গত কয়েকদিন ধরে বাঙাল মুসলিমদের ফেইসবুক আলোচনার একটা বিরাট বিষয় হল এই মাসনা ওয়া সুলাসা ওয়া রুবা‘। কারো কাছে এটা নিতান্তই মজা করার বিষয় এবং কারো কাছে সিরিয়াস বিষয়।
সত্যিকার অবস্থা হল, এটা অবশ্যই একটা সিরিয়াস বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা এটিকে কুরআন মজীদে ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেনঃ
ﻭَﺇِﻥْ ﺧِﻔْﺘُﻢْ ﺃَﻻَّ ﺗُﻘْﺴِﻄُﻮﺍْ ﻓِﻲ ﺍﻟْﻴَﺘَﺎﻣَﻰ ﻓَﺎﻧﻜِﺤُﻮﺍْ ﻣَﺎ ﻃَﺎﺏَ ﻟَﻜُﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨِّﺴَﺎﺀ ﻣَﺜْﻨَﻰ ﻭَﺛُﻼَﺙَ ﻭَﺭُﺑَﺎﻉَ ﻓَﺈِﻥْ ﺧِﻔْﺘُﻢْ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌْﺪِﻟُﻮﺍْ ﻓَﻮَﺍﺣِﺪَﺓً ﺃَﻭْ ﻣَﺎ ﻣَﻠَﻜَﺖْ ﺃَﻳْﻤَﺎﻧُﻜُﻢْ ﺫَﻟِﻚَ ﺃَﺩْﻧَﻰ ﺃَﻻَّ ﺗَﻌُﻮﻟُﻮﺍْ ( 4:3 )
“আর যদি তোমরা ইয়াতিমদের (মেয়েদের) সাথে বেইনসাফী করার ব্যাপারে ভয় করো, তাহলে যেসব মেয়েদের তোমরা পছন্দ করো তাদের মধ্যে থেকে দুই, তিন বা চারজনকে বিয়ে করো৷ কিন্তু যদি তোমরা তাদের সাথে ইনসাফ করতে পারবে না বলে আশংকা করো, তাহলে একজনকেই বিয়ে করো৷ অথবা তোমাদের অধিকারে যেসব মেয়েরা আছে তাদেরকে বিয়ে করো৷ বেইনসাফীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এটিই অধিকতর সঠিক পদ্ধতি৷” [সূরা আন-নিসা, ৪: ৩]
জাহিলী যুগে লোকজন একাধিক বিয়ে করত এবং এ ক্ষেত্রে কোন সংখ্যা-সীমা মেনে চলত না। অনেক ক্ষেত্রে তারা নারীদেরকে জোর করে নিজেদের অধিকারে নিত। নিজেদের তত্ত্বাবধানে থাকা ইয়াতিম মেয়েদেরকে বিয়ে করে নিত যাতে করে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করা যায় এবং তাদের সাথে কোন ইনসাফপূর্ণ আচরণ করা না লাগে। আল্লাহ তা‘আলার শরীয়ত এই বেনইনসাফীর পথ বন্ধ করে নির্দেশনা জারী করেছে। আল্লাহ তা‘আলা নির্দেশ দিচ্ছেন যেন ইয়াতীম মেয়েদের সাথে বেইনসাফী করা না হয়; তাদেরকে জোর পূর্বক নিজেদের দখলে না নেয়া হয় এবং তাদের সম্পদ কুক্ষিগত করা না হয়। বরং অন্য নারীদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ চারজনকে বিয়ে করে নেয় এবং তাদের সাথে ইনসাফপূর্ণ আচরণ করে। বেইনসাফীর ভয় থকলে যেন শুধু একজনকেই বিয়ে করে। শরীয়তের বিরাট একটা লক্ষ্য হল সমাজে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা দেখতে পাই আল্লাহর শরীয়ত মুসলিম পুরুষদেরকে একাধিক [সর্বোচ্চ চারজন] স্ত্রী রাখার অনুমতি দিয়েছে। এটা নিয়ে মুসলিমদের মাঝে আছে বিভিন্ন গ্রুপঃ
১। একটা গ্রুপ মারাত্মক হীনমন্য। এরা একাধিক বিয়ের কথা শুনলেই হীনমন্যতায় আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। এরা বিভিন্ন পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা লালন করে এবং ইসলামের ব্যাপারে পরাজিত মানসিকতা পোষণ করে। ফলে এরা বহুবিবাহের প্রসঙ্গ আসলেই বিরোধিতায় নেমে পড়ে।
২। দ্বিতীয় আরেকটা গ্রুপও হীনমন্য, কিন্তু ইসলাম পালনকারী। এরা সরাসরি বহুবিবাহকে অস্বীকার করে না। কিন্তু বহু বিবাহের প্রসঙ্গ আসলে বিভিন্ন ধানাই-পানাই শুরু করে প্রমাণ করা চেষ্টা করে যে আসলে বহু বিবাহ না করাই ভাল এবং ইসলাম একটার বাইরে বিয়েকে নিরুৎসাহিত করে। এরাও প্রথম গ্রুপের মত বহুবিবাহ প্রসঙ্গে খুব অস্বস্তিতে ভোগে।
৩। তৃতীয় আরেকটা দল বহু বিবাহকে খেলা হিসাবে নিয়েছে। এদের ভাব হল যখন ইচ্ছা, যাকে ইচ্ছা বিয়ে করবে। এদের কেউ কেউ চার এর অধিক স্ত্রী রাখারও অনুমতি থাকার প্রমাণ বের করে আমাদের উপরোল্লিখিত আয়াত থেকে। তাদের মতে এখানে সর্বোচ্চ ৯ জন বিয়ের অনুমতি আছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ বহু বিবাহকে সুন্নত হিসাবেও চালাতে চেষ্টা করে।
আসল কথা হল ইসলামী শরীয়তে বহুবিবাহ (সর্বোচ্চ চারজন স্ত্রী) মুবাহ। এটা নিয়ে ধানাই-পানাই করার কোন সুযোগ নাই।
এক্ষেত্রে দ্বিতীয় কথা হল সর্বোচ্চ স্ত্রী সংখ্যা ৪। এর বেশি সংখ্যা নির্ধারণ করা হল নিজেদের বাসনার অনুসরণ করা ও আল্লাহর কিতাবের বিকৃতি সাধন এবং রসূলুল্লাহর ( ﷺ ) নির্দেশের লংঘন।
এক্ষেত্রে তৃতীয় কথা হল দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়ে করার সময় আগে থেকে বর্তমান স্ত্রী[দের] কাছ থেকে অনুমতি নেয়ার দরকার নেই, যদি না বিয়ের চুক্তিনামায় এ রকম কোন শর্ত থেকে থাকে। কোন নারীই চাইবে না যে তার সপত্নী থাকুক। তাই তারা কখনো অনুমতি দেবে না; দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা মানুষের সমাজের সুষ্ঠু চালনা ও কল্যাণকে বিবেচনা করেন। তাই তিনি এ ধরণের কোন শর্ত আরোপ করেন নি।
এক্ষেত্রে চতুর্থ কথা হল প্রত্যেক স্ত্রীকে বস্তুগত বিষয়গুলোতে সমানাধিকার দিতে হবে। তবে কারো প্রতি হৃদয়ের টান একটু বেশি থাকলে কিছু করার নেই। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সমানাচরণে পরিবর্তন হতে পারবে না। স্ত্রীদেরকে একই ঘরে রাখা যাবে না। তাদেরকে আলাদা আলাদা ঘরে রাখতে হবে, সমানুপাতিক খোরপোষ দিতে হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এ ক্ষেত্রে আরো কথা হল এটা কোন পুরুষের জন্য শুধুমাত্র একাধিক নারীর সাথে বৈধ যৌন সম্ভোগের অধিকার নয়; এটা নয় কোন মজা ও খেল তামাশার বিষয়; বরং এটা একটা বিরাট দায়িত্বের ব্যাপার। সংসারের কর্তা হিসাবে এই সমস্ত নারী ও তাদের বিষয়াবলীর রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা এবং সন্তান-সন্তুতির শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও বড় করে তোলার মত কর্তব্যেসমূহের সুচারু আঞ্জাম দেয়ার বিশাল দায়িত্বের ভার বহনের মত যোগ্যতা ও শক্তির দরকার হয় একজন পুরুষের।
বহু বিবাহকারী পুরুষের আরো একটা বিষয়ে খেয়াল রাখা দরকার তা হল সমস্ত স্ত্রীদের সন্তানরা তার নিজের বীজের ফসল। সুতরাং সে এই সবগুলোর সমান যত্ন নেবে। তার স্ত্রীরা আলাদা হলেও সন্তানরা সব তার নিজের। কোন একজন স্ত্রী বা শুধু তার গর্ভজাত সন্তানদের প্রতি বিশেষভাবে ঝুঁকে পড়বে না। তাই এই সন্তানদের মধ্যে সদ্ভাব সৃষ্টি করা, তাদের মধ্যে শক্ত সিলাতুর-রেহম সৃষ্টি করার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদেরকে এই ধারণা দেয়া যে তারা সবাই একই পিতার ঔরসে জন্মেছে, সুতরাং তারা পরস্পরের ভাই-বোন। তথাকথিত সৎ ভাই-বোনের যে ধারণা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে এবং এর মাধ্যমে এক ব্যক্তির সন্তানদের মধ্যে যে বিরোধ তৈরি হয় তার অংকুর যেন না গজায় সে চেষ্টার কোন ত্রুটি সে করবে না।
এই সমস্ত বিষয়ের দিকে খেয়াল রাখার পর যে সমস্ত মুসলিম পুরুষদের সামর্থ আছে তাদের একাধিক বিয়ে করাই উচিৎ। একাধিক বিয়ে মূলতই সমাজের জন্য কল্যাণকর। আমাদের সমাজে অনেক বিধবা, তালাকপ্রাপ্তা ও অসহায় নারী আছে। সামর্থবান মুসলিমদের উচিৎ এদের বিয়ে করা। আর এই বহু বিবাহের উপকার লাভ করবে মূলত সমাজের নারীরা ও শিশুরা। কিন্তু আপনার উপর বর্তাবে বিরাট দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারলে আপনার জন্য রয়েছে বিরাট পুরষ্কার।
আমার যদি সামর্থ থাকত তাহলে আমিও একাধিক বিয়ে করতাম। এটা এজন্য নয় যে এর মাধ্যমে আমি একাধিক নারীর সঙ্গলাভ করতে পারতাম; বরং এটা এ জন্য যে এর মাধ্যমে আল্লাহ চাইলে আমার একটা বিরাট পরিবার হত। আমিতো চাই যে আল্লাহ যদি তৌফিক্ব দিতেন তাহলে আমার ১০০ সন্তান-সন্তুতি হউক, যাতে রীতিমত একটা গোত্র [clan] হয়ে যায়। এবং তাদের মাধ্যমে সায়্যিদুনা মুহাম্মদের [ ﷺ ] উম্মতের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সায়্যিদুনা উমর (রাঃ) বলতেন, “নারীদের কাছে যাওয়ার কোন প্রয়োজন আমি বোধ করি না। কিন্তু আমি শুধু এজন্যই যাই যে হয়তো আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমে একটা উত্তম আত্মাকে দুনিয়াতে প্রেরণ করবেন।” সন্তান-সন্তুতি মানুষের জন্য আকর্ষণীয় বিষয়। সমস্যা হল আজকের সমাজের লোকজনের দূর্নীতিগ্রস্ত মানসিকতা। ফলে এখন লোকেরা সন্তান নিতে চায় না। আমার চারটা বাচ্চা শুনে একজনের মুখ হা গেছিল। মনে হচ্ছিল যেন অনেক বেশি বাচ্চা কাচ্চা হয়ে গেছে আমার।
যে সমস্ত তরুণ ভাইয়েরা মাসনা, সুলাসা ও রুবা’ এর স্বপ্ন দেখছেন তারা নিজেদেরকে তৈরি করুন সেজন্য – আর্থিক, শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে। না হলে শুধু দিবাস্বপ্ন দেখে কোন লাভ নাই। এটা একটা মানসিক বৈকল্য। এরকম বিকল মানসিকতার লোকের কোন দরকার নাই আমাদের সমাজে। আগে একটা বিয়ের জন্য তৈরি করুন নিজেকে এবং তাড়াতাড়ি প্রথম বিয়ে সেরে ফেলুন। সাঈদ ইবন জুবায়র (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আমি ইবন আব্বাসের (রদিয়াল্লাহু আনহুমা) কাছে আসলে তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি বিয়ে করেছো?” আমি বললাম, “না”। তিনি বললেন, “বিয়ে কর, কারণ এই উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তির [মানে রসূলুল্লাহ ( ﷺ )] ছিল সর্বাধিক সংখ্যক স্ত্রী।”” [সহীহ আল-বুখারী, কিতাবুন-নিকাহ, হাদীস নং ৫০৬৯]
রসূলুল্লাহ ( ﷺ ) বলেছেন, "তোমরা সে সমস্ত নারীদের বিয়ে করো যারা প্রেমময়ী ও বেশি সন্তান জন্মদানে সক্ষম, কারন ক্বিয়ামতের দিন আমি তোমাদের সংখ্যার জন্য গর্ব করবো।" [আবূ দাঊদ ও নাসাঈ, সহীহ]
#বহুবিবাহ