প্রণয়
--হোসনে আরা মণি
‘কুত্তী মাগীডারে দে কষে। হারামজাদীর বড় বাড় বাড়িছে।’
বাপের বাধ্য সন্তান আয়নাল আদেশ প্রতিপালনের জন্য কিছুদূর ছুটে গিয়ে থমকে যায়Ñ গজনী কোল থেকে ছেলে ফেলে বিদ্যুদ্বেগে উঠে দাঁড়িয়েছে। আয়নাল স্ত্রীকে ভয় পায়। না, তার রক্তচক্ষুকে নয়, শ্বশুরের ‘ডাকাত সুনাম’টাকে।
এদিকে বুড়ি মায়মুনা চিৎকার করেই যায়। বছর বিশেক হল কানে কম শোনে, মাথাতেও একটু ছিট। আগে কোন ঘরে তার কত ভাল বিয়ে হয়েছিল, সেই স্বামী কত সোহাগ করতÑ বিনিয়ে বিনিয়ে তারই বর্ণনা চলছে সবিস্তার। পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ বছর আগেকার কথা, কিন্ত তাই বয়ান করে করে বুড়ি যেভাবে কেঁদে কেঁদে ওঠে তাতে মনে হয় শোকটা বুঝি তার নতুন। আইনুদ্দির আর সহ্য হয়না। বুড়িটাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করার প্রবল বাসনায় তার হাত-পা নিশপিশ করতে থাকে। কিন্ত পুরনো বাতের ব্যাথাটা তাকে প্রায় শয্যাশায়ী করে রাখায় হাত-পাগুলোতে বৌ পেটানোর সুখ সে এই মুহূর্তে যোগাতে পারেনা।
‘সেই কবে ওর ভাতার মরিছে আর ভাতারসুহাগী তার গীতই সারাজীবন গাইয়ে চলিছে। লাত্থি মার হারামজাদীর মুহি।’ আইনুদ্দি চিৎকার করে ছেলেকে উস্কায়। কিন্ত ছেলে যে আর নড়েনা। বিড়বিড় করে বলে, ‘বাপরে! ডাকাতির মাইয়ের ত্যাজ দ্যাহ। নাহ্, ওর বাপটা যদ্দিন আছে তদ্দিন....’ ওঝার হাতে শিকড় দেখা দাঁতভাঙ্গা নির্বিষ সাপের মত করেই আয়নাল পিছু হটে।
মাটির দাওয়ার দেয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে গুড়গুড় করে হুক্কা টানতে টানতে খিস্তি করতে থাকা আইনুদ্দিন এবার ছেলের দিকে চেয়ে দমে যায়। বীরপুরুষ ছেলের এমন হঠাৎ মাজাভাঙ্গা চেহারা দেখে সে সবই বুঝতে পারে। মনে মনে গালি দেয়, ‘হারামজাদা ছাওয়াল, এইবার বোঝ রূপ দেহে পাগল হয়ে ডাকাতির মাইয়ে বিয়ে অরার মজাডা কেমন। সারা জেন্দেগী বৌয়ের পায়ের তলায় কাটাবি।’
কিন্ত মনে মনে গালি দিলেও এ নিয়ে মুখে কিছু বলার সাহস আইনুদ্দির নেই। মজু সর্দার এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ডাকাত। কার কয়টা মাথা যে তার মেয়েকে ঘাঁটায়!
রাতে বিছানায় স্বামী-স্ত্রীতে কথা হয়। গজনী বলে, তুমি বাপের কথায় মার গায় হাত তুলতি যাও? তুমি জাননা এর পরিণাম?
ঃ বেশি ফ্যাচফ্যাচাসনে। মা যা সব গাবায় তাতে ওরে আমার মাইরে ফেলতিই মন চায়।
ঃ মা গাবায়। ক্যান গাবায়?
ঃ গাবানিই ওর রোগ।
ঃ সেই রোগ ক্যান হইছে?
ঃ ক্যান হইছে সেই ঘটনা আমি যা জানি তা তুইও জানিস।
ঃ জানিইতো। তার পরথম সুয়ামী তারে এত্ত ভাল বাসত যে তার কথা, তার ছিরিতি সে মনেত্তে কোনদিন মুছতি পারিনেই। ক্যামনে মুছবি? যুদ্ধের বছরে পাক আর্মির অত্যাচার আর সমাজের অবিচারের কতা বাদই দিলাম, তুমার বাপও তারে বিয়ের পরেত্তেই তার দগদগে পুড়া বুকি আগুনের ছ্যাকা, শূলের খোঁচা দিয়ে আসতেছে। ঘাও শুকোবার সুময়ই যে তুমার মা কোনদিন পাইলনা।
ঃ আমার মার জন্যি তোর এত দরদ ক্যান? তুইতো তার পুতির বৌ।
ঃ বৌ বুলেইতো তার কষ্টডা বুঝি। সুয়ামী যারে ভালবাসেনা সেই মাইয়ে মাইনষের কী পুড়াকপাল!
ঃ ক্যামনে আমার বাপ তারে ভালবাসবি ক তো? তার লাইফ হিষ্টোরি তো তুই জানিস। বারাঙ্গনা মেয়েছেলে........
ঃ বারাঙ্গনা না, বীরাঙ্গনা। নিজের মার সম্বন্ধেও ঠিকঠাক ভাষায় একখান কতা কওয়া শেহোনি? এই দুইখান শব্দের মধ্যি কত ফারাক জান?
ঃ কী কইরে জানব? আমিতো আর তোর মতন আট কেলাশ পড়িনি।
ঃ তা পড়বা ক্যান? বাপের এক ছাওয়াল, আল্লাদে বাপের কান্দে কান্দে ঘুইরেই ডাঙ্গর হইছ। ইশকুলি যাতি হলিতো মাটিতি পাও নামান লাগে।
ঃ খোঁচা দিয়ে কতা কবিনে কলাম, আমিও বাপের ছাওয়াল, মাইয়ে মাইনষের লাম্বা-চ্যাওড়া কতা আমারো সইহ্য অয়না। সাধে কি আর আমার বাপ মায়রে দেখতি পারেনা ভাবিস? ঘরের মেয়েছেলে দিনরাত যদি প্যাচাল পাড়ে আর পরের জন্যি কান্দে....
ঃ পর কারে কইচ্ছ? সে মানুষ তুমার মার পরথম স্বামী। মাত্তর দুই বচ্ছর তুমার মা তার সাথে সুংসার করার ভাগ্য পাইছিল। পুয়াতি বৌ ঘরে থুইয়া সেই মানুষ যুদ্ধে গেছিল। ছয়মাসের ছাওয়াল কোলে নিয়ে তুমার মা বিধবে হয়। তুমার বাপে যহন তারে বিয়ে করে তহন ছাওয়ালডা দুধও ছাড়েনি। সেই ছাওয়ালরে তুমার বাপে কত কষ্ট দিয়ে মারছিল। সেসব কষ্টের কথা মা কয়ে কান্দে আর আমার চোহি পানি আসে। তুমাগার পাষাণ কানে সে কথা ঢুকলিই গাও জ্বলে ওঠে, না?
ঃ কী কইস তুই এসব? আমার বাপের দিকডা একবার ভাবিসনে? সে পুরুষমানুষ। তার সামনে তার ইছতিরি আরাক পুরুষ মাইনষের সুনাম করলি তার খারাপ ঠ্যাহেনা?
ঃ ইস্! ভারি খারাপ ঠ্যাহে, না? সেই পুরুষির পাও ধুয়া পানি খাওয়ার যোইগ্যতাও যদি তার থাইকতো!
ঃ কী কলি!!
ঃ চোখ রাঙ্গায়োনা। গজনী ওসব চোখ-মোকের ভয় খায়না। হাভাতে পাষাণ পুরুষির বংশ কুনহানকার! মাথায় নেই ঘুড়ার গবর, খালি আছে আলগা ত্যাজ। কী আমার বীরপুরুষ! বাপের অরডারে নিজির মারে মারতি ধায়! একবারো হিসেব নেই যে ঐ মার প্যাটে না জন্মালি, ঐ মার দুধ না খালি এই দুনিয়ায় দাপায় বেড়াতাম কী কইরে! মা কী জিনিস তা সব ধরমেই চিনাইছেÑ অধম্মের পুতির কানে কী আর কোন ধম্মকথা সান্দিছে?
এভাবে বাপ তুলে শোধ নিয়ে গজনী বিছানায় পিছন ফিরে শোয়। আয়নালের আর কথা বাড়াবার সাহস হয়না।
মাঝরাত। কী এক অস্ফুট বিড়বিড়ানি আর চাপা কান্নার শব্দে আয়নালের ঘুম ভাঙ্গে। অন্ধকারে শব্দের উৎস দেখা না গেলেও সে অনুভব করে যে এ শব্দ তার খুব কাছ থেকেই আসছে। হ্যা, এতো গজনীরই কান্না মনে হচ্ছে। ঘুমন্ত গজনীর গায়ে হাত রেখে দুটো ঝাঁকুনি দিতেই সে ‘আঃ’ বলে জেগে ওঠে।
ঃ কী অইছে বৌ? কী অইছে তোর?
অশ্রু আর ঘামে ভেজা চোখ-মুখ মুছে ধাতস্থ হতে গজনী কিছু সময় নেয়। তারপর বলে, আমার বড় কপাল গো, আমার বড় ভাইগ্য.....
ঃ ক্যান? খুব ভাল খোয়াব দেখছিলি?
ঃ হ গো হ। ভাল মানে! যে খোয়াব দেখতি আমার রোজ রাত্রি মনে চাইত, যে মুখখোনের কল্পনায় কত রাইত আমার চোহে ঘুম আসতি দেরি অইত, তারে যে আইজ আমি দেখতি পালাম।
ঃ কার মুখ?
ঃ সেই মাইনষের। যে মাইনষের হাড়-মাংস সেই কতকাল আগে গোরে মিলাইছে, তেমু যে মানুষ আজো তুমার মার বুকির মদ্যি বাঁইচে আছে।
আয়নাল হতভম্ব। বলে কী এ মেয়েমানুষ! যার প্রতি প্রবল ঈর্ষায় তার বাপটা সারাজীবন জ্বলে-পুড়ে খাক হল সে ভূতের আছর কি এখন গজনীতেও পড়ল? কিন্ত তার প্রতি গজনীর কেন এই পক্ষপাত? মার মহব্বতের প্রতিই যেখানে তার কোন সহানুভূতি নেই সেখানে গজনীর এই উটকো মায়া! সত্যিই, মেয়েলোকের অন্তরের চেয়ে জটিল বস্ত আল্লাহ বুঝি আর কিছুই সৃষ্টি করতে পারেনি। দুর্বোধ্যতাকে বোধগম্য করতেই বুঝি আয়নাল প্রশ্ন করে, আত্মবিশ্বাস নষ্ট হওয়া ফ্যাসফেসে কন্ঠে, তুই তারে চিনলি ক্যাম্মায়?
গজনী হাসে। স্পষ্ট, মধুর, সুরেলা সুরেই সে হাসে। তারপর বলে, হায়রে পুরুষ! প্রেমিকমুখ চিনতি কি আর নারীজাতের ভুল হয়? ও যে জগতের দুর্লভ জিনিস। হাজার মন কাঁচের ভীড়েও হিরে চিনতি জহুরীর কষ্ট! তাছাড়া সে যে সত্যিকারের পুরুষ গো; এ জাতির ঘোর দুর্দিনে তাগের পৌরুষ, তাগের রক্তই যে আমাগের সম্পদ ছিলগো। আর শহীদ চেনা যাবিনে? তুমরা নষ্ট মুক্তিযুদ্ধা চেন আর আমি শহীদ চিনিনে? নাগো, তারে আমি এক নজরেই চিনছি। যে মানুষ মরার পরেও তিন-চার যুগ ধরে ভালবাসার মাইনষের চক্ষের পানিতে ধৌত হয়, সে যে আসমানের চান-তারা-সুজ্জির চাইতেও বেশি নূর ধরে; তারে চিনা যাবিনে? ........বাজান আমারে কী কইল জান? কইল, মাগো, দুখ্খো কইরোনা। দুনিয়াতে বড় ভালবাসা বেশিদিন টেহেনা। এই আমি যদি বাইচে থাকতাম তালি হয়ত মায়মুন সারাজীবন ধরে আমারে এত্ত ভালবাসতনা। আমিও হয়ত কোনদিন সংসারের নানা দুঃখ-ধান্দার চাপে পড়ে তুমার শ্বশুরের মতই তারে ....। আমরা যারা মুক্তি ছিলাম তাগের কয়জন আর এহন তুমার শ্বশুরের চাইতে বিবেকবান? তারচে এই ভাল হইছেনা? আমার মায়মুনের মনে আমি সারাজীবন একজন পঁচিশ বছরী যুবক-প্রেমিক হয়ে থাকলাম। তার মনে আমার যে ছবি তার কোন জরা নেই, কলুষ নেইÑ আমিরিত্যু সে একজন তরতাজা যুবকের পরনয়নী হয়ে থাকবিÑ এতবড় কপাল কয়জনের হয়গো মা?
এবার জেগে থেকেও গজনীর চোখে অশ্রুধারা। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বলে, ‘এতদিন মার দুর্ভাগ্যের কাহিনী ভাইবে আমার মন খারাপ অইত, চোখে পানি আইসতো। কিন্ত আইজ তার সৌভাগ্যডারে আমি চিনতি পারলাম। মেয়েমানুষের পোড়াজীবন। কয়জন মেয়েলোক জীবনে এমন একজন পুরুষরে পায়Ñ যারে তিন যুগ পরেও ভুলা যায়না! যার অসামান্য ছিরিতি বুকি পুইরে রাইখে অনায়াসে কাটাতি পারে তার সামান্য জীবন? তোমার মারে এতদিন পরে আজ আমার হিংসে হইচ্ছে, সত্যিই খুব হিংসে হইচ্ছে।’