[এক]
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটি সবসময়ই একটি অনির্দিষ্ট ধরণের এবং এর স্বরূপটি ঠিক কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে দেশের মানুষের মধ্যে বা রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐক্যমত্য নেই। যদি ঔচিত্যবোধের প্রশ্ন তোলা হয় তাহলে বলতে হবে কারো সাথে গায়ে পড়ে অশান্তি সৃষ্টি করা কোন সুনীতি হতে পারেনা, সে হিসেবে ভারতের সাথে আমাদের শান্তিময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখাই বাঞ্ছনীয়। এ বিষয়ে মনে হয়না কারো দ্বিমত করার অবকাশ আছে। তবে শান্তিময় ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে ভারতের পক্ষ থেকে যতটুকু অনুকূল সাড়া প্রয়োজন তা ভারত গত ৩৭ বছরে কতটুকু দিয়ে এসেছে? ভারতের আচরণ কি বন্ধত্বপূর্ণ, যুক্তিযুক্ত এবং সমঅধিকারের স্বীকৃতি দ্বারা পরিচালিত নাকি এটি উন্নাসিকতা, ঔদ্ধত্য ও আগ্রসী মনোভাব দ্বারা পরিচালিত? এ মৌলিক প্রশ্নগুলোর ব্যপারে দেশের মানুষ যেন ঠিক অতটা নিশ্চিত নয়। কোথায় যেন একটা সন্দেহ সংশয় সর্বদা তাড়া করে ফেরে। ধারণা করা যেতে পারে এ সন্দেহ সংশয়ের বীজ প্রোথিত রয়েছে বেশ অতীতে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির যখন অভ্যুদয় ঘটছিল তখন।
মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার প্রক্রিয়ায় ভারত সরাসরি সাহায্য করে, এ সত্যটির আলোচনা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিশ্লেষণ অপূর্ণাংগ থাকতে বাধ্য এবং এটিই হচ্ছে সেই ঘটনা যা ভারত সম্পর্কে আমাদের একটি ঐক্যবদ্ধ ধারণায় উপনীত হতে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে দিচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সম্ভবত দেশের কারো কারো ধারণা যেহেতু বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছে ভারত, তাই কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার সাথে চিরকাল প্রশ্নাতীত ও নিশর্ত (ভারতের আচরণ যাই হোক না কেন) বন্ধত্বের হাত বাড়িয়ে রাখাই বাংলাদেশের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত। আরো মনে করা হয়, যেহেতু ভারত আমাদের তুলনায় অতিমাত্রায় বৃহৎ শক্তির দেশ তার সাথে আমরা মোকাবেলা করে পারবনা কখনই, আর তাই ভারত বিরোধী মনোভাব স্থূল রাজনৈতিক কৌশল বৈ আর কিছুই নয়। কাজে কাজেই এসব স্থূলতা পরিহার পূর্বক বাংলাদেশের কিছু স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে হলেও ভারতের স্থায়ী আনুকূল্য লাভই আমাদের কর্তব্য। এ ধরণের লোকেরা কতটা দেশপ্রেমিক সে বিষয়ে অবশ্যই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। হয়ত দেশেপ্রেম বোধের চাইতে কৃতজ্ঞতাবোধের চেতনা তাদের অনেক বেশি তাড়িত করে। এ ধরণের লোকেরা সম্ভবত “কৃতজ্ঞতাবোধ সিনড্রোমে” ভুগছে।
অন্যদিকে দেশের একটি বড় অংশ মনে করে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ বটে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে এর ফলে বাংলাদেশকে চিরতরে ভারতের সামনে মাথা নিচু করে চলতে হবে। পিনাকরঞ্জনের মন্তব্যের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে যেয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক বলেন, “...ভারত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করেছে, তাই বলে আমরা সব কিছু উজার করে দেশকে বিপন্ন করে সব সময় ভারতের চাহিদামত সবকিছু দিতে বাধ্য থাকব! এটা কোন দেশপ্রেমিক স্বাধীনচেতা নাগরিকের উপলব্ধি হতে পারেনা। স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তার বিনিময়ে বাংলাদেশ ভারতকে অনেক বেশি দিয়েছে। আর কত দিতে হবে? এ বিষয়টাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। ” (আমার দেশ, ২৩ জুন ২০০৯, পৃষ্ঠা ১৩)
অন্যদিকে ভারত যে তার নিজের স্বার্থেই সাহায্য করেছিল এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এমনকি নিজে থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার ইচ্ছাও ভারতের কতটা ছিল তাও সন্দেহ। আর তাই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবে ভারত খুশি হতে পারেনি। এ প্রেক্ষিতে বলা যায় ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপারে যতটা উৎসাহী ছিল তার চেয়ে হয়তবা নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি তার কাছে মুখ্য ছিল। এ প্রসংগে নিউ এজ পত্রিকায় লেখা আর্টিকেলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলছেন, “...It was after all in that year (1971) that India joined us in our glorious war of liberation against the occupying Pakistani army that gave us our motherland, Bangladesh, and at the same time served to achieve the otherwise unachievable Indian desire to dismember, and thereby, severely weaken its arch enemy Pakistan....It was however, not long before our intrinsic sense of suspicion took over and we wanted the Indian army to leave our soil, much to the displeasure of the Indian ruling establishment.... ” (নিউ এইজ, ২৩ জুন ২০০৯, পৃষ্ঠা-১০ ) অর্থাৎ, ...এটিই হচেছ সেই সাল (১৯৭১) যখন দখলদার পাক সেনাদের বিরুদ্ধে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সাথে অংশগ্রহন করে এবং আমরা আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ লাভ করি। এই ঘটনা একই সাথে ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু পাকিস্তানকে আলাদা করার মাধ্যমে একে দারুণভাবে দুর্বল করে দেবার ভারতীয় লক্ষ্য পূর্ণ করে দেয়, যা অন্য কোনভাবে অর্জন করা সম্ভব ছিলনা। ...কিন্তু অল্পসময় না যেতেই আমাদের সহজাত সন্দেহের অনুভূতি আমাদের পেয়ে বসল এবং আমরা চাইলাম ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের মাটি ছেড়ে যাক, যা ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীকে বেশ অসন্তুষ্ট করে...
ভারত আসলে তার মৌল নীতির কোন পরিবর্তন করেনি। স্বাধীনতার প্রাক্কালে যেমন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও ভারত নিজেদের স্বার্থেই কাজ করে গেছে। সেই স্বার্থ আদায়ের ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায় বোধ ও আন্তর্জাতিক আইন বা নিয়ম নীতির তোয়াক্কা মনে হয় খুব কম ক্ষেত্রেই করেছে। আর তাই স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভারতের বন্ধত্বের নমুনা আমাদেরকে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একটি আলোচিত ঘটনা হচেছ বিএসএফ কর্তৃক দৃকনিউজ প্রতিষ্ঠাতা ও বিশিষ্ট ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলমের গ্রেফতার হওয়া। শহীদুল আলম বর্ডারের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি জানান, তিনি বিশ্বের অনেক ভয়াবহ বর্ডার দেখেছেন, যেমন প্যালেস্টাইন বর্ডার, জার্মান-পোল্যান্ড বর্ডার যেখানে নাইট শুটিং গান দিয়ে পাহারা দেয়া হয়; কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ বর্ডারকে তার কাছে ওসবের চেয়েও ভীতিকর মনে হয়েছে। তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন শেষে তিনি ক্ষোভের সাথে মন্তব্য করেন, “Considering that India has played such an important role in the liberation of Bangladesh, one would have expected a very, very different relationship between these two countries. Considering we call ourselves members of SAARC, we’d expect far more cordial relations between ourselves. The fence, the fact that the BSF is so trigger-happy, the fact that 52 Bangladshi have been gunned down in the last 6 months, the fact that it is a zone of terror for local people and for our BDR, speaks volumes of what it should not be about.” (নিউ এইজ, ২২ জুন ২০০৯, পৃষ্ঠা-১১) অর্থাৎ, তিনি বলতে চাচেছন, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, এই বিষয়টি আমলে নিলে যে কেউ দু’দুদেশর মধ্যে অত্যন্ত আলাদা ধরণের সম্পর্ক আশা করবে। তাছাড়া আমরা নিজেদের সার্কের সদস্য বলি, এই হিসেবেও আমাদের মধ্যে আরো সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আশা করা যায়। কিন্তু সীমান্ত প্রাচীর, বিএসএফের বন্দুকবাজির স্বভাব ও এর কারণে গত ৬ মাসে ৫২ জন বাংলাদেশীর মৃত্যু, এবং সীমান্ত এলাকা বিডিআর ও সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাসের রাজত্ব হবার ঘটনা ইত্যাদি বিষয়গুলো দু’দেশের সম্পর্কটি যে এমন নয় তা আমাদের বলে দেয়।
এতকিছু পরও আমাদের অনেকের জন্যই দ্বিধা দন্দ্ব থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আর এর কারণ খুজতে গিয়ে বিষয়টিকে একটু ভিন্ন আংগিকে বিশ্লেষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ। তার মতে আমাদের এই পররাষ্ট্রনীতির দ্বিধা দোদুল্যমানতা এবং বাইরের দেশের প্রভাব বিস্তার সমস্যাটির উৎস হচেছ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনা পদ্ধতি। তিনি বলছেন, “...বাংলাদেশের আজকের সমস্যার মূলে রয়েছে যেভাবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে - আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে আমাদের স্বশক্তি দিয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করতে পারিনি। সেটা করতে না পারার ফলেই বহু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো আমাদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, আমাদের প্রতিবেশিক অবস্থান এবং যাদের হাতে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল সেই নেতৃত্বের দুর্বলতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ তার যৌক্তিক পরিণতিতে যেতে পারেনি। যে কোন মুক্তিযুদ্ধের জন্য বৈদেশিক সাহায্য, আন্তর্জাতি সমর্থন প্রয়োজন হয় এবং সেই সাহায্য ও সমর্থন নেয়া অযৌক্তিক বা অনৈতিক নয়। কিন্তু যে মুক্তিযুদ্ধে অন্য দেশের সৈন্যরা সশরীরে এসে হাজির হয় তখন সেটা মৌল চরিত্র হারিয়ে ফেলে। ভিয়েতনামিরা আমেরিকা এবং ফরাসীদের বিরুদ্ধে দুই যাত্রায় দুই স্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। তারা অনেক দেশের কাছ থেকে ম্যটিরিয়াল এবং নৈতিক সহযোগিতা নিয়েছে। কিন্তু একটি বিদেশি সৈন্য তাদের পক্ষে লড়াই করেছে এই দৃষ্টান্ত কেউ দিতে পারেনা। সেজন্য আজকে ভিয়েতনাম রাষ্ট্রটি অন্যভাবে গড়ে উঠেছে এবং রাষ্ট্রটির ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হচেছ। ” (আমার দেশ, ২৮ মে ২০০৯, পৃষ্ঠা -৬)
[দুই]
বাংলাদেশে ভারতের রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী, যারা অযথা ভারত বিরোধীতার নামে দুই দেশের বন্ধত্বপূর্ণ (?) সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে চায় তাদের নিন্দা করলেন। একটু আগেই দৃকনিউজ প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলমের জবানীতে ভারতের বন্ধত্বের কিছু নমুনার কথা বলা হয়েছে। এ তালিকা অনেক দীর্ঘ করা যায়। এ সম্পর্কে বিভিন্ন লেখকরা লিখছেন। এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিতে আলোচনা করার অবকাশ নেই। তবুও পাঠকদের স্মৃতি ঝালিয়ে নেয়ার জন্য কিছু তথ্য দেয়া একেবারে অসমীচিন হবেনা।
২০০০ সাল থেকে জুলাই ২০০৮ পর্যন্ত বিএসএফের হাতে খুন হয়েছে ৭৬৭ জন, আহত হয়েছে ৭৮৬ জন, অপহৃত হয়েছে ৬৭৫ জন। গ্রেফতার ৫১৩ জন, ধর্ষিত ১০ জন, নিখোজ ৮২ জন এবং লুট হয়েছে ৬১ টি। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত শুধুমাত্র ফেন্সিডিলের বোতল আটক করা হয়েছে ১৪ লক্ষ ৯০ হাজার ৪০২ টি। (বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল) আগেই বলা হয়েছে বিগত ছয় মাসে ৫২ জন বাংগালী নিহত হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের বিভ্ন্নি সীমান্ত এলাকায় সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার একর জমি দখলে রেখেছে। (বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতি কয়েকটি আলোচিত সমস্যা, ড. মোহম্মদ আবদুর রব) চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বেরুবাড়ী হস্তান্তর করলেও, ভারত চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেনি। আংগরপোতা ও দহগ্রামের মানুষদের দৈনন্দিন দুর্ভোগ সীমাহীন। আর ফারাক্কার কথাতো এখানে নতুন করে আলোচনা করার কিছুই নেই। তবে এসব তথ্য, উপাত্ত ও পরিসংখ্যানের চাইতেও সবচেয়ে ভীতিকর বিষয় হল ভারতের মনোভাব। আর এই মনোভাবটি মাঝে মাঝে ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি বা আমলাদের বক্তব্য থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে। অতি সম্প্রতি ভারতের মনোভাব প্রকাশক এমনই একটি মন্তব্য পাওয়া গেছে ভারতের সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল শংকর রায় চৌধুরীর কাছ থেকে। তিনি বলেছিলেন, “Delhi can’t afford to let Dhaka slip off its radar” (এশিয়ান এজ পত্রিকা, ২৮ মার্চ ২০০৯)। অর্থাৎ ভারত কিছুতেই বাংলাদেশকে তার রাডার বা প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়াটা বরদাশত করতে পারেনা। ভারত যে শুধু বাংলাদেশকেই তার প্রভাব বলয়ে রাখতে চায় ব্যাপারটি তা নয়। বরং অন্যান্য প্রতিবেশীদের ব্যাপারেও তার প্রায় একই মনোভাব। ভারত তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে কেমন আচরণ করবে সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে সুপারিশ করেছেন স্ট্রাটেজিক স্টাডিজের প্রফেসর ব্রক্ষ্ম চেলানি। ব্রক্ষ্ম চেলানি দিল্লী ভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চে কাজ করেন এবং তাকে ভারতের শীর্ষ স্ট্রাটেজিক থিঙ্কারদের মধ্যে একজন মনে করা হয়, ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনেও তার সম্পর্কে এমনই মন্তব্য করা হয় (International Herald Tribune, February 21, 2009,)। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্ট্রাটেজিক ব্যাপার সম্মন্ধে এই অতি পরিচিত ভাষ্যকার ভারতের প্রতিবেশী বিষয়ক পলিসির জন্য তিনটি বিষয়ের উপর জোর দেন। এক. কার্যকরভাবে বর্ডার ম্যানেজ করা। দুই, এসব রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ঘটনা প্রবাহের উপর প্রভাব বিস্তার করা যাতে তারা ইনডিয়া বিরোধী তৎপরতার জন্য স্টেজিং গ্রাউন্ড বা ঘাটি হিসেবে ব্যবহৃত না হয় এবং তিন, নিয়ন্ত্রিত দেশ অথবা আশ্রিত রাজ্য হিসেবে ইনডিয়াতে তাদের গ্রহন করার ক্ষমতা। (যায়যায়দিন ১৬ জুলাই ২০০৬) এজন্যই আমরা প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে ভারতের হস্তক্ষেপের বিষয়টি দেখে থাকি। শ্রীলংকার এলটিটিই-এর পেছনে থেকে সহায়তার ব্যাপারটিতো সবারই জানা। এমনকি আফগানিস্তানের আভ্যন্তরিণ ব্যাপারেও ভারতের হস্তক্ষেপ আছে বলে ধারণা করা হয়। প্রোব ম্যাগাজিন “US Report: India, Not Pakistan, Creating Trouble for NATO in Afghanistan” শীর্ষক বিশেষ প্রতিবেদনে জানায়, “...US intelligence community is well aware, this is a problem which is exacerbated not only be the Taliban alliance with the so called al Qaida movement, moving into Pakistan from Afghanistan, but also because of covert support by the Indian Government and its intelligence services principally RAW, the Reasearch & Aanlysis Wings for the jihadist movement” (Probe, 17-23 October, 2008)। অর্থাৎ, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খুব ভালভাবেই জানে যে, এই সমস্যাকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবার পেছনে পাকিস্তান থেকে আফগানিস্থানে আসা তথাকথিত আলকায়েদা আন্দোলনের সাথে জোটবদ্ধ তালেবানরাই একমাত্র দায়ী নয়, বরং জিহাদী আন্দোলনের পেছনে রয়েছে ভারত সরকার ও এর গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ করে “র”, রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং,-এর গোপন সমর্থন।
আসলে ভারত গ্লোবাল প্লেয়ার হতে চায় এবং একসময় সে বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভুত হবে বলে তার বিশ্বাস। এজন্যই আশে পাশের দেশগুলোর প্রতি তার নিয়ন্ত্রণ রাখা প্রয়োজন। প্রফেসর ব্রক্ষ্ম চেলানির পরামর্শানুযায়ী প্রয়োজনে আশেপাশের দেশগুলোকে সে হয়ত নিজের মধ্যে গ্রহনও করে নিতে চাইবে। আর এ ব্যাপারটি যে একেবারে অসম্ভব নয় তাতো ভারত সিকিমের ঘটনার মাধ্যমেই প্রমাণ করে দিয়েছে। এজন্যই বাংলাদেশের মধ্যে সবসময়ই একটি ভয় কাজ করে এবং সেটিই স্বাভাবিক। আর এই ভয়ের ব্যাপারটি বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনুসও স্বীকার করছেন। তিনি বলছেন, “Although Bangladesh remains grateful to India for its military help during our liberation war, a pervasive feeling of fear about India persists in Bangladeshi minds. Perhaps this is understandable – India is seven times bigger than Bangaladesh, surrounds Bangaladesh almost completely, has the third largest army in the world, and is predominantly Hindu rather than Muslim” (Economic Times, 25/5/2008) অর্থাৎ, “বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সামরিক সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞ হলেও ভারতের ব্যাপারে একটি সর্বব্যাপী ভীতি কাজ করে বাংলাদেশের মনে। সম্ভবত এর কারণটা বোধগম্য - ভারত বাংলাদেশের চাইতে সাতগুণ বড় ও এটি বাংলাদেশকে প্রায় পুরোপুরি ঘিরে রেখেছে। এর রয়েছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী। এর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম নয় বরং হিন্দু।” এই ভয়টি যে শুধু মানসিক কোন ব্যপার নয় বরং এর পেছনে সত্যিকার কারণ জড়িত তা বলছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ জাতি হিসেবে যাত্র শুরু করার পর থেকেই আমরা আমাদের আভ্যন্তরিন কার্যক্রমে অযাচিত হস্তক্ষেপ অনুভব করতে থাকি। তিনি বলেন এই হস্তক্ষেপের ব্যাপারটি ধারণামূলক নয় বরং সত্যিকার। তিনি আরও জানান, “A senior Indian diplomat once told me personally at a social meeting in New Delhi ‘India wishes to see a pliant state in Bangladesh’.” (New Age, 23 June 2009) ভারতীয় কূটনীতিক ব্যক্তিটি হয়ত ঠিকই বলেছেন। ভারত দুর্বল এবং নমনীয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র দেখতে চায়। আর এজন্যই টিপাইমুখে বাধ নির্মানের ভারতীয় ইচ্ছায় বাংলাদেশের যে বিশেষজ্ঞরা নতজানু হয়ে নমনীয়তা প্রদর্শন করছেননা তারা স্বাভাবিকভাবেই পিনাকরঞ্জনের রোষানলে পড়লেন।
[তিন]
পিনাকরঞ্জনের ভাষায় বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা “তথাকথিত বিশেষজ্ঞ”। এক্ষেত্রে দু:খের বিষয় হল আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিনাকরঞ্জনের মন্তব্যের নূন্যতম কোন প্রতিবাদ করার প্রয়োজন উপলব্ধি করলেননা। এব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যারিস্টার রফিক-উল-হক রীতিমত দীপুমনিকে “খুকুমনির” সাথে তুলনা করেছেন। অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করে তিনি বলেছেন, “বড়ভাই আদর করে ছোট বোন খুকুমণিকে কিছু কথা শুনিয়ে দিল, আর খুকুমণি গভীর শ্রদ্ধাবোধ থেকে বড় ভাইয়ের ওই কটুক্তিকে আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছেন।”
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে পিনাকরঞ্জন শুধু বিশেষজ্ঞদের কটাক্ষ করেই থামেননি, বরং অত্যন্ত স্পষ্টভাবে টিপাইমুখ বিরোধী তৎপরতাকে একটি দলীয় রং দেবার চেষ্ট করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক সহযোগীদের নিয়ে বাধেঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্ট করছে। অথচ এটি সঠিক কথা নয়। তিনি যে দলের প্রতি ইংগিত করেছেন তার সাথে যারা সরাসরি বা আদর্শগতভাবে জড়িত নয় এমন লোকেরা টিপাইমুখ বাধের বিরোধীতা করছেন, যেমন ড. মোজাফফর আহমদ, ব্যারিষ্টার রফিক-উল-হক, ড. আইনুন নিশাত ইত্যাদি অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব। এদিকে বামপন্থী দলগুলো ও বুদ্ধিজীবী যেমন বদরুদ্দীন উমর আগাগোড়া টিপাইমুখ বাধের বিরোধীতা করছেন। মজার ব্যাপার হল স্বয়ং সরকার দলের শরীক রাশেদ খান মেনন টিপাইমুখ বাধ নিয়ে সরকারের শক্ত প্রতিবাদ করার ব্যর্থতাকে “মিউ মিউ” করা বলে অভিহিত করেছেন। ভারতের মনিপুরেও এ নিয়ে প্রতিবাদ হচেছ এবং ভারতীয় অনেক বিশেষজ্ঞরাই এর ক্ষতিকারিতা সম্পর্কে বলছেন। ফলে এটা খুব স্পষ্ট যে এটি কোন ক্ষুদ্র দল বা গোষ্ঠীর ব্যাপার নয়। এর সাথে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। “বন্ধুপ্রতিম”(?) দেশের কূটনীতিক হয়ে পিনাকরঞ্জন এভাবে আভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারে ইংগিতপূর্ণ মন্তব্য করে কি অত্যন্ত অন্যায় কাজ করলেননা?
[চার]
বাংলাভিশন চ্যানেলের একটি টকশোতে একজন সাবেক মন্ত্রী পিনাকের মন্তব্যকে কেন্দ্র করে দাবী করেন, “টিপাইমুখ বাধের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতিকারিতা রয়েছে” এ বিষয়টি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। এক অর্থে তিনি ঠিকই বলেছেন। কারণ কথায় বলে দেখে শিখা ঠেকে শিখার চেয়ে ভাল। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব দেখে কি আমরা শিক্ষা নিতে পারিনা? নদীতে বাধ দিলে নদী যে নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নেয়, ইতিহাস এর স্বাক্ষী - ফারাক্কার বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে দেশ পত্রিকায় দীর্ঘ আলোচনা করতে যেয়ে এমনটিই বলছেন কল্যাণ রুদ্র। একজন “ভারতীয়” লেখকের লেখার অংশ বিশেষ পাঠকের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরব এখানে।
কল্যাণ রুদ্র লিখছেন, “নদী কি প্রতিশোধ নেয়? ...সম্ভবত আমরা নদীকে বুঝিনি একেবারেই। তাকে জয় করতে চেয়েছিল মানুষ; আজ তার আক্রোশের ঝাপটা সামলাচেছ। সামলাতেও পারছেনা, জলের তোড়ে নিশ্চহ্ন হয়ে যাওয়া গ্রামের পর গ্রাম, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েক সহস্র মৃতদেহ তার প্রমাণ।.....নদী বিজ্ঞানীরা এখন বুঝতে পারছেন নদীতে বাধ দিলে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ওই বাধনের বিরুদ্ধে নদীর আক্রোশ কালক্রমে এমন রূপ নেয় যে অববাহিকার বিস্তীর্ণ অংশে বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রা বিপন্ন হয়ে ওঠে। ১৯৬০ সালে মিশরের নীল নদীর ওপর আসোয়ান বাধ তৈরীর কাজ শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে ওখানে শুরু হয়েছে প্রকৃতির বিদ্রোহ। যে জমিতে সেচের জল দেওয়া হয়েছিল, সেই জমি আজ লবণাক্ত, উপকূলে শুরু হয়েছে ব্যপক ভূমিক্ষয়, জলাধারে সঞ্চিত হয়েছে পলি, তার ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। এমন ঘটনা শুধু মিশরে নয়, পৃথিবীর নানা দেশে দেখা দিয়েছে বাধ তৈরীর পর। উন্নত দেশগুলোতে তাই কয়েকটি বাধ ভেঙ্গে দিয়ে নদীকে আবার মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর তথকথিত উন্নতির লক্ষ্যে সারা ভারতে যত বৃহদাকার বাধ তৈরী হয়েছে, তার সংখ্যা ৩৩০০। বড় বড় জলাধারগুলি বহু গ্রামকে স্থায়ীভাবে প্লাবিত করেছে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশনের এক সমীক্ষায় জানা গেছে প্রতিটি জলাধারের জন্য গড়ে ৪৪১৮২ জন মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই শুরু হয়েছে বাধের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন।...অভিযোগের আংগুল উঠেছে আমাদের ফারাক্কা ব্যারাজের দিকেও। গত কয়েক দশকে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় অন্তত ছয় লক্ষেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। বহু গ্রাম, একাধিক নগর গঙ্গাগর্ভে তলিয়ে গেছে। নদী তার গতিপথ বদলিয়েছে.....ফারাক্কা ব্যারেজ তৈরীর পর গত তিন দশকে ১৮৫৬ কোটি টন পলি গঙ্গাগর্ভে সঞ্চিত হয়েছে। তাই মালদহের গঙ্গা একটি অগভীর বদ্ধ জলার রূপ নিয়েছে ... ”
ড. আইনুন নিশাতের মতে, টিপাইমুখ বাধের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের সিলেট হয়ে ভৈরব, চাদপুর পর্যন্ত এবং টিপাইমুখের কাছে ফুলপুরে ব্যারাজ নির্মাণ করলে সুরমা, কুশিয়ারা শুকিয়ে যাবে (প্রথম আলো ২৮ জুন ২০০৯)। বাংলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এসব নদীগুলোকে কল্যাণ রুদ্রের ভাষায় “অগভীর বদ্ধ জলার” রূপে দেখতে চাননা, এরকম দেশপ্রেমিকরাই টিপাইমুখ বাধের প্রতিবাদ করছেন। দেশের মানুষ কখনই এই বাধকে সহজভাবে মেনে নেবেনা। ভিয়েনা কনভেনশন লংঘনকারী পিনাকরঞ্জন ও তার দেশীয় কর্তাব্যক্তিরা এটি উপলব্ধি করবেন এবং হুমকি ধমকির পথ পরিহার করে, আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তি অনুযায়ী কাজ করবেন এটাই সকলে ।
লেখাটি ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত : http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=959
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জানুয়ারি, ২০১০ বিকাল ৪:২৮