হিলারি হেরেও যেতে পারে
এবনে গোলাম সামাদ
দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকার সময়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়েছে এই দু’টি যুদ্ধে। রিপাবলিকান পার্টি সাধারণভাবে চায়নি ইউরোপের ব্যাপারে জড়াতে। তাদের এই নীতিকে বলা হয় আইসোলেশনইজম। ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখাচ্ছেন সনাতন এই রিপাবলিকান মনোভাব। তিনি চাচ্ছেন না বিশ্বরাজনীতি নিয়ে, বিশেষ করে ইউরোপের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে; কিন্তু রাশিয়া এখনো সামরিক দিক থেকে হয়ে আছে একটি বিরাট শক্তি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ভাবছেন, যেহেতু ডোনাল্ট ট্রাম্প ইউরোপ নিয়ে মাথা ঘামাতে চাচ্ছেন না, তাই তিনি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, তবে সেটা রাশিয়ার জন্য হবে ভালো। পুতিন এ জন্য সহানুভূতিশীল হয়ে উঠেছেন ট্রাম্পের প্রতি। পুতিন-ট্রাম্প সহযোগিতা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে বা বিলম্বিত করতে সহায়ক হবে। মার্কিনিরা হয়ে পড়েছেন রণক্লান্ত। তারা চাচ্ছেন না বড় রকমের যুদ্ধবিগ্রহে জড়াতে। তাই তারা শেষ পর্যন্ত ট্রাম্পের প্রতি ঝুঁকে পড়তেই পারেন। বিশ্ব পরিস্থিতি এখন ট্রাম্পের অনুকূলে।
২০০১ সালের ৯ নভেম্বর কিছু আরব মুসলিম তরুণ যাত্রীবাহী বিমান নিয়ে হামলা চালিয়েছিলেন নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ারে এবং ওয়াশিং ডিসিতে সেনা দফতরে। এর ফলে নিউ ইয়র্কে মারা যান তিন হাজার লোক। আর পেন্টাগনে মারা যান ৩০০ সামরিক কর্মকর্তা। এ ধরনের ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইতপূর্বে কখনো ঘটেনি। এখন সারা ইউরোপে আরব মুসলিম তরুণেরা করছেন হামলা। ট্রাম্প বলছেন, একমাত্র তিনি কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ ধরনের হামলার কবল থেকে রক্ষা করতে পারেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা একভাগ হলো মুসলিম। তিনি বলছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এই মুসলিম অভিবাসীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে দেবেন না। তার এই বক্তব্য আমাদের কাছে মনে হতে পারে খুবই উগ্র, কিন্তু মার্কিন ভোটারদের কাছে হয়ে উঠতে পারে খুবই আবেদনবহ। মানুষকে নিয়েই রাষ্ট্র। মানুষের মন ধর্মনিরপেক্ষ না হলে রাষ্ট্র কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। বারাক হোসেন ওবামাকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেয়ার সময় শপথ নিতে হয়েছিল বাইবেল ছুঁয়ে, অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ ছুঁয়ে নয়। যদিও বারাক হোসেন ওবামার পিতা ছিলেন ধর্মে মুসলমান।
জন্মলগ্ন থেকেই ধর্ম জড়িয়ে পড়েছে মার্কিন ইতিহাসের সাথে। ইংল্যান্ড থেকে পিউরিটান প্রটেস্টান খ্রিষ্টানরা মুক্তভাবে তাদের ধর্মচর্চা করার জন্য মে ফ্লাওয়ার নামক জাহাজে চড়ে ১৬২০ সালে বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে গিয়ে পৌঁছান। এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব সৈকতের উত্তরভাগে গড়েন ছয়টি জনবসতি, যা পরে পরিণত হয় স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়টি অঙ্গরাজ্যে। এগুলো হলো মেইমি, ভারমন্ট, নিউহ্যাম্পশায়ার, মেসাচুসেট, রোডহাইল্যান্ড ও কানেকটিকাট। এই ক’টি অঙ্গরাজ্যকে একত্রে উল্লেখ করা হয় নিউ ইংল্যান্ড নামে। যাকে বলা হয় মার্কিন সভ্যতা, তা প্রধানত গড়ে উঠেছে এই ছয়টি অঙ্গরাজ্যকে নির্ভর করে। এর পরে ইংল্যান্ড থেকে কোয়েকার খ্রিষ্টানেরা গিয়ে যে জনপদ গড়েন, তা হয়েছে ফিলাডেলফিয়া অঙ্গরাজ্য। ক্যাথলিক খ্রিষ্টানেরা আয়ারল্যান্ড থেকে গিয়ে যে জনপদ গড়েন, তা হয়েছে মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্য। অর্থাৎ ধর্মসম্প্রদায় ভিত্তিকভাবে অনেক অঙ্গরাজ্য গড়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আর এসব অঙ্গরাজ্যে ধর্মবিশ্বাসের আছে প্রবল প্রভাব, সেই জন্মলগ্ন থেকেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন ফিডজেরল কেনেডি (১৯১৭-১৯৬৩) এ পর্যন্ত একমাত্র কোনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টান যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন; কিন্তু তিন বছরের মাথায় তিনি ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। তার মৃত্যু এখনো হয়ে আছে রহস্যঘেরা। তার ছোট ভাই সিনেটর রবার্ট কেনেডি দাঁড়াতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য; কিন্তু তিনি ১৯৬৮ সালে নির্বাচনী প্রচার চালাবার সময় ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। এর পরে আর কোনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টান মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হননি। অর্থাৎ ধর্মের প্রভাবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ট্রাম্প কেবল ধর্মীয় আবেগকে রাজনীতিতে ব্যবহার করছেন না, তিনি বলছেন মার্কিন জাতীয়তাবাদের কথা। যারও সূচনায় নিহিত আছে নিউ ইংল্যান্ডের প্রটেস্টান পিউরিটান খ্রিষ্টান মতবাদের মধ্যে।
বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ একটা উল্লেখযোগ্য উৎপাদক ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, পৃথিবীর সর্বত্র। হিলারি মার্কিন জাতীয়তাবাদের কথা বলছেন না; কিন্তু ট্রাম্প বলছেন। মার্কিন ভোটদাতারা আকৃষ্ট হতে পারেন ট্রাম্পের বক্তব্যে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা নেমেছেন হিলারির পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায়; কিন্তু তার এই প্রচারণা হিলারির জন্য হতে পারে ক্ষতিকর। কেননা ওবামার ভাবমর্যাদা আর আগের মতো উজ্জ্বল হয়ে নেই। মার্কিন জনমতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভাবতে শুরু করেছে ওবামাকে বিশুদ্ধ মার্কিনি বলা চলে না। তিনি মার্কিন জাতীয়তাবাদের ও সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী নন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন ফেডারেশন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৭৭৬ সালে। জর্জ ওয়াশিংটন (১৭৩২-১৭৯৯) প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাধীন করেন। তিনি হন এর প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তিনি পরপর দুইবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাকে তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াতে অনুরোধ করা হলে তিনি বলেন, তিনি বিশ্বাস করেন প্রজাতন্ত্রী গণতন্ত্রে। তিনি চান না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাক। এ পর্যন্ত কেবল একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট পর পর তিনবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি হলেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫)। তিনি ছিলেন একজন ডেমোক্র্যাট। এর পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চিন্তাভাবনা শুরু হয় এমন আইন প্রণয়ন করার, যাতে কেউ দুইবারের বেশি বা মোট আট বছরের বেশি প্রেসিডেন্ট হতে না পারেন। কেননা ক্ষমতা মানুষকে জেদি, পীড়ক ও স্বার্থপর করে তুলতে চায়। কোনো প্রেসিডেন্টের হাতে যাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হতে না পরে, তাই করা হয়েছে এই আইন। হিলারির স্বামী বিল ক্লিনটন দুইবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। হিলারি তার স্বামীর সহযোগিতায় হতে চাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট। তাই তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার বাস্তব একটা অর্থ দাঁড়াতে পারে, বিল ক্লিনটন তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়া। অনেক মার্কিন ভোটার এ কারণে হিলারিকে ভোট দানে বিরত থাকতে পারেন। তারা ভাবতে পারেন, হিলারিকে ভোট দেয়ার অর্থ দাঁড়াবে বিল ক্লিনটনকে তিনবার প্রেসিডেন্ট করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেয়েরা যথেষ্ট সংখ্যায় বাইরে চাকরি করেন। মেয়েরা যথেষ্ট স্বাধীন; কিন্তু তাদের চাকরির বিবরণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তারা খুব উচ্চপদে অধিষ্ঠিত নন। বেশির ভাগ বড় কোম্পানির ম্যানেজার হচ্ছেন পুরুষ, মহিলা নন। মার্কিন ভোটা রেরা ভাবতে পারেন, হিলারি হলেন একজন নারী। তার ওপর তাই ভরসা করা যায় না। হিলারি ছিলেন ওবামার পররাষ্ট্র কর্ম-সচিব; কিন্তু তিনি এই পদে পারদর্শিতা দেখাতে পারেননি। আর না পারার কারণে তাকে সরে যেতে হয়েছিল ওই দায়িত্বপূর্ণ পদ থেকে। অর্থাৎ হিলারির লিঙ্গ হয়ে উঠতে পারে তার ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা। মার্কিনিরা একজন মহিলা প্রেসিডেন্ট না-ও চাইতে পারেন।
ট্রাম্প জন্মেছিলেন নিউ ইয়র্কে। তিনি প্রচুর বিদ্যার অধিকারী হয়েছেন আপন দক্ষতা গুণে। এরকম মানুষকে মার্কিনিরা শ্রদ্ধা করেন ‘সেলফ-মেইড ম্যান’ হিসেবে। হিলারি ছিলেন পেশায় একজন উকিল; কিন্তু তিনি ওকালতি করে বিশেষ কিছু উপার্জন করতে পারেননি। এ দিক থেকে তাই তার ব্যক্তিগত ভাবমর্যাদা ট্রাম্পের মতো কর্মঠ ও সাফল্যজনক নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বড়লোক হওয়া কোনো অপরাধ নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধনতান্ত্রিক দেশ। ধনার্জনকে সেখানে মন্দ ভাবা হয় না। যদিও বাইরের বিশ্বে তিনি একজন ধনকুবের হিসেবে হতে পারছেন নিন্দিত; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তিনি এই একই কারণে হতে পারেন নন্দিত। হিলারিকে নির্বাচনী প্রচারের জন্য চাঁদা নিতে হচ্ছে, কিন্তু ট্রাম্পকে কারো কাছে হাত পাততে হচ্ছে না। কেননা ট্রাম্প হচ্ছেন অর্থ-স্বাবলম্বী। তিনি নিজেই নিজের জীবনকে গড়ে তুলেছেন, হয়ে উঠেছেন ধনী। আমার তাই মনে হচ্ছে ট্রাম্প নির্বাচনে জিতে যেতেও পারেন, তার ভাবমর্যাদার কারণে।
ওপরে যা কিছু বললাম, তা সব কিছুই হলো আমার পুঁথিগত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে। আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো দিন যাইনি। ওই দেশ সম্পর্কে তাই আমার কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই; কিন্তু আমার এক বন্ধু থাকেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি সেই দেশে আছেন প্রায় ৬৫ বছর ধরে। তিনি মার্কিন নাগরিক এবং মার্কিন রাজনীতির যথেষ্ট খবর রাখেন। তিনি ক’দিন আগে এসেছিলেন তার জন্মভূমিতে বেড়াতে। তিনি প্রায়ই এরকম এসে থাকেন। কেননা তিনিও একজন বেশ বিত্তশালী মানুষ। তার সাথে আলাপ করে আমার মনে হলো, তিনিও ভাবছেন ট্রাম্পের জেতার সম্ভাবনা ক্ষীণ নয়। আমাদের পত্রপত্রিকা পড়ে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প জিতবেন না; কিন্তু অতটা নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো অবস্থা বিরাজ করছে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। জানি না কেনো আমাদের পত্রপত্রিকা এতটা হিলারিমুখর হয়ে উঠতে পারছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপার। যিনিই মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন না কেন, তার সাথে সুসম্পর্ক গড়েই চলতে হবে বাংলাদেশকে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
সূত্র :http://m.dailynayadiganta.com/?/detail/news/144287
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১৬ ভোর ৬:১৫