দুজন দুজনার
হোসনে আরা মণি
মদনপুর গ্রামের রসিক বুড়ো বদন মিয়ার থোঁতামুখটা শেষপর্যন্ত ভোঁতাই হল। বুড়ো বদনের কুঞ্চিত চর্ম ও গুটিকয়েক অস্থিসমৃদ্ধ ভাঙ্গাচোরা বদনের মাঝে যে চোখ দুটোতে যৌবনসুলভ দীপ্তিময়তার সাথে উদ্দীপনাময় চঞ্চলতা এমনকি কখনো-সখনো বেশ খানিকটা কামনা মাখা থাকত সে চোখ এখন নিষ্প্রভ, মৃতবৎ। নিজমুখে উচ্চারিত মাত্র একটি অপরিণামদর্শী শব্দ তার বিরাশি বছরের জীবনকে যে এমন ওলট-পালট করে দেবে তা কি আর বদন জানত?
সকালবেলা বদনের মেজাজটা ইদানীং প্রায় দিনই বেশ খারাপ থাকে। স্ত্রী সালেমা বিবি বয়সে বদনের চেয়ে বছর বিশেরও বেশি ছোট হলে কী হবেÑ বার্ধক্য তাকেই যেন পেয়ে বসেছে বেশি। এ নিয়ে বদনের আফশোসের সীমা নেই। বৌটা এ বয়সেই এমন হেজে গেল যে দীর্ঘায়িত পৌরুষভাগ্যে ভাগ্যমান বদনের পুরুষত্ব বিশেষ কোন কাজেই আসছেনা। সক্ষম পুরুষ বদনের শক্তিমত্তা কেবল তার নিজের মনেই গর্ব সৃষ্টি করে নিজের মধ্যেই স্ফীত হয়ে উঠছে, সালেমা বিবির মনে কোন শ্রদ্ধা-ভক্তি দূরে থাক, সামান্য সহানুভূতিও উদ্রেক করাতে পারছেনা। খাঁটি ‘মরদ’ হিসাবে স্ত্রীর নিকট থেকে যে সকৃতজ্ঞ সমাদর তার পাওনা তাতো সে পাচ্ছেইনা, উল্টো মুখঝামটা সয়ে দিন কাটছে। রাতেরবেলা স্ত্রীর সান্নিধ্যলাভে উন্মুখ, মত্তপ্রায় পুরুষকে যখন নিঃসাড়, নিষ্কাম নারীর দেহে উপগত হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে হয় তখন সেই অপমান তার মুখে যে কালবোশেখের মেঘ সঞ্চার করে তা পরবর্তী দিনের রৌদ্দ্রজ্জ্বল আবহাওয়াও যে দূর করতে ব্যর্থ!
বৈশাখী তা-ব তাই এ বাড়ির জন্য প্রায় নৈমিত্তিক ঘটনা। বাইরের কেউ অবশ্য বিশেষ কিছু বুঝতে পারেনা। বুড়োর হটকারী আচরণ দেখে সবাই ভাবে যে লোকটা মাথা পাগলা আউলা-ঝাউলা কিছিম। কিন্তু বুড়োটা যে রসের পাগল এবং রসের যোগান অপর্যাপ্ত হলেই কেবল তার পাগলামীর বায়ু মাথায় চড়ে তা সালেমা বিবি কাউকেই বুঝতে দেয়না। এসব শরমের কথা চেপেচুপে রেখেই সে স্বামীকে বাগে রাখার চেষ্টা করে। যেমনÑ বুড়োটা যদি ছুটে এসে তার সদ্য লেপা ঘর পায়ে কুটে যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলে তো সালেমা বিবি রাগে-ক্ষোভে দাঁত কিড়মিড় করলেও কোন প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেশিনীর বিস্মিত প্রশ্নের জবাবে অনায়াসে বলে, ভাত না রাইন্ধা ঘর লেপিচ্ছি তাই রাগ। তা দেখলে কান্ড? ঘর লেপিচ্ছি বল্যা কি আর ভাত রানবোনা? খিদে পালে মানুষটার আর জ্ঞান থাকেনা.....।
কিন্তু ইদানীং সালেমারও যেন কেমন হাঁপ ধরে আসছে। এই বয়সের মেয়েমানুষ আর কতটা সামলাতে পারে? বুড়োটার না হয় বয়সের গাছ-পাথর নেই, কিন্তু সালেমার তো তিনকুড়ি বয়স হতে চলল! ছেলে-বৌ-নাতি-নাতনি নিয়ে ভর-ভরন্ত সংসার। মেয়েরাতো নাতনীদেরও বিয়ে দিয়ে সেরেছে। অবশ্য সেসব বদন মিয়ার প্রথম সংসারের ফসল। দ্বিতীয় সংসারে অর্থাৎ সালেমা বিবির ঘরে তার কেবল গোটা পাঁচেক পুত্রই জন্মেছে, কন্যাদায় বাড়েনি। এজন্য অবশ্য বদন মিয়া বিবির পরে ‘বহুৎ খুশ’্Ñ আর যাই হোক বৌটা তার অপয়া নয়; বদন মিয়ার সংসার সে ভরিয়েছে ছাড়া কমতি কিছু ঘটায়নি। সংসারে যা কিছু উন্নতি তার পেছনে সালেমা বিবির অনেক অবদান। দুর্দিনে-দুর্ভিক্ষে বাপের বাড়ি থেকে অর্থকড়ি যৌতুক এনে সংসারটাকে ঠেক দিয়েছে, সারাজীবন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কিছুমাত্র অনুযোগ ছাড়াই হাসিমুখে ঘর-গেরস্থালি সামলেছে। যৌবনে সালেমা বিবির রূপও নেহাত ফ্যালনা ছিলনা। অথচ সে যে আর পাঁচটা উষ্কানিতে কান না দিয়ে একমনে তখনকার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী বিপতœীক পতির সংসার করেছে তার জন্য বদন কৃতজ্ঞ।
কিন্তু ইদানীং বুড়িটার ব্যবহার বদনের কাছে অসহ্য ঠেকে। কেবল রাতের আচরণই নয়, দিনের বেলাতেও বুড়ির ব্যবহারে কোথায় যেন একটা পার্থক্য টের পাওয়া যায়। আগেকার দিনে অর্থাৎ এই বছর কয়েক আগেও বৌটা তার কোন আবদারেই না করতনা। কিংবা করলেও পরে সুদে-মূলে উসুল করে দিত। সালেমা বিবির ব্যবহারে বরাবরই একটা বাধ্যতার ছাপ ছিল। বদন মিয়ার মুখে কখনো মেঘ জমলে সালেমার চোখের ধারাপতনে তা সত্ত্বর অন্তর্হিত হত। তাই কালবোশেখীর রুদ্র তা-ব ঘটবার অবকাশ খুব কমই মিলত। কিন্তু ইদানীং বৈশ্বিক উষ্ণতার যুগে জলবায়ুর চরিত্র বদলের মত করে বদন-সালেমার দাম্পত্য নিয়মেও কিছু বদল ঘটেছে। সালেমার ক্ষীণজ্যোতি চোখে এখন আর কারণে-অকারণে শ্রাবণধারা বয়না। বরং শুষ্ক-খরচোখে প্রেমহীন কোপ ও তাচ্ছিল্য মিশিয়ে সে প্রায়ই বলে, মরদের মুরোদ তো খালি ঐ একখান কামেই পরকাশ পায়। আর সবেতেই ঢুঁ ঢুঁ। সেই যে কয় নাÑ ভাত দিবার ভাতার তো না, কিল মারার গোঁসাইÑ উনি হলেন তাই। সেই কতকাল হয় সাঁঝ নামলেই চোখ আন্ধার, আতের কাম-কাইজ সব আন্দাজে সারি, কিন্তু তা নিয়া মিনসের কুনো মাথাব্যথা নাই। মিনসে আছে খালি ঐ এক ধান্ধায়। ঝাঁটা মারি অমন জুয়ানকিতে। আশি পার দিয়া ভীমরতি!
যেকথা এতদিন অপ্রকাশ ছিল এই অশীতিপর বয়সে এসে তা নানা বয়সী, নানা সম্পর্কীয়-অসম্পর্কীয় জনের মুখে নানা মাত্রার, নানা ঢংয়ের হাসির খোরাক যুগিয়ে চলে। বুড়োকে দেখে এখন সবাই হাসে। সবচে বেশি হাসে বুঝি পুতের বৌরা। ইদানীংকালের ফিচেল ছুঁড়িদের লাজ-শরম, আদব-লেহাজে এমনিতেই বড় অনটন দশা; তার উপর এই বজ্জাত বেটিগুলানের অনেকেই এসে জুটেছে শহর থেকে। ছেলেগুলো একটু লায়েক হলে পর গারমেন্টে চাকরির নাম করে শহর ধরে দুএক বছর পার করে পরে প্রায় খালি হাতে এককটা হুর বগলদাবা করে নিয়ে ফিরেছে। সেই হুরপরীরা যখন-তখন হি হি করে হাসে, ঘোড়ার বেগে ছোটে এবং পরিকল্পনার আপাদের সাথে ফুসুর ফুসুর করে কত কী পরামর্শ আঁটে। এদের পরামর্শ একদিন বদন মিয়ার কানে আসলে সে তো অবাক। তাজ্জব ঘটনা! এরা নাকি একটা দুটোর বেশি বাচ্চা বিয়োতেও রাজী না! ছোট বৌতো একদিন বলেই বসল, তোমকার মতন অত্তগুলান বিয়ান যাইবে নাগো মাও, পাঁচটা-দশটা ছল বিয়্যেই নষ্ট বানাবার চায়ে এট্টা-দুটা ছল নিয়া লেখাপড়া শিখায়া মানুষ করাই উচিৎকাম......
তো এই ‘উচিৎকামওয়ালী’রা যখন তাদের দাম্পত্যের অভ্যন্তরীণ জটিলতার রহস্য বুঝে মুখে আঁচলচাপা হাসি হাসতে শুরু করল তখন প্রায় নীরিহ সালেমা বিবিও বুঝি কোন সূক্ষ অপমানবোধে তাড়িত হয়ে বদমেজাজী মুখরা রমনীর বেশ ধারণ করল। আসলে সালেমা বিবিকেও ততটা দোষ দেয়া যায়না। সত্যিই তার শরীরটা ইদানীং ভাল যাচ্ছেনা। চোখে কম দেখা, রাতকানার সমস্যা তো আছেই; আরো নানারকম মেয়েলি সমস্যা তাকে খুব দ্রুত বার্ধক্যের শেষপ্রান্তে ধাওয়া করছে। অথচ বেআক্কেল বুড়োটার সেসবের প্রতি কোন নজর, কোন যতœ নেই; আছে কেবল আদিমতার প্রতি সেই পুরনো প্রকট আগ্রহ।
এই যখন পরিস্থিতি তখনই একদিন ঘটল সেই অঘটন। অবিমৃশ্যকারী বুড়োটা হঠাৎ এক হটকারী ঘটনা ঘটিয়ে বসলÑ বুড়ির সাথে বচসার একপর্যায়ে বুড়ির কী একটা মর্মপীড়াদায়ক তিক্ত, তীক্ষè অথচ চরম ন্যায্য কথার জবাবে সে হঠাৎ বুড়িকে তালাক দিয়ে দিল। তার এই আকস্মিক তালাক উচ্চারণ বুড়ির কাছে এতটাই অভূতপূর্ব যে বিস্ময়ে আতঙ্কে বিমূঢ় বুড়িটা হঠাৎ এক তীব্র চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
এরপর সবকিছু গ্রামদেশের স্বাভাবিক নিয়মেই ঘটতে থাকে। বুড়ো ও তার ছেলেদেরকে এ মর্মে সতর্ক করে দেয়া হয় যে তারা যদি ঐ তালাকপ্রাপ্ত মেয়েলোককে ঘরে রেখে দেয়াই সাব্যাস্ত করে তাহলে তাদেরকে শরিয়তসম্মত পথে হাঁটতে হবে, নয়ত....।
নয়ত যে কী হবে তা তারা জানে। এ ব্যাপারে তাদের যথেষ্ট প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। কাজেই তারা যেকোন উপায়ে সমাজের সন্তুষ্টিবিধান করে এর একটা ফয়সালা করতে ব্যগ্র হল।
ফয়সালাটা বেশ সহজেই স্থির হয়ে গেল। তালাকপ্রাপ্তা নারীকে সেই সংসারে বহাল রাখার একটাই শরিয়তসম্মত পন্থাÑ হিল্লা। অতএব, বদনমিয়া যদি সে মতে রাজি থাকে তো গাঁয়ের মুরুব্বীরাও এ সংসার টিকিয়ে রাখার পক্ষে মত দিতে পারে। এবার বদন মিয়ার মাথায় সত্যিই বাজ পড়ল। এই এতটা বয়সে ঘর ভরতি নাতি-পুতির সামনে এ কী দুঃসহ অপমান! নাহয় রাগের বশে সে দুকথা বলেই ফেলেছে, নাহয় সেটা বেফাঁসই ছিল, হয়ত সেটা একবারেই অনুচিত কথা। কিন্তু তাই বলে বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ সমাজপতিদের এ কেমন বিচার? তারা কি জানেনা যে গরীবের ঘরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমন দু-চারটা কথার আদান-প্রদান নিতান্তই ডালভাত। দুঃসহ দারিদ্রের চাপে পড়ে কত হলাহলই না সুসহ হয়, আর এতো সেখানে নিমপাতার রসমাত্র। তাছাড়া দাম্পত্য কলহ ব্যাপারটা দুনিয়ার কোন ঘরেই বা না আছে? হাড়ির পাশে হাড়ি থাকলে ঠুকাঠুকিতো একটু হয়ই। যারা এই ফতোয়া জারি করল তাদের বাপ-মায়ের মধ্যে কি কোনদিন দুকথা হয়নি? তাদের নিজেদের ঘরেও কি বেহেশতি প্রেম? তাহলে বদন মিঞার কী এমন অপরাধ? তিনবার তালাক বলে সেরেছে, তাইতো? তা এমন তালাক একজীবনে কত শতবার ভদ্দরলোকেরাই মনে মনে বলে তো বদন! তা তালাক না বলে সেদিন বদনের উপায়ই বা কী ছিল? চ-ালে মেজাজটা যা চড়েছিল! ঐ শব্দটা উচ্চারণের মধ্য দিয়ে উত্তপ্ত গরলটা ঢেলে দিতে না পারলে শান্ত হবার আর যে পথটা খোলা ছিল তাতে যে বদনের হাতে দড়ি পড়ত! তেমন বেঘোর কিছু ঘটিয়ে ফেললে যে দড়ি কেবল হাতে নয়, গলা অবধি পৌঁছে যেত তাকি সমাজ ভেবেছে? অথচ পেছনের ঘটনাটা ভদ্রজনের কানে কতইনা সামান্য ঠেকে!
সেদিন সকালেও বদনের মুখে যথারীতি মেঘ জমেছিল এবং সালেমা বিবির মুখেও ছিল রাজ্যের বিরক্তি। আয়েশি ছেলে-বৌদের কেউ কেউ তখনো বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। ছোট ছোট নাতি-নাতনিগুলো উঠোনের পরে এক্কাদোক্কা খেলার খোট কাটতে ব্যস্ত ছিল এবং বড় নাতীটা নিমের দাঁতন মুখে ছাগলগুলো নিয়ে চরাতে যাচ্ছিল। মুরগীগুলো এইমাত্র ছাড়া পেয়ে উঠোনময় ঘুরছিল এবং কামার্ত মোরগটার ‘টিজিং’য়ে বিরক্ত হয়ে মাঝে মাঝে কোঁ কোঁ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। এককথায় একটা গতানুগতিক সকালের শুভসূচনা। এমনসময় বদন তার ঐতিহ্যবাহী হুঁকাটা হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠোনের এককোনে খোলা হেঁসেলে উনুনের ছাইতোলায় ব্যস্ত স্ত্রীকে এসে গম্ভীরভাবে বলল, এনা আগুন দ্যাও।
আগুন কুন্ঠি পাইমু?
কুন্ঠি পাবু তা মুই কি করিয়া জানিমু? ব্যায়না কলকেয় আগুন নাগে এইডা কি নয়া শুনলি?
আইজ আগুন নাই। উদিনক্যা পাতা-খ্যাড় দিয়া হাঁসেল জ্বালাইছি। দেখিয়া যাও হাঁসেলের মদ্যে খালি ছাই। এটি আগুন কোটে?
ভাল করিয়া দ্যাক। কাইল গোবরের ঘুঁটা জ্বালাসনি?
কতা শুনিয়া মনে অয় গোয়ালত কত্ত গরু আছে! গোবর লাইদা ঘুঁটা হইছে! নিত্যি দিন গোবর কুড়িয়া ঘুঁটা বানিয়া দিই, আর মুই পারমনা। মোর ম্যালা কাম আছে।
হঠাৎই বদনের মেজাজটা চিড়বিড়িয়ে ওঠে। এই বাড়িতে একমাত্র বদনই এখনো হুঁকা খায়। ছেলেরা সব খায় ‘ছিরকেট’ কিংবা বিড়ি। কেবল এ বাড়ি কেন, এ গ্রাম এমনকি সম্ভবত এ বাংলা মুলুকে বদনই এখন একমাত্র হুঁকাখোর। কিন্তু হুঁকার কলকের জন্য যে ধিকিধিকি আগুন দরকার হয় তার অভাবে বদনের এত সাধের হুঁকাও এখন প্রায় অকেজো পড়ে। বদনকেও তাই এখন অভ্যাস করতে হয় দুয়েকটা কাগুজে বিড়ি কিংবা ‘ছিরকেট’।
কিন্তু এসবে বদনের নেশাটা ঠিক জমেনা। দাকাটা তামাকে চিটেগুড় মেখে প্রস্তুত পুর থেকে যে নেশায় সে অভ্যস্থ তাতে ওসব শৌখিন সাহেবীয়ানা নেহাতই তুচ্ছ। গতরাতে সালেমার অবাধ্যতার সাথে আজ সকালের এই অবহেলা, বদনের সম্পদহীনতার প্রতি ইঙ্গিত করে দেয়া খোঁটা এবং ‘ম্যালাকাম’ কথাটা বদনকে পলকে জ্বালিয়ে তোলে। হ, ম্যালা কামই আছে বটে সালেমার। পাঁচ-পাঁচটা ছেলে যে পেটে ধরেছে তাকে এখন ভাতের জন্য কামে যেতে হয় খাঁ-বাড়ি। খাঁদের চাতালের ধান ঝেড়ে কিংবা উঠোন নিকিয়ে, পোস্তা করা ঘরের মেঝে মুছে-টুছে দিয়ে সালেমা যা পায় তা দিয়েই তাদের ইদানীং গ্রাসাচ্ছাদন হয়। রাতকালে বদন যতই পুরুষ হোক, দিনের বেলায় সে কিন্তু ভারি কুঁড়ে। তাছাড়া বছর দশেক আগে মাটি কাটতে গিয়ে তার পায়ে কোদালের কোপ লেগে এমনই সংক্রমণ হয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত পাটা হাঁটুর কাছ থেকে কেটে ফেলতে হয়েছিল। সেই চিকিৎসা ব্যায়ের পেছনে তার একমাত্র ধানী জমিটা বাঁধা পড়ে যখন চিরতরে হাতছাড়া হল তখন থেকেই সালেমা তাদের দুজনের ছোট্ট সংসারটা একাই চালিয়ে আসছে। লায়েক ছেলেরা নিজ নিজ সংসার নিয়ে ঘোরতর ব্যস্ত।
তো বদনের মেজাজে সকালবেলার হুঁকোর ধোঁয়া না লাগলে মেজাজ হয়ে থাকে এমনিতেই তিরিক্কি। তার উপর সেদিন সকালে যখন সালেমা বিবি বদনের সাথে দুটো ভাল কথা না বলে নাতোয়াক্কার ভাবে খাঁ বাড়ির দিকে রওনা হল তখন বদনের পক্ষে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। সালেমার উদ্দেশ্যে হুঙ্কার ছেড়ে সে বলে উঠল, ব্যায়না উডে ভাত না রান্ধিয়া কুন্ঠে যাস? তোর ভাতারের ভাত রান্ধিবি কুন মাগী?
এভাবেই লেগে গেল। এরপর যখন ছাড়াবার ইচ্ছেয় দুপক্ষই আকুলি-বিকুলি করতে থাকল তখন ব্যাপারটা আর শুধু তাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নয়, হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের মূর্তিমান মাথাব্যাথা। তো সমাজ তো আর মাথাব্যাথার দরুণ মাথা কেটে ফেলার মত মূর্খ নয়, তাই তারা এর মোক্ষম দাওয়াইটাই অন্বেষণ করে চলে। তা দাওয়াইতো তাদের জানাই আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে মুশকিল এর প্রয়োগ নিয়ে। ষাটবছরী বুড়ির একরাতের পতিত্বে বরিত হতে কেউই যে উৎসুক নয়। উঠতি বয়সী ছুঁড়ি কিংবা ডগমগে যুবতী হলে এ কাজের উমেদার ঠেকাতে লটারি ব্যবস্থার দরকার পড়ত কিন্ত সালেমা বিবির মত একাহারী, শুঁটকোদেহী, কুশ্রী, নোংরা বুড়ির সাথে একরাতের অভিজ্ঞতার চিন্তাটাই যে কারো কারো কাছে ভয়াবহ ঠেকে! হায় কাল! মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ বছরের ব্যবধানে একমানুষের জীবনে কতই না বদল আনতে পারে! যে সালেমা বিবিকে একটু নিরিবিলিতে পাওয়ার লাগি এককালে কতজনা পাগল ছিল তার কপালে কিনা আজ এহেন অসম্মান!
মোড়লের দল অগত্যা টাকা দেয়ার শর্তে ভাড়া করে আনে পাশের গাঁয়ের ওলান পাগলকে। ওলান পাগল সারা বছর তীব্র পাগল থাকেনা। কেবল চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ এ তিন মাস তার মাথা ও মেজাজ চূড়ান্তরকম খারাপ থাকে। বাকি নটা মাস সে মৃদৃমন্দ পাগল। এ সময়টাতে সে বাড়ির টুকটাক কিছু কাজও করে থাকে। যেমনÑ গরুকে জাবনা দেয়া, ছাগলটাকে কাঁঠালপাতা কেটে দেয়া ইত্যাদি। তো এ সময়েই পাগলটা এমন একটা কাজ অনিয়মিতভাবে করে থাকে যার জন্য তার নাম হয়ে দাঁড়ায় ওলান পাগল। কাজটা এইÑ গরুর বাঁট থেকে সরাসরি দুগ্ধপান। কাজটা সে যে বীভৎস্য দক্ষতায় করে থাকে তা কেউ একবার দেখলেই তার পাগলামীর পরিমান সম্পর্কে কিঞ্চিৎ আন্দাজ করতে পারে।
তো সেই ওলান পাগলের সাথে নিকাহ্ পড়িয়ে একরাত্রি একত্রবাসের ব্যবস্থা করতে পারলেই সালেমা বিবি পুরনো স্বামীর সাথে নতুন করে ঘর করতে পারবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে ওলান পাগল পাগল হলেও সেয়ানা পাগল। কড়াক্রান্তির হিসাব না বুঝে সে কবুল বলতে রাজি না। পাঁচশ টাকা নগদের এক পয়সা কম থাকতেও সে বিয়ের পানি গাঁয়ে মাখবেনা জানিয়ে গ্যাট হয়ে বসে থাকে। এবার তাকে সাধ্যসাধনার পালা।
সালেমা বিবির বড়ছেলে রসুল মিয়া বাপের এই হঠকারিতার দরুণ এমনিতেই মরমে মরে ছিল। বুড়ি মাটার এই দুর্দশা তাকে এক অবর্ণনীয় অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তার ভাইয়েরাও তারই মত মাথায় হাত দিয়ে বসে থেকে নির্বোধ চোখে সমাজের মুখ চেয়ে থাকে। এতকাল মা-বাপের ভরণ-পোষণের ব্যাপারে তাদের তত গা না থাকলেও এখন এই দুর্বিপাক থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য তারা হয়ত তাদের সাধ্যমত সবই করতে পারত কিন্তু নগদে পাঁচশ টাকা যোগান যে তাদের সাধ্যাতীত। এদিকে মোড়লরা মোড়লীপনাতে যতই ওস্তাদ হোক, ট্যাকের টাকা খসানোর ব্যাপারে উৎসাহী নয় মোটেও। তাছাড়া তখন সময়টা মঙ্গার। এমন আকাল দিনে কোন গেরস্থই বা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে পারে? এ অবস্থায় পুঁটির তেলেই পুঁটি ভেজে ধর্ম ও সমাজ রক্ষা করাটা মোড়লদের জন্য সুবিধার, সুখেরও। কিন্তু যে পুঁটির গায়ে তেলই নেই তাকে ভাজা হবে কী দিয়ে, কোন প্রকারে? অতএব, মোড়লদের বিরক্তি চরমে ওঠে। রসুল মিয়াকে ধমক দিয়ে টাকার তাগাদা করে তারা অস্থির করে তোলে। রসুল মিয়ার অবস্থা শেষে হয়ে ওঠে বোঝাই গাড়িসহ খাদেপড়া বলদের মতÑ শত লেজমুড়া খেয়েও আর রা করেনা।
কিন্তু বদনের ভঙ্গি এখন ভিন্নতর। এ কয়দিন সেও যেন আপনার কৃত পাপের অনুশোচনার অনলে দগ্ধ হচ্ছিল। ঘরের দাওয়ায় গুম হয়ে বসে থাকা ছাড়া কোন কাজই যেন তার ছিলনা। সে যে মানুষ, তার যে আহার-নিদ্রা আছে, তা তার এক ঠাঁয়ে বসে থাকা দেখে মালুম হতনা। ছেলে-বৌরা কখনো একটা ভাঙ্গা টিনের থালার এককোনে একটা কিছু দিয়ে গেলে কতক্ষণ তাতে মাছিদের ভোজসভা চলত, তারপর হয়ত তা টেনে নিয়ে যেত প্রতিবেশিদের বিড়ালে। সেই অনাহারক্লিষ্ট হতবুদ্ধি বুড়োটা এখন হঠাৎ গাঝাড়া দিয়ে ওঠে। এতক্ষণ ধরে যে নাটক তার উঠোনে মঞ্চস্থ হচ্ছে তার মহড়াতো গত কদিন ধরেই সে নিঃশব্দে চেয়ে চেয়ে দেখছে। কিন্তু অভাগা মানুষের সহ্যশক্তির শেষসীমাও বুঝি এখন সে অতিক্রম করে ফেলেছে। তাই খাদেপড়া বলদের শেষ মুহূর্তের শক্তিমত্তা নিয়ে সে এখন খাড়া হতে চেষ্টা করে। কিন্তু হায়! সমাজ নামের যে গাড়ির এককোনা তার ঘাড়ে জন্ম থেকে জুড়ে দেয়া আছে তা যে এখন সমস্ত ভর নিয়ে তার একক কাঁধেই চেপে বসেছে! এই দুর্বিসহ ভর থেকে এখন পরিত্রাণের কী উপায়?
তবু বুড়ো চেষ্টা করে। একবারে অন্তিম চেষ্টা। গত কদিন ধরে যে বৌকে সে তার ঘরে পায়নি সমাজের বিধান মতে যাকে পাশের বাড়ির ঢেঁকিঘরের এককোনে রাত্রিবাস করতে হচ্ছে তাকে এখন সে হিড়হিড় করে নিজের ঘরে টেনে আনে। বুড়ি সালেমা বুঝি প্রতিবাদ করতে চায়। কিন্তু একপায়ে চলা মানুষের গায়ে এত শক্তি! রক্তজবার মত চোখ নিয়ে ধেয়ে আসতে চায় সমাজ। কিন্তু বুড়ো রুখে ওঠে। চিৎকার করে বলে, খবরদার কইলাম! খবরদার! বুড়ি সালেমার প্রায়ই উক্ত কথার অনুকরণে বলে, ভাত দিবার ভাতার না, গুয়ামারার গোঁসাই? মুই বাঁচিয়া থাকিতে মোর পরিবারে নিকাহ্ পড়ান? মুখত তালাক করিলেই যদি তালাক হয় তাইলে গাঁয়ের কজনার বৌ হালাল থাকিবার পারে বাহে? মোর যদি ফের ভয়ডর দেখাইবার চাও মুই গবরমেন্টের কাছত নালিশ দিমু। পাইলে ভালো, না পাইলে......
না পেলে যে কী তা অনুক্ত রেখেই বুড়ো সমাজের মুখের পরে তার ঘরের কপাট লাগিয়ে দেয়। বহু পুরনো, জীর্ণ কেঠো কপাট বুড়োর শক্ত কব্জির ধাক্কায় কঁকিয়ে ওঠে। এবার ভরদুপুরে জানালাবিহীন ফুটো চালের ঘরের আলো-আঁধারে শুধুই বুড়ো-বুড়ি।
দু’জন দু’জনার।