শাহ ইয়াছিন বাহাদুর আমার ব্ন্ধু, আমারা ১৯৯৯ থেকে ২০০৩ সালে সিলেটের সাহিত্য অঙ্গনে একটা আনন্দময় সময় কাটিয়েছি।এখন দুজন নারায়ণগঞ্জে আছি। আমি বাহাদুরের গল্পের একজন ভক্ত। একুশে বই মেলা-২০১২ তে `অন্ধকারের কাছাকাছি' শিরোনামের একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেই গল্পগ্রন্থ থেকে একটি গল্প আপনাদের জন্য...
বীর্যবাণ
শাহ ইয়াছিন বাহাদূর
##############
আজও বৃষ্টি হলো না। দু’দিন ধরে আকাশের এই এক হাল। বিকেলে উত্তর কোণে শ্লেটরঙা মেঘ জমে। হালকা ঠাণ্ডা বাতাসে উড়তে থাকে রুক্ষ্ম ধূলিকণা। আকাশের উপর নিচে এলোমেলো চক্কর দেয় কিছু বক আর কাক। এসব বৃষ্টির লণ যে জন্য গরুগুলোকে এক রকম দৌড়িয়েই বাড়ি নিয়ে আসে রাখালেরা। উঠানের আশেপাশে, ভীন বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া মুরগিগুলো আর জীর্ণ খালের তলানী থেকে হেলেদুলে উঠে আসা হাঁসের পাল খোয়ারে ঢোকে। গ্রামের মানুষের মনের ভেতরের ফাঁটলগুলো বৃষ্টি এলে ুধার্ত জমির রুগ্ন ধান চারার হেসে ওঠার সাথে সাথে ভরাট হয়ে যাবেÑ এই আশায় তারা পানি নেই তবু নদী পাড়ে আসে। মেয়েরা ত্বরিতে উঠান ঝাড়– দেয় বৃষ্টি হলে ময়লায় যেন কাদা না লাগে, বাচ্চারা প্রস্তুত থাকে বৃষ্টিস্নানের। কিন্তু বৃষ্টিটা এসেও যেন আর আসে না। দু’একবার আকাশটা গর্জনে ফেটে পড়তে পড়তেই উত্তরের মেঘগুলো বাতাসের ধাক্কায় সরে যেতে থাকে। মেঘগুলো ফসলের আঙিনা আর মানুষের মনের ফাটলসীমা পার হয়ে উড়ে যায় অন্য কোথাও। অথচ বাতাস হলো, ধূলি উড়লো, কাক-বক উড়লো, বৃষ্টি হলো না!
পিড়ায় বসে চাউলের ধান বাছছিল পরী। আগে এই একটা একটা ধান সে ফেলে দিত। কিন্তু এখন তা করে না। প্রতিটা ধান হাতের দু’আঙুলের নোখে টিপ দিলে ভেতর থেকে চাউলটা বেরিয়ে আসে। এরপর তোষটা ফেলে দেয় সে। ধান চালের যা দাম এখন। একটা একটা ধানের এক মুঠো চাল আর তা থেকে দু’নলা ভাত সারাদিনের রাুসে ুধার কাছে সামান্য নয়। চৈত্র মাসটা এভাবেই পার করতে হবে পরীদের। শুধু তারা কেন সবাইকেই। কার ঘরে আর জমা খাবার আছে। প্রায় প্রতিদিনই কী একটা লাউ বা এক ঝুড়ি শিম বা চিলের চোখকেও ফাঁকি দিয়ে যে মাছ লুকিয়ে থাকে কম জলে তাদের ধরে এনে নিজে না পেটে দিয়ে বাজারে নিয়ে যাও আর ফেরার সময় চার আনা আট আনা প্রতি সেরে কামানোয় দর কষাকষি করে বাজারের সবচেয়ে নিয়ম কিছু চাল আর ছটাকখানেক শুঁটকি নিয়ে বাড়ি ফিরে মেপে মেপে কয়েক নলা ভাত মুখে দাও সাথে গ্লাস গ্লাস পানি, পরে অনেক খাওয়ার ভঙ্গিতে একটু ঢেকুর তুলে রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে তেল চিটচিটে বালিশে মাথা রাখÑ এই হলো জীবন।
প্রতি বছর ভাল ফলনের আশায় থেকে শেষ পর্যন্ত তাড়াতাড়ি চলে আসা পানি না হয় শিলাবৃষ্টির জন্য শতভাগ ঘরে তোলা যায় না। এবার শুরুতে ধানচারাগুলো সবল হয়ে উঠায়, পোকামাকড় কম থাকায় একটু বেশিই আশা করছিল গ্রামের মানুষেরা কিন্তু এবার আর বৃষ্টির দেখা নেই। বৃষ্টি এদের সাথে কানামাছি খেলছে যেন কদিন যাবত।
: কইলো, তোর চাল বাছা হইলো? তাড়াতাড়ি আন, পানি গরম হয়া গেছে।
চুলায় ফুঁ দিয়ে একটা কলমির ডাল ভিতরে ঠেলে আগুন নড়াচড়া করতে করতে তাগিদ দেয় মরিয়ম।
: এই তো মা আনতাছি।
পরী উঠে চালগুলো কলসের পানি দিয়ে ধুয়ে তাড়াতাড়ি মা’র কাছে নিয়ে যায়। মরিয়ম পিঠের ডান পাশটায় বাম হাতের উপরের অংশটা দিয়ে একবার ঘষা দিয়ে বলে : এইবার যে কপালে কি আছে এক আল্লামাবুদ জানে। মেঘের নামে খোঁজ নাই, ঠাডা পড়ে। দুঃখে আর বাঁচি না।
মরিয়ম চালগুলো চুলার পাতিলের গরম পানিতে আস্তে করে ছেড়ে দিয়ে একটু পর পরীকে ধমকে উঠে : এ্যাই, তুই এমুন সুবারি গাছের মত খাড়াইয়া কী দেহস? ঘরে কাম নাই? যা বাত্তি জ্বালা গে।
তাইতো! বৃষ্টি হবে বলে সন্ধ্যা একটু আগেই হয়েছে আজ অথচ বাতি জ্বালাবার কথা মনে নেই কেন তার? ইদানীং এমন হয়Ñ একের পর এক ভাবনা কোত্থেকে এসে ওকে তাঁতিয়ে তোলে। গতকালও এমন হয়েছে। কলে কলসি ডুবিয়ে কলের ডাণ্ডায় ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই, কতোণ তার মনে নেই। তবে অনেকণ। পিছন থেকে মালেকা ভাবী এসে ওকে সুরসুরি দিয়ে না সজাগ করলে হয়তো তার ধ্যান ভাঙতোই না। কী ভাবে সে? পূবের হাটিতে যে মানুষটা তার মাকে নিয়ে এ গ্রামে একটা ঘর ভাড়া করে মাস দেড়েক যাবত থাকতে শুরু করেছে তাকে নিয়ে? হিরণ তো মেয়েদের থেকেও সুন্দর। সুন্দর করে সবসময় আঁচড়ানো থাকে তার চুল। বাতাসে ওড়েও। কমলা রঙের শরীর তার। এমন সুন্দর মানুষ পরী আর দেখে নি। যতবার পরী তাকে দেখেছে ততবারই তাকে চুপচাপ কেমন যেন একা একা লেগেছে। এমন মানুষদের চেহারায় মন খারাপের ছাপ মানায় না। কিন্তু সে তো শিতি। ঢাকায় পড়েও শুনেছে। তাকে নিয়ে ভাবতে যাবে কেন পরী?
সারা জীবনে একবার সে নাইনের মুখ দেখেছিল। গ্রাম থেকে দেড় মাইল দূরের স্কুলে মা তাকে একা দিতে আর ভরসা পাচ্ছিল না। সেই থেকে শেষ। আর হিরণ ঢাকায় বড় কলেজে পড়ে। একটা ব্যাপারে মাথা ধরে না পরীর। হিরণরা নিজেদের বাড়ি রেখে এখানে এই গ্রামে ভাড়া থাকছে কেন? এ গ্রামে টাকা দিয়ে কারোর বাড়িতে থাকার ঘটনা এই প্রথম। তারা নাকি একটা সুন্দর জায়গায় থাকতে চায়। টাকা পয়সার চিন্তা নেই। এ প্রস্তাবে কামালের বাপ দৌড়ে রাজি হয়ে গেল। ছোট একটা ঘরের বিনিময়ে মাস শেষে নগদ কিছু টাকা পয়সা এ দিনে সোনার ডিমের হাঁস পাওয়াই বটে। এরা সুন্দর গ্রামেই এসেছে। তা চারদিকে এত সবুজ আর কোথায় আছে? ভোরে-সন্ধ্যায় পাখি ডাকে, মক্তবে পড়তে যায় ছোটরা, মুয়াজ্জিন আজান দেয়, মানুষেরা সাঁতরায় পুকুরে। মাসে মাসে ফলমূলওতো পাকে এ গ্রামে। গ্রামের মানুষগুলোও ভাল। সকালগুলো ভাল, বিকেলগুলো ভাল, রাতগুলো ভাল, কেবল বৃষ্টিটা এই কদিন হয়েও হচ্ছে না এই যা।
: কী হলো, হইছেডা কি তোর?
মরিয়মের কথায় ধ্যান ভাঙে পরীর। তাড়াতাড়ি চিমনিটা একটা তেনা দিয়ে মুছে চুলা থেকে একটু আগুন একটা কাগজে করে নিয়ে হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে দেয়। কদিন আগে এক বিকেলে হিরণের সাথে কথা বলতে পেরেছিল পরী। সেদিন যে তার কী ভাল লাগছিল। বোধ করি সেই কথা বলার পর থেকেই তার ভিতরে একটা উড়ালপঙ্খি উড়ে উড়ে যেতে চাচ্ছে অনেক দূর।
সেদিন কামালের মা’র থেকে বিশটা টাকা ধার আনতে পরীকে পাঠিয়েছিল মরিয়ম। পরী কেন জানি সেদিন একটু আগ্রহ নিয়ে কামালদের বাড়িতে গিয়েছিল। জন্মের পর থেকেই তো এ বাড়িতে তার যাতায়াত তবু সেদিন ছিল ওই বাড়িতে হিরণরা আসার পর তার প্রথম যাওয়া। এত সুন্দর মানুষটার সামনে যদি পড়ে যায় হঠাৎ সে চিন্তায় সে ভাল করে চুল বেঁধেছিল। শাড়ি পেঁচিয়ে বারবার দেখে নিচ্ছিল কুচিগুলি ঠিক আছে কিনা, গোড়ালির ওপর পাড় উঠে গেল কিনা। স্নো মেখেছিল মুখে। ওই বাড়িতে পা দিতেই তার মুখটা জানি কেমন হয়ে গেল। লোকটার সাথে কামাল ঘরের সামনে যে জামগাছটা আছে এর নিচে বসে ‘ষোল কটি’ খেলছে।
সে আর সামনে এগুতে পারছিল না। পারছিল না ফিরে যেতেও। কামালকে ইশারায় ডাকতে সে একটু হাসল। এরপর বলল : পরীবু আস না? ভাইয়ার সাথে কথা কও। দেখবা কেমুন সুন্দর সুন্দর কথা কয়। জীবনে শোন নাই।
পরী একটু এগিয়ে আসে।
: চাচী কই?
কামাল খেলায় মাথা ঝুঁকে বলে : আব্বার সাথে হাসপাতালে গ্যাছে।
জিভ কাটে পরী : কী হইছে চাচীর?
কামাল নির্ভাবনায় জবাব দেয় : আমি জানি না তয় সিরিয়াস কিছু না। রাইত থেইকা কইলো মাথাডা একটু ঘুরাইতাছে। হেই সকালে আব্বায় নিয়া গেল।
পরী আস্তে করে বলে : ও।
কামাল বলে : আস না? একটু খেলাডা দেইখা যাও।
পরী যেতে কেমন একটু ভয় পাচ্ছিল। আবার ফিরে যেতেও মন সায় দিচ্ছিল না।
: তোমার নাম কি পরী?
নিজের নামটা ওই মানুষটার মুখে শুনতেই তার শরীরটা কেঁপে উঠল একবার। এত সুন্দর করে তার নামটা কোনদিন কেউ বলে নি। পরী মাথা নাড়ে।
: আমি হিরণ। আচ্ছা, তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
পরীর মাথাটা এবার ডানে-বামে নড়ে। লোকটা পেয়েছে কি। তার গ্রামে সে ভয় পাবে কেন? তবু প্রতিবাদ না করে আপোসের পথে এগুল।
: শুনলাম, আপনার মাও আছে। তাইন কই?
: আম্মু ঘুমুচ্ছে।
পরী আর কথা খুঁজে পায় না। হিরণ একটা কটি চাল দিয়ে আবার বলেÑ
: তুমি কি আম্মুর সাথে দেখা করবে? করলে একটু সকালে এসো। আম্মু তো একা, একটু সঙ্গ দিয়ে যেও।
আর কেউ হলে বয়েই যাচ্ছিল পরীর। কিন্তু হিরণের মুখের কথাগুলো তার কানের ভিতর দিয়ে যেন সুরের ঝংকারের মতোন ঢুকছিল। তবু হঠাৎ কী হলো : আচ্ছা আমি যাই- বলে কেটে পড়েছিল পরী। সেই থেকে ভেতরটা বড় উত্তপ্ত। মনের ভেতরে বহুদিনের খরা। বৃষ্টি চাইতে শুরু করেছে মন।
এ গ্রামে কামাল ছাড়া আর কোন সঙ্গী জোটেনি হিরণের। কামালের এখন কাশ সিক্স। যেদিন সে স্কুলে যায় সেদিন হিরণকে একা একা দাবা অথবা ‘ষোল কটি’ খেলতে হয়। বিকেলে একা একা হাঁটে। ধানেেতর আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাতাসের সাথে ধানের পাতার সেজদা দেয়া আর সেজদা থেকে ওঠা দেখতে দেখতে মাঠের ঘ্রাণে লম্বা করে শ্বাস নিতে নিতে বিকেলটা কাটিয়ে মাগরিবের আগ আগ সে ফিরে আসে।
এ গ্রামে কারেন্ট নেই। প্রথম প্রথম খুব সমস্যা হত তার। হ্যারিকেনের আলোয় এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। দিনে প্রচণ্ড গরম। পুকুরে গোসল করতে যায় সে। মা দিতে চান না।
: বাড়িতে টিউবওয়েল আছে। ওখানেই গোসলটা সেরে নে নাÑ কী দরকার ময়লা পানিতে যাওয়ার?
হিরণ মানে না। পুকুরের জল তাকে টেনে নিয়ে যায় রোজ। গ্রামের মানুষগুলো তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। ঘাটে তার শার্ট খুলতে লজ্জা হয়। মানুষগুলোর চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল দুইই থাকে। তার ভাল লাগে না। তবু লাগে নিজেকে আলাদা ভাবতে। কেউ তার মতো নয়। সে নয় কারো মতো যেন মানুষের ভিতরে একান্ত আলাদা হয়ে বেঁচে থাকার সহজাত প্রবণতা।
প্রতিদিন গোসল শেষে লুঙ্গিটা উঠানের তারে নেড়ে দিয়ে ঘরের বারান্দায় কিছুণ খালি গায়ে বসে থাকে। মা জোর করে গায়ে গামছা চাপিয়ে যান। এই দেখে কামালের মা মুখ টিপে হাসে। এত বড় ছেলের জ্ঞান নেই! হিরণ ঘরে ঢুকে শরীরে তেল মাখে। তেল মাখার উপসর্গটা গ্রামে এসে মা জুটিয়ে দিয়েছেন। : গ্রামে থাকছিস। গ্রামের মতো হতে শিখ নাÑ
হিরণ কিছু বলে না। মা’র অবাধ্যও হয় না।
টেবিলে বসে পড়ছিল হিরণ। তার উচ্চতায় টেবিলটা নিচু। মাথা নিচে নামিয়ে পড়তে লিখতে হয়। ঘাড় ব্যথা করে। একটানা অনেকণ পড়লে মাথাটা তার এমনিতেই ব্যথা ব্যথা করে। এজন্য সে চশমা লাগিয়েছিল। তবুও সমস্যাটা যাচ্ছে না। মাথাটা কেমন জানি করে অথচ অসুস্থ হয়ে পড়ে না। চোখের সামনে সে কেবল মেয়ে মানুষ দ্যাখে। গোপন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দ্যাখে। দেখে সেই দিকে এগিয়ে যায়। কতদিন সে এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে দেয়াল কিংবা গাছের সাথে ধাক্কা খেয়েছে কিন্তু যেদিন সে ধাক্কা খায় না সেদিন? তার কিছু মনে থাকে না, হুঁশ থাকে না। পরীকে ভালোই লেগেছে। লাজুক। পরিপাটি করে পরা শাড়িতে পরীকে দারুণ লেগে ছিল। গ্রামের মেয়েরাও ফ্যাশান জানে! ওর সাথে সে একবার দেখা করবে সে জো নেই। অথচ এই দুদিন ওকে দেখতে চাইছে মন। কামালকে দিয়ে একবার খবর পাঠালে কেমন হয়? নাকি ওকে নিয়ে পরীদের বাড়ি যাওয়া যায়? না, বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। মা রাগবে। তারচে প্রথম চিন্তাটাই বেটার।
কামালকে বলতে সে এমন করে তুড়ি বাজাল যেন সবচে সহজ কাজটাই করতে বলা হয়েছে তাকে। সে চলে গেলে হিরণের ভেতর একটু ভয় লাগে। একটু দুঃশ্চিন্তাও। এ গ্রামে মানুষ কম। মাথা শ্রেণীর একজন কামালের বাপ রশিদ মেম্বার। তবু এটা তো আর ঢাকা নয় যখন চলে গেলাম যেখানে খুশি কিংবা পরী তো আর চামেলিও নয় যে তার উপর-নিচের সবগুলো পশম মুখস্থ!
চামেলিকে মনে পড়ে খুব। ওকে তো হিরণ কষ্ট দিতে চায়নি। ভালোবাসতে চেয়েছিল। চামেলি কাছে এলে ওর গা থেকে সুবাস বেরোত। কাছাকাছি বসলে বরফের মত গলে গলে যেত সে। মিশে যেতে চাইত। আঁচলে লুকোতে চাইত। চামেলি সে সুযোগ দিত না।
মেয়ে হিসেবে সে ছিল যেমন চতুর তেমন সুন্দর। কিন্তু হিরণকে যে সে ভালোবাসে। পেতেও চায়। চাওয়ার কাছে তার চতুরতার বাঁধ ভাঙত ধীরে ধীরে। আর সে খুব কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে কলিজায় কলিজা চেপে প্রতিটা গলাকাটা শ্বাসকে মাটির ঢেলা বানিয়ে ফিরে আসত। কোনওদিন সে ভাবত আর যাবে না, ও আগে বিয়ে করুক, এরপর। কিন্তু আবার মন চায়। হিরণকে না দেখে একটা সকাল কাটানো মানে ওর মনে বন্দি পাখির ছটফটানি শুরু হয়ে যাওয়া। অথচ সেই চামেলিই ভুল বুঝল!
একদিন, সেদিন কবিতা বাসায় ছিল না। তাদের ভাড়া বাসার দুটো রুমই ফাঁকা। দু’তলায় থাকত তারা। দালানটার আশেপাশে ছিল বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা আর কয়েকটা গাছ। ওর জানালা ঘেঁষে উঠে এসেছিল গাছের ডাল। চামেলি এসে ঘরে ঢুকতেই সে জানি কেমন হয়ে গেল। নিশ্চিন্তে কিছুণ বসার ইচ্ছায় নিজেই দরজাটা চাপিয়ে দেয় চামেলি। হিরণ খাটে বসে পড়ে। চামেলি কাঁধের ব্যাগটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে ওর সামনে এসে বসে। মাথা নিচু হিরণের।
: কী হয়েছে তোমার?
চামেলির প্রশ্নে কথা বলে না হিরণ।
: কী ব্যাপার। মন খারাপ? আরে বাবা, আমায় বলবে তো নাকি?
হিরণ আস্তে করে মাথাটা তোলে। চোখ দুটো কিঞ্চিত লাল আর বড় হয়ে উঠে তার। চামেলি ভয় পেয়ে বলে : কী, কোনও সমস্যা?
হিরণ দু’হাতের আঙুলে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে।
: মাথাটায় যন্ত্রণা হচ্ছেÑ
শুনে ব্যস্ত হয়ে চামেলি ওর মাথায় হাত রাখে। : ঠিক আছে তুমি শোও। আমি তোমার মাথা টিপে দিচ্ছি।
হিরণ হাঁটু মুড়ে শুয়ে পড়ে। বাঁ দিকে কাঁৎ হয়ে শোয় সে। তার কোমরের পাশে বসে চামেলি ওর স্নেহজ হাতে কপালের চামড়ায় চাপ দিচ্ছিল। কিন্তু হিরণ আর পারছিল না। জোর করে জড়িয়ে ধরে চামেলিকে।
: চামেলি, আমাকে তুমি বাঁচাওÑ
হিরণের এ আচমকা ব্যবহারে কাঁপতে থাকে চামেলি। এক ঝটকায় দাঁড়াতে গিয়েও হিরণের সবল হাতের আকর্ষণে সে ব্যর্থ হয়। চাপা চীৎকার দেয় সে।
: হিরণ, কী হচ্ছে এসব। হিরণ? প্লিজ, তুমি ওরকম করো না। পায়ে পড়ি।
হিরণকে দমানো গেল না। সারা শরীর ঘামলো তার। আর চোখ ফেটে জলের ধারা বইতে থাকলো চামেলির। উপুড় হয়ে বিছানায় শুয়ে অগোছালো কাপড়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল সে। এর মাঝেই কবিতা চলে আসায় চামেলি চরম লজ্জায় কোনমতে গায়ে কাপড় জড়িয়ে পা টেনে টেনে হাতে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেল। সিঁড়িতে আওয়াজ হলো শক্ত জুতোর। ঘরের টেবিলে পড়ে রইল কাঁধব্যাগ।
হিরণের কি যে হলো। এ শহরের একটা মানুষও কি তার মতো আছে আর?
কাউকেই সে ভালোবাসতে পারছে না কেন? কাউকে তো সে ঘৃণাও করে না। ভালো লাগা আর ঘৃণার সহাবস্থান কি ওর ভিতরে নেই? চামেলির সবকিছু তার ভালো লাগে। সে কেন বাধা দেয়? এতে তো হিরণেরই লাভ বেশি। ও আরাম পায়। অথচ ও বাধা চায় না। ও চায় রাজা হতে । এই পৃথিবীর রাজা। কামরূপের রাজা। যখন ইচ্ছে হবে নারীসমুদ্রে দু’হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতরাবে। চামেলি ওকে বুঝল না। একবার চামেলি ওকে জিজ্ঞেস করেছিল : তুমি কী হতে চাও?
হিরণ নির্বিকার জবাব দিয়েছিল : রাজা হব।
চামেলি মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে একটু হেসে বলেছিল : তা তো হয়েই আছ।
কথাটা না বোঝার ভান করেছিল হিরণ : কী রকম?
হেসেছিল চামেলি : ওমা, ওরকম একটা ভাব করছ যেন... একটু থেমে আবার সে বলে : তুমিই আমার রাজা।
: আমি কামরূপের রাজা হতে চাই।
হিরণের ধরা হাতটা দুম করে ছেড়ে দিয়ে অবাক আর ভয়ার্ত চোখে তাকিয়েছিল চামেলি : মানে?
হিরণের ঠোঁটেও হাসি এসেছিল। অসুন্দর সেই হাসি। আয়নায় এরপর যতবার সে রিহার্সেল করেছে ততবারই নিজের কাছেই কুৎসিত লেগেছে। চামেলির কাছে তো লাগবেই। ও চাইতো না হিরণ বহু নারীর রাজা হোক। কোন মেয়েই তা চাইবে নাÑ এ জ্ঞান ওর নেই। ওর কেবল মনে হয় ও একা। খুব বেশি একা। যতণ নারীতে আছে, মাংসে মাংস আছে ততণ সে রাজা। ততণ সে তৃপ্ত, ততণ সে জীবিত। সুতরাং তাকে রাজা হতে হবে। তৃপ্ত হতে হবে। বাঁচতে হবে। আর এর জন্য চাই মাংস। গরম গরম কম্পিত মাংস।
ট্রাটকি থেকে বেরিয়ে বদনাটা টিউবওয়েলের পাড়ে রেখে ঘরে যাবার মুহূর্তে জমিলা হঠাৎ আবিষ্কার করল অন্ধকারে উঠানে কেউ একজন বসে আছে। এত রাতে ওখানে বসে থাকবার কে? হিরণ নয় তো! ওতো রাতে বেরোয় না, তবে কে...
: উঠানে কেডা?
উঠান থেকে হিরণ আস্তে করে জবাব দেয় : আমি হিরণ।
জমিলা একটু এগিয়ে আসে : এত রাইতে আন্ধাইরো বইসা কী কর?
হিরণ কথা বলে না।
: খারাপ লাগতাছে?
এতণ হিরণের মাথাটা নিচু ছিল। এবার একটু উঁচু করে জমিলাকে দেখতে চাইল সে। অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা গেল না।
: গরম লাগছে।
হিরণের কণ্ঠ শুনে জমিলা আশ্বস্ত হয়। ছেলেটা কি ওকে দেখে ঘাবড়ে গেছিল? হতে পারে। বয়স কম। জোর তেইশ কি চব্বিশ। কিন্তু কবিতা বলে আরো কম। এ কথা কারোর বিশ্বাস হয় না। আরেকটু হলেই চৌকাঠে যার মাথা ঠেকবে তার কিনা তেইশ? কী সুন্দর হিরণের স্বাস্থ্য। দেখলে বয়সের দাড়ি-কমা মানতে চায় না চোরা চোখ। লোভ হয়।
: তা তোমরা শহরের মানুষ। এখানে নতুন তো তার লাগি গরমডা একটু বেশি। দেখ না বৃষ্টি নাই বহুদিন।
হিরণের মাথাটা আবার নিচের দিকে ঝোকে। : আমি একটু পানি খাব।
: তোমার ঘরো পানি নাই?
: জ্বি না। সব আম্মুর রুমে। আপনি কেবল একটা গ্লাস দিন। আমি কল থেকে নিয়ে খেতে পারব।
: থাক, কল থেকে খাওয়া লাগব না। ঘর থেকেই দিতেছি।
জমিলা ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। হিরণ উঠে পড়ে। সত্যিই কি ওর তৃষ্ণা খুব? কি জানি একটা কিছু বলতে চাইছিল। মুখ দিয়ে এসে গেছে, তার কি?
: আঙ্কেল কোথায়?
: কেইসের হাজিরা দিতে গ্যাছে।
: এত রাতে?
: আরে না। হাজিরা কাইল। মাইঝ রাইতে গাড়িত উঠা লাগে। কামালরে আজকা বললাম আমার সাথে থাকতে। থাকলো না। ওরে তুমি জাদু করছ নির্ঘাত।
এই ফাঁকে হিরণ ঘরের চারপাশটা দ্রুত দেখে নেয়। পাশাপাশি দুটো চৌকিতেই বিছানা পাতা। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় বোঝা যায় কোন বিছানা থেকে জমিলা উঠে বাইরে গেছিল। হিরণ জানে রশিদ মেম্বার আজ বাড়ি নেই। তবু প্রশ্নটা করেছিল সে।
জমিলা কলসি থেকে পানি আনতে যায়। কলসিটা বাম হাত দিয়ে বাম পায়ের ওপর কাঁৎ করে ডান হাতে একটা স্টিলের গ্লাস এর মুখের সামনে ধরে। জমিলার মাথাটা ডানদিকে একটু হেলে, আর একবার বুক থেকে আঁচলটা সরে যায়।
হিরণ দেখছিল। আর মনে হচ্ছিলÑ জমিলা চামেলি থেকেও আরও সুন্দর, মজবুত। তার মাথাটা এলোমেলো করে। জমিলা গ্লাস নিয়ে এগিয়ে আসে। কিন্তু হিরণের চোখ ঐ কলসি ধরা রমনীর আঁচলখসা বুকে। সে ওদিকেই তাকিয়ে আছে।
: নেও। পানি খাবা না?
হিরণ জেগে উঠে। জমিলা আবার বলে : ওমাÑ খারায়া খাবা? বইসা খাও।
খাটে বসতে গিয়ে ওর হাতটা কাঁপে আর গ্লাস থেকে একটু পানি পড়ে যায় নিচে। পানি খেতে খেতে তার শরীরের মাতলামোটা ফিরে আসে। হঠাৎ সে জমিলার পা দুটো জড়িয়ে ধরে। আর কান্নাস্বরে বলে : আমাকে আপনি বাঁচানÑ
এর জন্য প্রস্তুত ছিল না জমিলা। : কী করতাছ, পা ছাড়ো? কী হইছে তোমার?
হিরণ ব্যস্ত। একটু মাথা উঁচু করে এবার সে জমিলার দুটো উরু জড়িয়ে ধরে আর আগের কথাটা আবার বলে। ওর মাথাটা এখন জমিলার পেট চেপে আছে। জমিলা দু’হাত দিয়ে ওর মাথা ধরে ঝাঁকুনি দেয়। : কী হইছে তোমার, এমুন করতাছ কেরে? হিরণ আরেকটু ওপরে উঠে হাঁটুয় ভর দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে।
জমিলারও যে কী হলো হঠাৎ সেও আর কথা বলছিল না। জড়িয়ে আসছিল সব।
: তুমি তোমার ঘরে যাও। বদনাম হয়া যাবে।
হিরণ তাকে বিছানায় শোওয়াতে চায়। জমিলা বাধা দিতে গিয়েও পারে না। হিরণ কি ওর স্বামী?
তবে কেন সে বাধা দিচ্ছে না? নাকি সেও হিরণের লোভে পা দিয়ে ভুললো স্থান কাল? হিরণ দেরি করে না। দ্রুত ওর কাজটা সেরে নেয়। জমিলা বাধা দেয় আর সে রাজা হয়ে যায়। কামরূপের রাজা।
জমিলার হঠাৎ কী হল? তাকে কোথায় নিয়েছিল হিরণ? কতদিন ধরে সে উপোস? সত্যি উপোস নাকি হিরণকে কাছে পেয়ে তা মনে হয়েছে? হিরণ চলে যায়। কোমরটা হালকা চিনচিন ব্যথা করে জমিলার। এ সময় এ ব্যথা-বোধটা বড় আরামদায়ক। হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে সে। জগতের শত কোটি অদৃশ্য অজানা ঘটনাতে আজ সেও শামিল হলো। হার মেনে গেল হিরণের কাছে। চিনচিন ব্যথা করছেই। ঘুম আসছে না জমিলার। আর আসবে না আজ।
নিজের ঘরে এসে আলো জ্বালে হিরণ। হ্যারিকেনের আলোয় নিজের ঘর্মাক্ত শরীরটা একবার দেখে নেয়। খাটে গুটিশুটি মেরে ঘুমুচ্ছে কামাল। ও কোনদিন জানবে না একটু আগে জমিলার সাথে হিরণের কী হয়েছে? ও জানবে না একটা বিশ্বাসঘাতক একটু পর তার পাশে শোবে যে তার মায়ের মাংসের খলবলানি দেখে এসেছে, গ্রাস করে এসেছে। সে কি মহাপাপ করে ফেলেছে? তা কেন হবেÑ সে তো রাজাই হতে চায়। মহারাজা হতে চায়। কামরূপের রাজা। এখন একবার গোসল দিতে পারলে ভাল হতো। থাক, মা জাগতে পারে। হ্যারিকেনটা ঝিমিয়ে বিছানায় যায় হিরণ। জাগতিক কোন সুখ-দুঃখে তার বড় কোনও অভিজ্ঞতা নেই কেবল এই একটা মাত্র ব্যাপার ছাড়া। এখানে সে আলেক্সান্ডার বা হিটলার। সব চাই। নিজের মতো করে চাই। পৃথিবীর আর কিছু তাকে এভাবে টানে না। চায়ও না ও। যে জন্য রাতগুলোকে মাঝে মাঝে দিনের মতো করে কাটাতে পারলে বাঁচায় প্রাণ ফিরে পায় হিরণ।
দুপুরে এখন খুব গরম। অনেক ওপরে উঠে গেছে আকাশ আর তার গায়ে যেন স্থায়ীভাবে সেঁটে আছে নীল নীল মেঘ। ঘরের সামনে উঠান তাতে দু’একটা মুরগি গম্ভীর পায়ে এলোমেলো ছন্দে হাঁটে। তাদেরও এখন চৈত্রমাস। ঘরের চৈত্র ঘরের ুদ্র ুদ্র প্রাণীদেরও বুঝিয়ে ছাড়ে।
ঘরের সামনে চেয়ারে বসেছিল হিরণ। পরী আসছিল কামালদের ঘরের পাশ দিয়ে। জমিলা ভয়ার্ত চোখে রান্নাঘর থেকে পরীর দিকে তাকিয়ে মাথাটা আবার অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। পরী কোথায় যায়? ওকে থামানো দরকার। কিন্তু সাথে কামাল থাকায় সে কাজটা আর করা গেল না। বরং না দেখার ভান করল।
: আরে পরী, তুমি?
পরী একটু হাসার চেষ্টা করে। ওর চোখে জিজ্ঞাসা। এত সুন্দর মানুষটা তাকে ডেকে কী বলতে চায়? কেন ডাকল সে?
: এসো এসো। ঘরে এসো।
: আপনের আম্মা কই?
: ঘুমে।
: ওমা রোজই এ সময় ঘুমায়?
: বললাম না। এ ঘুমটাই তার হয়। রাতে ঘুম হয় না।
পরী একটু অবাক হয়। : কেন?
: কি জানিÑ
: মানে?
: সেটা আরেক দিন শোনো।
: উনাকে ঘুম পাড়ায়া দেন না কেন রোজ রোজ?
: আমি তো চাই কিন্তু মা চায় না। তুমি কি দেবে?
প্রশ্নটা আচমকা ছুঁড়ে দেয় হিরণ। পরী লজ্জার হাসি হাসে। : কী যে কন...
তখন কোনও রাখঢাক না রেখেই হিরণ বলে-
: তোমাকে আমার ভালো লেগেছে পরী। তুমি যদি চাও...
পরীর জবান থেমে যায়। এ লোক বলে কি! তার ভেতরটায় একটা উত্তাল স্রোত যেন বইতে চলেছে। ওকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিক মতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না পরী।
: কী বললে না যে?
পরী সলজ্জ্ব ভঙ্গিতে বলে : কী বলব?
: একটু আগে যে বললামÑ
: কী?
: আশ্চর্য! তুমি বোঝনি? আমি চাই তোমার সাথে আমার প্রতিদিন দেখা হোক, কথা হোক। আমি খুব একা পরী।
শেষের কথাগুলোয় একটু কাকুতি ছিল। আর তা পরীকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। একা! কেন? এই গ্রামে এতো এতো মানুষের কারো সাথে কি হিরণ মিশতে পারেনি? পরীকে বেছে নিল কেন সে? সে কি সত্যিই পরীকে চায়? এতে তো তার ভাগ্যই বলতে হবে। যদি সত্যি বলে হিরণ।
: কই বললে না?
এবার নিচু মাথাটা একটু উঁচু করে হিরণের দিকে এক পলক ভালো করে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে বলে : আরেকদিন বলব।
এরপর প্রতিটি কদমে বেশি করে ভর দিয়ে অথচ ভেতরে ভেতরে জীবনের প্রথম উচ্ছাসকে লালন করে করে বেরিয়ে গেল। হিরণের চোখ কয়েক পলক ওর চলে যাওয়া দেখল। এ উপলে কামালকে কিছু দিতে হবে।
রাতের এ গ্রাম খুব শান্ত। নীরব। ন’টাতেই গভীর রাত নেমে আসে। গ্রাম থেকে শহরের দিকে চলে গেছে যে সড়ক তার পথ ধরে অন্ধকারে হাঁটছে পরী আর হিরণ। পরী এদিক ওদিক মাথা ঘোরাচ্ছে বারবার। ভয় করছে তার। এই প্রথম গভীর রাতে তার বাইরে আসা তাও হিরণের সাথে। পরীর সাথে তার চাচাতো বোন ঘুমায় একজন। তাকে বলে কয়ে চুরি করে সে হিরণের কথামতো সড়কের ধারে কড়ই গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। হিরণ উপস্থিত ছিল আগেই।
: তুমি কি ভয় পাচ্ছ পরী?
: কিয়ের ভয়?
: এই যে এত রাতে তোমাকে ডাকলামÑ
: ভয় পাইলে কি আর আসতাম?
: আমি খুব খারাপ মানুষ পরীÑ পরীর একটা হাত ধরে বলে হিরণ।
: কি যে কন নাÑ
: সত্যি বলছি পরী।
: এখন আমি কী করবার পারি?
: তুমি আমাকে ভালো করে দিও।
একটু জোরে হেসে ওঠে পরী। : আপনে না মাঝে মইধ্যে পোলাপানরার মতোন কথা কন।
: সত্যি?
: তো কি?
: আমি তোমার কাছে একটা নতুন জীবন চাই পরী। তুমি কি দেবে?
ভ্র“ কুঁচকে তাকায় পরী। : এত রাইতে কি এই কথা বলবার লাগি ডাকছেন?
: তুমি একটু কাছে এসো না পরী।
পরী আসতে চায় না। : আমার শরম লাগে। বলেও থাকতে পারল না। শরীর ঘেঁষে বসে দু’জন।
: পরী তুমি যদি আমার কাছাকাছি থাক তাহলে আমি আমার জীবনটাকে পাল্টে ফেলতে পারব।
: আপনে তো বড়লোক- বলে হিরণের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দেয় পরী। তার ভয়টা কাটতে থাকে।
: কী যে বল না। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে ব্যস। এর বেশি কিছু জানার দরকার আমার নেই, তোমার?
: আমারও নাই তবু ডর লাগে।
হিরণ পরীর একটা বাহু চেপে ধরে। : কীসের ভয়?
: আপনারে যদি হারায়া ফেলি?
: না, আমি হারাব না।
: সত্যি?
: তিন সত্যি।
: আমার শরীল ছুঁইয়া কন।
হিরণ দ্বিধায় পড়ে। : কোথায় ছুঁয়ে বলব?
ছুঁয়ে বলার কথাটা বলেও যেন বিপদে পড়ে পরী এমন ভঙ্গিতে বলে : জানি না।
হিরণ দু’হাতে পরীর দুটো বাহু চেপে ধরে এবং এই প্রথম পরীর চেহারায় যেন আধো অন্ধকারেও চামেলি জমিলারা ভেসে ওঠে। হিরণের দুটো হাতই শক্ত হয়ে আছে। কী করবে সে? এই নির্জনে এতণ পর তার এমন লাগছে কেন? পরীও কি আজ আর কেউ হয়ে গেল? মাথাটায় ঝিম ধরে। রাজা হবার ইচ্ছায় শরীরটা হা হতে থাকে। পরীকে সে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে আর ওর শরীরের উঁচুতে-নিচুতে হাত চালাতে থাকে। পরী অবাক হয়। : কই কিছু কইলেন না? কী করেন?
: পরী আমাকে তুমি বাঁচাওÑ
: ছাড়েন, কি করেন?
পরী ছাড়া পায় না। সে ভয় পেতে থাকে। শরীরের প্রতিটি পেশিতে পেশিতে খিঁচুনি আসে। প্রচণ্ড সুরসুরিতে ভেতরটা হিম হয়ে আসে। হিরণ দ্রুত আরো গভীরে যেতে চায়। পরী আকুতি জানায়, গোঙায়Ñ কাজ হয় না। এই রাতে এত দূর কেউ আসবে না। পরী ভুল করল কেন এত বড়? পুরোপুরি পাল্টে যায় হিরণ। পরী আর ওকে চিনতে পারে না। হিরণ বড় হতে থাকে। অনেক বড়। পরীর কল্পনা থেকেও বড় এবং কষ্টদায়ক। হিরণ রাজা হতে থাকে আর সদ্য যুবতী পরী চাপা চীৎকারে লুটিয়ে পড়ে সড়কের ঘাসে।
ততণে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। এতদিনের কাঙ্খিত বৃষ্টি। ঝরঝর পড়ছে বৃষ্টি । বৃষ্টির জন্য পরীরা ছোটবেলায় ছেলেতে মেয়েতে কাঁদা ছোড়াছুড়ি খেলেছে। বৃষ্টি এলে ভিজেছে, নেচেছে। কিন্তু আজ বৃষ্টি তাকে ভেজাচ্ছে। বৃষ্টির জল থেকে তার চোখের জল আলাদা করা গেল না এই কাল রাতে। অশ্র“ এমনই কখনো ভেজায় আর কখনো নিজে ভেজে। পরীর আজ দুটোই হলো।
সারাটা পথ বৃষ্টিতে ভিজে এসেছে হিরণ। বৃষ্টি থামেনি। ঘরের সামনে এসে অবাক হয়। তার ঘরে আলো জ্বলছে। জ্বলছে মার ঘরেও। মার ঘরে উঁকি দিয়ে একটু ভয় পায় মাকে দেখতে না পেয়ে। ছোট্ট করে ডাক দেয় সেÑ মা, আম্মু? কোন সাড়া না পাওয়ায় ভেজা কাপড়েই ঘরে ঢোকে সে। মা নেই। বিছানায় একটা কাগজ কলম দিয়ে চাপা দেয়া। কী হলো মা’র? বিছানায় কাগজটা তুলে হ্যারিকেনের পরিষ্কার আলোয় মেলে ধরে সে।
হিরণ,
শেষ পর্যন্ত তোকে ছেড়েই আমার পালাতে হলো। যে জিনিস আমি এত বছর সংযম করে ভুলে থেকেছি কেবল তোর দিকে চেয়ে তুই সে জিনিস নিয়েই ক্রমাগত ছিনিমিনি খেলছিস। তোর দশ-এগার বছর বয়সেই আমাদের ছোট কাজের মেয়েটাকে একদিন তুই কাঁৎ করেছিলি বিছানায়। সেদিন সে আমাকে দুনিয়ার অভিশাপ দিয়ে ঘৃণায় বিদায় নিয়েছিল। এরপর আমার বাড়িতে আমার ভায়ের মেয়েকে চেপে ধরেছিস। সেদিন আমি মরে যেতে চাইছিলাম। তার আগে তোকে শেষ করে দিতে, পারিনি। পারলে অনেক আগেই তা করতাম। তবে আমি ধৈর্য ধরেছি। একদিন তুই বদলাবি। সৃষ্টির ধ্বংস করার অধিকার আমার কতটুকু? এরপর থেকে আমার বাবার বাড়ি যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। অথচ আমার ভাই মাসে মাসে টাকা দিচ্ছে, সেই টাকায় তুই আর আমি চলছি। সুখে-দুঃখে একটা স্বপ্নই দেখে গেছিÑ একদিন তুই বদলাবি। কিন্তু তুই আমার স্বপ্নকে দিন দিন বলাৎকারের পর বলাৎকার করে গেছিস। বলতে আমার আজ লজ্জা নেই। যার কাছে এ বোধটুকুও নেই তার কাছে কেন আর গোপনীয়তা? তোর জন্য এক জায়গায় কিছুটা দিনও স্থির থাকতে পারিনি। এই শহর, শহরের নানা জায়গায় বাসা বদল করতে করতে শেষমেষ গ্রামে এলাম ওই একটাই আশাতে। কিন্তু ওখানে এসে তুই একজন মা’কেও নষ্ট করতে ভয় পাসনি। তোর বুক কাঁপে নি!
আমিও একটা মানুষকে ভালবাসতাম! সে মানুষটা দেশের মহাদুর্যোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর পর আর দেখা পাইনি। কথা ছিল সে ফিরে এলে বিয়ে হবে আমাদের। হলো না। আমাদের ভালোবাসায় কোনও পাপ ছিল না, শরীর ছিল না। সে ফিরতে পারেনি। বরং আমার জীবনটা সে সময় গড়ার বদলে ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। সে কথা তুই জানিস না। জানতেও চাসনি কোনদিন। আমার শুধু একটাই আফসোসÑ তুই তো কেবল পাকিস্তানি কুকুর মেলিটারিদের বীর্যেই জন্মাস নি, আমার এই নাড়ি ছিঁড়েও তো আলোর মুখ দেখেছিস। তবে কেন তুই কেবল তাদের মতোই হবিÑ আমার মত একবারও হবি না? আর সে কথা বলব না। তুই আমাকে শেষ করে দিয়েছিস। যেমন করে আমি সেই কুকুরদের পায়ে পড়েছিলাম আজ সেভাবেই তোর পায়ে পড়ছি তবু আর কারো স্বপ্ন তুই ভেঙে গুঁড়ো করে দিস না। স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানী জালিমের বীজ আর ছড়াস নে। আর যদি তোর জ্ঞান হয় তবে অন্তত একবার নিজেকে পাল্টে ফেলিস। এই বৃষ্টিতে আমার অনুরোধটা জানি না তুই কতটুকু রাখবি। -ইতি কবিতা।
চিঠি পড়ে ভেজা শরীরও টস টস ঘামতে থাকে হিরণের। ভেতর থেকে গরম ফাঁপ বেরুচ্ছে। মা মা বলে ভেতরটা কাতরাচ্ছে। না, আর নয়। বেঁচে থাকলে পাল্টে যাওয়া হিরণ হিসেবে মাকে তার মুখ দেখাবার জো নেই আবার মরতেও চাচ্ছে না মাকে না ফিরিয়ে। তারচে বরং অন্য পথ বেছে নিতে এই মুহূর্তে সিদ্ধান্তে পৌঁছে এবং ধারে কাছে মায়ের রাখা একটা বাক্স খোঁজে হিরণ যেখানে অন্তত একটা ভোতা ব্লেড আছে।
আলোচিত ব্লগ
কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন
বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?
সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী
বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন
জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন
=বেলা যে যায় চলে=
রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।
সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন