কবে বড় হবে
--হোসনে আরা মণি
গল্পটি-- পৃথিবীর। একটি শহরের। কয়েকটি জীবনের। জীবনবোধের।
সকাল দশটা। যেকোন শহরের জন্য একটা হুড়োহুড়ির সময়।
দোকানদারেরা শব্দদূষণ করে সাটার গোটাচ্ছে, ধুলো উড়িয়ে ঝাটপাট দিচ্ছে এবং দোকানের সামনে রাস্তায় বালতি থেকে পানি ছিটাচ্ছে।
পাজেরো আরোহী সাহেব-মেমগণ অলস বসে মোবাইলের বাটন টিপছেন, কপালে বিরক্তির রেখা এঁকে মনে মনে কোন মন্ত্রীর চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করছেন এবং দুবাইয়ে ফ্ল্যাট বুকিংয়ের পরিকল্পনা আঁটছেন।
ঘরে ঘরে গিন্নীদের ধুন্ধুমার অবস্থা। যেহেতু তারা বেকার জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত, সেহেতু তাদের কর্মযজ্ঞের আলোচনা নিষ্প্রয়োজন।
সিটিং সার্ভিসের পাদানিতেও তখন আরেকটা বাদুড়ের ঠাঁই নেই দশা। গাড়ির মধ্যে আমজনতার সাথে মিলে আছে কিছু পকেটমার, মিচকে বদমাশ, উঠতি প্রেমিক, পাকা খেলোয়াড় এবং অবশ্যই কিছু ‘লেট লতিফ’ যারা নটার অফিস দশটায় এবং দশটার ব্যাপার বারোটায় করতে চিরকালই অভ্যস্থ।
অন্যসব দিনের মতই আজো এ শহরের মানুষেরা জীবনের আরেকটি দিনকে ক্ষয় করে পৃথিবীটাকে কয়েক সুতো এগিয়ে বা পিছিয়ে দেয়ার ব্যাপারে যার যার পূর্বনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে চলছে মাত্র। এমন সময় এ ঘটনা।
ঘটনায় প্রবেশের পূর্বে আমরা জেনে নেই ওসময় কে কী করছিল।
ওরা ছয়জন-- আলিশা, রুমা নাজ, অনির আম্মু, কবি হিরণ রাহমান, ডাঃ শাফিক হুসাইন এবং মন্তাজ মুন্সী।
বাড়ির নাম ঝিঁ ঝিঁ নিবাস। এর পাঁচতলার একটি ফ্ল্যাটে সুন্দরী, সুতন্বী আলিশা তখন তার দৈনন্দিন মেকাপে ফাইন্যাল টাচ্ দিচ্ছিল। অর্ণবের প্রাডোটা আজ প্রথম লংড্রাইভে ছুটবে। আলিশাকে পাশে না পেলে এই সেলিব্রেশনটা কী করে ইনজয় করবে সে? অতএব আলিশার ভেতরকার উল্লাস তার মুখের কমপ্যাক্ট পাউডার ছাপিয়ে ঝলমলিয়ে উঠছিল।
প্রায়সেলিব্রেটি রুমা নাজ জিন্সের ঊর্ধ্বে টপ চড়িয়ে কপালে সানগ্লাস তুলে এলামেলো চুলে আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে স্বচ্ছন্দ দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। দোতলার মুখে এসে সে হঠাৎ কী মনে পড়ায় থমকে গেল এবং ‘ওহ্ শীট্’ বলে স্বগোতোক্তি করে ফের চতুর্থতলায় উঠতে থাকল।
মোটাসোটা গিন্নী অনির আম্মু এখন অনিকে স্কুল থেকে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু ডালটা এখনো ফোটেনি দেখে এই ফাঁকে সে স্বামীর ওয়ারড্রোবের কাপড়গুলো একটু গুছিয়ে রাখছিল। যা অগোছালো না লোকটা!
ছয়তলা বাড়ির একমাত্র পুরুষ ব্যাচেলর চিলেকোটার ভাড়াটিয়া কবি হিরণ রাহমান ধীরে-সুস্থে গুনগুনিয়ে হিন্দি ছবির চটুল গানের দু’কলি ভাঁজতে ভাঁজতে গালে শেভিং ফোম ঘষছিল।
এ বাড়ির সর্বাধিক সম্মানিত ভাড়াটিয়া ডাঃ শাফিক হুসাইন তার বিএসএমএমইউ এর ডিউটির কথা মাথায় রেখে ল্যামডা এইডের সাথে তার বনিবনাটা ওভারফোনে একটু ঝালাই করে নিচ্ছিলেন। এসব নামকরা প্রতিষ্ঠানগুলো ডাক্তারকে ঠকায়না বটে কিন্তু নাক উঁচু মনোভাবটাও গোপন রাখেনা। দেশের সব নামকরা বিশেষজ্ঞসার্জন যাদের পকেটে তাদের সাথে দরকষাকষিতে শাফিক এখনই পারবেন কেন। তবু যাহোক রাজনৈতিক অঙ্গনে শক্ত খুঁটি থাকায় একটু-আধটু যা কল্কে পাওয়া যায়।
ঝিঁ ঝিঁ নিবাসের কেয়ারটেকার কাম সিকিউরিটি ইনচার্জ কাম ইনভেস্টিগেটর কাম একাউন্ট্যান্ট কাম কালেকটর মন্তাজ মুন্সী ঐ সময়ে ঠিক কী করছিল? সম্ভবতঃ তার অন্যদিনকার মতই একটা নিত্যকর্মে নিরত ছিল-- লুঙ্গির মধ্যে হাতটা গলিয়ে খুব করে অন্ডকোষটা চুলকে নিচ্ছিল।
এমন সময় প্রথম ঝাঁকুনিটা দিল।
মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে---
রূপবতী আলিশা তার রূপের গুরুত্ব ভুলে
রুবিনাজ তার গগনচুম্বী উচ্চাকাক্সক্ষা ভুলে
অনির আম্মু তার সাজান সংসারের মায়া ভুলে
ডাক্তার তার ক্যারিয়ার দৌড়ের চিন্তা ভুলে এবং
মন্তাজ মুন্সী তার চুলকানির আরাম ভুলে যখন সরকারি রাস্তায় বেসরকারি অনুভূতি নিয়ে বেওয়ারিশ বনার সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে তখন কবি হিরণ উন্মুক্ত আকাশের নিচে দোদুল্যমান ছাদের পরে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে পানির পাইপ আঁকড়ে ধরে শুয়ে থাকাই সাব্যস্ত করে।
দুলছে জগৎ, কাঁপছে জমিন। মানুষের পায়ের তলা থেকে সর্বংসহা ছুটে পালাতে চাইছে। বহতল ভবনগুলো চোখের সামনে ক্রমাগত দোল খেয়ে চলছে-- যেন মাটির খুঁটিতে পুতে রাখা একেকটি দোলনা। কিন্তু এ দোলনায় আটকে থাকা শিশুরা নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমুবার বদলে প্রানপন চিৎকার দ্বারা সমগ্র বিশ্বের শ্রবণযন্ত্রে তাদের মরণাতঙ্ক পৌঁছে দিতে একান্ত নিরত।
এখন অগণিত সুরম্য-বীভৎস্য ভবনে আকীর্ণ নগরটিতে আলিশা, রুবিনাজ, অনির আম্মু, ডাক্তার, মুন্সী, কবি-- সকলের চিন্তা একটি বিন্দুতে কেন্দ্রিভূত-- কোথায় মিলবে একটি বিন্দুবৎ স্থান যেখানে দাঁড়ালে অন্ততঃ মাথার পরে কোন ভবন ভেঙ্গে পড়ার সম্ভাবনা থেকে বাঁচা যায়?
অথচ একটু পরে পায়ের তলার মাটি যখন স্থির হয়, মানুষ যখন প্রকৃতির প্রহার থেকে মুক্তি পেয়েছে বলে মনে করে তখন তারা এক অপরের দিকে চেয়ে অর্থহীন বোকার হাসির আড়ালে মূলতঃ দ্ব্যর্থবোধক হাসিই হাসে। তারপর ঢুকে পড়ে যে যার ডেরায়।
তারপর--
সুন্দরী আলিশা ফোনে বন্ধুকে বলে, জান জান, যা ভয় পেয়েছিলামনা.........
রুবিনাজ তার গডফাদারকে বলে, ইউ জাস্ট ইমাজিন, বিল্ডিংগুলো সব দুলছিল..........
অনির আম্মু অনির আব্বুকে ফোনে বলে, তুমি ঠিক আছতো?
ডাঃ শাফিক এ নিয়ে আলোচনাকে সিলি ম্যাটার মনে করেন। তিনি বরং টিভি চ্যানেলে ভূমিকম্প বিষয়ক খবরের আপডেট দেখতে থাকেন।
মুন্সী মন্তাজ চট করে ঘরে না ফিরে রাস্তার জনতা ও ফুটপাথের দোকানদারদের ভূমিকম্প বিষয়ক আলোচনা ও মতামত উপভোগ করে শেষে নিজের ঘরে ঢুকে ফুলির মার মোবাইলে কল করে কুশল জানার শুরুতে বলে, তুগার অনে কি আইজ মাডি কাঁপছিল?
শুধু কবি হিরণ রাহমান এ নিয়ে কারো সাথে খোশগল্পে মত্ত হওয়ার বদলে লিখতে বসে পৃথিবীর প্রতিহিংসা ও মানবজাতির অনিত্যতা বিষয়ক একটা দূর্দান্ত আবেগময় অথচ উঁচুদরের দার্শনিক কবিতা। সে কবিতার প্রধান উপাদান এক হতবিহ্বল উদ্ভ্রান্ত নারী, যে ভূমিকম্পের সময় আপনার ঘুমন্ত সন্তানকে ঘরে অরক্ষিত ফেলে নিরাপত্তার খোঁজে রাজপথে নেমে এসে সন্তান হারাবার আশঙ্কায় মাতম করছিল। আমাদের কবি হিরণ সে দৃশ্য সচক্ষে না দেখেও কেবল ঘটনার পরে ঘনঘটাময় আলোচনা শুনেই ভয়ঙ্কর কবিত্বের জোরে লিখে ফেলে একটা দুর্ধর্ষ দার্শনিক তত্ত্বসমৃদ্ধ ঠাসবুনোটি কবিতা।
সবই ফের পূর্ববৎ।
কেবল ধরিত্রিমাতা ফের ঘুমুবার পূর্বে একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে মনে মনে বলে, আমার সন্তানেরা, তোমরা কবে বড় হবে?