গড় আয়, জিডিপি, নিরাপত্তাসহ ইন্ডিয়া থেকে সব দিকে এগিয়ে সিঙ্গাপুর। সুখী ও ধণী দেশের তালিকায় সিঙ্গাপুরের নাম অনেক উঁচুতে। প্রাচ্যের অসংখ্য ভ্রমন পিপাসু তাই অহরহ আসেন এ দেশে। তবে সিঙ্গাপুরের ভিসা প্রক্রিয়া যতটা সহজ-ইন্ডিয়ার বেলায় তা ততটাই কঠিন।অন্তত বাংলাদেশীদের জন্য।
আগের বার দুইয়েক ভ্রমনের অভিজ্ঞতা থেকেই এবারেও সিঙ্গাপুর যাওয়ার চিন্তা করি। সাথে নতুন যোগ হয় মালয়েশিয়া। যথারীতি ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক স্টেটম্যান্ট ( আগে ভ্রমন না করলে ব্যাংক সলভেন্সী সার্টিফিকেটও লাগে ) , দুই কপি ব্লাংক প্যাড, ভিজিটিং কার্ড, নির্দিষ্ট মাপের দুই কপি ছবি নিয়ে হাজির হলাম নারায়ণগঞ্জের আল মিনা ট্রাভেল এজেন্সীতে। সার্ভিজ সার্জ বাবদ ৪ হাজার টাকা। ১০-১২ দিনের মাথায় পেয়ে গেলাম সিঙ্গাপুরের ডাবল এন্ট্রি ভিসা। পরে একইভাবে মালয়েশিয়ার ভিসাও নিলাম। এরই মধ্যে ৩৪ হাজার ৫ শ’ টাকায় ঢাকা টু চাঙ্গি এয়ারপোর্ট , কুয়ালালামপুর টু ঢাকা বিমান রিটার্ন টিকেট নিয়েছি।
১৪ মার্চ ভোরে লাগেজ গুছিয়ে ঢাকা হযরত শাহজালাল (র) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে ছুটলাম ট্যাক্সি করে। এয়ারপোর্ট পর্যন্ত আমার সঙ্গী হলেন ফতুল্লা রিপোর্টার্স ক্লাব সাধারন সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও দফতর সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ সুমন। ছোট হওয়ায় লাগেজ বুকিংয়ে না দিয়ে বোডিং পাস নিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষার পর সারলাম ইমিগ্রেশন। পৌণে ৯ টার দিকে চেপে বসলাম বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৮৪ এ। নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট পর সকাল সাড়ে ৯ টা রৌদজ্জ্বল আকাশে উড়ল বিমান। জানালার পাশে সিট পড়ায় সব কিছু স্পষ্ট চোখে পড়ছিল। এক সময় মেঘের উপর উঠল বিমান। কালো মেঘগুলো সেদিন রোদের কারনে ফর্সা ছিল। ৪ ঘন্টা আকাশে উড়া শেষে বিমান থামল সিঙ্গাপুরের চাঙ্গী এয়ারপোর্টে। ইমিগ্রেশনে মুখোমুখি হলাম এক চাইনীজ মহিলার।
টুকটাক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সহজেই ছাড় পেলাম। এরপর চলন্ত সিঁড়ি, বিনা পয়সার এলআরটি ( চালক বিহীন এক ধরনের ছোট ট্রেন) দিয়ে পৌছলাম এমআরটি স্টেশনে। তখন হঠাৎই মনে পড়ল - আমাদের দেশেও মেট্রো ট্রেন হচ্ছে। ডিজিটাল স্কীনে টাচ দিয়ে জেনে নিলাম গন্তব্যস্থল ফেরার পার্ক এর ভাড়া। দুই সিং ডলার মেশিনে পুরতেই হাতে এসে গেল টিকেট। নেই কোন টিকেট মাস্টার, কালো বাজারী। রাতভর টিকেটের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না এ দেশে। এমআরটিতে এক বাঙ্গালী ভাইয়ের সাথে পরিচয় হল। আলাপ হল দেশ নিয়ে, দেশের রাজনীতি -অর্থনীতি নিয়ে। এরই মধ্যে এক স্টেশনে থেমে অন্য ট্রেনে উঠে বসলাম। ট্রেনে প্রবীণদের জন্য নির্ধারিত কিছু আসন আছে। প্রবীণ দেখলে ওই আসন ছাড়াও নিজের সিটটিও ছেড়ে দেয় চাইনীজরা। সম্প্রতি আমাদের দেশেও ষাটোর্ধদের ফাস্ট সিটিজেন ঘোষনার কথা শুনলাম। আশা করছি এ দেশেও প্রবীণরা সব ক্ষেত্রে সম্মানিত হবেন।
এমআরটি থেকে নেমে আবারো চলন্ত সিঁড়ি বেয়ে উপড়ে উঠলাম। এখানে বলে রাখি এ দেশে এমআরটি স্টেশনগুলো পাতালে অবস্থিত। এমআরটি পথও বেশীর ভাগই মাটির তলে। চলে দূরন্ত গতিতে। চলার শব্দ শুনলে মনে হবে কাল বৈশাখী ঝড় হচ্ছে। ট্রেনের ভিতরটা একেবারে স্বচ্ছ। দুই পাশে আসন ছাড়াও মাঝে অনেক জায়গা থাকে। স্কিনে চলতি স্টেশন, পরবর্তি স্টেশনের নাম দেখা যায়। একটু পর পর তা স্পীকারে ঘোষনা দেন সুরেলা কন্ঠি। আমি গন্তব্যে এসে মোস্তফা প্লাজার সামনে এসে ১০ ডলারে একটি মোবাইল সিম নিলাম। কল দিলাম ভাগ্নী জামাই সোহাগকে।
সিঙ্গাপুরের মোস্তফা প্লাজা বাংলাদেশী ও ভারতীয়দের প্রিয় বিপনী বিতান। দিন রাত ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে এই বৃহৎ শপিং মল। এখানে মাছ -মাংস থেকে শুরু করে শিশুদের খেলনা, কসমেটিক্স, জামা কাপড় এমনকি স্বর্ণালংকারও পাওয়া যায়। ক্ষুদা লাগলে আছে খাবারের ব্যবস্থা। এর আশপাশের অনেক বাঙ্গালী দোকান, রেস্টুরেন্ট আছে। কম টাকায় থাকার জন্যও এ এলাকার সুনাম আছে। দেশ থেকে কেউ এলে এ এলাকায়ই রিসিভ করা হয় সাধারনত। সোহাগ আসার আগ পর্যন্ত আমি এংগেলা মসজিদের বিপরীত পাশে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমার সামনে দিয়ে অসংখ্য মানুষ তখন হেটে যাচ্ছে। কেউ ইন্ডিয়ান, কেউ চাইনিজ কেউবা ইউরোপ আমেরিকার। প্রাচ্যের অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখলাম। যারা হাতে ম্যাপ নিয়ে ঘুরছে এই শহরে। চোখের সামনে গাড়িগুলো সাঁ করে চলছে। এরই মধ্যে টু্যূরিস্ট গাড়ি থেকে এক ইউরোপিয়ান মহিলা হাত নাড়ল। জবাবে আমিও চুপ করে থাকলাম না।
এসব দেখার পাশাপাশি আমার ভাবনা তখন ইন্ডিয়ার ভিসা প্রক্রিয়া নিয়ে। কত সহজে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ভিসা পেলাম। অথচ ইন্ডিয়ার ভিসা নিতে কত ঝামেলা। ই- টোকেন নামক যন্ত্রনার পাশাপাশি আইডি কার্ড, বিদ্যুৎ বিলসহ ফাইলভর্তি কাগজপত্র নিয়ে দাঁড়াও। এরপর দাদাদের সব প্রশ্নের উত্তর দাও। যদি মনে ধরে তা ভিসা দিবে, নয়তো খালি হাতে ফিরিয়ে। অথচ এরই মধ্যে কত খরচ হয়ে গেছে, সেই দিকে ভ্রুঁক্ষেপ নেই দাদাদের। তাদের এইসব কান্ডে মনে হয় আমরা সবাই ইন্ডিয়া থাকার জন্য বেকুল। ভুল ভাবছেন হে প্রতিবেশী দাদা। আমরা কেন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে ওখানে যাব। আমরা কম কিসে ? আমাদের আছে গর্বিত ‘৭১ , যা অনেকের ঝুলিতে নেই। আর থাকার জন্য যেতেই যদি হয় তো ইন্ডিয়া কেন কত উন্নত দেশইতো আছে। আশা করছি অচিরেই পরিবর্তন হবে দাদাদের মানসিকতা।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৫ দুপুর ১২:২৩