মানুষ ও সাপের মধ্যকার পার্থক্য কি??
এক
তখন ক্লাস সেভেনে পড়তাম। স্কুল আওয়ার সকাল দশ টা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা। টিফিন আওয়ারে আম্মু এটা সেটা খেতে দিতে চান না তাই বড় টিফিন বক্সে করে ভাত দিতেন। আমার ক্লাসে মিঠু নামে একটা ছেলে পড়তো। রিকসাওয়ালার ছেলে তাই অর্ধেক বেতনে পড়তো। গালে টোল পড়তো হাসলে। ছেলেটি আমার আশে পাশে ঘুরঘুর করতো সবসময়। টিফিনের সময়ও। কয়েকদিন পর থেকে কেন জানিনা তাকে ভাগ দেয়া শুরু করলাম। দুপুরের টিফিন – ভাত আর ডিম। আমি আর মিঠু ভাগ করে খাই। শেষের দিকে এমন হত- আমি হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত- মিঠু আমার ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা নিয়ে আমাদের খাওয়ার রুমে (কেজি ক্লাসের একটা রুমকে খাওয়ার রুম বানিয়েছিলাম আমরা বেশ ক’জন মিলে) যেত, আমি পরে আসতাম। সে আমার ঠিক বন্ধু ছিল না। ক্লাসের শেষের দিকে বসত। পড়ার জন্য স্যারের হাতে মার খেত প্রতিদিন। অন্যান্যদের স্বাভাবিক হৈ-হল্লা’তে কোনোদিন অংশ নিত না। মাঝে মাঝে বুঝতেই পারতাম না ও এসেছে কি না- শুধু টিফিন আওয়ারেই ওর উপস্থিতি টের পেতাম।
পরের বছর অন্য স্কুলে ভর্তি হলাম। আগের স্কুলের ওদিকে যাওয়া হত না। তাই মিঠুর খবরও আর জানতাম না অনেক বছর।
স্কুল শেষ করলাম, কলেজ টাও শেষ হল- ভার্সিটিতে পড়ছি। একদিন এক বড় ভাইয়ের সাথে রিকশায় চড়ে উনার অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম। গলির মুখ ছোট তাই বিপরীত দিক থেকে আসা একটা প্রাইভেট কারের জন্য বেশ কয়েকটা রিকশা আটকে আছে। আমাদেরটাও। কথা বলতে বলতেই হঠাৎ পাশের ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপের ভেতরে চোখ পড়লো। কালিঝুলি মাখা একটা মুখে চোখ আটকে গেল- ভীষণ চেনা মনে হল মুখটা-কে! সারা হাতে কালি, ময়লা একটা শতছিন্ন জামা’তে ছোপ ছোপ কালো দাগ। কাজ করতে করতে কথা বলছে আর হাসছে। সে-ই টোল। পুরোপুরি চিনতে পারলাম আমি। মিঠু! হঠাৎ করেই মিঠুর চোখ পড়ল আমার দিকে! কয়েক সেকেন্ড লাগলো তারও আমাকে পুরোপুরি চিনে নিতে। আমি তখনো কথা বলছিলাম বড় ভাইয়ের সাথে। দু’সেকেন্ডের জন্য হেসে উঠেছিল তার কালিঝুলি মাখা সেই মুখটা। সেই চাহনি- স্কুলে থাকতে যে দৃষ্টিতে চেয়ে থাকত আমার দিকে! নিজেকে অবাক করে দিয়ে একটা অদ্ভুত কাজ করলাম আমি- অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম! অন্য দিকে তাকিয়ে আছি- বুঝতে পারছি মিঠু আমার দিকে তাকিয়ে আছে! কেন জানি আর তাকালাম না ওর দিকে। বাসায় এসে সারারাত খুব পোড়ালো তার সেই দৃষ্টি। নিজেকে নিজের আচরণের জন্য ক্ষমা করতে পারছিলাম না। মনে মনে ঠিক করলাম সকালে গিয়ে ওর সাথে কথা বলব। চাইলেই তো আমি তাকে ভাল কোনো চাকুরীতে ঢুকিয়ে দিতে পারি! কিন্তু সকালে কি কাজে জানি ব্যস্ত হয়ে যাওয়াতে ভুলেই গিয়েছিলাম মিঠুর কথা। তারপর ভুলে গেলাম পুরোপুরিই। আর মনেই পড়েনি।
এরপর কেটে গেল আরো ৩ টি বছর। একদিনের কথা। ভার্সিটি’র ক্লাস শেষে ফিরছি। সন্ধ্যা হয়ে আসলো। দোকানে দোকানে আলো জ্বলে উঠেছে। বাসে উঠছি এক ব্যস্ত মোড় থেকে। বাসে উঠার জন্য খুব ঠেলাঠেলি হচ্ছে। আমি উঠে পড়লাম কোনোমতে। আমার পেছনের ভদ্রলোক উঠছেন কাঁচা বাজার নিয়ে। হঠাৎ তার পেছনের কমবয়সী (সম্ভবত কলেজ পড়ুয়া) একজন ছেলে চিৎকার করে উঠলো – ‘এ...ই পকেটমার’ বলে। ছেলেটা হাতে নাতে ধরেছে পকেটমার কে- বাজার নিয়ে যিনি উঠছেন তার পকেট থেকে মোবাইল নেয়া অবস্থায়। তারপরের ঘটনা সহজেই অনুমেয়। যার মোবাইল নিয়েছে তিনি তার হাত মুঠি করে এক ঘুষি বসালেন পকেটমারের গালে। ভদ্রলোকের হাতে ছিল পিতলের আংটি। পকেটমারের নাক ফেটে রক্ত বের হল ফিনকি দিয়ে। পাশের ফলের দোকানগুলোর উজ্জ্বল আলোয় সেই রক্ত মনে হল ঝিলিক দিয়ে উঠলো। তারপর যে ধরলো সেই ছেলেটা উপুর্যুপুরি কয়েকটা লাথি দিল বুকে। পকেটমারটি টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। মার চলছেই। এবার পুরোপুরি স্পষ্ট করে আমি দেখতে পেলাম পকেটমারের মুখ। দেখেই বুকটা ধুক করে উঠলো। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য মাথাটা জালানা দিয়ে বের করে দিলাম। এবং যা দেখলাম তাতে বুকটায় ভীষণ মোচড় অনুভব করলাম। মিঠু!! পকেটমারের দায়িত্ব নিয়েছে এখন ফুটপাতের মানুষ। অনেক মানুষ জমে গেছে! কিল-ঘুষি-লাথি চলছেই একের পর এক। এত মানুষ ডিঙ্গিয়ে নিচে নামা যেমন এখন সম্ভব না – তেমনি মিঠুর পক্ষ নিয়ে কিছু বলতে যাওয়াটাও এখন হয়তো বাস্তব সম্মত না। এসব চিন্তা করছি আর এমন সময় আমার বাস ছেড়ে দিল। বাস চলে যাচ্ছে আর আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছি রাস্তার উপর পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে আমার সহপাঠি মিঠু। রিকাসাওয়ালার ছেলে মিঠু। সেই মিঠু হাসলে যার গালে টোল পড়তো! সেই মিঠু যে ডিমের অসম ভাগ করে আমাকে বড় অংশটা দিয়ে বলতো- এইটা তুই নে...
নাহ্, মরেনি মিঠু। মরলে হয়তো স্থানীয় পেপারে দেখতে পেতাম। মরতে মরতে বেঁচে গেছে। মরতেও পারতো। অপরাধ- মোবাইল চুরি (ধরে নিচ্ছি)।
দুই
সাপ দেখলেই মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হল এটা কে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে। যদিও আমরা সকলেই জানি যে সাপ মানেই বিষাক্ত নয়। বেশিরভাগ সাপই খুবই নিরীহ। মানুষ দেখলেই তারা পালায়। কিন্তু অত কিছু চিন্তা করার সময় আমাদের কোথায়? মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত পেটাবো আমরা- পিটিয়েই যাব।
নোয়াখালীর কোম্পানিগঞ্জের চরগুলোতে কিছুদিনের মধ্যেই বেশ কিছু ডাকাতি হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি ডাকাতের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে সাভারের আমিন বাজারের অধিবাসীরা। তারা ঠিক করল এবার সবাই মিলে একযোগে-একসাথে ডাকাতির বিরুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও রুখে দাঁড়াবে। জনমের মত শিক্ষা দেবে। শান্তি ফিরিয়েই আনবে। সবাই প্রস্তুত। প্রয়োজন শুধু ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে একটা চিৎকারের। যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে বেরিয়ে আসবে। পিটিয়েই মেরেই ফেলবে।
মাঝরাতে অন্ধকারে সন্দেহ হতেই পারে। ধরে নিলাম গাঁজা খাচ্ছিল সাম্মাম, ইব্রাহিম, পলাশ, কান্ত, টিপু রা। ‘এই কে রে ওখানে!!’ পালানো ছাড়া কি উপায় ছিল ছেলেগুলোর? ছোটবেলায় এর গাছ ওর গাছ থেকে পেয়ারা আম কত কিছু চুরি করেছি। ‘এই কে রে’ শুনে দৌড়েছি প্রাণপন। ওরাও দৌড়েছে। কিংবা হতে পারে মাঝরাতে সম্পূর্ণ অপিরিচিত একটা এলাকায় এসে এমন কিছু যদি দেখে ফেলে যা তাদের দেখার কথা ছিলনা এবং এরপর ‘এই কে রে ওখানে’ চিৎকারে পালানো ছাড়া মাথায় কিছু আসবে না কারো। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি এর মাঝেই কেউ ‘ডাকাত ডাকাত’ বলে চিৎকার করে উঠবে। ফলাফল- তরতাজা কিছু ১৫—১৬ বছরের ৬জন ছেলে হারালো তাদের মা বাবা।
ডাকাত ধরা পড়েছে চরকাঁকড়ায়। সবাই হুড়হুড় করে ছুটে আসল। কিছু অতি উৎসাহীর হাতে ততক্ষণে চলে এসেছে লাঠি, গাছের গুঁড়ি, ইত্যাদি। মারতে মারতে রক্ত বের হচ্ছে মাথা দিয়ে মুখ দিয়ে- ভেংগে যাচ্ছে একে একে সবকটা হাঁড় মড়মড় করে। যে রক্ত ঐ ডাকাতের মুখ চোখ দিয়ে বের হচ্ছে ওটা হয়তো যারা মারছে তাদের রক্তের সাথে মিলে যায়- কি এসে যায় তাতে! মানুষ মেরে ফেলার মজাই আলাদা। আর যারা যারা তাকিয়ে দেখছে তারা সবাই দেখলো চেয়ে চেয়ে- একটা মানুষ, জলজ্যান্ত মানুষ আস্তে আস্তে ভেঙ্গে পড়ছে, অজ্ঞান হচ্ছে, কোঁকাচ্ছে, আস্তে আস্তে গলার স্বর মিঁইয়ে আসছে, একসময় গলা থেকে আর কোনো স্বরই বের হচ্ছেনা, কোনো নড়াচড়া নেই, নিঃশ্বাস নেই......কি চমৎকার দেখা গেলো!!
সবশেষ- মিলন। যাদের কাছে শত বিপদেও নিজেকে নিরাপদ ভাবা যায়- তাদের চোখের সামনেই আরেকটি শিশুকে পিটিয়ে হত্যা! ইট দিয়ে মাথায় আঘাত, এরপর লুটিয়ে পড়া, এরপর একই দৃশ্য!
তিন
মিঠু’রা কারা? এদের জন্ম কি আমাদের মায়েদের গর্ভে নয়? এরা কি কারো না কারো না কারো বন্ধু নয়? তারা যদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে সেই দায় কি আমরা বাবা, মা, প্রতিবেশি, বন্ধু, আত্মীয় স্বজন হিসেবে এড়াতে পারি? আমাদের যত্নে তো তাদের জীবন অন্যরকমও হতে পারতো! অপরাধ তো আমরাও করি। বুকে হাত দিয়ে কজন বলতে পারি এই সামান্য মোবাইল চুরির চেয়ে বড় কোনো অপরাধ আমরা কখনও করিনি কিংবা প্রতিনিয়ত করছিনা? আমরা আমাদেরকে কি শাস্তি দেব? মৃত্যুদন্ড??
একটা মৃত্যু হয়ে গেছে গণপিটুনিতে। মামলা হল। কি নামে? নিশ্চয় বেশ কিছু অজ্ঞাতনামার নামে! হয়তো (ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করিনা) ফুটেজ দেখে বিচারও করা হবে। কিন্তু যারা গোল করে দাঁড়িয়ে থেকে একটা জলজ্যান্ত মানুষের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তামাশা দেখেছেন তাদের কি অপরাধ নেই? তাদের বিচার কে করবে?
দিনের পর দিন গণপিটুনিতে একটার পর একটা হত্যা! চোর হোক, ডাকাত হোক, খুনী হোক যত বড় অপরাধই করুক, দেশের প্রচলিত আইনে সবকিছুরই বিচার আছে- বিচার আইনেই হবে। এভাবে নয়! ইট দিয়ে নয়, লাঠি দিয়ে নয়, গনপিটুনিতে নয়! গণপিটুনি হলে মানুষ মরবেই। ভুল হলে শোধরানোর কোন সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয় এ গণপিটুনিতে। দিন দিন বাড়তে থাকা এই সামাজিক অন্যায়ের ভুলের আর কত মাশুল আমরা গুনবো?
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের চিরাচরিত লোকভুলানো আশ্বাস- ‘অপরাধী যে-ই হোক তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে’! এমনকি মানবাধিকারের সোল এজেন্সি নিয়ে যারা বসে আছেন তাদেরও এ ব্যপারে কোন উচ্চবাচ্য লক্ষ্য করা যায়না।
আজ সাম্মাম, ইব্রাহিম, পলাশ, কান্ত, টিপু কিংবা মিলন...বিশ্বাস করুন, কাল যে আপনি নন তা কেউ বলতে পারবেনা। জানিনা কোনদিন সময় হবে- আমরা সকলে একসাথে বলে উঠবো ‘গণপিটুনি বন্ধ হোক।’ দরকার হলে আইন করে বন্ধ করা হোক গণপিটুনী। এর বিরুদ্ধে আসুন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি। মানুষকে সাপের চেয়ে কিছুটা তো ভিন্ন চোখে দেখি!
জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা
বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আত্মপোলব্ধি......
আত্মপোলব্ধি......
একটা বয়স পর্যন্ত অনিশ্চয়তার পর মানুষ তার জীবন সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই বয়সটা হল পঁয়ত্রিশ এর আশেপাশে। মানব জন্মের সবকিছু যে অর্থহীন এবং সস্তা সেটা বোঝার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি !
হঠাৎ ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হল । সাথে সাথে জিভে ..জল... চলে এল । তার জন্য একটু সময়ের প্রয়োজন, এই ফাঁকে আমার জীবন থেকে নেয়া ইলিশ মাছের কিছু স্মৃতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসছে এটা ১০০% নিশ্চিত। আমেরিকায় ইতিহাসে মহিলা প্রেসিডেন্ট হয়নি আর হবেও না।
আর এস এস সহ উগ্র হিন্দুদের লিখে দেওয়া কথা টুইট করেছে ট্রাম্প। হিন্দুদের ভোট-আর ইন্ডিয়ান লবিংএর জন্য ট্রাম্পের এই টুইট। যার সাথে সত্যতার কোন মিল নেই। ট্রাম্প আগেরবার ক্ষমতায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
ট্রাম্প জিতলে কঠোর মূল্য দিতে হবে ইউসুফ সরকারকে?
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে বাংলাদেশের মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে। ৫ তারিখের নির্বাচনে ট্রাম্প জিতলে আরেকবার বাংলাদেশের মিষ্টির দোকান খালি হবে।
আমি এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু না বললেও ডায়বেটিসের রুগী হিসেবে আমি সবসময়... ...বাকিটুকু পড়ুন