সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আদিকাল হতেই নারীরা ছিলো অগ্রগণ্য। আদিম মানুষেরা উৎসবে বা আনন্দে তাদের গোত্র প্রধানের নেতৃত্বে নাচ-গান ও পান-ভোজনের উদযাপন করতো। বেশিরভাগ গোত্র প্রধানই থাকতো নারীরা। নারীরা শিকারে নেতৃত্ব দিতো, গোত্রের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজন ও ভালোমন্দ বাছাই করে দিতো। পুরুষরা ছিলো নারীর আজ্ঞাবহ।
সাধারণতঃ একজন নারী যাকে ইচ্ছা তাকেই শয্যাসঙ্গি বানাতে পারতো। মানুষের মধ্যে তখনো ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। তাই প্যাগানিজম বা অতিপ্রাকৃত ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকলেও সেই ঈশ্বর তখন পর্যন্ত মানুষের যৌনতার মধ্যে নাক গলানো শুরু করেনি। সে সমাজে পিতৃ পরিচয় মুখ্য ছিলো না, মাতৃ পরিচয়ই ছিলো আসল। তাছাড়া মাতা বা নারী নিজের পতি রূপে সুস্থ সবল ও তরুণ পুরুষদেরই পছন্দ করতো। যতোদিন গোত্রপ্রধান হিসেবে ক্ষমতায় থাকতো, ততোদিন যেকোনো পুরুষই সেই নেতৃর আদেশ মানা তথা যৌনসঙ্গি হবার জন্য বাধ্য ছিলো। সন্তান বাৎসল্য থাকলেও যৌনতার জন্য নিষিদ্ধ বা অজাচার ধারণা তখনো মানুষ প্রবর্তন করেনি।
কালক্রমে মানুষ সম্পদ জোগার করা এবং এক জায়গায় থিতু হওয়া শিখলো। ধীরে ধীরে সম্পদের দখলদারীত্ব নিতে গিয়ে নারী হয়ে পড়লো ঘরমুখী সম্পদের রক্ষক। পুরুষ নারীর নেতৃত্বের জায়গা নিয়ে নিলো। সভ্যতা যখন নগরকেন্দ্রিক হতে শুরু করলো, তখন একেক নগরে গড়ে উঠলো একেক সংস্কৃতি, একেক কৃষ্টি, একেক ধারণা ও মতবাদ, একেক প্রথা ও কুসংস্কার। এসবের সাথে সাথে জন্ম হলো একেক রকমের ঈশ্বরেরও।
সমাজপতি নব্য সেসব পুরুষরা তখন নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী ঈশ্বর, ঈশ্বরের দূত, প্রথা, কুসংস্কার ইত্যাদি তৈরি করলো।
সভ্যতার শুরু থেকে এটা স্পষ্ট যে, একদল জ্ঞানী লোক সামষ্টিক মানবজাতির স্বার্থের কথা ভেবেছে, আরেকদল জ্ঞানী ভেবেছে ব্যক্তিগত স্বার্থ। সামষ্টিক স্বার্থের জন্য কাজ করা মানুষগুলো মানবজাতিকে যতোখানি এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে, ব্যক্তিগত লোভ ও স্বার্থের জন্য কাজ করা জ্ঞানপাপীগুলোও মানবজাতিকে ততোখানি পিছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। বিজ্ঞান এবং দর্শনের সম্মিলিত অগ্রযাত্রা এবং পশ্চাৎযাত্রা তাই চলছে এবং চলছে।
সভ্যতার বর্তমান পর্যায়ে আমরা দেখছি, মানুষের সম্পর্ক, ভালোবাসা বা যৌনতাকে পূঁজি করে সবচেয়ে বড় বড় ব্যবসাগুলো পরিচালিত হয়। শিল্পের সূচনালগ্নে শিল্প ছিলো মনের স্বতস্ফূর্ত আবেগ প্রকাশ। তবে আজ সেই আবেগ প্রকাশক শিল্প হয়ে পড়েছে পূঁজির দাস এবং ব্যবসার সবচেয়ে বড় উপাদান। উদাহরণ হতে পারে ভারতীয় মেইনস্ট্রিম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি যেখানে রাস্তাঘাট ও বিদেশে নাচানাচি, এলাকায় মারামারি ও টিপিক্যাল প্রেমিকা নামের একজন নিম্নপদস্থ নারীর উপস্থিতি থাকে। এসব আপনার আমার জীবনে সচরাচর ঘটে না, কিন্তু আপনি আমি এসব অবান্তর বিষয় কামনা করি যৌনতাগিদে। আমাদের সেই তাগিদই এসব মেইনস্ট্রিম সস্তা ছবি তৈরির প্রধান নিয়ামক। (যদিও একদল ডিরেক্টর ঐশ্বরিকভাবে জীবনধর্মী ও বস্তুনিষ্ঠ সিনেমা বানিয়ে যাচ্ছেন।)
ফেসবুক সম্ভবত মানুষের সম্পর্ক এবং ভালোবাসা নিয়ে ব্যবসা করা এ যাবতকালের সবচেয়ে সফল প্রতিষ্ঠান।
এর সাফল্য এবং ব্যবহার এশিয়ার অংশে বেশী। এর আবিষ্কারকের দেশের লোকেরাও এতো বেশী ব্যবহার করে না ফেসবুক যতোটা আমরা করি। এর কারণ সম্ভবত সম্পর্ক তৈরির ফাঁকিবাজি।
ব্রাজিলের কোনো মেয়েকে কোনো ছেলে যদি বলে, তোমার বুক খুব সুন্দর। মেয়েটি খুশী হয়ে ধন্যবাদ জানাবে।
আমেরিকায় কোনো মেয়েকে কোনো ছেলে যদি বলে, তোমাকে দেখে আমার গার্লফ্রেন্ড বানাতে ইচ্ছা করছে। কিছুক্ষণ কথা বলতে চাই। সেটা ওখানকার মেয়েরা খুব স্বাভাবিকভাবে নিবে।
ওখানকার ছেলে ও মেয়েদের কাছে বিষয়গুলো নরমাল। তাই সম্পর্কের জন্য ফেসবুকের প্রয়োজন হাস্যকর।
আমাদের দেশে উপরোক্ত কোনো কাজই করা যাবে না। এ কারণেই সম্ভবত উৎপত্তি ইভটিজিং এর মতো জঘন্য বিষয়। পারস্পরিক সম্মানবোধ যেমন নেই এখানে, ছেলেদের নেই মেয়েদের সংস্কারাবদ্ধ মনের প্রতি সম্মান।
আমার সাথের বহুত ছেলেকে দেখেছি, চারপাশের মেয়েদের সাথে জঘন্য ব্যবহার করতে, অথচ নিজের মা-বোনের সাথে আশা করে সকলে বোনসুলভ ব্যবহার করবে!!!
ভণ্ডামির এরচেয়ে নিকৃষ্ট নমুনা আর হয় না।
তবে এটা স্পষ্ট, সম্পর্ক গড়ার উন্মুক্ত জায়গা নেই বলেই এশিয়ান ছেলেমেয়েদের কাছে ফেসবুক অত্যন্ত প্রিয়। এখানে একই সাথে নিজেকে শো অফ করা, প্রেমিক প্রেমিকা জোটানো, নিঃসঙ্গ জীবনে একরাশ ভার্চুয়াল নারীপুরুষের উপস্থিতি এশিয়ান ছেলেমেয়েদের মনের সবচেয়ে নেশাগ্রস্থ আনন্দের জায়গা।
আমার পরিচিত ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশই ফেসবুকে আমার সাথে কানেক্টেড। তাদের অনেকের সাথে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয় এবং এদের বিরাট অংশের কাছে ফেসবুক সম্পর্ত তৈরির জায়গা। কারণ ব্যক্তিগতভাবে এরা প্রেম তথা যৌনজীবনে অসুখী। এবং সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে এরা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে না। এদের যৌনতার বিকল্পও ফেসবুক।
পুঁজিবাদীদের অবশ্য এতো সংস্কার বা বিধিনিষেধ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। পুঁজি সম্ভবত একমাত্র অস্ত্র যা দিয়ে সংস্কার বা বিধিনিষেধ ইচ্ছামতো তৈরি করা যায়, কোনো জ্ঞান দিয়েও এটা করা যায় না বর্তমানে। পুঁজিবাদীদের জন্য আছে বিভিন্ন পার্টি, এসকর্ট হাউজ, লোভাতুর প্রেমিকা, সাদা চামড়ার সুন্দর মাংসের মস্তিষ্কহীন ছেলে।
অনেকগুলো সিনেমা এবং বইয়ের কথা মনে পড়ছে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে। ঐশ্বরিক কিছু ডিরেক্টর এবং লেখকগণ কতো সুন্দরভাবে আমাদের নিস্ফলতাপূর্ণ জীবনযাপন ও মূল্যহীন আয়োজনের বর্ণনা দিয়ে গেছেন!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:০৪