somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাগলের হাসি-কান্না

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৩ দুপুর ১২:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ইদানীং মজনু বড্ড জ্বালাচ্ছে। আর কাউকে নয়, বৌকে। যখন-তখন, যত্র-তত্র আক্রমনের শিকার হতে হতে বৌটার হাড়মাস কালি না হলেও একাকার হতে চলেছে আরকি। মাথার নাট-বল্টু ঢিলা হবার পর থেকেই মজনুর চাহিদা আগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। আর শেষের দিকে অর্থাৎ নাট-বল্টু সব হারিয়ে যাবার পর থেকে তার যা অবস্থা হয়েছে তা বোধহয় কামদেবেকেও ছাড়িয়ে যায়। মজনু তার বাপ-মায়ের দেয়া নামকে কালে-দিনে সার্থক প্রতিপন্ন করলেও বৌ কিন্ত তার লাইলী নয়। একেতো তার শ্বশুরআব্বা মেয়ের নামকরণের সময় ভবিতব্যে থাকা জামাইবাবাজীর নাম নাজানার অপারগতায় ম্যাচিং নামটা রাখতে পারেননি, তার উপর চরিত্রগত দিকেও বৌটা মজনুর উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। আর তাই কোন নির্জন পুকুরঘাটে, চুলোর পাড়ে কি কলতলায় অর্থাৎ যেকোন সময় লোকসমাগমের সম্ভাবনাময় স্থানে হঠাৎ আক্রান্ত হলে আম্বিয়া নিজেকে মেলে দেয়ার বদলে যেভাবে বৃথা ছটফট করে তাতে তাকে মজনুর অনুপযুক্ত স্ত্রী বলেই মনে হয়।
পাড়ার মেয়েরা গা টেপাটেপি করে, মুখ ফিরিয়ে হাসে। তবে বয়ষ্কারা সহানুভূতি জানায়, দেখা হলে কুশল জিজ্ঞাসা করে। যেমন- এইতো সেদিন রহিম ব্যাপারীর বৌ তাকে জিজ্ঞেস করছিল, সন্ধ্যের সুময় গাও ধুলু নাকি বৌ?
- হ।
- কাতিমাসের এই সন্ধ্যেকালে গাও ধুলি জ্বর হবিতো। এনা সকালে কাম সারিসনি কিসোক?
আম্বিয়া নিশ্চুপ। ঘাটে আরো দুজন কমবয়সী নারী ছিল। একজন মুখ নামিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে কলসি ভরতে থাকলেও আরেকজন দিব্যি বলে বসে, দাদী য্যান কী! ওর দামানের গতিক য্যান শোননাই! ও পাঁচওক্ত নামাজ পড়ে, পারতি সধ্যি নামাজ ক্বাযা করেনা। সন্ধ্যেকালে গাও না ধুয়ে ওর উপায় কী?
বিবেচক দাদী এবার গম্ভীর হয়ে যায়। কোন রঙ্গ-রসিকতার ঢেউ তার বুকে ছলকায়না।
তো এই মজনু যখন পাগল হিসাবে দশগ্রামে প্রসিদ্ধ হয়ে পড়ল, তখন আম্বিয়ার দিনকাল ঐ এক উৎপাত ছাড়া খুব খারাপ কাটেনি। পাগলের স্ত্রী-সন্তানদের সামাজিক সম্মান বিশেষ কিছু থাকার কথা নয় কিন্ত মজনুর পরিবারের বিষয়টা রীতিমত ব্যাতিক্রম। গ্রামের লোকেরা মজনুর পরিবারকে বরং সম্মানের চোখেই দেখে।
মজনু যখন পাগল হওয়া শুরু করে তখন দিনকতক খুব জিকির-আসগার নিয়ে মসজিদে পড়ে থাকত। মসজিদের ইমাম প্রথমদিকে তার মতিগতি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। ভেবেছিল বুঝি মজনু মিঞার মনে আল্লাহর প্রতি খুব জোর ডর ও মহব্বত একসাথে জেগে উঠেছে। তাই তাকে আশেকে খোদা ভেবে দিনকতক বেশ একটু যত্ন-আত্তি করার চেষ্টা করেছিল, অর্থাৎ তাকে নির্বিঘ্নে জিকির করার সুযোগ করে দিয়েছিল। কিন্ত হঠাৎ একদিন তার চোখে পড়ে যে সম্পূর্ণ নাপাক ও বেঅযু মজনু লুঙ্গির মধ্যে হাত গলিয়ে অণ্ডকোষ চুলকাতে চুলকাতে অবিরত জিকির করে চলছে। মজনুর মজনুত্ব সম্পর্কে তার মনে সেদিনই সন্দেহ গজাতে থাকলেও এ গ্রামবাসীর ভক্তির তোপে পড়ে ভিনগ্রাম নিবাসী ইমাম সেদিন কিছু না বলাই সঙ্গত বিবেচনা করে।
অন্যান্য গাঁয়ের মানুষের মত কোন এক বিচিত্র কারণে এ গ্রামবাসীদের মনেও আজগুবি ব্যাপারে বিশ্বাস অতি প্রবল। যুক্তি-তর্কের বাইরের ব্যাপারগুলোতে অন্ধভাবে বিশ্বাসস্থাপনকে তারা ধর্মবিশ্বাসের মত করেই গ্রহন করে। তাই কোন প্রশ্ন উত্থাপনকারীকে তারা কখনোই বরদাশ্ত করেনা। এ মসজিদে চোদ্দ বছর ধরে ইমামতির অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ইমাম এদেরকে বেশ চেনে। এ গাঁয়ের হাওয়ার গতি সে ভালই অনুধাবন করতে পারে। আর তাই সে এরই মধ্যে বুঝে ফেলেছে যে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় মক্তবে বিনাবেতনে শিক্ষকতা করতে থাক ওস্তাদজী শেখ মজনু মিঞা যে ঘোরের মধ্যে আছে তাকে যদি সে এখন মস্তিষ্কবিকৃত বলে ঘোষণা করেতো ইমামসাহেবের ইজ্জ্বতের তোয়াক্কা না করে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাবার মত মুরিদ-মোজাহেরের অভাব মজনু মিঞার নেই।
মজনু সম্পর্কে নানা মিথ এরই মাঝে গ্রামে গ্রামে প্রচার হয়ে পড়েছে। কোন এক ঘোর অমাবস্যার রাতে স্বপ্নাদেশ পেয়ে সে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে কবরস্থানে যায় এবং সেখানে নামাজ শেষে সালাম ফেরাবার সময়ে সে তার ডানে দণ্ডায়মান এক অলৌকিক পুরুষের সাক্ষাৎ পায়। শুভ্র পোশাকধারী নূরানী সুরতের দরবেশকে শেষরাতের ফিকে হতে থাকা আঁধারে দেখে প্রথমে ততটা ভয় না পেলেও সেই দরবেশ যখন তার মাথায় হাত রেখে কী একটা দোয়া পড়ে আলাদীনের দৈত্যের সেই জাদুর কার্পেটের মত করে পায়ের নিচে ইরানি গালিচার চেয়েও সুদৃশ্য জায়নামাজ সমেত ঊর্ধ্বে উড্ডীন হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় তখন নাকি সে জ্ঞান হারায়। পরদিন গ্রামবাসী কবরস্থান থেকে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করলেও পূর্ণ সচেতন অর্থাৎ দুনিয়াদারীর প্রতি মনোযোগী সে আর হয়নি।
তো ঐ ইমামের মনে যাই থাক, নানা বিবেচনায় সে মজনুর মসজিদে অবস্থান করায় অমত পোষণ করেনা। বরং উঠতি পাগলের চূড়ান্ত পাগলামী প্রকাশের ক্ষণটির অপেক্ষায় থাকে। সেক্ষণ আসতে অবশ্য বিশেষ দেরিও হয়না। মজনুর মস্তিষ্ক বিকৃতির পরিমান দিনে দিনে বাড়তে থাকে। শেষে একদিন এমন দাঁড়ায় যে বৈশাখের তীব্র গরমে গা জুড়াতে পুকুরে নেমে সে পাড়ে উঠে আসে গামছা ছাড়াই। বৌ-ছেলে চিৎকার করে ছুটে আসে, মেয়েরা মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে; বিস্মিত প্রতিবেশিদের ভক্তিতে তবু টান ধরেনা। তবে সেই থেকে মজনুর মসজিদে প্রবেশ বন্ধ হয়। ইমাম ও স্থানীয় কয়েকজন শিক্ষিত মাওলানার ঐক্যমতকে গ্রামবাসী স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়। গ্রামটায় শিক্ষিতের হার বাংলাদেশ বিবেচনায় সন্তোষজনক; অধিকাংশ লোকই সাক্ষর। কাজেই বেআব্র“ ব্যাক্তি মোমিন হলেও যে মসজিদে প্রবেশাধিকার রাখেনা সেটুকু ধর্মজ্ঞান প্রায় সবারই রয়েছে।
পাকাপাকিভাবে পাগল সাব্যস্ত হবার পরও কিন্ত মজনুর জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র কমেনি। তার তুচ্ছ জীবনাংশের পরিচ্ছন্ন ইতিহাসের সাথে পাগল হবার পেছনের অলৌকিক ঘটনা ও বর্তমানে কৃত নানা দার্শনিক উক্তি তাকে এলাকার এক বিশিষ্টজন বলে স্বীকৃতি দেয়। পাগল মজনুকে প্রথমে তার স্ত্রী-পুত্র কাপড় পরাতে চেষ্টা করলে সে অবলীলায় বৌকে বলে, ‘তুমিতো এ জিনিস কতই দেখছ, ঢাইকা আর কাম কী’। ছেলেকে বলে, ‘তুইতো ব্যাটা এই মেশিন থিকাই পয়দা হইছস, এখন শরম পাস কিসোক?’ এসব কথা লোকের মুখে মুখে রটে বাতাসের বেগে ছোটে। ফছকে ছোঁড়া-ছুঁড়ির দল হি-হি হা-হা করে, তাদের মারা মুখে আঁচলচাপা দেয়। আর যুবকের দল একথার সুত্র ধরে কিছু উচ্চাঙ্গের তামাশা করে গমগমে স্বরে হা-হা হাসে বটে কিন্ত মোটের উপর সবাই পাগলটাকে স্নেহই করে- আহা! অমন ভাল একটা মানুষের এই দশা!
প্রতিবেশিদের কেউ যে নাগাসন্ন্যাসের দর্শনে বিশ্বাস করে তা নয়, তবু কেউ কেউ মজনুর এ উক্তিতে মোহিত হয়- ‘আসবারকালে আসলি ল্যাংটা, যাবার কালে দিবি ঘোমটা, মাঝখানে তোর খেমটা নাচন রে.........।, রীতিমত লালনতুল্য দর্শন! এছাড়া তার ‘আরামে ঘুমাও’ ও ‘মিলেমিশে থাক’ দর্শনটাও এলাকায় জনপ্রিয়। একটু খোলাসা করা যাক।
নগ্ন মজনুকে কাপড় পরবার জন্য পীড়াপীড়ি করা যখন তার পরিবার প্রায় ছেড়েই দিয়েছে তখন একদিন হঠাৎ দেখা গেল যে মজনু তার দেহের সম্মুখদিকে নিচের অংশে একটা ডাবের খোল ঝুলিয়ে, তার মধ্যে তার বিশেষ অঙ্গকে বিশেষ কায়দায় স্থাপন করে, চেহারায় রাজসিক গাম্ভীর্য মেখে, বুক চিতিয়ে, অনায়াসে জনসমক্ষে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। হাঁটার দুলুনিতে বা বসতে-শুতে কোন কারণে ওটা বিচ্যুত হলে সে ফের ওদের পজিশন ঠিক করে দিয়ে খুব আদরমাখা স্বরে বলছে, আরামে ঘুমাও।
তবে মজনুর ওটা যে কুম্ভকর্ণের নিদ্রাতে মোটেই আস্থাশীল নয় তা বোঝা যায় তার ক্ষণে ক্ষণে ফুঁসে ওঠা চেহারায়। আরামে ঘুমাবার পাত্রটি বটে! আর এজন্য আম্বিয়ার হেনস্থার শেষ নেই। ছেলে-মেয়ে কে কোথায় আছে সেদিকে পাগলের লক্ষ্য নেই, যেখানে-সেখানে আম্বিয়াকে পেড়ে ধরল তো ধরলই। অবস্থা এমন হয়েছে যে ছেলে-মেয়েদেরই এখন দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে পাহারা দিয়ে হলেও অন্ততঃ প্রতিবেশিদের দৃষ্টি থেকে তাদেরকে ওসময় আড়াল করে জৈবিক কর্মের গোপনীয়তা বজায় রাখার। দুঃখে-লজ্জ্বায় আম্বিয়ার মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্ত মরেও যে শান্তি নেই- প্রায় নাবালগ সন্তানগুলোর কী হবে, কে তাদের দেখবে!
আম্বিয়ার একটা সান্ত্বনা এইযে, স্বামী তার উন্মাদ হতে পারে কিন্ত চরিত্র হারায়নি। আগের মতই মানুষটা পরস্ত্রীর প্রতি সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে চলে। কোন নারীর পানে বদনজর দেবার ইতিহাস তার জীবনে নেই। তো এই কামুক অথচ চরিত্রবান, পাগল অথচ দার্শনিক মজনু হঠাৎই সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে হা-হা করে বিকট উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করে। পাগলের অট্টহাসি মোটেই সুখশ্রাব্য জিনিস নয়। লোকজন হঠাৎই তাদের রক্তের মাঝে একটা হিম হিম অনুভূতি বোধ করে- এ পাগলতো কখনো হাসেনা! আজ তার কী হল! লোকদের ভাবনা হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। আসলেই মজনু মজনুত্ব প্রাপ্তির পর কখনো হাসেনি। বরাবরই সে একটু রাশভারি ভাবের মানুষ; ফালতু ঠাট্টা-ইয়ার্কি, হি-হি, হা-হাতে সে কোনদিনই যোগ দেয়নি। তবে একটু মুচকি হাসি, স্মিতহাসি, কাষ্ঠ হাসি- এসবতো সব মানুষকেই জীবনে কখনো না কখনো হাসতে হয়। তেমন হাসি মজনুও হেসেছে বটে কিন্ত পাগল হবার পরে কদাপি নয়।
এক ভোরে চারদিকে সাজসাজ রব, হুলস্থুল অবস্থা। ঝাড়–-লাঠি হাতে ব্যাপক মারদাঙ্গাবাজ কিছু জনতার দঙ্গলকে শান্তি-সুখের আবেশ মাখা প্রভাতি প্রকৃতিকে হতচকিত করে তার গ্রামের পথধরে ছুটে যেতে দেখে মজনু উদাসভাবে কী যেন ভাবতে থাকে। বাতাসে কথারা বয়ে যায়। তার কিছু কিছু মজনুর অন্যমনস্ক কানেও ধাক্কা খায়। এমনই একটা কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করায় সে আচমকা ঠা-ঠা করে হাসতে শুরু করে । আর সে হাসিতে ভয় পেয়ে কয়েকটা কাক কা-কা করতে শুরু করলে আরো আরো কাকেরা এসে জড়ো হতে শুরু করে। তারপর সবাই মিলে মিছিল করে জ্বালাময়ী শ্লোগান দিতে শুরু করলে পাগল বড় বড় চোখে কিছুক্ষণ তা দেখে নিয়ে ধীরপায়ে বাড়িতে গিয়ে ঢোকে ।
যে কথাটা কানে লাগায় ঐ বিশিষ্ট উন্মাদও অট্টহাসি হেসেছিল তা সম্ভবতঃ এই- ‘তেনাকে চান্দে দেখা গেছে গো’। আমাদের এরূপ অনুমানের কারণ ঐদিন ঐকথাটা ছাড়া ঐ দাঙ্গাবাজ জনতার মুখে আর কোন কথা ছিলনা ।
পরদিন দুপুরনাগাদ মজনু যথারীতি হেলতে-দুলতে তার প্রতিবেশি গ্রামের বাজারটিতে হাজির। গ্রাম্যবাজার হলেও এ বাজারে বেলা এগারোটার মধ্যে শ’পাঁচেক মানুষের ভীড়। বাজারের গমগম ধ্বনি অনেকটা দূর থেকে শ্র“ত হয়ে আগমনকারীকে এর আভিজাত্য ও মর্যাদা সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই শতেক কণ্ঠের ঐক্যতান মজনুর কাছে এতই চিত্তাকর্ষক যে প্রতিদিন সম্ভব না হলেও একদিন পর একদিন হলেও তার এখানে আসা চাই ই চাই। আজ মজনু যখন বাজারে হাজির হল তখন বাজারটাকে তার মনে হল যেন প্রেতপুরী। কোথাও এতটুকু সাড়া-শব্দ নেই। দু’একটা কুকুর শুয়ে-বসে অলসভাবে ঝিমানো ছাড়া এবং কজন ভবঘুরে টাইপের লোক ও টোকাইজাতীয় কিছু ছেলেপুলে ছাড়া বিশেষ কাউকে দেখা গেলনা। অধিকাংশ দোকানের ঝাঁপ বন্ধ। কী যেন এক অদৃশ্য আতঙ্ক চারধারে ছড়িয়ে পড়ে বাতাসকে পর্যন্ত ভারি করে তুলেছে। পাগল খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে এদিক-ওদিক তাকায় আর বিড়বিড় করে বলতে থাকেঃ সবগুলান চান্দে গ্যাছে, সব গুলান......। এরই মধ্যে হঠাৎ হকারটাকে দেখা গেল তার খবরের বোঝা সাইকেলে চাপিয়ে যথানিয়মে এসে হাজির। ভবঘুরে লোকগুলো এগিয়ে আসে। হকারের উদ্দেশ্যে একটা ইতস্ততঃ লাজুক হাসি ছড়িয়ে বলে, আজকের খবরে কী আছে বাহে?
হকার কথা বলেনা। থমথমে মুখে খানিকটা বিরক্তি মেখে চুপচাপ কাগজগুলোর মাঝে কী যেন খুঁজতে থাকে। ভবঘুরেদের একজন মামাবাড়ির আবদারের সুরে বলে, একখান কাগজ দ্যাননা পড়ি। হকার কিছু না বলে কাগজগুলো ঘেঁটেই চলে। নাছোড়বান্দাটা ফের বলে, দ্যাননা একখান কাগজ, পড়ি ফেরত দিমু, আল্লার কিরা। প্রচণ্ড বিরক্তিতে হকার এবার ফেটে পড়েঃ কী খবর দ্যাখার লাই জিদ করছু? কাল সারাদিন চক্ষের সামনে যা যা ঘটতি দেখছু তাইতো লেখছে। এই দ্যাখ কত্তগুলান লাশ...... এই দ্যাখ........ এই দ্যাখ....... ভাল কর‌্যা দ্যাখ এর মধ্যি তগো বাপ-ভাইগো পাতি পারিস......... দ্যাখ, ভাল করি দ্যাখ; খায়েশ মিটছে?
হকারটা একতাড়া খবরের কাগজ ওদের নাকের কাছে দুলিয়ে-দুলিয়ে বলতে থাকে। ওরা একটু পিছিয়ে যায়, একটু বুঝি বিস্মিতও হয়ঃ হঠাৎ করে কী হল রহমালীর? এমন ক্ষেপে উঠল কেন? এমন সময় বলা নেই, কওয়া নেই মজনু পাগল কোত্থেকে ছুটে এসে কাগজগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে দেখতে দেখতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলতে ফেলতে চিৎকার করতে থাকে, যা যা চান্দে যা, সবগুলান চান্দে যা। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। পাগলের হাসির মত পাগলের কান্নাও সাংঘাতিক। সে কান্না শুনে কুকুরগুলো হঠাৎ ঝিমুনি থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে ঘেউঘেউ করে বিভ্রান্তভাবে ছুটতে থাকে আর মানুষেরা হয়ে পড়ে স্তব্ধ। হকার রহমালী তার জীবিকার অবলম্বনগুলোকে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখেও কিছু না বলে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে চেয়ে দ্যাখে। পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় লাশেদের ছবি আর তার পাশে অর্ধচন্দ্রের গায়ে পরিস্ফুটিত লহুরঞ্জিত শ্মশ্রুময় একটি বিশেষ মুখের ছবি বুঝি তারই দিকে চেয়ে থাকে।
এর দিনকতক পর ঐ গ্রামে একটা দারুন অগ্রিম কালবোশেখী বয়ে যায়। ঝড়ে অনেকের বাড়ি পড়ে, গোলা ওড়ে। কিন্ত এরই মাঝে একজোড়া গাছ যেন বিধাতার অট্টহাসি গায়ে মেখে নিজেরাও মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। আর সে গাছ দুটো হল পাশাপাশি একটি কলা ও একটি মাঝারি উচ্চতার সুপারী গাছ যাদের শাখাগুলো একে অপরের সাথে মিলেমিশে থাকার শর্তে পাগলা মজনুর হাতে কোনএকদিন গ্রন্থিবদ্ধ হয়েছিল। উন্মাদ মজনু প্রায়ই দুটো পাশাপাশি অবস্থিত ভিন্নগোত্রীয় গাছকে এভাবে আত্মীয়তা স্থাপনের উপদেশ দিয়ে শাখায় শাখায় এমনই নিবিড় করে বেঁধে দেয় যে কেউ চেষ্টা করলেও সে গ্রন্থির মোচন ঘটাতে পারেনা । গ্রন্থি রচনার সময় মজনু বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে এমনভাবে তাতে ফুঁ দেয় যে দূর থেকে তাকে দেখলে কোন কামেল ফকিরের মন্ত্রোচ্চারণ ও ফুৎকার প্রদানের ভঙ্গিটা স্মরণ হয়। তো পাগলকে ভয় করলেও এবং পাগলামোকে ঘৃণা করলেও জ্যান্ত একটা পাগলের পাগলামী কাছ থেকে দেখার কৌতুহল যেহেতু মানুষের মনে চিরন্তন সেহেতু মজনুর এই কর্মকাণ্ডও বহু লোকে খুব আগ্রহ নিয়ে কাছ থেকে দেখে থাকবে। তাই গ্রামের সবারই জানা আছে যে মজনু যখন দুটো গাছের ডাল-পাতাকে একসাথে কষে মুচড়ে গিট্টু পাকাতে থাকে তখন খুব ভাব-গম্ভীর স্বরে বলতে থাকে, মিলে মিশে থাকো বাবারা, মিলে মিশে থাকো। তারপর আয়তুল কুরছির দু’একটা আয়াত পড়ে খুব জোরে একটা ফুৎকার দিয়ে ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী গাছজোড়ার দিকে রওনা করে। গ্রামের দুষ্ট ছেলের দল তাই পথের ধারে রাস্তার মোড়ে গৃহস্থের বাগানে অর্থাৎ যত্রতত্র ঐ মিলেমিশে থাকার নমুনা দেখে উচ্চস্বরে হাসে ও নিজেরাও সুর করে বলে, ‘মিলেমিশে থাকো........মিলেমিশে থাকো......... ।’
পাগলামী ব্যাপারটা সত্যিই সংক্রামক।


২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×