছাড়া জান্নাতের ঘ্রানও পাওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন-
فَادْخُلِي فِي عِبَادِي وَادْخُلِي جَنَّتِي
শামিল হয়ে যাও আমার বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে ৷ সুরা ফজর-২৯-৩০।
এখান থেকে বুঝা যাচ্ছে যে জান্নাতের মধ্যে তারাই প্রবেশ করতে পারবে যারা বান্দাদের মধ্যে তালিকা ভুক্ত ছিল। অথবা জান্নাতের প্রবেশ করার পুর্ব মুহুর্ত্য পর্যন্ত একজন মানুষকে আল্লাহর গোলাম হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে হবে। কোন অবস্থায় আল্লাহর গোলামীর সাথে অন্য কিছু কে শরীক স্থাপন করা যাবে না। গোলামের তালিকা থেকে নাম কাটা যায় এমন কোন কাজ করা যাবে না যা শর্ত ভংগ হিসেবে গনায় ধরা হবে। যেমন ধরুন কোন একটি অফিসে আপনি চাকুরীর আবেদন করলেন এবং কিছু শর্ত সাপেক্ষে চাকুরী পেয়েও গেলেন কিন্তু আপনি প্রতিনিয়ত অফিসের গুরুত্ব্যপূর্ণ শর্তগুলো কে এড়িয়ে যাচ্ছেন বা পাত্তাই দিচ্ছেন না এমতবস্থায় আপনার চাকুরী চলে যাওয়াই স্বাভাবিক। আপনি নোটিশ বোর্ডের দিকে তাকালেন না যেখানে আপনার বহিস্কারের নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে যারা কুফরি করেন তারা খোদার বান্দা হিসেবে থাকেন না তারা মুলত তাগুতের গোলাম হয়ে যান। তাদের কে তাগুত এমন ভাবে আকড়ে ধরে যে, তারা তাগুতের গোলামী করতে করতে এক সময় নিজেকেই তাগুতের কাতারে নিয়ে যান। এই বিষয়ে বিস্তারিত আসবে সামনের আলোচনায়।
বৃহস্পতি বার আমাদের মারকাজে বয়ান করছিলেন এক মুরব্বী। প্রসঙ্গত জেনে রাখা দরকার যে, আমি প্রায় মারকাজে যাই এবং তাবলীগ জামায়াতের মারকাজে যেতে আমাদের প্রায় তিরিশ টাকার ভাড়া গুনতে হয়। আসা যাওয়ায় প্রায় একশত টাকা লেগে যায়। বাদ মাগরিবের পরে ঈমানের বিষয়ে অনেক দারুন দারুন বয়ান হলো। বিভিন্ন নবীদের জীবনি থেকে এবৎ সাহাবায়ে কেরামের কষ্ট আর দুরদশার ইতিহাস শুনিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হলো যে, তারা এমনি এমনি ঈমানের স্বাধ পায়নি। অনেক ত্যাগ আর তিতিক্ষার পরে তারা ঈমানের দৌলত পেয়েছে। আমাদের কেও ঈমানের স্বাধ পেতে হলে ঠিক সেই তরিকায় মেহনত করতে হবে।
বয়ানের একটি বিশাল অংশ নিয়ে রাতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিলাম যে, আমরা তাহলে এমন সস্তা ঈমান কি করে পেলাম ? যদি এমন ঈমান পেয়েই থাকি তাহলে আমাদের অবস্থা এত করুন কেন ? এতগুলো মানুষ কেবল একটি শব্দকে উপলদ্ধি করার জন্য কতই না কষ্ট করছে। ঈমানের স্বাধ পাওয়ার জন্য কত প্রচেষ্টা তারা চালাচ্ছে। নিজেদের পকেটের টাকায় মানুষের হাজারো অপবাদ সহ্য করে অন্যের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ইসলাম আর ঈমানের বয়ান করছে। কতই সুন্দর লাগে দেখতে। কিন্তু আশ্চায্যের বিষয় হচ্ছে এই যে, এত বিশাল জনগোষ্টির বেশির ভাগ লোকই আছেন যারা আসলেই ঈমানের প্রকৃত অর্থ বুঝতে স¤পূর্ণ রুপে ব্যার্থ হয়েছেন। সাহাবায়ে কেরামের মতো তরিকার কথা আমরা মুখে উচ্চারন করলেও তাদের মতো হিম্মত করে ঈমানের প্রকৃত অর্থও সাধারন জনগনের কাছে পৌছাতে পারছি না।
আমার শশুর বাড়ির সবাই তাবলীগের প্রকৃত মেহনত করেন। তারা নিজেদের বাসায় মাস্তুরাত জামায়াত আনার আবেদন করেছেন কিছু দিন আগে। শুনেছি কিছু দিনের মধ্যেই সেখানে জামায়াত পাঠানো হবে। এরা নিজেরাও পরিবার শুদ্ধ কয়েকবার জামায়াতে সময় লাগিয়েছেন। আমার একমাত্র সমন্ধি তিনিও কয়েক চিল্লার সাথী। ভারতে সফর করা হয়েছে তার বহু বছর আগে। কাকরাইলের মুরব্বিদের সাথে তার ভালো যোগাযোগ রয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ অত্যান্ত আমলদার মানুষ তিনি। তার বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তোলে যে, মানুষ কি করে এমন হয় যে, সারাদিন কেবল একি ভাবনা মাথায় নিয়ে ঘোরে, কি করে একটি লোক কে নামাজী বানাবে, কি করে কয়েকজন লোককে জামায়াতে পাঠাতে পারবে। এসব মানুষকে কি করে আপনি ইসলামের দুষমন ভাবতে পারেন। আমাদের ভাবা দরকার যে, গলদ কোথায়। এ বিষয়ে একটি ঘটনা বলি।
সেদিন মসজিদের বয়ান শেষ হলে বড় ভাইকে বললাম যে, আমার একটি লেখা প্রকাশিত হচ্ছে ব্লগ সাইট গুলোতে। আপনি তো অনলাইনে বসেন, পারলে পড়ে দেখেন। তিনি জানতে চাইলেন যে, কি বিষয় নিয়ে লিখছি। আমি বললাম তাগুতের বিষয়ে। আপনি জানেন তাগুত সম্পর্কে ? তিনি বললেন যে, না আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না। আমি বললাম যে, ঈমানদার হওয়ার প্রাথমিক যে শর্ত সেটি হচ্ছে তাগুতের সাথে কুফরি করা বা করতে থাকা। অথচ আপনি তাগুত কি সেটাই জানেন না। তিনি রেগে গেলেন, তিনি বললেন, মানে কি, তাগুত সম্পর্কে না জানলে কি ঈমানদার হওয়া যাবে না। তার মানে কি আপনি বুঝাতে চাইছেন যে, আমি ঈমানদার নই। ঠিক আছে আমি আবরো কলেমা পড়লাম। আমি বললাম যে, আসলে সেরকম কিছুই নয়, সূর্য উদয় ছাড়া যদি দিনে অস্তিত্ব্য অসম্ভব হয়, তাহলে তাগুতের সাথে কুফরি কার ছাড়া ঈমানদার হওয়াও অসম্ভব। যেহেতু আল্লাহ নিজে বলেছেন এবং ঈমানদার হওয়ার জন্য শর্ত দিয়েছেন যে, প্রথমে তাগুত কে অস্বিকার করে তার সাথে কুফরী করবে অতঃপর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনতে হবে। উদাহারন হিসেবে আমি তাকে নিম্নের আয়াতটি পড়ে শুনালাম।
لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ ۖ قَد تَّبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ ۚ فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا ۗ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
“দীনের ব্যাপারে কোন জোর-জবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথ থেকে সঠিক মত ও পথকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। এখন যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর ওপর ঈমান আনে , সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরে , যা কখনো ছিন্ন হয় না ৷ আর আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন। সুরা বাকারা- ২৫৬।”
হয়তো যে অর্থে তাগুতের সাথে কুফরী বুঝানো হয়েছে আমি আর আপনি তার হক আদায় করছি কিন্তু বিষয়টি জানতে পারছি না। এ কারনে আমরা ঈমানদার হিসেবে স্বিকৃত যেমন হবো আবার এমনও হতে পারে যে, যে অর্থে তাগুতের গোলামী শব্দটি ব্যবহ্রত হয়েছে, সেই অর্থে আমরাও হয়তো কোন না কোন ভাবে তাগুতের গোলামীতে লিপ্ত আছি অথচ জ্ঞানের অভাবে বুঝতে পারছি না। এখানেই আমাদের মুসলিম জাতির বড় সমষ্যা। তারা যা কিছু করে বংশ পরস্পরায় প্রাপ্ত জ্ঞান থেকে করে। নিজের হেদায়েতের জন্য সামান্য টুকো জ্ঞানও তারা অর্জন করার মতো সময় ব্যায় করতে পারছেনা। ফলাফল হচ্ছে এই যে, তারা একদিকে আল্লাহর ওপর ঈমান আনার মেহনত করছে, অন্যদিকে তাগুতের গোলামীর ষোলকলাও পূর্ণ করছে।
তাগুত কে অস্বিকার করার বিষয়টি উল্লেখ্য করতে গিয়ে উপরোক্ত আয়াতে কুফরি শব্দটি কে চয়ন করা হয়েছে। এর অর্থ দাড়ালো এই যে, আল্লাহর ওপর ঈমান আনার প্রামথিক শর্ত হচ্ছে তাগুতের সাথে কুফরী করা। অন্য কথায় যে কেউ আল্লাহর ওপর ঈমান আনবে সে তাগুতের সাথে কুফরিরত থাকবে। অন্যদিকে যারা তাগতের সাথে আপোষ করবে, তাকে গ্রহণ করে নিবে তারা আল্লাহর সাথে কুফরিরত থাকবে। এ জাতিয় লোকেরা ঈমানের ওপর দণ্ডায়মান থাকতে পারে না। এই কারনে আল্লাহ পাক স্পষ্ট করে বলে দিলেন যে, তাগুতের সাথে কুফরী করে যে সকল মানুষেরা ঈমানের পথে আসবে তারা এমন এক মজবুত অবলম্বন আকড়ে ধরবে যা ছিড়ে যাবার নয়। আমাদের ঈমানের অবস্থা হচ্ছে হুজুর সা এর সেই বানীর মতো যে, আমার উম্মাতেরা রাতে ঘুমাবে ঈমান নিয়ে আর ঘুম থেকে জেগে উঠবে ঈমানহারা হয়ে। এমন ভংগুর ঈমান কেবল মাত্র তারাই পাবে যারা তাগুতের সাথে কুফরী না করেই বংশপরস্পরায় ঈমানের দাবি করবে। তাদের বাহ্যিক উপসর্গগুলো দেখলে সহজেই বুঝা যাবে যে, এরা আসলেই আল্লাহর বান্দার তালিকা থেকে খারিজ হয়ে গেছে। অথচা এরা জেনে শুনে নিজেদের কে আল্লাহর গোলামীর জগত থেকে মুক্ত ঘোষনা করেছে।
আমি আশা করছি যে, আমাদের পাঠকদের সামনে তাগুত শব্দটির পরিচয় বিস্তারিত ভাবে জানার আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। পরবর্তি পর্বে তাগুতের শাব্দিক এবং পারিভাষিক অর্থ নিয়ে আলোচনা করবো ইনশায়াল্লাহ। সেখানে আমরা কোরআনের মুহকামাত আয়াত দিয়ে তাগুতের পরিচয় তুলে ধরবো। আশা করছি সবাইকে সাথে পাবো। আল্লাহ হাফেজ
(চলবে)