বাংলাদেশ প্রতিদিনে তসলিমা নাসরিনের ‘বাহিরে অন্তরে’ কলামে আজ ব্লগার মেঘকন্যার অসাধারণ, আবেগঘন (একদিন হয়ত হয়ে উঠবে কালোত্তীর্ণ) লেখাটি পড়ে আমার এ মামুলি লেখাটা ব্লগে দেয়ার আগ্রহ জন্মাল। গত সপ্তাহে এই দিনে লেখাটি লিখে দুটো পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে ছাপা হওয়ার অপেক্ষায় আছি। পত্রিকায় ছাপা হবে কিনা জানিনা কিন্ত ব্লগের পেজে এখনই এটা ঠাঁই পাবে । তাই তসলিমা ও মেঘকন্যাকে কিছু কথা বলার জন্য সহজ মাধ্যম হিসেবে ব্লগটাকে বেছে নিলাম। হ্যা, তসলিমা, আপনার মন খারাপের কিছু নেই। পুরুষ জাতের কাছ থেকে আপনি যত গালি খেয়েছেন, তা হয়ত অগণনসংখ্যক নারীর আজীবন খাওয়া গালির সমতুল্য। কিন্ত এদেশের নারীদের কাছ থেকে আপনি যত গালি পেয়েছেন তা কিন্ত পৃথিবীতে কোন নারীর প্রতি নারীজনের প্রদত্ত গালির সংখ্যা-মাত্রার কোন রেকর্ড থাকলে তা ভঙ্গ করত নিশ্চিত। তবুও বলছি, আপনার মনখারাপের কিছু নেই। কারণ সময়ের আগে এসে পড়া মানুষেরা চিরকালই তার পার্থিবকালের কাছ থেকে আপনার অনুরূপ ব্যবহার পেয়ে আসছে। পৃথিবীকে যিনি প্রথম গোল বলে দাবী করেছিলেন তার কপালে কী জুটেছিল তা আপনি জানেন। সব সত্যিকথা সবসময় সবার মগজে ঢোকেনাÑ এটাও আপনি জানেন। সব জেনে-বুঝেইতো আপনি নিঃসঙ্গ দ্রোহী হয়ে একলা চলার নীতি মেনে সত্যকথনের অগ্রদূত হয়েছিলেন। আপনার সেই দ্রোহিত সত্যকথন যে একেবারে বৃথা যায়নি তার জ্বলন্ত প্রমান আজকের মেঘকন্যা। এমন অগণিত মেঘকন্যা আজকের বাংলাদেশে তৈরি হয়ে নিঃশব্দ দেয়াশলাই বাক্সের মত নিরীহভাবে আমাদের প্রাত্যহিকতার সাথে মিশে আছে বলে আমি মনে করি। এদেশের কয়েককোটি নিরেট বুদ্ধির নারীর ভীড়ে একজন মেঘকন্যা আমাদেরকে আশা জাগায়। হোকনা একজনÑ তবু সে শক্তিশালী, কারণ তার মধ্যে যে স্ফুলিঙ্গ আছে তা অনেক বড় প্রলয়ময় সৃষ্টির সম্ভাবনায় দীপিত-উজ্জ্বল। মেঘকন্যাকে বলছি, তসলিমার সব ভাবনার সাথে একমত হলেও প্রকাশভঙ্গির সাথে একাত্মতাপোষণ আজো আমার জন্য দুরূহ। কিন্তু তোমার লেখাটা পড়ে আমার মনে হল অনেক বড় সাহিত্যসম্ভাবনা তোমার মধ্যে রয়েছে এবং প্রকৃত গুণের কদর করার মত একটা সাহসী গুণী হৃদয়ও তোমার রয়েছে। তোমাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। তোমার লেখা থেকে তোমার বয়স বিষয়ে যে ধারণা পেলাম তাতে তুমি আমার সমবয়সী। অদেখা মেঘকন্যার প্রতি বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করে বলছি, তসলিমা যা বলেছেন তা বহু শতাব্দী ধরে পদদলিত, লালসা-রিরংসায় নিষ্পেষিত নারীর জন্য বলেছেন। তোমার এই লেখা সেই নারীসমাজের পক্ষ থেকে তসলিমার জন্য যথার্থ মানপত্র। তুমি এগিয়ে যাও বন্ধু। আমাদের আজকের ভীরু-দুর্বল, পুরুষতন্ত্রের ঘেরাটোপে বন্দি বদ্ধমস্তিষ্কের নারীদেরকে একদিন নিশ্চয় তোমার পাশে পাবে, যেমন তসলিমা পেলেন তোমাকে। সে পর্যন্ত বেঁচে থেকো মেঘকন্যা, বেঁচে থাকুন তসলিমা। চিন্তার স্বাধীনতার চর্চা করে বেঁচে থাকাটাই আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
তসলিমার জন্য একখানি হাত।
--হোসনে আরা মণি
এই লেখাটা আমি লিখতে শুরু করেছিলাম প্রায় এক মাস পূর্বে। ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এ তার সম্প্রতি প্রকাশিত কলামগুলো আমি নিয়মিত পড়ি, যদিও এ পত্রিকার নিয়মিত গ্রাহক আমি নই। না, নেটে নয়, কাগজেই আমি তার ‘বাহিরে অন্তরে’ পড়ে থাকি; বলা যায় খানিকটা বাধ্য হয়েই পড়ি। এ উপভোগ্য বাধ্যতা আমার অবাধ্য মনন যে কারণে মেনে চলে সেটা নিয়ে দু’লাইন বলি। এক. তার বিষয়ে কৌতূহলÑ যা তার বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত বইগুলো চোরাই পথে কিনতে আমাকে প্রনোদনা যুগিয়েছে। দুই. প্রতি বৃহস্পতিবারের ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ এক স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আমার হাতে পৌঁছে। আমি মনে রাখি বা না রাখি জনৈক হিতৈষী (সাংবাদিক) এ পত্রিকাটি আমায় উপহার দিবেনই। এখন কথা হলÑ উনি কেন নিয়মিত এটা আমায় সরবরাহ করছেন? এ নিয়ে যে আমি দু’মিনিট না ভেবেছি এমন নয়। এক্ষেত্রে আমার কাছে দুটি কারণ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। এক. যেকোন কারণে হোক আমার মধ্যে উনি সেই সাহসী সম্ভাবনার ফুলকি কল্পনা করেছেন যা ‘বাহিরে অন্তরে’র লেখকের মধ্যে রয়েছে (ওনার কল্পনা অবশ্যই অতিরঞ্জিত)। দুই. তার লেখার প্রতি ওনার যথেষ্ট পরিমান আগ্রহ, কৌতূহল, ভাললাগা ইত্যাদি, যা তাকে অন্যের সাথে শেয়ার করতে আগ্রদ্দীপনা যোগাচ্ছে।
প্রতি বৃহস্পতিবারের কলামটি তাই পড়তে হয়। একজন পুরুষ এত আগ্রহ করে একজন চরম নারীবাদী লেখিকার লেখা আরেকজন ভীতু নারীকে নিয়মিত সরবরাহ করেন, ব্যাপারটায় কোথায় যেন আমি একটু বিশেষত্ব দেখতে পাই। তাকে নিয়ে আমার কৌতূহল সেই কোন ‘মেয়েবেলা’য় গড়ে উঠলেও তার ব্যাপারে কখনো কিছু পত্রিকায় লিখব এ ছিল আমার কাছে একেবারেই অভাবিত। এমনকি মাসখানেক আগে যখন আমি তার প্রসঙ্গে পাতা দুয়েক লিখে ফেলেছি তখনো আমি নিশ্চিত ছিলামনা যে সেটা আমি কোনকালে পত্রিকার পাতায় প্রকাশের অনুরোধ নিয়ে সম্পাদকের দ্বারস্থ হতে পারব। কেন এই অনিশ্চয়তা? কেন এত দ্বিধা? এর একটাই কারণ, একটাই জবাবÑ ভয়। কেন ভয়? কিসের ভয়? জুজুর ভয়, অসূরের ভয়। কোন সে জুজু? কোথায় অসূর? কেন, হুমায়ন আজাদের কথা কি আমি ভুলে গেছি? যাকে নিয়ে এত কথা তার অবস্থাও কি আমি জানছি না? তার ‘নির্বাসন’ কি আমি পড়িনি? সাম্প্রতিক কলামগুলো কি পড়ছিনা? কে চায় চলতিপথে মাথার পেছনে একটা আচমকা বাড়ি খেতে? কে চায় দেশ ছেড়ে বিদেশ বিভুঁইয়ে ক্রমাগত তাড়া খেয়ে বেড়াতে? অনেকে ভাবেন এমন কি বলেনও, ‘ওয়েস্টার্ন কান্ট্রি, ফাস্ট লাইফ’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আমি কোনদিন বাংলাদেশের বাইরে পা না রাখলেও অনুভব করি, আত্মীয়-পরিজনহীন নির্জন প্রবাসজীবন, অনিশ্চিত কর্মসংস্থান, সময়ে-অসময়ে প্রাপ্ত দুঃসহ অপমান, আপন প্রাণভিক্ষা চেয়ে ভিনদেশী রাষ্ট্রের কাছে আকুল আবেদন (অনেক অখ্যাত বাঙ্গালী এটা করে সগর্বে ইমিগ্রান্ট বনে যায় বটে কিন্তু সেসব উচ্চাকাক্সক্ষী-ভাগ্যান্বেষী বাঙ্গালী আর খ্যাতিমান লেখকের আতœমর্যাদাবোধের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছু পার্থক্য থাকে)Ñ এসব নিশ্চয়ই আমার কাক্সিক্ষত নয়। আমি এই ছোট্ট দেশের ছোট্ট এক শহরের ছোট্ট ঘরের এককোণে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিতান্ত সরল সুখের দিনগুলো ছেড়ে কোনরকম ‘এক্সাইটমেন্ট’ কে স্বাগতম জানাবার মত সাহসী নই। আর নই বলেই তাকে নিয়ে লেখা পাতাদুই লেখা আমি উদাসীনতাভরে কবে কোথায় হারিয়ে ফেলেছি।
কথা হলÑ আজ কেন আমি তাকে নিয়ে লিখছি? কে বা কী আমাকে হঠাৎ সাহসী করে তুলল? তুললেন ওসমান গনি, তুললেন মারুফ রসুল। ওসমান গনির নামটা জানি, ব্যক্তিকে চিনিনা। মারুফ রসুলের ‘এক্টিভিটি’র কিছুটা জানি, ব্লগিংয়ের সুত্রে তার শানিত জ্ঞান-মেধা-মননের কিছুটা আঁচও করতে পারি, টিভির পর্দায় এই তরুণের চেহারাও দুয়েক ঝলক দেখেছি। হ্যা, মারুফ রসুলদের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সংগ্রাম করা। প্রকাশক অর্থাৎ ব্যবসায়ীর যেকোন দাবীর ভেতর বৈষয়িক গন্ধ লুকিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু অবৈষয়িক তরুণের দাবীতে নির্বোধ আবেগ, নিঃস্বার্থ প্রেম, আর লাভালাভবিবেচনাহীন নির্ভেজাল ঔচিত্যবোধ ছাড়া আর কিছুই থাকেনা।
হ্যা, মারুফ যদি তার দেশে প্রত্যাবর্তনের দাবী করে থাকেন তো ধরে নেয়া যায় যে এদেশের তরুণের এক বড় অংশ লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে, যেকোন ধর্ম নির্বিশেষে মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, শক্তিশালী-অনমনীয় অবস্থানধারী নির্বাসিতাকে ফিরিয়ে আনতে সোচ্চার হতেও দ্বিধা করবেননা। এই তরুণেরা চাইলে যে কত অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে গোটা ২০১৩ জুড়ে আমরা তা দেখেছি, হয়ত আরো দেখব।
এবার আসি এই লেখিকার প্রতি আমার ব্যক্তিগত অনুুভূতি ও মতামতের কথায়। প্রথমে বলে রাখি, আমি একজন নিতান্ত ভীতু মানবী। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমার ভীরুতা প্রমানিত। তাই সাহসকে আমি সম্মান করি। সাহসী ব্যক্তিÑ সে নারী-পুরুষ যাই হোক আমার চোখে পরম শ্রদ্ধেয়। জীবনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের চোখে আমি স্পষ্টবাদী, দুর্বিনীত, এমনকি ডাকাবুকো হিসেবে চিহ্নিত হয়ে তাদের বিরাগভাজন হয়েছি। অথচ ভেতরের এক আমি অপর আমিকে ভীতুর ডিম, ‘কানারী’ (কাপুরুষের লিঙ্গান্তর) বলে চিরকাল অভিসম্পাত করে চলেছি। আজ এই মামুলি লেখাটি লিখতে গিয়েও আমার হাত কাঁপছে। আমি আমার মাথার পেছনে অদৃশ্য কোন ভারী বস্তর আঘাত অনুভব করছি। এমন কি তার চেয়েও কোন ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার চিন্তা আমার মগজে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। তবু আমি লিখছি। ‘শনিবারের চিঠি’ আমাকে লিখতে প্রনোদনা যোগাচ্ছে, প্রজন্ম চত্বরের প্রোজ্জ্বল তারুণ্য আমাকে উৎসাহিত করছে এবং সর্বোপরি সেই চর্মচক্ষে নাদেখা নারীÑ যিনি সেদিন থেকে আমাকে তার হয়ে অন্ততঃ একটি কথা বলার জন্য আমার দিকে ভর্ৎসনাপূর্ণ ভ্রুকুটির নিচে আকুতি মাখা চোখে চেয়ে আছেন, যেদিন আমার মায়ের এক সহোদর আমার কোন একটা অর্বাচীন কথায় রুষ্ঠ হয়ে তিরষ্কার করতে গিয়ে বলেছিলেন, “এ মেয়ে বড় হলে নিশ্চিত তসলিমা টাইপ হবে।” তসলিমা কে, বা তার টাইপই বা কী, তা সেদিন না জানলেও আমার প্রায়বালিকা মন এটা বুঝেছিল যে ওরকম কিছু একটা হতে পারা আরাধ্য হওয়া উচিৎ।
কিন্তু পরে যখন তার লেখা পড়লাম, তার সম্পর্কে জানলাম, তাকে নিয়ে সত্য-মিথ্যের মিশেলে রচিত নানা কেচ্ছা শুনলাম, তার সম্পর্কে নানা দেশের নানা দিকপাল কবি-সাহিত্যিকের মন্তব্য পড়লাম, হামলা-মামলা-মানহানি বিষয়ে জানলাম, তাকে স্বচক্ষে দেখেছে এমন সাহিত্যিক- সাংবাদিকের কাছ থেকে তার সম্পর্কে কিছু কিছু শুনলাম, তখন বুঝতে পারলাম যে আমি সহ¯্র বছরের সাধনায়ও কোনদিন তসলিমা হতে পারবনা। তসলিমাকে তাই আমার তসলিম। আমি সাহসী না হতে পারি, সৌভাগ্যবশতঃ সাহসের মূল্য বুঝি। আফশোস! এ জাতির এক বড় অংশ বুঝি সেটাও বোঝেনা। নইলে যে ‘কোদালকে কোদাল’ বলতে পারে তাকে দেশ থেকে হটিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে আজ প্রায় দেড়যুগ সময়েও কেউ ‘টুঁ’ শব্দটি করেনা!
স্যালুট ওসমান গনিকে, স্যালুট মারুফ রসুলসহ সহযোগী, সহযোদ্ধা সেইসব তরুণকে যারা ‘অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ এর পক্ষে তাদের অকুতোভয় হাতগুলোকে উত্তোলিত করতে পারলেন। তাদের শক্তিশালী হাতের ভীড়ে আমি আমার ভীরু, দূর্বল হাতখানিকে একটু উঁচিয়ে ধরলাম মাত্র। পরম করুনাময় আমায় সুরক্ষা দিও; তোমার নাম করি বা না করিÑ আমি কিন্তু নাস্তিক নই।