স্যাটেলাইটের অন্যান্য জমকালো চ্যানেলগুলোর দৌরাত্ম্যে ‘ডিসকভারি’ কিংবা ‘এনিমেল প্ল্যানেট’ এর প্রতি যুবসমাজ যদিও কিছুটা অনাগ্রহী, তবু প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে নির্মিত এ ডকুমেন্টারিগুলোর একটা বিশেষ শ্রেণীর দর্শকপ্রিয়তা কিন্তু সবসময়ই আছে। আমার তো মনে হয় এ ধরণের একটা বিরাট দর্শক শ্রেণী হল রোগীরা! হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বার কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অপেক্ষমানদের ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়- গিলতেই হয় এসব! এখনতো আবার বাংলাতেই ডাবিং করে দেখায়! যদিও এইসব নাটুকে কায়দার ডাবিং শুনলে আমার প্রচন্ড হাসি পায়!
":হেই দেখে যাও ডেভিড, আমি কতবড় একটা সাপ ধরেছি!!! (কন্ঠে রাজ্যের বিস্ময়)
:হুম, সাপটি সত্যিই অনেক বড়!!!! (তার যেন এইমাত্র জন্ম হয়েছে- এমন একটা ভাব নিয়ে)
:আরেহ! এ সাপটাকে আমি কয়েকবছর আগেও ধরেছি বলে মনে হচ্ছে! এ হচ্ছে মেয়ে সাপ! দেখো দেখো এর লেজের দিকটা দেখো। আমি তখন মার্ক করে রেখেছিলাম। এখনো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
:তাহলে তো এই সাপ তোমার পূর্ব পরিচিত!
:সত্যিই তাই!"
যাই হোক আসল কথায় আসি। হঠাৎ করেই কিছুদিন আগে আইএমডিবি ঘাটতে গিয়েই চোখ পড়লো একটা টেলিভিশন সিরিজের উপর। ৯ দশমিক ৬ রেটিং নিয়ে এখন পর্যন্ত সকল প্রকার টিভি সিরিজ কিংবা মুভি’কে পেছনে ফেলে সবার উচ্চাসনে বসে আছে “প্ল্যানেট আর্থ” (Planet Earth) নামক একটা টিভি সিরিজ!! তাই বলে ডকুমেন্টারি? তাও আবার ন্যাচার নিয়ে? কি এমন আছে এতে? সবগুলো নামিয়ে নিয়ে দেখতে বসলাম। দেখা শেষে পারলে তো আমি ১০/১০ দিয়ে দেই!!
এই “প্ল্যানেট আর্থ” বিবিসি ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইউনিট নির্মিত ২০০৬ সালের টেলিভিশন সিরিজ। পাঁচ বছর ধরে নির্মিত এই সিরিজটি বিবিসি’র এ যাবৎ কালের সর্বাধিক ব্যয়বহুল ডকুমেন্টারি। আর হবেই বা না কেন- ডিসকভারি চ্যানেল এবং জাপান ও কানাডা’র সরকারী টেলিভিশন চ্যানেল এর যৌথ প্রযোজনায় ১৬ মিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিং-এ নির্মিত এই ডকুমেন্টারি পৃথিবীর প্রথম হাই ডেফিনিশান (HD) প্রকৃতি নির্ভর মুভি যা পৃথিবীবাসীর কাছে এ ধরণের ডকুমেন্টারি সম্বন্ধে ধারণাই পাল্টে দিয়েছিল। ২০০৬ সালে প্রথম বিবিসিতে সম্প্রচারের পরের বছর আমেরিকা সহ সারা পৃথিবীতে দেখানো হয় এই ডকুমেন্টারি। বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার স্যার ডেভিড এটেনবরো ’র ধারাবর্ণনায় ডকুমেন্টারির প্রতিটি মূহুর্ত্ব সত্যিই ভীষণ উপভোগ্য এবং প্রাণবন্ত! ১১ পর্বের এই সিরিজ ক্ষণে ক্ষণে দর্শককে নিয়ে যায় এ গ্রহের কতই না না-জানার দেশে যেখানে সবাই মুগ্ধ হয়ে নতুন করে আবিষ্কার করে চেনা-অচেনা প্রানীদের! পরিচিত হয় তাদের একেবারে নিজস্ব জগতের খুঁটিনাটি দিকগুলোর সাথে। সকল মহাদেশের মোট ৬২ টি দেশের ২০৪ ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ৭১ জন ক্যামেরা অপারেটর ২০০০ দিন ব্যয় করে এই সিরিজটি শ্যুট করেছে।
পুরো সিরিজটিকে এ বিশ্বের প্রাণীজগতের ভিন্ন ভিন্ন আবাসভূমি’র উপর ভিত্তি করে এগারো পর্বে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্বে সুমেরু থেকে কুমেরুর পুরো ভ্রমণের একটা সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। বাকি পর্বগুলো হল- পর্বত, স্বাদু পানি, গুহা, মরুভূমি, বরুফে বিশ্ব, সমতলভূমি, জংগল, অগভীর সমুদ্র, মৌসুমি বনাঞ্চল, গভীর মহাসমুদ্র।
পর্বগুলোর নাম শুনে মনে হতে পারে এ আর নতুন কি- সব জায়গাই তো দেখেছি বা শুনেছি! কিন্তু বিশ্বাস করুন দুঃসাহসিক এই ডকুমেন্টারি টিম আপনাকে এমন সব জায়গায় নিমিষেই নিয়ে যাবে যার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি আগে কখনও! হা-করা মুখ নিয়ে বারবার ভাববেন, “এমন জায়গাও আছে এই পৃথিবীতে”! আর প্রাণী? পুরো সিরিজ টা দেখার পর একটা সিদ্ধান্তে আপনাকে আসতেই হবে– পৃথিবীর এমন কোনো স্থান বোধহয় নেই যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই!
এখন থেকে চিন্তা করেছি এই সিরিজ-টা নিয়ে একটা সিরিজ লিখবো। এর সেল্ফ এক্সপ্লেনেটরি সব পর্বগুলো নিয়ে বেশি কিছু বলার হয়তো নেই- কিন্তু প্রচন্ড আগ্রহ থেকেই ব্যপারটা শুরু করা। অনেকটা রিভিউ টাইপ হলেও প্রধান প্রধান বিষয়বস্তু নিয়ে নিজস্ব কিঞ্চিৎ জ্ঞান মিলিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করব। আর কারো যদি কোনো বিষয়ে কিছু বোঝার কমতি থাকে কিংবা বাড়তি কিছু জানার ইচ্ছে জাগে (হোক সেটা দূর্বোধ্য কোনো বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া) তার প্রশ্নের উত্তর দিতে সর্বাত্মক চেস্টা করব। ভয় নেই- আমার লেখাপড়া অনেকটা কাছাকাছি বিষয় নিয়েই!
আগেই বলেছিলাম প্রথম পর্ব বাকিসব পর্বের চুম্বক অংশগুলো নিয়ে করা যা পুরো সিস্টেমটাকে অদ্ভুত নৈপুণ্যে এক সুঁতোয় ঘেঁথে দেয়। এতে করে যাচাই হয়ে যায় পরবর্তী পর্বগুলোর আলাদা করে বিভক্তিকরণের প্রযোজ্যতা।
...তো আসুন শুরু করা যাক!
প্রথম পর্বঃ Pole to Pole: মেরু থেকে মেরুতে (সুমেরু থেকে কুমেরু)
শূন্যের নিচে সত্তর ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা! চার মাস ধরে সূর্যের আলো নেই। প্রচন্ড তুষারপাতের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে এন্টার্ক্টিকা মহাদেশের সকল প্রাণীকুল পালিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখানে না আছে পানি, না আছে কোনো খাদ্য। বেঁচে থাকা অসম্ভব। আর এই অসম্ভবের মাঝেও পালায়নি একটি প্রজাতি। পুরুষ এমপেরর পেঙ্গুইন। শত প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বুকের নিচে তারা আগলে রেখেছে তাদের ভবিষ্যত সন্তানদের- তাদের মহিলা সংগীর পেড়ে যাওয়া ডিম। বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা ছাঁপিয়ে তাদের চোখে মুখে ভেসে ওঠে একরাশ অনিশ্চয়তা!
ওদিকে এন্টার্ক্টিকার ঠিক উলটো দিকে উত্তর মেরুতে তখন দীর্ঘ পাঁচ মাস পর প্রথম বারের মত উঁকি দিয়েছে সূর্য! প্রথম আলোর ছটায় গত পাঁচ মাস ধরে অভুক্ত থাকা মা শ্বেত ভল্লুক যখন গর্ত থেকে মাথা বের করে প্রথম বারের মত- এক পলকের জন্য মনে হয় সূর্য বুঝি দিগন্তের বদলে তার চোখেই উদিত হয়েছে! মাত্র দু’মাস আগে জন্ম নেয়া সন্তানদের পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার এই-এ সময়! বাচ্চারা ক্ষুধার্ত। তাদের খাওয়ানোর জন্য নিজেকে খেতে হবে যে! কিন্তু সময় তেমন একটা নেই! উত্তাপে বরফ গলে যাওয়ার আগেই পেতে হবে খাদ্যের সন্ধান। এখনও হাঁটতে না শেখা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে মা রওনা দেয় অজানার পথে।
ওদিকে এই শীতের সময় মেরু অঞ্চল থেকে ৩ মিলিয়ন ক্যারিবু (মেরু অঞ্চলের হরিণ) সর্বোচ্চ ২০০০ মাইল পথ ভ্রমণের পর অতিথী হয়ে আসে উত্তর কানাডায় তুন্দ্রা অঞ্চলে (মেরু অঞ্চলের ঠিক পরের আবাসস্থল)! প্রাণীজগতের অন্য কোনো সদস্যই এতটা পথ মাইগ্রেট করেনা।
৫০০ মাইল দক্ষিণে বরফের রাজ্যে তখন পিনপতন নিরবতা ! পৃথিবীর তিনভাগের একভাগ গাছ নিয়ে গঠিত এই কনিফারাস স্পিশিজ (সূঁচালো পাতার গাছ যেমন পাইন ইত্যাদি) এর রাজ্যকে বলা হয় তাইগা বা বোরিয়াল ফরেস্ট। এ অঞ্চল সবসময় যে বরফে আচ্ছাদিত থাকে তা নয়। বসন্ত কিংবা গ্রীষ্মে প্রাণীর কোলাহলে মুখর হয়ে ওঠে এই অঞ্চল। শীত এলেই সবাই হয় মাইগ্রেট করে দূরে চলে যাবে, অথবা গর্তে লুকাবে!
আর এদিকে তিন লক্ষ বৈকাল টিল (রাশিয়ার এক ধরণের হাঁস) সাইবেরিয়ার হাঁড় কাঁপানো শীত থেকে বাঁচার জন্য কোরিয়াতে এসে আশ্রয় নেয়। একই ঝাঁকে এই হাঁসের সমগ্র প্রজাতির উড়ে আসার দৃশ্য সত্যিই অসাধারণ!
কিন্তু এমনও কিছু অঞ্চল এই পৃথিবীতে আছে যেখানে ঋতুর বৈচিত্র্যই নেই! বিষুবীয় এই অঞ্চলগুলোতে সারাবছর সূর্য ঠিক মাথার উপর থাকে। তাই এই অঞ্চলগুলো ফুলে-ফলে ভরপুর! জীবন এখানে বৈচিত্র্যময়! এক নিউ গিনিতেই রয়েছে ৪২ প্রজাতির বার্ডস অব প্যারাডাইস। স্বর্গের পাখি!! হুম, পাখিগুলোকে দেখলেই এদের নামকরণের কারণ জানতে পারা যায়!
ওদিকে গ্রীষ্মে পেরুর উপকূল জুড়ে সাগরের নিচ থেকে ঢেউয়ের হাত ধরে আসা সাগরতলের খাদ্যের লোভে এদিকটায় পাড়ি জমায় সিল সহ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণী। আর এদের লোভে আসে গ্রেট হোয়াইট শার্ক নামের হাংগর। পৃথিবীর ভয়ংকরতম এই শিকারী প্রাণীর শিকার ধরার ক্ষিপ্রতা ক্যামেরায় ধরা পড়ে ৪০ গুন স্লো করার পর।
ভারত মহাসাগরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া উত্তপ্ত হাওয়া এই গ্রীষ্মে হিমালয় দর্শনে যায়। সেখানে ঠান্ডা হয়ে বায়ুমন্ডলের আরো উপরে উঠে আবারো রওনা দেয় মহাসাগর অভিমুখে! পথে আমাদের জন্য ঝরিয়ে যায় আশির্বাদের বারিধারা- মৌসুমি ঝড়! সবাই তো আর এতটা আশির্বাদপুষ্ট নয়- তাই আফ্রিকার মরু অঞ্চলে তখন পানির জন্য হাহাকার! পানির খোঁজে হাজার হাজার হাতি, জিব্রা, জংলী মোষ তখন রওনা দিয়েছে বতসোয়ানা (আফ্রিকার একটি দেশ) অকোভাংগো অঞ্চলের জলাভূমির অভিমুখে। একসময় অকোভাংগো পানিতে ভরে ওঠে আর কালাহারি মরুভূমি হয়ে ওঠে ফুলে-ফলে সুজলা সুফলা। দেখলে বিশ্বাসই হয়না এই অঞ্চলে কিছুদিন আগেও প্রাণের কোনো অস্তিত্বই ছিলনা! আর প্রাণের অস্তিত্বের সাথে সাথেই শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাঝে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগীতা।
এতকিছুর পর সূর্যের সময় হল এন্টার্ক্টিকায় ফিরে যাওয়ার যেখানে গত চার মাস ধরে মৃত্যুর সাথে প্রতিনিয়ত পাঞ্জা লড়ে অপেক্ষা করছে পেঙ্গুইন পুরুষেরা। সূর্যের আগমনে তাদের ঘর আলোকিত করে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরোয় যাদের এতদিন তারা শত প্রতিকূল পরিস্থিতির কাছ থেকে আগলে রেখেছিল! একবুক অনিশ্চয়তা আর ভয় নিয়ে কাটে তাদের দিন.....অল্প সময়ের জন্য আসা এই গ্রীষ্মে তারা তাদের বাচ্চার খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবে কি?
প্রথম পর্ব মানে Pole to Pole ডাউনলোড করতে পারবেন এখান থেকে। ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।