ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে দুর্গাপূজা। এ পূজা পবিত্র না অপবিত্র তা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু এই শারদীয় দুর্গোৎসবের একটি জঘন্য ইতিহাস জেনে এর প্রতি তীব্র ঘৃনা হয়।
দুর্গাপূজার ইতিহাস অনেক পুরানো হলেও আমাদের দেশ ও ইন্ডিয়াতে প্রচলিত শারদীয় দুর্গাপূজার ইতিহাস মোটেও অতি প্রাচীন নয়। পলাশী যুদ্ধের ক’দিন পরেই পলাশীর দেবাসুর (দেব ও অসুরঃ লর্ড ক্লাইভ দেবতা, সিরাজউদ্দৌলা অসুর! লেখক ভবানীচরণ বন্দোপাধ্যায় এভাবেই একে নামাঙ্কিত করেছেন।) সংগ্রামকে উপজীব্য করে বাংলায় শারদীয় দুর্গাপূজা প্রথম চালু হয়। এর আগে বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন ছিলো না। শ্রীরাধারমন রায় ‘কলকাতার দুর্গোৎসব’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘দুর্গাপূজা পলাশী যুদ্ধের বিজয় উৎসব।’ বাংলাকে (সমগ্র বাংলা) পরাধীন করে পলাশী যুদ্ধের বিজোয়ৎসব করার জন্যই এই পূজা ১৭৫৭ সালে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় নদীয়া ও কলকাতায়। এই উৎসবের আসল উদ্দেশ্য ছিলো ‘পলাশী বিজয়ী’ লর্ড ক্লাইভের সম্মাননা ও সংবর্ধনা প্রদান।
রাধারমন রায় লিখেছেন-
“১৭৫৭ সালের ২৩জুন তারিখে পলাশীর রণাঙ্গনে মীর জাফরের বেইমানির দরুণ ইংরেজ ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটলে সবচেয়ে যারা উল্লসিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র আর কলকাতার নবকৃষ্ণ। কোম্পানির জয়কে তারা হিন্দুদের জয় বলে মনে করেন। ধূর্ত লর্ড ক্লাইভও তাদের সেরকমই বোঝালো। ক্লাইভের পরামর্শেই তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব করার আয়োজন করলেন। বসন্তকালীন দুর্গাপূজাকে তাঁরা পিছিয়ে আনলেন শরৎকালে- ১৭৫৭ সালেই তাঁরা বহু টাকা খরচ করে শরৎকালীন দুর্গাপূজার মাধ্যমে পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব পালন করলেন। এরপরের বছর শরৎকালে দুর্গাপূজা করে তাঁরা পলাশীর যুদ্ধের স্মারক উৎসব পালন করেছেন আর অন্যান্য হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ীদেরও তা পালন করতে উৎসাহিত করেছেন। শরৎকালীন দুর্গাপূজা যে বছর প্রবর্তিত হয়েছিলো, সেই ১৭৫৭ সালেই কৃষ্ণচন্দ্র ও নবকৃষ্ণ দু’জনেই লক্ষাধিক টাকা খরচ করেছিলেন। নবকৃষ্ণ টাকা পেয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌল্লার গুপ্ত কোষাগার লুট করে। আর কৃষ্ণচন্দ্র টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভের প্রত্যক্ষ কৃপায়।
আগে বসন্তকালে চালু ছিলো দুর্গাপূজা আর শরৎকালে চালু ছিলো নবপত্রিকাপূজা। দুর্গাপূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলো মূর্তির ব্যপার, আর নবপত্রিকা পূজার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলো নটি উদ্ভিদের ব্যপার। পরে এই দু’টি ব্যপারকে গুলিয়ে একাকার করে ফেলা হয়েছে। ১৭৫৭ সাল থেকে নবপত্রিকা হয়েছে দুর্গা। তাই শরৎকালে দুর্গাপূজার বোধনের দরকার হয়। আর আগে নবপত্রিকা পূজা করে পরে দুর্গাপূজা করতে হয়।
তাহলে দাঁড়ালো এইঃ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিজোয়ৎসব পালন করার জন্যে বসন্তকালের দুর্গাপূজাকে শরৎকালে নিয়ে এসে নবপত্রিকা পূজার সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। এই কাজ করেছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্র এবং কলকাতার নবকৃষ্ণ। আর তাঁদের উৎসাহিত করেছিলো ক্লাইভ। ক্লাইভ যে উৎসাহিত করেছিলো তার প্রমাণ হচ্ছে নবকৃষ্ণের বাড়িতে পূজা অনুষ্ঠানে ক্লাইভের সপরিষদ উপস্থিতি।
নবকৃষ্ণের পুরানো বাড়ির ঠাকুর দালানটি তৈরি হয়েছিলো ১৭৫৭ সালেই। খুবই তড়িঘড়ি করে এটি তৈরি করা হয়েছিলো। দুর্গাপূজার চাইতেও ক্লাইভকে তুষ্ট করা ছিলো নবকৃষ্ণের কাছে বড় কাজ। তিনি ভালো করেই জানতেন, সাচ্চা সাহেব ক্লাইভ ধর্মে খ্রিস্টান, মনে মনে মূর্তি পূজার ঘোর বিরোধী। অতএব, স্রেফ দুর্গাঠাকুর দেখিয়ে ক্লাইভের মন ভরানো যাবে না এটা তিনি বুঝেছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভের জন্য বাইজী নাচের, মদ-মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এজন্য একই সময়ে একই উঠানের একপ্রান্তে তৈরি করিয়েছিলেন ঠাকুর দালান, আরেক প্রান্তে তৈরি করিয়েছিলেন নাচ ঘর। নবকৃষ্ণের কাছে দুর্গাঠাকুর ছিলো উপলক্ষ, ক্লাইভ ঠাকুরই ছিলো আসল লক্ষ্য। দুর্গাপূজার নামে তিনি ক্লাইভ পূজা করতে চেয়েছিলেন। কলকাতায় শরৎকালীন দুর্গোৎসব প্রবর্তনের সময় নবকৃষ্ণ সাহেব পূজার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা পরে উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠে কলকাতার বাবুদের মধ্যে দুর্গাপূজা উপলক্ষে সাহেব পূজা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হওয়ায়।”
[রাধারমন রায়ঃ কলকাতা বিচিত্রা, পৃষ্ঠা ২৩৫-২৮৩; দেহ সাহিত্য কুটীর প্রাইভেট লিমিটেড, ২১, ঝামাপুকুর লেন, কলকাতা।]
পলাশীতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে এই পূজার উৎসব কেনো? এই বিজয় আসলে কার??
আসলে লর্ড ক্লাইভই একদল নিকৃষ্ট শ্রেণীর প্রতারক গোষ্ঠি নিয়ে এই উপমহাদেশের সম্পদ হরিলুটের খেলায় মেতে উঠে। আর একে ধামাচাপা দিতে তৎকালীন ঘিলুহীন হিন্দু ধার্মিকদের তুষ্ট করে শুরু করা হয় শারদীয় দুর্গাপূজার উৎসব। তাই শারদীয় দুর্গাপূজার উৎসব দেখে আমার সেই মীরজাফর আর ঘষেটি বেগমদের কথা মনে পড়ে যায়। এই উৎসব দেখে আমার ঘৃণা আসে একরাশ।
ক্লাইভকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করে একটি লুটেরার দল রাতারাতি রাজা-মহারাজায় পরিণত হয়েছিলো। এই লুটেরারা ইংরেজদের হাতে দেশকে তুলে দিয়ে নিজেদের গোলায় ভরেছিলো অবৈধ সম্পদ। ১৮৩৯ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে গবেষক বিনয় ঘোষ সেকালের কলকাতার শ্রেষ্ঠ উঠতি ভাগ্যবান, যারা ইংরেজদের সহায়তায় দেশকে লুটে খেয়ে ধনী হয়েছিলো, তাদের একটি তালিকা দিয়েছেন ‘টাউন কলকাতার কড়চা’ নামক বইতে। এই লুটপাটের তালিকায় অনেক বিখ্যাত পরিবারের মধ্যে একজন হচ্ছেন ‘কার ট্যাগোর (ঠাকুর) এন্ড কোম্পানি’ এর প্রতিষ্ঠাতা দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাঁর পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আর তাঁরই কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
[দ্রষ্টব্যঃ টাউন কলকাতার কড়চা, পৃষ্ঠা ৭৭-৮৮
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১১:২৯