শীত শেষ হয়েছে। ঢাকাবাসীর গা থেকে ব্লেজার-সোয়েটার নেমে গেছে প্রায়। বস্তি ও ফুটপাথের হাড় জিরজিরে উদোম শরীরগুলো এখন রগটান করে ছুটতে শুরু করেছে । প্রকৃতির উপহাস সয়ে টিকে থাকা দেহগুলো এখন প্রকৃতির আশীর্বাদ মিঠে রোদ্দুরকে তাচ্ছিল্য দেখতে শুরু করেছে। প্রখর হিমে নবজাতকের মৃত্যুর আশঙ্কা কমে যাওয়ায় পোয়াতীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। এক কথায় গণমানুষের জীবনে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান গতি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, বিচ্ছিন্ন কিছু খুন-ধর্ষণ-গুম-ডাকাতি-মুক্তিপণ সত্বেও যখন কিছুটা শান্তি শান্তি ভাব বিরাজ করছে তখনই ঘটল এই ঘটনা। বেশ কিছু তরুণ-তরুণী হঠাৎই শাহবাগ মোড়ে একত্রিত হয়ে খালি গলায় ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই বলে চিৎকার করতে শুরু করলে পথচারীদের অনেকেই থমকে দাঁড়াল। তাদের কেউ কেউ তরুণদের সাথে গলা মেলান। এভাবে ক্রমান্বয়ে সংখ্যাটা বাড়তে থাকলে একসময় কারো কারো হাতে এল হ্যান্ডফোন। অবিরত চিৎকাররত তরুণদের গলা বসে পুরোপুরি বুজে যাওয়ার আগেই এল মাইক্রোফোন। এরপর আধুনিক সাউন্ড সিস্টেমে গণসঙ্গীত বাজতে শুরু করলে দেশাত্মবোধের প্রবল আবেগ শাহবাগে গণপ্লাবন বইয়ে দিল। এ প্লাবন ক্রমবর্ধমান হয়ে এমন করে ফুঁসতে শুরু করল যে দলে দলে নেতারা এসে তাদের একাত্মতা জাহির করতে চাইল। কিন্ত তরুণেরা তাদের অভিসন্ধিমূলক উপযাচকতা সাথেও তারা পরিচিত তাদের মিথ্যাচার ও অভিনয় কৌশলের সাথেও তারা পরিচিত। তাই তারা নেতাদেরকে একদম প্রস্তাবনার পর্যায়েই হটিয়ে দিল । তাদের একদাবী, কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই, সব রাজাকারের ফাঁসি চাই ।
জাতীয় সংসদে আন্তঃ অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হল । তরুনদের অবিরাম দ্রোহ চলছেই। ফেসবুক ,ব্লগ ,টুইটারে নিভৃতে যে আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়েছিল, তাকে এখন পরিবর্তনকামী মানুষেরা আশার আলোর সৃতিকাগার বলে ভাবছে । কিছু প্রবীন তরুনেরা টকশোগুলোতে এ আকাক্সক্ষাও ব্যক্ত করছে যে এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি যেন রাষ্ট্র চালনার পদগুলোতে তারুণ্যের অভিষেকের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়।
এমনই উন্মাতাল টানটান সময়ে বছিরদ্দি একদিন ঝন্টুর হাত ধরে শাহবাগ এসে দাঁড়ায়। কয়েকদিন আগে কিছু তরুণ ছেলেমেয়ে একজন রাজাকারের ফাঁসির দাবীতে এখানে জমায়েত হয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল। এখন প্রতিদিন কত বিখ্যাত মানুষ নাকি একাত্মতা জানাতে এই শাহবাগ আসছে। ওরা এর নাম দিয়েছে স্বাধীনতা প্রজন্ম চত্ত্বর। নামটা বছিরদ্দির মনে খুব ধরেছে, যদিও প্রজন্ম শব্দটার অর্থ তার কাছে তেমন স্পষ্ট নয়।
টিকাটুলির বস্তির মোড়ের যে দোকানটার বাইরে দাঁড়িয়ে বছিরদ্দি এখন টিভি দেখে সেই দোকানী মনজু মিঞা এ আন্দোলনকে বড় ভাল চোখে দেখছেনা। তার যুক্তি-- এটা আওয়ামীলীগের আরেক টার্ম ক্ষমতায় থাকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু জাতিকে ভুলিয়ে রাখার অপকৌশল মাত্র। কিন্ত আন্দোলন পছন্দ না করলেও, এর কারণ ও তাৎপর্য বিষয়ে অপব্যাখ্যা করলেও সারাদিন টিভিতে এ সংক্রান্ত সংবাদ, সর্বশেষ আপডেট ও সরাসরি স¤প্রচারিত অনুষ্ঠানমালা এমনকি টকশো নামের প্যানপেনে আলোচনাও তাকে দেখতে হয় কারণ তার খরিদ্দাররা ইদানীং পেয়ার কা কাহানি কিংবা শিলা কা জওয়ানি ছেড়ে এই গরম ব্যাপারে মেতে উঠেছে।
সেদিন দুপুরবেলা দোকানের ভীড়-ভাট্টা কমে গেলে মনজু মিঞা বছিরদ্দিকে ডেকে বলে, আবে ও বইশর্যা, ছাহবাগ গ্যাছোচ নি?
কত্ত! আগেতো আমি উহানেই রিশকা চালাতাম।
আবে হালার পো হালা, আমি ছে আগেকার কতা কইনিক্যা। আমি কই এই হালায় আবাল পুলাপাইন আইছ্যা চান্দি গরমকরণের পরেকার কতা। তুমিতো হালা রিছকা চালায়া ছারা ঢাহার ছহর ফিল্ডিং মারা পার, মাগার আমারতো এই এক দুকানে বয়া থাইকতে থাইকতে অণ্ডকোছে আমঢ়াগাশ গজাইবার লাগশে। যাওনা হালায় একদিন, চক্ষু ছার্থক কর্যা দেহা আও। তুমিতো আবার হালায় মুক্তি আছিলা।
এ জাতীয় কথা বস্তির কেউ বললে বছিরদ্দি নিশ্চিত অপমানবোধ করত কিন্ত মনজু মিঞার কথা সে গায়ে মাখেনা। লোকটা মুখে যাই বলুক অন্তরটা কিন্ত বড্ড সাফ। অন্য কেউ না জানুক বছিরদ্দি তা বেশ জানে। বিউটি ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডে ছেলে জয়নাল আর তার বৌ আয়শার মৃত্যুর পর বিধ্বস্ত বিউটিতে তাদের লাশ খুঁজে পেতে এই লোকটা যা করেছে তা ভুলবার নয়। তার সহযোগিতা না পেলে বছিরদ্দির পক্ষে সম্ভব ছিলনা আপন সন্তানের পোড়া বিকৃত দেহের অংশ বিশেষ অগ্নিদাহের ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধার করে সেই হরিণাকুণ্ডুর অজপাড়াগাঁয়ে নিয়ে দাফন করে।
মনজু মিঞার কথার জবাবে বছিরদ্দি কিছুই বলছেনা দেখে মনজু মিঞা এবার কণ্ঠটাকে নরম করে বলে, বশির্যা, মাইন্ড খাইলানি? আবে মুক্তি তুমিতো হালায় একলা না, আমিও আছিলাম। ছাবমেশিনগান দিয়া দুমাদুম গুলি হয়ত ছুঁড়ি নাই, গেরিলা হয়্যা গ্রেনেড চার্জও করি নাই, মাগার রছুনের ঝুড়ির তলায় মাল লুকায়া বুড়িগঙ্গা পার করি নাই? মুক্তিগো লাই ভাত রাইন্ধা মাঝ রাত্তিরে দোলাইখালে লয়া যাই নাই? হুনছি তহন যারা এসব কাম করছে তারাও নিহি মুক্তি। মাগার আমিতো হালায় মুক্তি বইলে কুনোদিন নিজেরে জাহির করি নাই। কুনো ছম্মুন্ধীর কাছে গিয়া ছাট্টিফিকিটির লাগি দরবারও করি নাইক্যা। দ্যাশের অছময়ে যা করা উচিৎ বইলা মনে হইশিল তাই করছি। আবার যদি তেমুন দিন আহে যদি মনে অয় আমার হালায় কিছু করণ দরকার, মানে ঐ একাত্তরের মতন দ্যায়ালে পিঠ ঠেইক্যা গ্যাশে তালিতো বুক ঠুইক্যা দাঁড়াইতেই অয়। কী কও?
বছিরদ্দি আর কী বলবে? কী আর তার বলার আছে? দিন কতক আগে জোয়ানমর্দ্দ ছেলে-ছেলের বৌ হারিয়ে তার এখন পাথর দশা। ছেলেটা যে পাঁচবছরী নাতিটাকে দুনিয়াতে রেখে গেল তার প্রতি জাগতিক কর্তব্যবোধে তাকে এখনো নড়তে চড়তে হচ্ছে, রিক্সার প্যাডেল ঘুরাতে হচ্ছে, দিনে একবার হলেও হাড়িতে কিছু ফুটাতে হচ্ছে। হ্যা, সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে অস্ত্রহাতে সম্মুখ যুদ্ধই করেছিল। কিন্ত তাতে কী? তার ভরা যৌবনের উত্তাল দিনগুলোতে দেশের জন্য সে কী করেছিল আজ তার কোন প্রমানই যে তার হাতে নেই। মুজিবের আমলের সার্টিফিকেট যখন দিনের পর দিন তোরঙ্গে আটকা ছিল তখন কোনদিন ভাবেনি যে ওটা কোন জাগতিক কাজে আসবে। ওসব সনদ-টনদ কাজে লাগাবার মত বিদ্যা তার পেটে ছিলনা, মগজের বুদ্ধিতেও ছিল খামতি। সে সোজা মানুষ। মনজু মিঞার আজকের বক্তব্যের মতই সোজা-সাপ্টা ছিল তার চিন্তা। সে সময় দেশ-দশের বিপদ দেখে তার তরুণ রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। খানিকটা উন্মাদনা, খানিকটা কর্তব্যবোধ এবং অনেকখানি অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তাবোধে তাড়িত হয়েই সে একদিন কয়েকজন ইয়ার-দোস্তের সাথে মিলে বর্ডার পার হয়েছিল। ফিরেছিল একটা থ্রি নট থ্রি হাতে। তারপর বেশ কয়েকটা অপারেশনে সফলভাবে অংশ নেয়া বছিরদ্দি গায়ে এতটুকু আঁচড় ছাড়াই যখন স্বাধীন দেশের মুখ দেখল তখন দিনকতক অস্ত্র হাতে গ্রামময় খুব হম্বিতম্বি করে ফিরল। একদিন ডাক এল অস্ত্র জমা দেয়ার। সুবোধ বালকের মত অস্ত্র জমা দিতেও হল। বছিরদ্দি ফিরে গেল তার বাপের দেড়বিঘা ক্ষেতের কোলে।
এরপরতো কতকী ঘটে গেল। সব কি আর বছিরদ্দি গুছিয়ে ভাবতে পারে! শুধু মনে পড়ে সাধারণ ক্ষমা, রক্ষী বাহিনী, বাকশাল, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু--ইতিহাসের এমনই কিছু টুকরো-টাকরা অংশের কানে শোনা স্মৃতি। গোটা দেশ জুড়ে কখনো অরাজকতা, কখনো গণতন্ত্র, এই নির্বাচন তো ফের সরকার পতনের আন্দোলন। এর মধ্যেই কোন আকালে দেনার দায়ে বছিরদ্দির বাপের সেই সম্বল দেড়বিঘা উড়ে গেল, কৃষক বছিরদ্দি দিনমজুরে পরিণত হল। একসময় জীবন সংগ্রামের দুঃসহ দাবীর মুখে অগণনসংখ্যক পূর্বপুরুষের স্মৃতিসম্বলিত খোড়ো চালাঘরের মায়া কাটিয়ে আলো ঝলমলে মহানগরী ঢাকার বাসিন্দায় পরিণত হল। এসবের মধ্যে সেই অমূল্য সনদখানা মূল্যহীনতার প্রায়শ্চিত্ত করতে কবে কোথায় যে অদৃশ্য হল তার হদিস আর মেলেনা। এরপর নাকি কতবার কত সরকার নতুন করে সনদ দিয়েছে, বছিরদ্দির পক্ষে তার খোঁজ রাখা সম্ভব ছিলনা। এইতো কিছুদিন আগের কথা-- কে একজন বলছিল আবার নাকি মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করে সনদ দেয়া হচ্ছে এবং এখন নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতাসহ তাদের সন্তান এমনকি নাতিদেরও নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বক্তা ছিল ঢাকাইয়া; রসিকতা করে বলছিল, হালার বাপ কিংবা দাদায়ও যদি মুক্তি হইত তাইলে আজ আমারে পায় কুন হালায়! মুন্ত্রী-মেনিষ্টার না হবার পারি কুনো না কুনো ছরকারি অপিছের পিওনছাব ভি হইতি পাত্তাম।
অচেনা বক্তার মুখের এই নয়া খবর বছিরদ্দিকে এতটাই উজ্জীবিত করে যে একদিন সে সত্যিই সনদ যোগাড়ের চেষ্টায় মাঠে নামে। কিন্ত এখানেও বড্ড হোঁচট খেতে হয় তাকে। হাজার দশেক নগদ হাতে ধরিয়ে না দিলে কমান্ডার থেকে শুরু করে কর্মকর্তা পর্যন্ত কেউ যে কোন দলিলে তার নামই খুঁজে পায়না। সেই কোন চল্লিশ বছর আগেকার কথা-- বলতে গেলে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়োর গপ্প। কার এত দায় পড়েছে যে কোথাকার কোন মুক্তি বছিরের দুঃসাহসিকতার কাহিনী তথ্য-উপাত্তসহ মুখস্থ করে বসে আছে!
এখন এই শাহবাগের স্ফুলিঙ্গ দেশের আনাচে কানোচে ছড়িয়ে পড়েছে বলে টিভির খবরে প্রকাশ। এ স্ফুলিঙ্গ কতটা আগুন জ্বালাতে পারবে, একাত্তরের মত আগুন হয়ে ছড়িয়ে পড়বে কিনা তা বছিরদ্দি বুঝতে পারেনা। তবে যেভাবে আন্দোলন এগিয়ে চলছে, যেভাবে সবস্তরের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও অংশগ্রহন বাড়ছে তাতে সময়ই বলে দেবে যে শেষপর্যন্ত কী ঘটে।
অত মানুষের ভীড়ে ঝন্টু হারিয়ে যেতে পারে ভেবে বছিরদ্দি তাকে কাঁধে তুলতে চায় কিন্ত পাঁচবছরী নাতির আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ দুই-ই বড় প্রবল। দাদার কাঁধে চড়ার প্রস্তাবকে অবহেলাভরে উড়িয়ে দিয়ে সেও শ্লোগান দেয়, ‘জয় বাংলা!’ তারপর দাদার হাত ছেড়ে একছুটে মিশে যায় প্রজন্ম চত্ত্বরের দ্রোহিত এ প্রজন্মের মাঝে আগামী প্রজন্মের প্রতিভূ হয়ে।