চিনির বাজারে কারসাজি করে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বাজার থেকে ছয়শ’ কোটি টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত এবং অব্যবস্থাপনার ফলে দেশের সাধারণ ভোক্তাদের এই ছয়শ’ কোটি টাকার যোগান দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম কমছে। বাংলাদেশেও চিনির দাম ছিল সহনীয় পর্যায়ে। প্রতি কেজি চিনি পঁয়তাল্লিশ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল। একেবারে আচমকা সরকারের কাছ থেকে ঘোষণা আসলো ষাট টাকার বেশি দরে চিনি বিক্রি করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। সরকার ষাট টাকা দরে ন্যায্য মূল্যে চিনি বিক্রি করবে। চিনি আমদানিকারক এবং বাজার নিয়ন্ত্রণকারী বাঘা বাঘা ব্যবসায়ীরা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। সরকার যদি ন্যায্য মূল্য বলতে ষাট টাকা নির্ধারণ করে তাহলে আমরা পঁয়তাল্লিশ টাকায় কেন চিনি বিক্রি করবো। অপরদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিকে যখন পঞ্চাশ টাকা
দরে চিনি বিক্রি করতে মাঠে নামানো হলো তখনো চাক্তাই খাতুনগঞ্জে চিনি বিক্রি হচ্ছিল পঁয়তাল্লিশ টাকা দরে। সরকারের বাড়তি দরের সাথে পাল্লা দিতে ব্যবসায়ীরা উঠে পড়ে লাগলেন। আর এভাবে পঁয়তাল্লিশ টাকার চিনি ক্রমে ষাট টাকায় গিয়ে ঠেকার যোগাড়যন্ত্র সম্পন্ন হচ্ছে। গতকাল চাক্তাই খাতুনগঞ্জে বিক্রি বন্ধ রেখে চিনির দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সরকারের তরফ থেকে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়া না হলে ভোক্তাদেরকে ভুগতে হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে চিনির চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ছে। অপরদিকে সরকারি খাতে উৎপাদন প্রতিনিয়তই কমছে। বছর কয়েক আগেও রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ১৬টি চিনিকল প্রতিবছর গড়ে দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করতে পারতো। যা বর্তমানে কমে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টনে নেমেছে। বছর পাঁচেক আগে দেশে চিনির চাহিদা ছিল পুরোবছরে লাখ দশেক টন। বর্তমানে তা চৌদ্দ লাখ টনে গিয়ে ঠেকেছে। অপরদিকে গত কয়েক বছরে দেশে বেসরকারি খাতে বড় বড় পাঁচটি চিনিকল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। বছর দশেক আগেও চিনির বাজার পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। বর্তমানে এই খাতে সরকারের ভূমিকা তেমন একটা নেই বললেই চলে। দেশের ৫টি বেসরকারি চিনিকল গড়ে প্রতিদিন ৫ হাজার টন চিনি উৎপাদন করতে পারে। ব্রাজিল, থাইল্যান্ড, ভারত এবং মায়ানমার থেকে চিনি আমদানি হয়। বর্তমানে ব্রাজিল এবং থাইল্যান্ড থেকে সুগার আমদানি করে পাঁচটি চিনিকলে পরিশোধন করে বাজারজাত করা হচ্ছে। সরকারি কোন নিয়ন্ত্রণ না থাকায় হাতে গোনা কয়েক ব্যক্তি চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এতে করে প্রায়শঃ দেশে চিনি কেলেংকারীর ঘটনা ঘটে। প্রতিবছর রোজাকে সামনে রেখে এমন ঘটনা ঘটে। চলতি বছরও একই ধরনের ঘটনা ঘটার আশংকা করা হচ্ছে।
চলতি বছর চিনির বাজার একেবারে স্থিতিশীল ছিল। ভারতে প্রচুর চিনি উৎপাদন হয়েছে। ব্রাজিল কিংবা থাইল্যান্ডেও একেবারে রমরমা অবস্থা। আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম ক্রমাগত পড়ছে। বর্তমানে দেশে যে চিনির মজুদ রয়েছে বা যেগুলো পাইপ লাইনে রয়েছে সেসব চিনির আমদানি খরচ কেজি প্রতি চল্লিশ টাকার বেশি পড়েনি। চিনি নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্যও কোথাও ছিল না। কিন্তু একেবারে হঠাৎ করে সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী রাষ্ট্রায়ত্ত্ব চিনিকল পরিদর্শনে গিয়ে ৬০ টাকাকে ন্যায্য মূল্য ঘোষণা দিলেন এবং সরকারি চিনিকলগুলোর চিনি ষাট টাকা দরে বিক্রি করার নির্দেশনা দিলেন। অথচ চাক্তাই খাতুনগঞ্জে তখন ৪৫ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি হচ্ছে। সরকার ৬০ টাকা চিনি বিক্রিকে ন্যায্যমূল্য ঘোষণা দিয়ে ষাট টাকার বেশি দরে যাতে চিনি বিক্রি না হয় সেই ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন।
ব্যাপারটিকে মেঘ না চাইতে জলের মতো মনে করলেন দেশের হাতে গোনা কয়েকজন চিনি আমদানিকারক এবং বেসরকারি পাঁচটি মিলের মালিক। রাতারাতি চিনির বাজার দর বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হলো। ইতোমধ্যে চিনি নিয়ে মাঠে নেমেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবি। ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করে টিসিবি পঞ্চাশ টাকা দরে চিনি বিক্রি করছে। চাক্তাই খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরাও থেমে থাকেননি। ৪৫ টাকার চিনি ইতোমধ্যে তারা ৫১ টাকায় নিয়ে গেছেন। গতকাল চাক্তাই খাতুনগঞ্জে বড় বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কোন চিনি বিক্রি করা হয়নি। আজ কালের মধ্যে চিনির বাজার দর আরো বাড়িয়ে সরকারের ঘোষিত ন্যায্যমূল্যে নিয়ে যাওয়ার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, দেশে রোজার একমাস এবং আগের ও পরের কয়েকদিনে চার লাখ টনের মতো চিনির ব্যবহার হয়। এই চার লাখ টন চিনিতে কেজি প্রতি ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে অন্তত ছয়শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বাজার থেকে তুলে নেবে।
দেশে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ চিনির মজুদ রয়েছে। আরো চিনি পাইপ লাইনে রয়েছে। দেশে চিনির কোন সংকট নেই। অন্তত রোজার মধ্যে চিনি সংকটের কোন আশংকা নেই। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির যা অবস্থা তাতে প্রতি কেজি চিনি চল্লিশ টাকায় বিক্রি করা সম্ভব। অথচ বাজারে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এখন সরকার যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে ভোক্তাদের ভুগতে হবে বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।