নিউ ইয়ারের পর সোফির আমাদের এখানে আসবার কথা অনেক আগে থেকেই। প্লান মতই সব ঠিক ঠাক। ওর আসবার দিন সকাল থেকেও অঝোর ধারে বৃষ্টি - নতুন কোন ব্যপার নয়, এখানে আসবার পর থেকে পুরো মাসটাই প্রতিদিন আকাশ অঝোর ধারে ঝরেছে। এমন কি আমাদের আশে পাশের কিছু কিছু যায়গায় ছোট খাটো বন্যা পর্যন্ত হয়েছে। যে টুউম্বা গেলেম গত সপ্তাহে সেখানেও নাকি বন্যা হচ্ছে বৃষ্টির পানি উপচে। কি অবাক ব্যপার।
সোফির আসবার দিন সকালে হঠাৎ ক্লিফ অফিস থেকে ফোন করে বললো ওদের শহর ইভ্যাকুয়েট করতে বলেছে তাই সে অন দ্যা ওয়ে টু হোম। লাইন কেটে গেল কথা ঠিক মত শেষ করবার আগেই ভাবলাম নিশ্চই জোক করছে। আমার যেহেতু আগের দিন ফার্নিচার বাসায় এসে পৌচেছে সেহেতু বাসা গোছানো নিয়ে ব্যাস্ত ছিলাম।
ভাবলাম ক্লিফ বাড়ি আসলেই সব জানা যাবে। কাজের ফাঁকে কখন যে ঘন্টা পেরিয়ে গেছে বুঝিনি। হঠাৎ টনক নড়ল আরে ক্লিফ বলল বাসায় আসছে এখন ঘন্টা দেড় হয়ে গেছে ঘটনা কি? বাইরে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি!! সাগর ফুসে ফুসে উঠছে। ফোন দিলাম ক্লিফ কে লাইন পাওয়া গেল না, ফোন দিলাম ওর অফিসে কেউ ফোন ধরে না। করি কি। পরে ওর এক কলিগকে ফোন দিয়ে জানলাম টুউম্বা ভেসে গিয়ে বৃষ্টির পানি বন্যা হয়ে ব্রিসবেন সিটির দিকে আসছে আর ঘন্টা খানেকের মদ্ধেই ব্রিসবেন সিটি বন্যায় ভেসে যাবে। তাই সবাই শহর ছেড়ে বাসার পথে। টেনশনে তখন আমার মাথা খারাপ অবস্থা। ক্লিফ এখনও বাড়ি ফেরেনি শুনে উনি বলল আরেক ঘন্টা অপেক্ষা কর এর পর যদি না আসে তখন এ্যাকশন নেয়া হবে।
টিভি খুলে বন্যার ক্রমাগত নিউজ দেখা শুরু করলাম। নাআমিকে ফোন দিলাম বলবার জন্য যে যদি ওর বাড়িতে পানি আসে তাহলে যেন এখানে চলে আসে কিন্তু বলা হলো না। সে বাইরে বাসের ও মেয়ের অপেক্ষায় কিছুই শুনতে পাচ্ছে না আমার কথা শব্দে। যাই হোক এস এম এস করে দিলাম পরে। ক্লিফ বাড়ি পৌছালো ঘন্টা দেড়েক পরে। পথে জ্যাম ছিল বন্যার কারনে। যাক বাবা তাও তো এলো। বলল অফিস অনির্দিষ্ট কালের জন্য ক্লোজেড। বন্যা পরিস্থিতি বুঝে জানানো হবে কবে খুলবে। তবে নেক্সট উইকের আগে নয়।
ফ্লাই করবার আগে সোফি ফোন দিয়ে জিঙ্গেস করল এমন বন্যা সে আসবে কিনা। অভয় দিয়ে বললাম কোন ভয় নেই আমরা কোস্টে থাকি, বন্যা এখানে আসবেনা। আমাদের আস্বাস শুনে সে নাচতে নাচতে প্লেনে উঠে পরল
সোফিকে এয়ার পোর্টে আনতে গিয়ে পথে কয়েক যায়গায় পানি ওঠা দেখলাম। ভয় হলো মনে মেয়েটাকে তো আসতে বললাম এর পরে বন্যায় যদি ও আটকে যায় এখানে কি হবে তখন? এক দিন পরে ওর চলে যাবার কথা।
সোফির প্লেন ঘন্টা দেড়েক দেরিতে ল্যান্ড করল। এর মাঝে হোদোল রাজার উদ্বিগ্ন গলার ফোন পেলাম। আমরা কেমন আছি বন্যায় তা জানবার জন্য। ভাবি হায়রে আমরাতো ভাল আছি আর ভাল হয়তো থাকবো কিন্তু এত গুলো পরিবার যাদের বাড়ি অলরেডি পানিতে ভেসে গেছে বা যাবে বলে জানানো হয়েছে তাদের কি হবে। ওকে আস্বস্ত করে বললাম আমারা ভাল আছি ভয় নেই কোন কারন আমাদের বাড়ি সাগর পারে। নদির বন্যায় আমদের কিছু হবে না।
অনেক দিন পরে সোফির সাথে দেখা। ওকে বাড়ি আনা মাত্র সে কি যে খুশি হয়ে গেল যায়গাটা দেখে আর ওর খুশির সাথে সাথে সুর্যি মামাও যেন খুশি হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ালো।
ডিনার সেরে আমরা তিনজন চমৎকার একটা সুর্যাস্ত দেখলাম আমাদের ব্যালকনিতে বসে।
সন্ধ্যার পরে বন্যার অবস্থা অনেক খারাপ হয়ে গেল। শহর ডুবছে। মানুষ দলে দলে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে বন্যা ত্রান সেন্টারে। অনেকই নিখোজ, অনেকই মারা গেছেন পানিতে ভেসে গিয়ে। এর মাঝ একটা ঘটনা মনে খুব নাড়া দিল। এক মা তাঁার দুই ছেলে কে স্কুল থেকে নিয়ে বেড়ি ফিরছিলেন ড্রাইভ করে। পথে বন্যার স্রোতে পরলেন গাড়ি সহ। স্রোত তিনজনকে সহ গাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে চলল উল্কার গতিতে। মাঝ পথে ক'জন গাড়িটাকে আটকে ওদের বাঁচার চেষ্টা করলেন। প্রথমে বড় ছেলে (১৩/১৪ বছর) কে বের করে আনতে চাইলে সে বলল আমার ছোট ভাই কে আগে বাঁচাও। ছোট ছেলেটা কে গাড়ি থেকে বের করে আনতে আনতে আর সাময় পেলনা ওরা মা আর বড় ছেলেটাকে বের করে আনবার। স্রোতের প্রচন্ড টানে মা আর ছেলে ভেসে চলে গেল অথই তলে। ওদের আর বাঁচানো গেল না। এত গুলো শক্ত সমর্থ মানুষ কিছুই করতে পারলনা ঐ সর্বগ্রাসী স্রোতের শক্তির সাথে।
এভাবেই টিভির বন্যার নিউজ দেখে আমাদের সময় কাটল সে রাতে, মনে কষ্টের দানা বাধা শিশির নিয়ে। পরদিন ছিল চমৎকার সুর্য ওঠা দিন। তাই বলে বন্যা থেমে নেই। শহরটা গ্রাস করে সাবার্বের দিকে ধাওয়া করেছে।
আমরা বের হলাম সোফিকে নিয়ে আমাদের লালুভুলু তে চেপে । স্কার্বার্গ মার্গেটে গেলাম তাজা তাজা মাছ কিনতে সোফির জন্য, প্রায় দু বছর পরে দেখা ওর সাথে। মাছ কিনে পাশেই আমারা ব্রকফাস্ট করলাম ফিশ এন্ড চিপস দিয়ে
জায়গাটা চমৎকার। সাগর পারে সাগুরে মাছের দোকান। ওখানেই মাছ ধরবার ট্রলার আর বোট গুলো। মাছ ধরে ধরে তুলেই সেই তাজা মাছ বিক্রি করছে। আমার সি ফিশ খুবই প্রিয়। আর মাছের দোকানেই ফিশ এন্ড চিপস বিক্রি করছে, দোকানের পাশেই আবার বসবার জায়গা খাবার জন্য।
ফিশ এন্ড চিপস খেতে বসতে দলে দলে পাখি এসে আমদের ঘিরে ধরলো
যেমন করে কাক আর মুরগি আশে পাশে হাটা হাটি করে তেমন করে বক আর গাংচিলেরা একটুকরো মাছের আশায় আমাদের ঘিরে ধরল।
ফেরার পথে নাড্জি বীচে নিয়ে গেলাম সোফিকে। ওখানে দেখলাম এখানকার রাবিশ ডিসপোজাল ডিপো। এখানে মানুষ জন যেখানে সেখান ইচ্ছে করলেই রাবিশ ডিসপোজ করতে পারে না। ডিসপোজাল সেন্টারে গিয়ে ডিসপোজ করতে হয়। আর ডিসপোজ করতে নরমাল জিনিসের জন্য $৮ প্রতি ডিসপোজালে। জানলাম বন্যার কারনে ফ্রি ডিসপোজাল দেয়া হচ্ছে কিছু দিনের জন্য। খবরটা নিয়ে রাখলাম কারন আমাদের ফার্নিচার আনপ্যক করলেই অনেক কার্টুন বের হবে ডিসপোজ করার জন্য আর তার সাথে রাবিশ জিনিস পত্র।
বাড়ি ফিরে আবারও খরব দেখা আর চোখের সামনে ব্রিসবেন শহর টা কে তলিয়া যেতে দেখলাম। যেখানে দুদিন আগেই এ ঘাট থাকে ওঘাটে পার হয়ে ছিলাম রিভার ট্যাক্সিতে করে আজ সেই ঘাটের কোন চিন্হ নেই ।
বিভিন্ন সাবার্বে মানুষ জন নৌকায় চড়ে চলছে। হাজার হাজার মানুষের বাড়ি ঘর দরজা জানালা স্রোতে ভেসে গেছে। ডুবে গেছে দোতলা তিন তলা বাড়ি গুলো পর্যন্ত।
সন্ধ্যায় ডিনার বানালাম তিনজনের জন্য সকালে কেনা স্মাসল্স এজ সার্টার, স্ক্ালপ স্যালাড,প্রন, অস্টে্রলিয়ান বাগ আর হয়াইট ব্যইট দিয়ে।
ডিনারের পরে তিন জন ফিশিং গিয়ার নিয়ে আমাদের যেটিতে গিয়ে বসলাম মাছ ধরতে। আমাদের ব্যইট কেনার কথা মনে ছিল না তাই ক্লিফের রাবার প্রন ব্যইট দিয়ে মাছ ধরবার চেষ্টা চালালাম আমরা। সোফিতো হেসেই খুন রাবার ব্যইট দেখে। ঘন্টা দুই জেটিতে কাটিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বলাই বাহুল্য শুন্য হাতে
ফোন দিলাম নাআমিকে কিন্তু পাওয়া গেল না লাইন। পরে জেনেছি ওদের পাওয়ার আপ ডাউন করার ফোনে চার্জ দিতে পারেন নি বলে চার্জ ছিল না। ক্লিফের জি এম - গ্রায়াম ওদের এলাকায় থাকেন। উনাকে ফোন দিলাম ঐ এলাকার অবস্থা জানবার জন্য নাআমিকে না পেয়ে চিন্তায়। উনি বললেন উনাদের এলাকা সেইফ। কোন সমস্যা হবার সম্ভবনা নেই। ওটা শুনে ভাল লাগলো। স্বস্তি পেলাম জেনে নাআমি মেয়ে সহ ভাল থাকবেন।
দু'দিন আগেই নাআমির সাথে দেখা হলো। ফোনে কথা হবার পরে ঠিকানা নিয়ে ওর বাড়ি গেছিলাম আমি আর ক্লিফ। যেমন মিষ্টি মা তেমন মিষ্টি মেয়ে।
ওদের বাড়ি তে যাওয়া মাত্রই হাজার হাজার খাবারে টেবিল ভড়িয়ে ফেলল। আমার মনে পরল বাংগালী আতিথয়েতার কথা। চমৎকার তার ছোট্ট দোতলা বাগানে ঘেড়া বাড়ি। অনেক গল্প হলো। অনেক কথা হলো। অবশ্যই এত সব খাবার খেতে খেতে। চমৎকার রাধুনিও সে। ভাল কাটল ওদের ওখানে সময়টা।
পরদিন সোফি চলে গেল আর আমাদের ঘর গোছানো শুরু হলো। আমাদের ফার্নিচার সোফি আসবার আগের দিন, বন্যার আগের দিন পৌচেছে। কিভাগ্য আমাদের। একদিন দেরি হলেই আমাদের ফার্নিচারের কন্টেইনার টা পানির তলে চলে যেত ফার্নিচার সহ। টিভিতে দেখলাম যেখানে পোর্ট থেকে আনা কন্টেইনার গুলো রাখা হয় সে যায়গাটা কন্টেইনার সহ পানির নিচে।
বন্যার পানি নামা শুরু করেছে গত তিন দিন হলে। শহরের সব ভেসে যাওয়া গাছপালা আর ঘড় বাড়ি গুলো আমাদের বে তে এসে ঠেকছে। সোফা, চেয়ার, টেবিল, জিম ইকুইপমেন্ট সব আসছেতো আসছেই। এখনও কয়েকজন মানুষ নিখোজ। কোনদিন যে আস্ত মানুষ ভেসে আসে সেই আশংকায় এই এলাকা বাসি।
পরিক্কারের কাজে সবাই নেমে পড়েছে পরিবার পরিজন সহ। আমারাও আমাদের বে পরিস্কারের গেলাম। সবাই চেনা নেই জানা নেই একে অন্যকে সাহায্য করেই যাচ্ছে নির্দ্বধায়। ভাল লাগলো মানুষে মানুষে এই বন্ধন দেখে। মনে হলো এমনইতো হবার কথা এমনই তো হওয়া উচিৎ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১১ সকাল ১০:৪৭