জেলে নগরী থেকে বহু কষ্টে প্রযুক্তি মেশালো আধুনিক সিঙ্গাপুর গড়েছেন লী কুয়ান ইউ। ২৩ মার্চ ৯১ বছর বয়সে পরলোকগমণ করেন তিনি। এর তিন দিন আগে ১৯ মার্চ আমি সিঙ্গাপুর থেকে বাসে করে মালয়েশিয়ায় যাই। ৩০ সিং ডলারে লাপাম লাপাম বাসের টিকেট কাটি আগের দিন। সকাল সাড়ে ৯ টায় মোস্তফা প্লাজার পিছন থেকে বাস যাত্রা শুরু হয়।
১৪ মার্চ সিঙ্গাপুরে পা রেখে পরের দিনই স্যান্টোসা বীচে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ব্যস্ততার কারনে বন্ধু শাহীন সারওয়ার সঙ্গে যেতে পারেনি। ওই দিন কোন কাজ না থাকায় ভাগ্নী জামাই সোহাগ আমার সঙ্গী হয়। ফেরার পার্ক স্টেশন থেকে ২ টাকায় হারবার ফন্টের টিকেট কেটে চেপে বসি এমআরটিতে। মাঝে ট্রানজিট নিয়ে আরেক ট্রেনে উঠে গণÍব্যস্থলে পৌছি। রবিবার হওয়ায় ওই দিন স্যান্টোসা যাওয়ার ট্রেনে খুব ভিড় ছিল। ট্রেন থেকে নেমে ক্যাবল কারে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেই, ভাল করে চারপাশ দেখব বলে।
ধীর পায়ে চলতে চলতে চোখে পড়ে অনেক কিছু। স্যান্টোসা বীচে যাওয়ার পথে জাতীয় প্রতীক সিংহের বিশাল মুর্তি নজর কাড়ে যে কারো। কেউ ইচ্ছে করলে টিকেট কেটে এর উপড়ে উঠতে পারেন। যেখান থেকে সিঙ্গাপুরের অনেকটা দেখা যায়। এর পাশেই রয়েছে পাহাড়ের নীচে তৈরী একটি গুহা। যেখানে কৃত্রিম ঝড়নার পাশে ছবি তুলতে কেউ ভুল করে না।
এখানে একটি বিশালাকার ক্যাসিনো রয়েছে। সিঙ্গাপুরে হাতে গোণা কয়েটা ক্যাসিনোর সব ক’টির মালিক সরকার। ক্যাসিনোতে বিদেশীরা প্রবেশ করতে পারে বিনা টিকেটে। সিঙ্গাপুরিয়ানদের বেলায় সেই নিয়ম নেই। শুধুমাত্র ক্যাসিনোর বেলায়ই বিদেশীদের প্রতি সহৃদয় সরকার। আসলে তাদের চাওয়া ভিনদেশীরা এসে জুয়ায় খরচ করুক। তবে সেই চেষ্টা যে বিফল তা ভিতরের চিত্র দেখলেই বুঝা যায়।
আগেই বলেছি রবিবার হওয়ায় এদিকটায় খুব ভিড়। বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে কর্মরতরাও অনেকে বন্ধের দিনে বীচে ছুটছেন একটু গা জুড়াতে। এর মধ্যে ভিয়েতনামীদের সংখ্যা বেশী। এ দেশে ভিয়েতনামী মেয়েরা গৃহকর্মী ছাড়া বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। গৃহে কাজ করলেও শ্রম আইনের পুরো সুবিধা ভোগ করেন তারা। কোন কোন ভিয়েতনামী আবার সিঙ্গাপুরের সিটিজেন। আমি যে ফ্লাটে ঘুমাতাম সেখানে ঢাকার মিরপুরের ভাতিঝা নয়ন এর স্ত্রীও একজন ভিয়েতনামী। তার অমায়িক ব্যবহার আমার বহুকাল মনে থাকবে। বিশেষ করে তার আধো বাংলায় বলা ‘ আংকল ভাত খা-ই-ছো’।
অনেকটা পথ হেঁটে স্যান্টোসা বীচে পৌছলাম মাথায় কড়া রোদ নিয়ে। বীচের পাশে কাঠের পাটাতন করা রেস্টুরেন্টে তখন প্রাচ্যের অনেক পর্যটক ভোজন সারছে। বালিতে গা গরম করে নিতে দেখা গেল কতক স্বল্পবসনাকে। পাশেই ইন্ডিয়ানদের একটি অনুষ্ঠান হচ্ছে হৈ হুল্লোর করে। সাউন্ড বক্সে হিন্দি গানের সুরে রঙ আর জলকেলি করছে নানা বয়সী মানুষ। এখানে বলে রাখি সিঙ্গাপুরের একটা বিশাল সংখ্যাক নাগরিক ইন্ডিয়ান। এ দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রাখায় তারা শুরু থেকেই এ সুবিধা ভোগ করছে বলে শোনা যায়।
সব কিছু ছাপিয়ে সমুদ্রে তাকানোর পর মন খানিকটা হতাশ হল। স্বল্প পরিসরে একটি বীচ। জলে নেই কোন ঢেউ। এটা কেমন সমুদ্র। মনে হল এর চেয়ে ঢের ভাল আমাদের কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা। স্যান্টোসার বীচ অবশ্য আমাদের পতেঙ্গার সাথেই পেরে উঠবে না। এরপরেও সিঙ্গাপুরের এই ক্ষুদ্র বীচে প্রাচ্যের কত লোক বেড়াতে আসে। তারা নির্বিঘেœ সেখানে সময় কাটায়। জলে নেমে দেখলাম কত পরিস্কার তা। আমার অদূরেই কয়েক কপোত-কপোতী অন্তরঙ্গভাবে সমুদ্র¯œান করছে। ওদিকটায় কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বীচে নেই কোন হকার, ফটোওয়ালাদের উৎপাত তো চিন্তাই করা যায় না।
এবার বুঝলাম বিশ্বের বৃহত্তম বীচ কক্সবাজারে না এসে কেন বিদেশী পর্যটকরা স্যান্টোসার ছোট এই বীচে ভিড় করে। নিরাপত্তার বিষয়টিই যে মুখ্য তা বোধহয় আমাদের নীতি নির্ধারকরা এখনো অনুধাবন করতে পারেননি। যদি পারতেন তাহলে চট্রগ্রাম টু কক্সবাজার সড়কটি এতদিন ধরে এক লেনে থাকত না। ঢাকা থেকে কক্সবাজার রেল যোগাযোগ হত অনেক আগেই। আর সমুদ্র বীচে নীরাপত্তা জোরদারসহ ব্যবস্থাপনায় থাকত কড়াকড়ি।
কেন জানি মনে হয় আমাদের কক্সবাজার- সেন্টমার্টিন দিয়েই আমরা এই দেশকে এগিয়ে নিতে পারি অনেকটা। বিদেশী পর্যটকদের চাহিদা বুঝে সেখানে তাদের জন্য সব করার উদ্যোগ নিলে ঝাঁকে ঝাঁকে পর্যটক চলে আসবে আশা করছি। এ জন্য সরকারকে কঠোর কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। লী কুয়ান যখন সিঙ্গাপুরের দায়িত্ব নেন তখন ওই দ্বীপ রাষ্ট্রটির মানুষ এত ভদ্র ছিল না। কড়া আইনের প্রয়োগই তাদের ভদ্র হতে বাধ্য করেছে। বৃহৎ দেশ বলে হয়ত কেউ কেউ বলবে বাংলাদেশের বেলায় তা সম্ভব না। কেন নয় ? আমাদের দেশের সরকার ইচ্ছা করলে সিঙ্গাপুরের মডেল হিসেবে সেন্টামার্টিন- কক্সবাজারকে দিয়ে শুরু করতে পারে। পর্যায়ক্রমে অন্য এলাকাগুলোতে তা ছড়িয়ে দেয়া যায়। এক টুকরো স্যান্টোসা দিয়ে সমৃদ্ধ সিঙ্গাপুর হতে পারে
আগের লেখাটি পড়ুন ‘ সুন্দর সিঙ্গাপুর ’ - Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৫ সকাল ১১:৪৮