আজ ৪ঠা আগস্ট, ২০১৫ ইং তারিখের প্রথম আলো পত্রিকা যারা পড়েছেন তারা খবরগুলো জানেন।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে গতকাল ৩/৪ জন দুবৃত্ত যুবকদের একটি দল মুহুর্মুহু বোমা ফাটিয়ে যাত্রীভর্তি একটা বাস থামায়। তারপর ফিল্মি স্টাইলে পিস্তল বাগিয়ে বাসের ভিতরে প্রবেশ করে এবং একবাস ভর্তি যাত্রীর সামনে মুঠোফোন ব্যবসায়ী নুরুল ইসলাম (৪২) কে গুলি করে হত্যা করে। হত্যা করে নুরুল ইসলামের হাতে থাকা ব্যাগ নিয়ে দিব্যি সুস্থ তবিয়তে তারা চলে যায়। নুরুল ইসলামকে যখন গুলি করা হয়, তখন বাসভর্তি যাত্রীরা ৩/৪ জন যুবকের হাতে প্রাণ খোয়ানোর ভয়ে বাসের চেয়ারের নিচে মাথা গুজে পড়ে থাকেন। এবং নিজেদের অমূল্য পৈত্রিক প্রাণটাকে রক্ষা করতে পারার জন্য সম্ভবত তারা মনে মনে উল্লাসও বোধ করে থাকবেন।
এরপর ঘটনা শেষে মানুষ হিসেবে নিজেদের করণীয়টুকু খুব দ্রুতই তারা সেরে ফেলেন। আবেগঘন স্টাইলে পুরো বাসকেই হাসপাতালে নিয়ে নুরুল ইসলামকে দ্রুততার সাথে হাসপাতালে পৌঁছানোর কর্মটি সম্পাদন করেন তারা!!
এখন ব্যাগের ভিতরে থাকা বস্তুসমূহ কি হতে পারে তা বাদ দেয়া যেতে পারে। হতে পারে টাকা, হতে পারে জরুরী কাগজপত্র বা দলিল। হতে পারে মূল্যবান যেকোনো কিছু। মূল্যবান এমন জিনিস, যা একজন মানুষকে রাস্তাঘাটে কুকুরের মতো মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট!
বিস্তারিত জানতে ক্লীক করুন এখানে
এবার আরেকটি ঘটনায় আসি। আজকের ৪ঠা আগস্ট প্রথম আলো পত্রিকায় আরেকটি খবর আছে, তা হলো।
বনানী সৈনিক ক্লাব সংলগ্ন রেল লাইন ধরে একটি ৫/৬ বছরের ছেলে হাঁটছিলো। সময়টা ছিলো দুপুরের দিকে। রেল লাইন ধরে আসতে থাকা ট্রেনকে বাচ্চাটি দেখতেও পায়নি, ট্রেনের শব্দ খুব সম্ভব সে খেয়াল করেনি। ট্রেন এসে পড়েছিলো খুব কাছাকাছি। এতো কাছে যে, মৃত্যু ছিলো সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র।
সে সময় দুপুরে হোটেল থেকে লাঞ্চ খেয়ে কর্মস্থল ম্যাডোনা ফ্যাশন পোশাক কারখানায় ফিরে যাচ্ছিলেন মো: সুমন নামের ২৯ বছর বয়সী একজন পোশাক শ্রমিক। তিনি যখন শিশুটিকে রেল লাইনের উপর হাঁটতে দেখেন, তখন শিশুটির মৃত্যু ছিলো সময়ের ব্যাপার মাত্র। ট্রেন একেবারে সন্নিকটে।
কি হয় এসব ক্ষেত্রে?
মানুষ চিৎকার করে উঠে। বাঁচানোর জন্য কি করবে ভাবতে থাকে। কিংবা বিবেককে কিভাবে কাজে লাগাবে সেই চিন্তা করে।
কিন্তু সুমন কিছুই চিন্তা করেন নি। শুধু দেখছিলেন সামনে একটি প্রাণ হয়তো অকালে ঝড়ে যাবে ক্ষণিকের মধ্যে। জীবন রক্ষা করতে হবে শিশুটির। সুমন কোনো ধরণের বিপদ সম্পর্কে না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন রেল লাইনের উপর। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন শিশুটিকে। ট্রেন তখন একেবারে সামনে।
সুমনের অসাধারণ ঝুঁকি নেয়ার ফলে রক্ষা পায় শিশুটির প্রাণ। কিন্তু সুমন কিন্তু রক্ষা পাননি। ট্রেন মূহুর্তে তাঁকে পিষ্ট করে। ট্রেনে কাটা পড়ার পর যখন তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেয়া হয়, তখন সুমন আর বেঁচে নেই। বিশ্বাস করুন, এই কথাটি যতো সহজে আমি লিখছি, কথাটা অতো সহজ না!
একটি জীবন মূল্য দিয়ে বাঁচিয়ে গেলো অন্য জীবনকে!
ভাবতে পারেন এই আত্মত্যাগ! সুমন কিন্তু জানতেন না তিনি মারা যেতে পারেন, তিনি জানতেন বাচ্চাটি মারা যেতে পারে। বাচ্চাটিকে বাঁচাতে হবে
বিস্তারিত জানতে ক্লীক করুন এখানে
এবার ভাবুন শুরুর ঘটনাটি আর শেষের ঘটনাটি। যাদেরকে আমরা অফিসিয়াল, ফিল্মি সাজে সেজে থাকতে দেখি, যাদেরকে দেখি কথার তুবড়ি দিয়ে সারা বিশ্ব জয় করে নিজের জীবনের মূল্য ধরতেও ব্যর্থ হয়ে যেতে- সেই তাদেরকেই কিন্তু আমরা প্রতিনিয়ত সমাজের অংশ মনে করি।
পোশাক শ্রমিক, নিম্নবিত্ত লোকজন, রিক্সাওয়ালা- এদেরকে ভাবি সমাজের উচ্ছিষ্ট! ধিক আমাদের নিচু প্রবৃত্তির চিন্তাধারাকে! ধিক্!
দেখুন, ৩/৪জন যুবকের হাতে নিজের প্রাণ খোয়ানোর ভয়ে আপনার মতো, আমার মতো লোকেরা কিভাবে নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে আসি! ভয় পাই, যদি আমরা মরে যাই! অথচ সেখানে কিন্তু আপনি একা থাকেন না, আমিও একা থাকি না। সেখানে থাকে আপনারা, আমরা, জনতারা। এতোগুলো মানুষের সামনে যখন ৩/৪ জন দুর্বৃত্ত তাদের অমানিবকতার জয় নিয়ে যায়, তখন মানবতা দূরে থাক। আমাদের পুরুষত্ব কোথায় ছিটকে পড়ে আছড়ে মরে যায়- তা কি আমরা জানি?
প্রতিনিয়তই কাপুরুষ হচ্ছি আপনি, আমি, আমরা সবাই। তাও আবার গুটিকয়েক জনের কাছে।
আমাদের মধ্যে কি কোনো মানবিক যোগাযোগ নেই?
আমাদের মধ্যে কি কোনো মানবিক অনুভূতি নেই?
আমাদের মধ্যে কি এটা কাজ করে না যে, আমরা আসলে একা নই। ওই দুবৃত্তরা একা??
আমরা কেনো সম্মিলিত চিন্তা করতে পারি না? কিসের অভাব আমাদের??
এই ভদ্র-শান্তশিষ্ট-নিরীহ পশুর মতো মুখ বুজে পড়ে থেকে মানবিকতাকে গলা টিপে হত্যা করতে আমাদের একটুও বাঁধে না! এতোই নিকৃষ্ট আমরা!!
ইতিহাসে কোনো জায়গা হয়তো নেই সুমনের মতো নায়কদের। কিন্তু আমরা সবাই যদি এক একটা সুমন হতাম, বিশ্বাস করুন। সবই যদি একজন সুমন হতাম, তবে কোনো নুরুল ইসলামকে রাস্তাঘাটে কুকুরের মতো মরতে হতো না। রাজন নামের কোনো শিশুকে বিকৃতমনা লোকগুলো পিটিয়ে মেরে ভিডিও তৈরি করতে পারতো না। পারতো না অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু কিংবা সমাজের ভিন্নচিন্তার লোকগুলোকে গুপ্ত হত্যা করে ধর্মের মিথ্যা জয়গান করতে!
আমরা যদি একজন সুমন হতাম, তবে বনানীর ওই শিশুর মতো পুরো জাতিই রক্ষা পেতো। পুরো জাতিটাই তৈরি হতো অনেকগুলো সুমনের মতো চিন্তা করা শিখতে।
পোশাক শ্রমিক, কুলি-মজুর, বাদামওয়ালা, পতিতা, রিক্সাওয়ালা, পথশিশু- কি পায় এরা আমাদের কাছ থেকে??
এরা কিন্তু শিক্ষিত না। কিন্তু যেসব শিক্ষিত লোক তাদের কাছ থেকে শিক্ষামূলক আচরণ আশা করে, তাদের শিক্ষা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এই বঞ্চিতরা কিছুই পায় না। চড়-থাপ্পর, লাথি-উষ্ঠা অবশ্য নিয়মিত দেই তাদের আমরাই। কিংবা কেউ দিলেও তার প্রতিবাদ করা হতে বিরত থাকি আমরাই। এই যখন আমাদের অভ্যাস, কি করে এমন অভ্যাস নিয়ে বন্দুকের মুখ হতে মানুষকে উদ্ধার করে মানবতার জয় ঘোষণা করবো??
আমি আসলে সমাধান জানি না, শুধু ঘৃণা প্রকাশ করতে পারি। আপনার উপর, আপনাদের উপর। আমার উপর, আমাদের উপর।
একরাশ ঘৃণা, অবজ্ঞা আর থুথু!
অনেকগুলো সুমনের খুব দরকার আমাদের জাতির নিরাপত্তার জন্য। অনেকগুলো ত্রাণকর্তা দরকার আমাদের জন্য। কারণ আমরা আসলে Collective Consciousness- কে এক করা বা এক হওয়াই শিখিনি। আমারা শিখিনি যে, একতাই বল।
কে আছে যে আমাদের পতন হওয়া বিবেককে একত্রে একটি মালায় গাঁথা শিখাবে। তাহলে বিলাসবহুল পৃথিবী না দেখি, একটু মানবতার জয় দেখতে পারতাম! বড় আশ জাগে এজন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৪২