ডাকসু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। দীর্ঘ ২৮ বছর পরে এই ছাত্র সংগঠনের ৮ম নির্বাচন হতে যাচ্ছে। নানা আলোচনা সমালোচনার ভিড় ঠেলে শুরুতেই বিতর্ক বাধে এবারের নির্বাচনে একটি ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে।
ঢাবিতে সক্রিয় কোনো ছাত্র সংগঠনই চায়নি ডাকসু নির্বাচনে ইসলামপন্থী কোনো ছাত্র সংগঠন অংশগ্রহণ করুক। তারা খোলাখুলিভাবেই বিরোধিতা করেছে। সব থেকে বেশি বিরোধিতা এসেছে বামপন্থী এবং সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে। এ ইস্যুতে বিএনপির ছাত্র সংগঠনও তাদের সাথে সুর মিলিয়েছে।
মূল আলোচনার আগে আমরা ডাকসু ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলিয়ে নিতে পারি- ১৯২১ সালে ঢাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ডাকসুর জন্ম হয় ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে। শিক্ষার্থীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও গোড়া থেকেই জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। ১৯২৫ সালে সাধারণ সভার মাধ্যমে এর খসড়া গঠনতন্ত্র অনুমোদন করা হয়।
প্রতিষ্ঠার শুরুতে এ সংগঠনের নাম ছিল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ’। ১৯৫৩ সালে নাম পরিবর্তন করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ’ করা হয়। ওই বছর থেকে উপাচার্যকে সভাপতি এবং একজন শিক্ষককে কোষাধ্যক্ষ করে ১৬ জন ছাত্র প্রতিনিধি ও ১০ জন কর্মকর্তা নিয়ে ডাকসু গঠিত হয়।
এর আগে ঢাবির প্রতিষ্ঠাকালীন তিন হল (ঢাকা, সলিমুল্লাহ ও জগন্নাথ) থেকে একজন শিক্ষক এবং ছাত্র প্রতিনিধি নিয়ে সংসদ গঠিত হতো। শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটের নির্বাচন পদ্ধতি চালু হয় ১৯৭০ সালে।
সূচনালগ্নে ডাকসুর সদস্য পদের জন্য ১ টাকা চাঁদা দিতে হতো। ১৯৯০ সালের পরে ডাকসুর আর কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৭ বার ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর আদালতের নির্দেশে আগামী ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ৮ম ডাকসু নির্বাচন এবং এবারই প্রথম ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন নামের একটি ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন নির্বাচনের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করেছে।
ডাকসু নির্বাচনকে দেশের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন বলা হয়, কারণ জন্মের পর থেকে এ সংগঠন দেশের সকল ন্যায্য আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে। এখান থেকে বেরিয়ে এসেছে দেশের প্রথিতযশা বহু নেতৃত্ব।
আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা রক্ষার আন্দোলন, আমাদের দেশ প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা আন্দোলন, এরশাদের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের কোনো ন্যায্য আন্দোলনের ইতিহাস ঢাকসুকে বাদ রেখে লেখা সম্ভব নয়। এমনকী ২০০৭ সালে কেয়ারটেকার সরকারের অন্যায্যতার বিরুদ্ধেও এই সংগঠন গর্জে উঠেছিল।
আমি মনে করি আগামীতে দেশের ইসলামপন্থী রাজনীতির ইতিহাস রচনায়ও ডাকসু গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, যার সূচনা হলো ইশা ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে।
২. ১৯৯০ সালে পরিবেশ পরিষদ নামে মূলত বাম ছাত্র সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে ঢাবির ক্যাম্পাসে ‘ধর্মভিত্তিক’ ছাত্র রাজনীতি অন্যায্যভাবে নিষিদ্ধ করে। সেই সূত্র ধরে আসন্ন ৮ম ডাকসু নির্বাচনে এককভাবে পূর্ণপ্যানেল ঘোষণাকারী একমাত্র ইসলামপন্থী ছাত্র সংগঠন ইশা ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়ে।
বাম ও সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলতে শুরু করেন ঢাবিতে কোনো ‘ধর্মভিত্তিক’ ছাত্র রাজনীতি করা যাবে না। তারা ৯০ সালের মৌখিক নিষিদ্ধের কথাও উল্লেখ করেন।
অপর দিকে ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন বেশ সচেতন ভাবে কোনো বিতর্ক বা উস্কানিতে না জড়িয়ে ক্যাম্পাসে দৃশ্যমান কার্যক্রম শুরু করে। সংগঠনটির নেতারা বিভিন্ন দাবিদাবা নিয়ে উপাচার্যর সাথে দেখা করেন। রাজু ভাস্কর্যের সামনে মিছিল সমাবেশ করেন। মধুর ক্যান্টিন ভিত্তিক আড্ডায় যোগ দেন এবং অবশেষে ২৫ সদস্যের পূর্ণপ্যানেল ঘোষণা করে তাক লাগিয়ে দেন।
১৯৯০ সালে কথিক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলো ক্যাম্পাসে ধর্মভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে মূলত ইসলামি ছাত্র শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিল। সে সময়ের মৌখিক নিষিদ্ধ করণ বিশেষ কোনো সমালোচনার মুখে না পড়ার প্রধান কারন হলো ছাত্র শিবির স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতের ছাত্র সংগঠন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন।
ইশা ছাত্র আন্দোলনের মূল সংগঠন ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে রাজনীতি করে। এই সংগঠনের বিরোধিতা করে বা তাদের ডাকসু নির্বাচনের বাইরে রাখতে ‘ধর্মভিত্তিক’ শব্দটা ব্যবহার করে কথিত প্রগতিশীলরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারেনি। বরং নিজেরাই নানামুখী সমালোচনার খাদে পড়ে।
প্রশ্ন ওঠে- ইশা ছাত্র আন্দোলন বা তাদের মূল দল দেশের সংবিধান মেনে বৈধভাবে রাজনীতি করতে পারলে, জাতীয় নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে পারলে, ডাকসু নির্বাচনে পারবে না কেনো? ‘ধর্মভিত্তিক’ বলতে কথিত প্রগতিশীল বা বামশীলরা কী বোঝাতে চায়? রাজনীতি তো ধর্মের ভিত্তিতে হয় না, রাজনীতি হয় আদর্শের ভিত্তিতে।
ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক আদর্শ হলো ‘ইসলাম’। এই সহজ বিষয়টাকে কথিত প্রগতিশীলরা ধর্মের নামে চালিয়ে দিয়ে মূলত নিজেদের ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাবের প্রকাশ ঘটায়। তারা ইসলামপন্থীদের আদর্শিকভাবে মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে প্রগতিশীলতার হলুদ রং গায়ে মেখে ঘুরঘুর করে। যা এবার নগ্ন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
কথিত প্রগতিশীল বা বাম ছাত্র সংগঠনগুলো এত দিন মনে করতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অভয়ারণ্য। সেখানে ভিন্ন আদর্শের কাউকে তারা এক্সেস দিতে চাইতো না। দীর্ঘ দিন একটা বলয় সৃষ্টি করে তারা এই ধারা অব্যাহত রাখতে পারলেও এখন আর পারছে না। কারণ তারা ২০১৯ সালে বসবাস করলেও চিন্তা চেতনায় পড়ে আছে এখনো শত বছর পেছনে। যে কারণে দেশের জাতীয় রাজনীতিতেও তাদের অবস্থান রাজনৈতিক এতিমখানায়।
আমি খুব অবাক হয়ে লক্ষ করেছি- বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী দল ইসলামি শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন দেশের কিছু ইসলামপন্থীদের কাছ থেকেও হ্যাংলা সমালোচনার মুখে পড়েছে। অথচ নৈতিকভাবে তাদের খুশি হওয়ার কথা ছিল। তারা তা হতে পারেনি। মনের দৈন্যতা প্রকাশ করতে গিয়ে এত নিম্নস্তরে নেমে পড়েছে যা কথিত প্রগতিশীলদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি।
তাদের অকথ্য, অগ্রহণযোগ্য সমালোচনা দেশের ইসলাম প্রিয় মানুষকে শুধু বিস্মিতই করেনি, চরম আহতও করেছে। পশ্চাৎমুখী এই শ্রেণীকে উদ্দেশ্য করেই হয়তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন- ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলছে, আমরা তখনও বসে- বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে’।
৩. ডাকসুর অতীত নির্বাচনগুলোর সুষ্ঠুতা নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক নেই। এমনকী সামরিক সরকারদের আমলেও ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। শুধুমাত্র একবার (১৯৭৩) এ নির্বাচনকে কলঙ্কিত করে ব্যালট বাক্স ছিনতাই এর ঘটনা ঘটেছিল। সে নির্বাচনে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগ এবং বামপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ প্যানেল দিয়েও জাসদ ছাত্রলীগের বিজয় ঠেকাতে পারেনি।
৮ম ডাকসু নির্বাচন নিয়ে জনমনে আশঙ্কার অন্ত নেই। শিক্ষার্থীদের মনে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে- একাদশ জাতীয় নির্বাচনের মতো ঐতিয্যবাহী ডাকসু নির্বাচনকেও কলঙ্কিত করা হতে পারে। সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন নিজেদের বিজয় নিশ্চিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ভোট প্রদানে (বিশেষ করে ইসলামপন্থী এবং কোটা সংস্কারপন্থীদের) বাধা সৃষ্টি করা হতে পারে। রাতের অন্ধকারে ভরে যেতে পারে ভোটের বাক্স।
শিক্ষার্থীদের মনে এসব আশঙ্কা তৈরি হওয়ার পেছনে অনেকগুলো যৌক্তিক কারণ রয়েছে- নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর অধিকাংশ দাবীদাবা মানা হয়নি। ক্যাম্পাস সকল সংগঠনের জন্য সমতল করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। ভোটকেন্দ্র হলের বাইরে বের করার গণদাবি আমলে নেয়া হয়নি। ভোটার তালিকা এবং প্রার্থীদের বৈধ তালিকা নিয়েও ব্যাপক অসন্তষ দেখা দিয়েছে।
সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের প্রার্থীদের রঙ্গিন পোষ্টারে ক্যাম্পাস ছেয়ে গেলেও কর্তৃপক্ষ গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ইসলামপন্থীদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সংবাদ মাধ্যমের বৈরী আচারণ সকলের নজরে পড়েছে।
এত কিছুর পরেও আমরা প্রত্যাশা করি ৮ম ডাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। ঐতিয্যবাহী এ প্রতিষ্ঠানের ঐতিয্য বজায়ে রাখতে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সকল ছাত্র সংগঠন আন্তরিকতা দেখাবে।
লেখক: পলাশ রহমান। ইতালি থেকে।
সাংবাদিক, ইসলামি রাজনীতি বিশ্লেষক