ক'দিন থেকেই পেটের মধ্যে টেনশনে টনটন করছিল। ২২ ঘন্টা ! একটানা এত লম্বা জার্নি আমি জীবনে কখনও করিনি, তার উপরে দুবার প্লেন বদলিয়ে যেতে হবে আফ্রিকার জাম্বিয়ার এক অজ পাড়াগাঁয়ে যার নাম লুম্মুয়ানা। জীবনে কখনও একা জার্নি করতে ভয় পাই নাই, একা একাই সব জায়গাতে গিয়ে অভ্যস্ত। এবার এত লম্বা জার্নি করব শুনে এমন কোন চেনা মানুষ নেই যে সাবধান করে দেয়নি। এমনকি আমার ল্যান্ডলেডি এস এম এস করে বলল "Never talk to any stranger, never eat from any strangere ....bla ....bla ...bla......." তো সবার সাবধানি কথায় আমার ভয়হীন মনে ভয় ঢুকে গেল! ভয়ের চোটে পেটের ভেতর ইকুবিকু করতে থাকল যাবার আগের ক'দিন থেকে। যাবার দিন সকালে Unexpected surprise from a friend আমার মনটাকে ভাল করে দিল! সাথে উধাও হয়ে গেল মনের সব ভয় আর ধুকপুকানি।
বার বার চেক করলাম কিছু ফেলে যাচ্ছি কিনা। ৫ ঘন্টা পরে পার্থ এয়ারপোর্ট ল্যান্ড করে শীতে হু হু করে কেঁপে উঠলাম, আর টের পেলাম আমার ওভারকোটের বেল্ট টা ব্রিসবেন এয়ারপোর্টে স্ক্যনিং সেকশনে ফেলে এসেছি । আমার খুবই প্রিয় একটা ওভেরকোট । মনে হলো এশা'র কথা, এশা এয়ারপোর্টে কাজ করে তাই ওকে ফোন দিয়ে বললাম একটু খোজ করতে এয়ারপোর্টে ফেলে এলে ওদের ঠিক রেখে দেবার কথা।
মেজাজ টাই খারাপ হয়ে গেল যাত্রার শুরুতে এমন একটা ঘাপলা হওয়ায় । ৪ ঘন্টার ট্রানজিট আমার পার্থে। টার্মিনাল চেঞ্জ করে সাউথ আফ্রিকান এয়ারলাইন্স এর গেটে পৌছাতেই মনে হলো Right! I am finally going to Africa! আমার সামনে পেছনে ডাইনে বায়ে কালোর ছড়াছরি....কিছুক্ষনের ভেতর নিজেকে আর তেমন কাল মনে হলো না খুব একটা, বরং নিজের কালো চামড়া কে একটু একটু ফর্সা ফর্সা মনে হতে থাকল ।
একবার খুব ছোটবেলায়, আমার বয়স ৫/৬ হবে হয়ত, তখন আমরা হল্যান্ড থাকি, ডেল্ফট এর এক সুপারমার্কেটে এক আফ্রিকান কালো দম্পতিকে শেল্ফ থেকে প্রডাক্ট চুরি করতে দেখেছিলাম, দেখে ভিষন ভয় পেয়েছিলাম। কারন আমাকে শেখানো হয়েছিল যারা চুরি করে বা ডাকাতি করে বা এধরনের খারাপ কাজ করে তারা খুবই ভয়ঙ্কর ধরনের খারাপ মানুষ। আমি সেই থেকে ভাবতাম চোররা খুবই ভয়ঙ্কর ধরনের জিনিস....পেলেই ধরে খেয়ে ফেলবে। তো সেদিন থেকে আফ্রিকানদের আমি জমের মত ভয় পেতাম। তখন আমাদের পাশের বাড়ির নেইবার ছিল আফ্রিকান, ওরা আমাকে "উতুপুতু বাচ্চাটা" বলে যখন আদর করে কোলে নিতে আসত আমি ভয়ের চোটে কেঁদে ফেলতাম। এই ভয় আমার আরো গভীর হয়েছিল বড় হবার পরে সিংগাপুরে যখন এক নাইজেরিয়ান ছেলে আমাকে ফলো করতে করতে প্রিন্সিপালের চোখের সামনে দিয়ে আমার কলেজের ক্লাসের ভেতরে ঢুকে পরেছিল। মনে হয় টিকটিকি দেখেও আমি ভয়ে এত জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদি নাই। এর পরে ক্লিফের এক আফ্রিকান বন্ধুর সাথে পরিচয় হবার পরে আস্তে আস্তে আমার ভয় কেটেছিল...... এখন আর ভয় পাইনা ওদের । আমি মোটেও রেইসিস্ট নই তবে আমার ছোট বেলার কিছু স্মৃতি আর এক্সপেরিয়েন্স আমার ভেতর জমে বসে আছে ভয় হয়ে। এরকম আরো কিছু কিছু ব্যপার আছে আমার যাতে আমি আজও রিএক্ট করি।
পার্থ থেকে লম্বা ১৫ ঘন্টার জার্নি শুরু করলাম। প্লেনে আমার সহজে ঘুম আসে না তবু ঘুমানোর চেষ্টা চালালাম সাধ্য মত..... এদিক ওদিক নানান কসরত করে ঘুমাতে না পেরে কয়েকটা মুভি দেখে ফেললাম আর ৫/৬ বার সারা প্লেন চক্কর দিয়ে এলাম। আমার পাশের যাত্রি একজন ব্ল্যাক। তিনি চাদর মুড়ি দিয়ে সেই যে ঘুম দিলেন একেবারে শুধু খাবারের সময় গুলোতে উঠলেন। স্বপ্ন'র বদ দোয়া কাজে লাগে নাই ....খিক ব্রিসবেন থেকে পার্থ পর্যন্ত তো আরো মজা ছিল পাশের সিট টা তো খালিই ছিল ....মনে মনে স্বপ্ন কে ভেঙ্চি কেটে বললাম শকুনের দোয়ায় গরু মরে নাই !!
১৫ ঘন্টা পরে জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টে যখন ল্যান্ড করলাম আমার পা ফুলে ঢোল আর হাটুর ব্যথায় কু কু করছি। ইমিগ্রেশনের অফিসার আমার পাসপোর্ট নিয়ে নানান কায়দায় সেটাকে এনট্রি দেবার ফাকে গল্প জুরে দিলেন আমার সাথে....এই অভিঙ্গতা আমার প্রায়ই হয় সব ইমিগ্রেশনেই, কেন জানি না উনারা আমার সাথে গাল গল্প করতে খুবই আনন্দ পান। আবার আমাকে জানিয়েও দিলেন যে নেক্সট টাইম আমি এখান দিয়ে গেলে তিনি টের পাবেন । ব্রেকফাস্ট করতে একটা ফুডকোর্টে গেলাম। যে মেয়েটা ওখানে খাবার দেয় সে আমাকে দেখে খুব মজা পেয়ে সেও গল্প জুরে দিল খাবার দেবার ফাঁকে। এই মানুষ গুলো আমাকে অভিভুত করে দিল তাদের ব্যবহারে! They made me feel so special!! কথায় কথায় জানতে পারলাম ওরা কখনও বাংলাদেশি কাউকে দেখে নাই তাই আমাকে দেখে প্রথম প্রশ্ন ওদের মনে আমি কোন গ্রহ থেকে আবির্ভুত হলাম। সাদা চামড়া আর ইন্ডিয়ান দেখে ওরা অভ্যস্ত। আমাকে ওদের ইন্ডিয়ান বলে মনে হয় নাই আবার আমি সাদা চামড়ারও নই, তবে আমি কি???
৪ ঘন্টার ট্রানজিটে জোহানেসবার্গ এয়ারপোর্টের দোকান গুলোতে ঘুরে ঘুরে পার করতে থাকলাম। অসাধারন সব কপার দিয়ে বানানো জিনিস দেখলাম। জুয়েলারি থেকে শুরু করে চামচ পর্যন্ত। ওদের প্রচুর কপারের খনি তাই কপার খুব সস্তা আর এভেইলএবল ওখানে। কাঠের তৈরি চমৎকার সব ডেকোরেশন পিস থেকে শুরু করে প্রচুর জুয়েলারি দেখলাম আর তার সাথে এ্যনিমেলের হাড়ের তৈরি জিনিস।
এর পরের প্লেনটা তে উঠবার সময় হয়ে গেল। ওরা আমাদের একটা বাসে করে প্লেনের কাছে নিয়ে গেল। ছোট বড় অনেক প্লেন দেখছি টারম্যাক এ আর ভাবছি এটাই মনে হয় আমাদের হবে....কিন্তু না সব পেরিয়ে একটা ছোট আর একটা খুবই ছোট প্লেনের মাঝখানে বাসটা দাড়াল। আমি ভাবলাম ছোট প্লেনটাতে নিশ্চই আমরা যাচ্ছি।
এই প্লেনে চড়েছিলাম।
আমার ধারনা কে পুরো উলটে দিয়ে আমাদের যখন খুবই ছোট প্লেনটাতে উঠতে বলা হলো আমি ভয়ানক ভাবে ভয় পেলাম। এত ছোট প্লেনে আমি আগে কখনও উঠি নাই.....হাহ্ তখনও জানিনা ভবিষ্যত আমার ভাগ্যে আরো ছোট প্লেনের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। দুই ঘন্টার পথ নিমেষেই পেরিয়ে জাম্বিয়ার এনডোলা শহরের এয়ারপোর্টে পৌছালাম, ল্যন্ড করবার আগে আকাশ থেকে তুললাম এনডোলা শহরের কিছু ছবি।
এনডোলা এয়ারপোর্ট টারম্যাক
প্লেন থেকে তোলা এনডোলা স্টেডিয়াম
প্লেন থেকে তোলা আফ্রিকা
প্লেন থেকে তোলা আফ্রিকা
ইমিগ্রেশন এ লম্বা সময় লাগলো। এখানকার অফিসার রা "চোখ থাকিতেও অন্ধ" ভাবে কাজ করেন। আমার পাসপোর্ট দেখে খুটে খুটে প্রতিটা পাতা খুজেও আমার নাম কোথাও পেলেন না। আমি তাকে আমার নামের পাতা বের করে দিতেই তিনি আবার পাতার পর পাতা উল্টিয়ে আমাকে জিঙ্গেস করলেন "তোমার নাম কোথায়?" এভাবে এক্সপায়ারিডেট থেকে শুরু করে সব ব্যপার গুলোতেই একই অবস্থা চলল। কারন আমি যখন উনাকে সাহায্য করছি পাতাটা খুজে দিতে তখন উনি অন্য কোনদিকে তাকাচ্ছেন আশেপাশের দৃশ্য অবলোকন করছেন....আমি ক্লান্তি, বিরক্তি ও হতাশার শেষ প্রান্তে তখন......। যাই হোক শেষ পর্যন্ত যখন বাইরে এলাম দুপুরের মিস্টি রোদ আমার গায়ে খুব একটা আরামের ছোয়া দিল। ক্লিফ আর তার বন্ধু আমাকে নিতে এসেছিল। শুনলাম এখন আমাদের ৬ ঘন্টার ড্রাইভ করে তবে গন্তব্যে পৌছাতে হবে। ২২ ঘন্টা আকাশে আর ৮ ঘন্টার মত ট্রানজিটের ঝামেলার পরে এখন ৬ ঘন্টা ড্রাইভ হা হা হা মনে আনন্দে নৃত্য করবার উপক্রম আমার আরকি । ক্লিফ কাজ করছে জাম্বিয়ার লুম্মুয়ানা কপার মাইন এ, সেখানেই যেতে হবে। এত ঝামেলার পরেও খুবই এক্সাইটেড ফিল করছিলাম এটা ভেবে যে আমি আফ্রিকাতে!!! "ওয়াও" করার মত ব্যপার এটা আমার কাছে।
এনডোলা থকে লুম্মুয়ানা যাবার পথে গাড়ি থেকে থেকে তোলা পথের ছবি
চোখে পরে মাইলের পর মাইল শুধু পোড়া ঘাস আর ছারা ছারা জঙ্গল
এনডোলা শহরটা খুব একটা বড় না। আমাদের দেশের যে কোন ছোট মফস্বল শহরের মতন। প্রথমেই যেটা চোখে পরল তা হলো লাল মাটি আর কালো মানুষ। লাল মাটির লাল ধুলো চারিদিকে উড়ছে আর নানান রং এর বাহার সেই কালো মানুষদের গায়ে। পথে যেতে যেতে গাড়ি থেকে কিছু ছবি তুললাম সেই লাল মাটি আর কালো মানুষদের।
ওটা একটা কপার মাইনের শেষ প্রান্ত
পথে কিছু দুর পর পর ছারাছারা গ্রাম
লাল মাটির কাঁচা পথ
গ্রামের মার্কেটে টমেটো আর সব্জি বিক্রি করছে লোকাল মানুষরা। এরা টমেটো খুব বেশি খায়
পথে কয়েকটা মাইন দেখলাম, এর পর শহর পেরোতেই শুরু হলো জংগল। যতদুর চোখ যায় প্রান্তরের পর প্রান্ত শুধু জংগল আর জংল। আমি এনডোলায় ল্যান্ড করেছিলাম দুপুর ১ টার দিকে এর পরের দু'ঘন্টা এক্সাইটমেন্ট নিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখতে চলে গেল, ৩ টার দিকে আমাকে জেট ল্যগ এ পেলো। হাত পা মাথা কাপিয়ে আমার ঘুম এল। আমি গাড়ির ভেতর লম্বা হয়ে শুয়ে দিলাম ঘুম।
লুম্মুয়ানা মাইন সাইডে পৌছাতে রাত হয়ে গেল
ঘুম ভেঙ্গে জঙ্গলে পূর্নিমা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম
একেবারে ঘুম ভাংল মাইনের বাইরের গেটে যখন পৌছুলাম। উঠে দেখি অসাধারন জোছনা! আকাশ জুরে থালার মত এত্ত বড় লালচে চাঁদ! গভির গহীন জংগলের লম্বা লম্বা গাছের উপর বিশাল চাঁদ আর তার পাগল করা আলো! অসাধারন ভাল লাগায় গা ছম ছম করতে থাকে আমার। ইচ্ছে করে গা ছমছম করা জোছনায় গা ভাসিয়ে আমি উরাল দেই....।
গা কাপিয়ে শীত পরেছে তখন। দিনের বেলায় গরম ছিল সূর্য ডোবার সাথে সাথে কঠিন ঠান্ডা পরল। আরো ২০মিনিট ড্রাইভ করে আমরা গন্তব্যে পৌছালাম। কেমন সব ঠান্ডা ঠান্ডা চারিদিকে....। গাড়ি থেকে নামতেই সামনে একটা টিনের চালের টিনের ঘর। সামনে লাল মাটির পথ আর ছোট্ট উঠোন টাইপের কিছু একটা। ক্লান্তিতে আর ঠান্ডায় আর কিছু দেখবার মন ছিল না। সোজা শাওয়ার নিয়ে বিছানায় ...........।
চলবে............।
সব ছবি গুলোই গাড়ি থকে চলন্ত অবস্থায় তোলা তাই ছবি গুলো খুব একটা ভাল আসেনাই