আমাকে কেউ রান্না শেখায়নি কখনও । পেটে খিদের গুতানি খেয়ে আর মা/ফুফুদের রান্না জিভে লেগে থাকায় ভাল খাবারে স্বাদের জ্বালা যন্ত্রনায় রান্না করতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই থেকে আজ ও আমার রান্নার এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছি। কখনও বাংগালী তো কখনও ইটালিয়ান বা কখনও টার্কিশ, কখনও বা ওয়েস্টর্ান। আর রান্নাটাকেও আনন্দের মনে হয় যখন দেখি আমার রান্না খেয়ে কেউ খুব মজা পাচ্ছে। তাই রান্না করতে আমার ভালই লাগে। নতুন নতুন রেসিপি ও বিভিন্ন দেশের খাবার রান্না করতে গিয়ে এক ধরনের ক্রিয়েশনের আনন্দ পাই আমি ।
সারা জীবন কাজে ব্যস্ত থাকায় রান্না করতে পছন্দ করলেও এই ব্যাপারটাতে খুব বেশি সময় দিতে পারিনা। তাই আমার সব রান্নাই ঝট পট ও কম সময়ে বানানো। আর সব সময়ই খেয়াল রেখেছি কি করলে আরো কম সময়ে রান্নার ব্যাপারটা শেষ করা যায় ও খাবারটা স্বাথ্যসম্মতও হয়।
আর দশজন বাংগালী মেয়ের মতন রুপ চর্চার সময়ও জীবনে খুবই কম পেয়েছি। তাই আমার রুপচর্চার ব্যাপারটাও অনেক ঝট পট ও ছোট করে আনতে হয়েছে সময়ের অভাবে। তাই বলে তো ব্যাপারটা একেবারেই হেলায় ফেলে রাখতেও পারিনা । আমি বিশ্বাস করি - যে নিজের যত্ন নিতে না পারে সে অন্যের যত্নও নিতে পারবে না ঠিক মত। যেমন আমার বিশ্বাস - নিজেকে ভাল না বাসতে শিখলে অন্যকে ভালবাসা যায় না। আবার "প্রথমে দর্শনধারী পরে গুন বিচারি" - এরকম একটা কথা বাংলায় ও অন্যান্য ভাষায় প্রচলিতও আছে। বা "যে রাঁধতে জানে সে চুলও বাঁধতে জানে" - এটাতেও আমার বিশ্বাস। আমি হয়ত একটু সেকেলে ধাঁচের মানুষ। এখনও ওষুধের উপর আস্থা না রেখে লতা পাতা আর হারবাল বা ভেজষ জিনিস দিয়ে জীবন চালাতে ভালবাসি।
আমি যে কোন অসুখের ট্রিটমেন্ট প্রথমে হারবাল জিনিস দিয়ে সারাবার চেষ্টা করি, তার পরে না হলে যাই ডাক্তরের কাছে।
যাই হোক সময়ের অভাবেই আমি ভাবতে শুরু করলাম কি করে এই রুপ চর্চা আর রান্নাটাকে এক করা যায়। রান্নাতো করা হয়েই যায় খিদের পাল্লায় পড়লে, কিন্তু রুপ চর্চা?
যখনই যেদেশে গিয়েছি আমি সে দেশের বৃদ্ধাদের সাথে কথা বলে বের করবার চেষ্টা করেছি তাদের রুপের মূল রহস্য কি বা তাদের রুপচর্চা তারা কিভাবে করতেন। বাংলাদেশে দেখেছি আমার মা/ফুফুরা সবাই মুখে কঁাচা হলুদ, ডাল, দুধের, স্বর এসব লাগাতেন। এখন এসব করার সময় কোথায় পাই ? অন্য দেশে দেখলাম ওরা কাঁচা হলুদ, আদা, তেতুল ও পানের মিশ্রন দিয়ে চা বানিয়ে খায়। তো এমন তথ্য সংগ্রহ করা শুরু করলাম আর সময় পেলেই ভেজিটেব্ল ও অন্যান্য হার্বের গুনাগুন খুজে বের করে পরা শুরু করলাম। আর তা থেকে আমার রান্নার রেসিপি বানান শুরু হলো। স্কিন সুন্দর করবার জন্য মুখে হাতে পায়ে নানান জিনিস লাগানোর সময় টুকু বাচিয়ে সোজা ওগুলোই খাওয়া শুরু করলাম। কারন আমার বিশ্বাস উপরটা সুন্দর করতে হলে তা ভেতর থেকে সুন্দর করতে হয় সে সব ব্যপারেই। কারো মন ও হৃদয়টা সুন্দর হলে সে বাইরেরও সুন্দর হয় আর তার স্বভাব ও সুন্দর হয় সে কাজেও ভাল হয় ।
তো আমার রান্নার রেসিপি টা রুপ চর্চার উপর ভিত্তি করে তৈরী। আজ আমার মুরগী রান্নার রেসিপিটা আপনাদের সাথে শেয়ার করব। আপনাদের আমার রান্না ঘরে নিয়ে যাই চলুন।
আমি আমার রান্নার জায়গাটা পরিপাটি ও পরিষ্কার রাখতে পছন্দ করি এতে রান্নায় সুবিধে হয় ।
রান্নায় সব সময় এই উপকরন গুলো ব্যাবহার করি।
১। কাঁচা হলুদ পেষ্ট, ২। আদা/রসুন পেষ্ট, ৩। ফ্যানেল সিড (মৌরি), ৪। কিউমিন সিড (আস্ত জিরা), ৫। সরিষার তেল বা অলিভ অয়েল, ৬। কাল জিড়া, ৭। সড়ষে, ৮। লেবুর রস, ৯। কাঁচা মরিচ খুব ঝাল টা, ১০। শুকনা মরিচ পেষ্ট, ১১। তেতুল, ১২। টমেটো ১৩। মাওয়া..... এরকম সব জিনিস।
মাসে একবার প্রচুর কাঁচা হলুদ, আদা ও রসুন কিনে এনে ছুটির দিনে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে কাঁচের বয়োমে ভরে ফ্রিজে রেখে দেই। একটা বোতলে কাঁচা হলুদ পেষ্ট, অন্য বোতোলে আদা/রসুন পেষ্ট।
আমি কোন কিছু মেপে রান্না করিনা । সব কিছুই আন্দাজে দেই ।
তো মুরগি রান্নার জন্য আমি সম্ভবত ১ কেজি মুরগি পরিষ্কার করে ছাকনির উপর রেখে দেই এক্সট্রা বাইরের পানিটা ড্রেইন হয়ে যাবার জন্য। এর পরে মুরগির মাংসটাকে ছোট ছোট কেটে কেটে নিন - এতে তাড়াতারি সিদ্ধ হবে আবার ভেতরে মসলাটাও যাবে।
অন্য দিকে দুটো বড় পিয়াজ কুচিয়ে নিয়ে আর ১৫/১৬ কোয়া রসুন আস্ত ছিলকা ছারা । চুলায় প্যান দিয়ে সরিষা বা অলিভ অয়েল বা যে কোন ভেগিটেব্ল তেল দিন পরিমান ও আপনার স্বাদ মত। রসুন কোয়া গুলো ছেড়ে দিন ৩০ সেকেন্ড পরে পিয়াজ কুচি দিয়ে একটু ভাজুন। পিয়াজ নেতিয়ে আসলে ফ্যানেল সিড বা মৌরি দিন ২ চা চামচ পরিমান আর আস্ত জিরা দিন ২.৫ চা চামচ পরিমান। একটু বেশি হলে কিছু যায় আসে না । এবার লবন দিন পরিমান মত। পিয়াজে খুবই হালকা লালচে ভাব এলেই ( পিয়াজ খুব ব্রাউন করে ফেলবেন না এর ফুড ভ্যালু চলে যাবে) ওতে আদা/রসুন বাটা ২ টেবিল চামচ পরিমান, কঁাচা হলুদ বাটা ১.৫ টেবিল চামচ (বা পরিমান মত বেশিও দিতে পারেন একটু এতে কোন অসুবিধে নেই।) দিয়ে নাড়ুন। অল্প করে শুকনা মরিচের পেষ্ট দিন রং ও গন্ধ হবার জন্য। ঝাল হবার জন্য খুব ঝাল অলা কাঁচা মরিচ আপনার স্বাদ মতন দিন। এর পরে দিন গরম মসল্লা - গোল মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, তেজ পাতা। মসলা গুলো পুরে ওঠার আগেই অল্প করে পানি দিন।
মসলা ভাল করে কষিয়ে নিন একটুক্ষন। এর পরে কাটা মুরগিগুলো ওর ভেতর ছেড়ে দিন। একটু কষিয়ে ঢাকনা দিয়ে দিন আর হাল্কা আঁচে দিয়ে রাখুন। একটুপরে দেখবেন মুরগি থেকেই পানি বেড়িয়ে এসেছে। সেই পানিতেই অনেক সময় মাংস সিদ্ধ হয়ে যায়। আর না হলে, পানিটা শুকিয়ে এলে মাংসটাকে আরেকটু কষিয়ে নিন পানি শুকিয়ে গেলে। যদি আলু দিতে চান এসময় বা এর একটু আগে দিয়ে দিন ছোট ছোট টুকড়ো করে। মুরগি থেকে বেড়োনো পানি শুকিয়ে গেলে একটু কষিয়ে যদি ঝোল রাখতে চান তাহলে আন্দাজ করে পরিমান মত পানি দিন যাতে মাংস ও আলু সেদ্ধ হয়ে যায়। আর যদি আলু ছারা কষানো বা ড্রায় করতে চান তাহলে এতটুকুই পানি দিন যাতে শুধু মাংসটা সিদ্ধ হয়ে পানি শেষ হয়ে যায়। এত বেশি পানি দেবেন না যাতে মাংস সিদ্ধ হয়ে গলে যায়। বা আলু সিদ্ধ হয়ে গলে যায়। আমার কষানোর সময়ের এই ছবিটা তোলা।
এখানে চিলি পাডি নামে এক ধরনের লাল কাচা মরিচ পাওয়া যায় সেগুলো প্রচন্ড ঝাল!!!! এটা না খেলে আন্দাজ করার কোন উপায় নেই এর ঝালের পরিমান। আমি ওগুলো রান্নায় দিতে খুব পছন্দ করি ।
সেদিন আমার আলু দিয়ে মুরগীর ঝোল খেতে খুবই ইচ্ছে করছিল। ক্লিফ আবার কষানোটা বা কোরমা খুবই পছন্দ করে। যেহেতু সে নেই তাই আমি আমার পছন্দ মতন করে ঝোল রান্না করলাম আলু দিয়ে।
কষানো হয়ে গেলে পরিমান মত ঝোলের পানি দিয়ে কিছুক্ষন মাঝারি হিটে জাল দিন যাতে মসলা গুলো মাংসের ভেতরে যায় ও মাংস আর আলু টা ঠিক যাষ্ট সিদ্ধ হয়। আবার বেশি সিদ্ধ যাতে নাহয় ।এক চা চামচ মাওয়া পেষ্ট দিতে পারেন শেষ করবার আগে। পানি স্বাদ মত শুকিয়ে এলে চুলা নিভিয়ে দিয়ে প্যানটা ঢেকে দিয়ে রান্না শেষ করুন। অন্য কোন বক্সে বা পাত্রে যদি ঢালতে চান তাহলে অন্তত ২০ মিনিট পরে ঢালুন।
এর সাথে আপনি টমেটো, তেতুল বা দই যোগ করতে পারেন কষাবার সময় বা রান্না শেষে ওর উপর ধনেপাতা কুচিও দিতে পারেন আপনার স্বাদ মতন। টক দই, তেতুল এতে মোটা হবার সম্ভবনা কম থাকে। এই আমার মুরগি রান্না শেষ।
আদা, রসুন, ফ্যানেল সিড, জিরা, কঁাচা হলুদ, গরম মসল্লা, তেতুল - গুগল সার্চ দিয়ে এগুলোর গুনাগুন খুঁজতে ভুলবেন না যেন। আর প্রতিবার মুরগি একই ভাবে রাধবেন না। একেক সময় একেক ভাবে। মুরগী যত মজারই হোকনা কেন একই ভাবে যদি সব সময় রান্না করেন তাহলে দু'দিন পরে কিন্তু ওতে অরুচি হবে। কখনও কোরমা, কখনও ঝালের ঝোল, কখনও কষানো, কখনও টক দই দিয়ে দেন, কখনও বা দুধ বা হানি।
আর মুরগি যেমন একই ভাবে রোজ খেলে অরুচি আসে, মানুষের জীবনটাও কিন্তু তেমনই, একই ভাবে রোজ জীবন যাপন করলে জীবনে কিন্তু অরুচি বা একঘেমী চলে আসে।
কখনও চুল উচু করে বাঁধুন কখনও বা বেণী বা ছেড়ে দিন। কখনও টিপ পড়ুন কখনও নয়। কখনও বামে সিঁথি করুন কখনও ডাইনে.....এ ভাবেই তো জীবনে রং বসাতে হয় জীবনটা কে সুন্দর করবার জন্য। একে অন্যকে যদি গ্রান্টেড ধরে না নেন এবং প্রতি দিন নিজেকে নতুন নতুন করে আপনি উপস্থাপনা করেন তবে আপনার সঙ্গিটি সব সময়ই আপানর প্রেমে পরে থাকবে - কথাটা ছেলে ও মেয়ে সবার জন্য প্রজোয্য। নিজেদের যত্ন নিন সবার আগে সবার যত্ন নেবার জন্য। স্বামীরা ভাববেন না বিয়ে করলেন মানে বউয়ে মাথা কিনে নিলেন- বউ এর কাছে প্রতিদিন অন্যভাবে নিজেকে উপস্থাপন করুন, মাঝে মাঝেই অন্তত ফুল কিনে বাসায় ফিরুন তাকে স্পেশাল ফিল করাবার জন্য। আর বউ যখন পরিপাঠি করে সাজেন তখন তাকে সত্যি কথা টা বলুন "তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে"। স্ত্রী'রা ও তাই করুন, ছেলাদের যখন স্মার্ট লাগে বলুন আপনার সঙ্গিকে তাকে চমৎকার লাগছে!! এতে দুজনই দুজনের মূল্য বোঝে আর ভুলে যায় না । আর রান্না শেষে বড় বিলাই এর হসব্যান্ডের মতন থালা বাসন ওয়াসিং এ ও রান্না ঘর গোছাতে সাহায্য করুন । রান্না আর কিছু নয় কিন্তু প্রিয়জনের প্রতি ভালবাসা, মমতা, বুদ্ধি আর খাবারের মিশ্রন । সবাই ভাল থাকুন।
বিঃদ্রঃ এখানে যে তেল দেখছেন ঝোলের উপর তা কিন্তু মুরগি থেকে বেরুনো আর যে তেলটা ব্যবহার করেছি তা অলিভ অয়েল। অলিভ অয়েল বা সরিষার তেল আপনার পেটের কম ক্ষতি করে বরং স্কিন সুন্দর করে। আর কঁাচা মরিচের ঝালে আলসার সারে এবং ওয়েট লুজ করে। অন্য গুলোর গুনাগুন গুগোল সার্চ দিয়ে জেনে নিন। স্পেশালী গরম মসল্লা। আদা, রসুন, তেতুল, ফ্যানেল ও জিরা ....এইসব।