আমি বরাবরই একজন সাধারন মুসলিম। দিনের একটা বিরাট অংশই নিজের পেশায় ব্যস্ত থাকতে হয়। অবসরে ইসলামী বইপুস্তক পড়ি, যতটুকু পারি ইসলামকে জানার এবং মানার চেষ্টা করি। সাথে সাথে তুলনামুলক অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কেও জানার চেষ্টা আছে। অন্ধভাবে কিছুই মানি না। ইসলাম আমার বাপদাদার ধর্ম বলেই যে মানছি তা নয়। আমি আমার নিজ বুদ্ধি বিবেচনায় ইসলামকে যৌক্তিকভাবেই মানি। ইসলাম সম্পর্কে জানি বলেই ফরজ কাজগুলোর মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখি। পীর, দরবেশ, মাজার, শবে বরাত, মিলাদুন্নবী, কবরপূঁজা ইত্যকার বিষয়গুলো এড়িয়ে চলি। এ কারনে অনেকে আমাকে অধার্মিক, নাস্তিক নামেও আখ্যায়িত করতে কসুর করেননি। আমাদের দেশে প্রচলিত কোন নফল এবাদতের সাথেই আমি জড়াইনি, যদিও সেই ছোটকাল থেকেই নফলের নানা ফজিলত শুনে এসেছি। পীর আউলিয়াদের কেরামতির কথা আমি কখনোই বিশ্বাস করিনি, এখনো করি না। আমাদের বার এসোসিয়েশন থেকে বাংলা কোরআন শরীফ দেয়া হয়েছে। আমি সেটা নিয়মিতই পড়ি। বুঝে বুঝে পড়ি। না বুঝে পড়াকে আমি কোন মূল্যায়ন করি না। আমার এক বন্ধুর (এই মুহুর্তে তার নাম বলে তাকে বিব্রত করতে চাই না) উপহার দেয়া আরজ আলী মাতব্বরের ৩টি ভলিউমই পড়েছি, মাতুব্বরের একটা যুক্তি আমার খুবই মনে ধরেছে, তাহলো, ‘যা বুঝি না, তা আমি মানি না।’ আসলেই না বুঝলে সেটা মানার তো কোন প্রশ্নই আসে না।
নাস্তিক আরজ আলী মাতব্বর থেকে আমি শিখে নিলাম, যা পড়বো, বুঝে বুঝে পড়বো। সেই হাতেখড়ি। আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু (যার নাম বলতে চাচ্ছি না) পাঁড় নাস্তিক। তার এক্স-মুসলিম পরিচয় সে প্রকাশ করতে চায় না। বেনামে ছদ্মনামে নানা ব্লগে নাস্তিকতা প্রচার করে বেড়ায়। কিন্তু সেই নাস্তিক বন্ধুই আমাকে ইসলাম শেখাতে আসে। শুরুটা শুনুন। আমি রবীন্দ্র সংগীতের একজন ভক্ত। সময় পেলেই এয়ার ফোনে রবীন্দ্র শুনি। আমার নাস্তিক বন্ধু বললো আমার গান শোনার কারনে আমার নাকি নামাজ রোজা কিছুই হবে না। আমি নাকি মুসলিম থেকে খারিজ হয়ে গেছি। এ প্রসঙ্গে একগাদা ইসলামী রেফারেন্স আমাকে শুনিয়ে ছাড়লো। তার সেইসব রেফারেন্স শুনে বুঝলাম, ইসলাম মানা তো ভারি কঠিন। খুব বিপদের কথা তো। নিজের তাগিদেই কোরআন খুলে পড়লাম। কোরআনে রয়েছে, ইসলাম খুবই সহজ একটা ধর্ম। বুঝলাম আমাদের আধশেখা মোল্লা মৌলভীরা ‘রং নাম্বার’ (পিকে ছবির)। আমার বন্ধু তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। বন্ধু বললো, আদি পুস্তকের নবির জীবনী পড়লে কেউই নবিকে আর মানবে না। তাতে নবির চরিত্র খোলাসা হয়ে পড়েছে। সে নিজে পড়ে দেখেছে। নবির যে ছবি আমরা বাল্যকাল থেকে দেখে এসেছি, সীরাতে নাকি তার পুরা বিপরীত চিত্র রয়েছে। সে আমাকে মুফাস্সিল ইসলাম, মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ, মহিউদ্দিন, আরিফুর রহমান, আসাদ নুর সহ নামজাদা নাস্তিকদের ভিডিও দেখালো। ব্যস আর যায় কোথায়, আমিও সংগ্রহ করে ফেললাম ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম, আল-ওয়াকেদি, ইবনে সাদ, জারির আল তাবারির লেখা বেশ কিছু আদি গ্রন্থ। মার্টিন লিংগস এবং ক্যারন আর্মষ্ট্রং-ও বাদ গেলো না। যতটুকু পারা যায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম। আর তাতে আমি নতুন কিছু আবিস্কার করতে না পারলেও একটা জিনিস বুঝলাম, তা হলো, আইনজীবীরা যে টেকনিকে অপর পক্ষকে ঘায়েল করেন সেই একই টেকনিক ব্যবহার করছেন নাস্তিক ভাইয়েরা। বাদীপক্ষের আর্জির নানা ভুলভ্রান্তি তুলে ধরে বাদীপক্ষকে ঘায়েল করার রীতিটা খুবই কার্যকরী। এতে ভাল কাজ হয়। এখানেও লক্ষ্য করলাম, মুসলমানদের সীরাতগ্রন্থ, হাদীসগ্রন্থ আর কোরআন থেকে নানা ভুলভ্রান্তি তুলে এনে মুসলমানদের ঘায়েল করা হচ্ছে। ধরুন, কোরআনের একটা আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা কাফিরদের গর্দানে আঘাত করো।’ এই আয়াত দ্বারা কোরআনে বর্বরতা আছে মর্মে নানাভাবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে রং রস দিয়ে বর্ণনা করা হচ্ছে। আমার পেশাগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই ধাঁচের আক্রমণ খুবই ফলপ্রসু। অপরপক্ষের কিছু বলারই থাকে না। নাস্তিক ভাইয়েরা এই কৌশল বেশ ভালভাবেই কাজে লাগাচ্ছেন। তোমার হাদীস দিয়ে তোমাকে কুপোকাত। এই কৌশলটা তারা রপ্ত করেছেন ফেইথ ফ্রিডম, ইসলাম-ওয়াচ ব্লগ সাইটগুলোর অনুকরনে। এদেশে ধর্মকারী, ইষ্টিশন ব্লগ গুলোতে এই ধাঁচের লেখা প্রকাশ করা হয়। আর উপরে উল্লেখিত নাস্তিক ভাইয়েরা তাদের ভিডিওগুলোও একই অনুকরনে তৈরী করেছেন। তবে প্রত্যেকেই ‘নতুন কিছু করি’ ষ্টাইলে নতুনত্ব দেবার চেষ্টার কসুর করেননি। যেমন নব্য নাস্তিক মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ তার প্রথম ভিডিওতে নতুন একটা বিষয় সামনে এনেছেন। তা হলো, উরাইনা বংশের উপর নবির অমানবিক অত্যাচার প্রসঙ্গ। এ বিষয়টা এতোকাল কেউ উত্থাপন করেননি। কাজেই এটার প্যাটেন্ট কেবলমাত্র তারই। মুফতি বলে কথা! নাস্তিক জগতে এসেই তিনি খুব ঝড় তুললেন। মার মার কাট কাট। কিন্তু কদিন যেতে না যেতেই যেই সিনেমা, সেই বাইস্কোপ। একই জিনিস ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার, অবিরত। শেষমেশ জীবনান্দ দাসের কবিতার তফসির করলেন। বুঝালেন কোন একটা বিষয় নিয়ে যা তা তফসির বা ব্যাখ্যা করা যায়। এটা যে তার নিজের বিরুদ্ধেই গেলো, মুফতি সাহেবের সেটুকু বোঝার ক্ষমতা আছে বলে মনে হয়নি। নিজেকে তিনি নাস্তিকদের নবি পর্যায়ে তোলার আশায় এসে দেখলেন, এখানে অনেক বড় বড় কুতুব অনেক আগে থেকেই ফ্লপ মেরে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন।
যাক, আমার আলোচ্য বিষয়ে ফিরে আসি।
আমার নাস্তিক বন্ধুটি অনেক রাত অবধি পড়াশুনা করে। মজার ব্যাপার হলো, তার লাইব্রেরী নানা ইসলামী বইয়ে ঠাঁসা। কোরআন, বুখারী, মুসলিম, তিরমিজ থেকে শুরু করে ইসলামের ইতিহাসের আদি গ্রন্থ, সীরাতগ্রন্থ, সব কিছুই আছে। অনেক নামজাদা রাইটারের লেখা মহানবির জীবনীর কালেকশান তার আছে। তার বিশেষ একটা নোট খাতাও আছে, যাতে সে তার লেখার উপাদান লিখে রাখে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস কোন ইসলামী স্কলারও এতো পড়াশুনা বা গবেষনায় মেতে নেই। বন্ধুটি মহানবির জীবনী থেকে মহানবির নানা খুত খুঁজে খুঁজে বের করে আনে আর তা ব্লগে প্রকাশ করে। আফসোস সে এতো এতো ইসলামী বই থেকে ভাল কিছুই খুঁজে পায়নি। তার কাছে সবই বর্বরতা, নৃশংসতা, লুটতরাজ, শিশু-কামিতা, আর ধর্ষনের কাহিনী বলেই নাকি মনে হয়। দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য মানুষকে কোথায় নিয়ে পৌঁছে দেয় একবার খেয়াল করুন। মহানবির সাথে মা আয়শার বিয়েতে সে শিশুকামিতা দেখে, জিহাদ-এর মধ্যে সে খুঁজে পায় বর্বরতা, গনিমতের মালের মধ্যে পায় লুটতোরাজ, সে কালের দাস-দাসী প্রথা আর জিজিয়া করের মধ্যে সে খুঁজে পায় নৃশংসতা আর অমানবিকতা। তার এতো জ্ঞানের বহর যে তাকে বুঝাবার মতো কোন সামর্থ্য আমার আছে বলে অন্ততঃ সে মনে করে না। বরং তার কাছ থেকেই নাস্তিকতা শিখতে থাকি। নাস্তিক বন্ধুটি মনে করে, আমি পৈত্রিকসুত্রে যে ধর্ম পেয়েছি সেটা অন্ধভাবেই মেনে আসছি, কোন রকম প্রশ্ন করার জো এই ধর্মে নেই। যুক্তি মেনে মানবিকতার (তার ভাষায়) ধর্মে ফিরে আসার লক্ষ্যে সে আমার পিছনে লেগে থাকলো। কোরআনের যে সব অসামঞ্জস্য সে আমাকে বুঝিয়েছে, তার উত্তর আমি পেয়ে গেলাম ডঃ জাকির নায়েকের লেখা থেকে এবং ড. মরিস বুকাইলির বই থেকে। আমার ভ্রান্তি কেটে গেলো। আমার এই ভ্রান্তি কেটে যাবার পর আমি কলম ধরি নাস্তিকদের মিথ্যা ধারনা অপনোদনে। টৃডে ব্লগ এবং সামহোয়ারইন ব্লগে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, আমার বন্ধুটি খেপে উঠেনি, বরং বিজ্ঞানের কচকচানি বন্ধ করে আমাকে কোরআন-হাদিস থেকে ইসলামের অসারড়তা প্রমান করে যেতে থাকে। এরি মধ্যে এক মুফতি যিনি কিনা ১০ বৎসর একটা মসজিদের ইমামতি করেছেন, কোরআনের হাফেজ, মাদ্রাসার মোহতারাম এবং হজ্বও করেছেন, হঠাৎ করে ইসলাম ত্যাগ করার ঘোষনা দেন এবং একের পর এক ভিডিও বানিয়ে চমক সৃষ্টি করেন। যার কথা আগেই বলেছি। হ্যা, সেই মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ। তিনিও সেই একই পদ্ধতির প্রয়োগে ইসলামকে একটি অসহনীয় বাজে ধর্ম বলে আখ্যা দিতে থাকেন। এবার তাদেরকে একটু সিরিয়াস নিয়ে আমিও সমানতালে তাদের মিথ্যা ও অসাড় বক্তব্যের জবাব দিয়ে ভিডিও বানাতে শুরু করলাম, যদিও ভিডিও বানাবার মতো সেরকম ভাল জ্ঞান আমার নেই, তবুও চেষ্টা চলতে থাকলো। ইতিমধ্যে ইসলাম বিষয়ে প্রচুর পড়ে ফেলেছি আমি। নাস্তিক বন্ধুটি আমার পেছনে লেগে না থাকলে ইসলামের অনেক কিছুই আমার জানা হতো না। সামহোয়ারইন ব্লগে আমার প্রকাশিত লেখাগুলো পড়লে আপনারা তার কিছুটা আভাষ পাবেন।
নাস্তিকেরা মুসলমানদের গ্রন্থ থেকে উদ্বৃতি দিয়ে ইসলামকে হেয় করার অপচেষ্টায় মেতেছেন, সেটা আগেই বলেছি। মুরতাদ সালমান রুশদীও কিন্তু ইসলামের স্কলার আল-ওয়াকেদি ও ইবনে জারির তাবারির সীরাতগ্রন্থের উদৃতি দিয়ে স্যাটানিক ভার্সেস লিখেছিলেন। বুঝুন ঠেলা। এটা ঠিক যে, কোন একটা বিষয়কে পজিটিভ এবং নেগেটিভ দুভাবেই নেয়া যায়। এ সংক্রান্তে মুফতি মনোয়ার হোসেন একটি ভাল উদাহরন দিয়েছেন। বন্ধুবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষন ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের মুলমন্ত্র। এ ভাষনের প্রেক্ষাপট যদি কেউ না জানেন বা প্রেক্ষাপটটি যদি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেন তাহলে এ ভাষনেও অনেক বর্বরতা খুঁজে পাবেন। যেমন ‘আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো, কিম্বা ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ আজ থেকে ১০০ বৎসর পর কোন স্বাধীনতা বিরোধী মানসিকতার লোক যদি বঙ্গবন্ধুর জীবনী লিখেন, তাহলে তিনি তার মত করেই সেটা লিখবেন। আর স্বাধীনতার ৪০ বৎসর পেরুতে না পেরুতে কত রাজাকারই তো মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেলেন আর কত মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার হয়ে গেলেন, সে হিসাবটা করে দেখুন।
কুরআনের অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা নিয়েও আছে নানামত। একই জিনিসকে আপনি দুভাবে বুঝতে পারেন। ধরুন, কোন পন্যে লেখা বয়েছে, ‘সুগার ফ্রি’। এতে কেউ বুঝলো এতে সুগার ফ্রি দেয়া হয়েছে আবার কেউ বুঝলো এতে কোন সুগার নেই। কিম্বা সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে আসা বলতে কেউ বুঝলো, গুনে গুনে ৭টা সমুদ্র এবং ১৩টা নদীর দুরত্ব, কেউ বুঝলো অনেক দুর বুঝাতেই কেবল সেটা বলা হয়েছে। ৭টা সমুদ্রও নয়, ১৩টা নদীও নয়। আবার ধরুন আপনার চাকর ছেলেটা চা আনার সময় কাপটা ফেলে ভেঙ্গে ফেললো। আপনি বললেন, ‘খুব ভালো করেছো।’ তাৎক্ষনিক যারা ব্যাপারটা দেখেছে, তারা বুঝেছে, আপনার এই খুব ভালোর অর্থ কিন্তু ‘খুব খারাপ।’ কিন্তু শত বছর পর আপনার ইতিহাস লিখতে বসে কেউ যদি বলেন কাপ ভাঙ্গা-কে হুজুর খুব পছন্দ করতেন। তাই কাপ ভাঙতে দেখে তিনি বলেছিলেন, খুব ভালো করেছো।’ বুঝুন ঠেলা।
একই জিনিস থেকে দুরকম অর্থ বের করা অসম্ভব নয়। কোরআনের অর্থ নিয়েই একেকজনের একেক রকমের ব্যাখ্যার কারনে নানা দল উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। এরজন্যে মূলতঃ কথিত ইসলামী ব্যাখ্যাকারকরাই দায়ী আর দায়ী মুসলিম নামের দলদাসরা, যারা ইসলামের নয়, দলের পূঁজারী। শিয়া, সুন্নি, সালাফী, ওহাবী, আহলে সুন্নত-ওয়াল জামাত, আহলে হাদীস আরো কত কি। অথচ আল্লাহপাক বলেন, আর কে বেশী উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর পথে আহবান করে এবং আল্রাহর নির্দেশ মেনে চলে এবং বলে, আমি 'মুসলিম' [আল কোরআন, ৪১: ৩৩] সুরা আল ইমরানে বলা হয়েছে, তাহলে বলে দিন (ওদেরকে) তোমরা সাক্ষী থাকো একথার যে আমরা সর্বান্তকরনে আল্লাহতে আত্মসমর্পনকারী 'মুসলিম' [৩: ৬৪] কোরআনে বিশ্বাস থাকলে মুসলিম ছাড়া অন্য কোন পরিচয় কি গ্রহনযোগ্য? কিন্তু দলদাসদের সেটা কে বুঝাবে?
আমার নাস্তিক বন্ধুর কল্যাণে আমাকে অনেক পড়াশুনা করতে হলো। নাস্তিকদের প্রচারিত প্রায় ভিডিওই আমি দেখেছি। তাদের মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করেছি। ইসলামের বিকৃত বর্তমান রূপ দেখে তারা ইসলামকে বিবেচনা করেন। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ ধর্ম হলো ইসলাম।
আমি তোমার উপর কুরআন এ জন্য নাযিল করিনি যে তুমি দু:খ-কষ্ট ভোগ করবে। (সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১-২)
আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ্ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না...”[সূরা বাকারাহ্; ০২:১৮৫]
আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না। (সূরা আল মায়েদা, আয়াত ৬)
“তিনি (আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন) দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি’ ”[সূরা হজ্ব; ২২:৭৮]
‘আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাজিল করেছি; সেটি এমন যে, প্রত্যেক বস্তুর সত্য ও সুস্পষ্ট বর্ণনা; হেদায়াত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ (সূরা নাহল, আয়াত ৮৯)।
আল্লাহতালা সহজ করে দিলেও, গোমরাহীতে লিপ্ত লোকেরা কঠোরতার পথ বেছে নিয়েছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘একদল লোককে তিনি সঠিক পথ দেখিয়েছেন, আর দ্বিতীয় দলটির উপর গোমরাহী ও বিদ্রোহ ভালোভাবেই চেপে বসেছে; এরাই (পরবর্তী পর্যায়ে) আল্লাহ তালাকে বাদ দিয়ে শয়তানদের নিজেদের অভিভাবক বানিয়ে নিয়েছে, (এ সত্বেও) তারা নিজেদের হেদায়াতপ্রাপ্ত মনে করে। (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩০)
জীবনকে শরীয়ত সম্মতভাবে উপভোগ করার জন্যে আল্লাহপাক বরং তাগিদ দিয়েছেন, একই সুরার পরবর্তী আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, হে আদম সন্তানেরা, তোমরা প্রতিটি এবাদতের সময়ই তোমাদের সৌন্দর্য গ্রহন করো, তোমরা খাও এবং পান করো, তবে কোন অবস্থাতেই অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩১)
‘(হে নবী)তুমি বলো, আল্লাহতালার (দেয়া) সেসব সৌন্দর্য এবং পবিত্র খাবার তোমাদের জন্যে কে হারাম করেছে? যেগুলোকে তোমাদের জন্যে আল্লাহতালা স্বয়ং উদ্ভাবন করেছেন ; তুমি বলো এগুলো হচ্ছে যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্যে পার্থিব পাওনা, (অবশ্য) কেয়ামতের দিনও এগুলো ঈমানদারদের জন্যেই (নির্দ্দিষ্ট থাকবে); এভাবেই আমি জ্ঞানী সমাজের জন্যে আমার আয়াতসমুহ খুলে খুলে বর্ণনা করি।’ (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩২)
কিন্তু হাদীসের নামে, তফসিরের নামে ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে কতিপয় অজ্ঞ লোকজন কেবল যে কঠিন করেছে তা-ই নয়, নিজেদের মন মানসিকতা অনুযায়ী নানা বাধাঁ নিষেধের খড়গ চাপিয়ে মানুষের জীবনকেও জাহান্নামে পরিণত করে ছেড়েছেন। তারা তাদের নিজেদের ভাবনা, সংস্কার আর মনমানসিকতা দিয়ে ইসলামকে বিচার করেছেন এবং সেটাই মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। সদ্য নাস্তিক মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদকে তাই বলতে শুনি, ‘ইসলাম ছেড়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি। এখন পৃথিবীর মুক্ত বাতাস গ্রহন করতে পারছি, পারছি জীবনকে উপভোগ করতে। নানা বাধানিষেধের যাতাকলে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।’ মাসুদ সাহেব একটা ভিডিওতে গান শুনতে শুনতে বলছেন, এতোকাল কোন গান শুনতে পারিনি। ইসলামে মানা আছে। তার এই বক্তব্য শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম এমন লোক মুফতি হলেন কি করে? ইসলাম সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানটা তো অন্ততঃ থাকতে হয়। পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেবের মত গান-বাজনা কিভাবে হারাম তার একটা বর্ণনাও তিনি দিলেন। অথচ কোরআন, সহি হাদিস বা আদি সীরাতগ্রন্থের পর্যালোচনায় গান বাজনা হারাম, এমন একটি উক্তিও দেখতে পাইনি। বরং এর পক্ষেই পেয়েছি। কট্টরপন্থীরা গান-বাজনার বিপক্ষে কোরআনের যে আয়াতটা শত শত বৎসর ধরে ব্যবহার করে আসছেন, তাহলো,
“এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে(আল্লাহর পথ) নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে। এদের জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি”। [সূরা লোকমান, ৩১:৬]
এ আয়াতকে চরম ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে গান আর অবান্তর কথাবার্তাকে কথিত তফসিরকারকরা সমার্থক করে ফেলেছেন। আদি ইতিহাস লেখক আল-ওয়াকেদী তাদের মধ্যে অন্যতম। ইবনে মাসউদের বরাত দিয়েও বলা হয়, তিনি নাকি বলেছেন, ‘অবান্তর কথাবার্তা’ হল ‘গান’। অবান্তর কথাবার্তা কি কেবল গান বাজনাতে থাকে? বই পুস্তক, গল্প উপন্যাস, কবিতা, দৈনন্দিন কথাবার্তা ইত্যাদিতে থাকে না? কোরআনকে বাদ দিয়ে কে কি বলেছেন তা নিয়ে যারা বেশী গবেষনায় মেতে থাকেন, তারাই এ ধরনের মূর্খতা দিয়ে জীবন ব্যবস্থাকে কঠিন করে তুলেছেন। মহানবির জীবনীর প্রথম লেখক ইবনে ইসহাককে আস্তিক নাস্তিক সকলেই মানেন। মহানবির মৃত্যুর মাত্র ১০০ বৎসরে মধ্যে লিখিত বলে তাকে সহিশুদ্ধ মানেন। যা হাদীস গ্রন্থনারও অনেক আগে রচিত হয়েছে। যদিও ঐ সময়কালে ১০০ বৎসর পরে শুনে শুনে সহিশুদ্ধভাবে জীবনী লেখাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করা যায় না। তবুও আদি সীরাত বলে কথা। এবার তার গ্রন্থ থেকেই শুনুন।
খাইবার অভিযানের সময় রাসুল বলেন, ‘নামো তো একটু ইবনুল আকওয়া, তোমার সেই উটের গানটা গাও তো শুনি।’ ইবনুল আকওয়া উট থেকে নেমে গান গাইল। রাসুল (স) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে রহমত করুন।’ [ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলুল্লাহ(স), শহীদ আখন্দ অনুদিত ও ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশিত গ্রন্থের ৫৫১ পৃষ্ঠা]
আর দফ বাজানোর কথা তো সহি হাদিসগ্রন্থেই আছে। কোরআন-হাদিসের কোথাও গান বাজনা নিষেধ না থাকলেও, অজ্ঞ তফসিরকারেরা একে অপরকে অনুসরন করে গেছেন অনাদি কাল ধরে। সাদাচোখেও অনেক সময় ইসলামকে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। প্রসঙ্গক্রমে খারিজিদের কথা একটু না বললেই নয়। এই খারেজীরা পুরুষদের মধ্যে পৃথিবীর প্রথম মুসলমান, মহানবির নিকটাত্মীয়, মহানবির সর্বক্ষণের সঙ্গী, খোলাফায়ে রাশেদীনের অন্তভূর্ক্ত এবং বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী হযরত আলীকে কাফির ফতোয়া দিয়ে হত্যা করেছিলেন। আমরা খারিজীদের সম্পর্কে মানসপটে যে ছবি আঁকি তারা আসলে সেরকম ছিলেন না। তারা ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক, নিষ্ঠাবান এবং আবেগপ্রবন। সারারাত তাহাজ্জুদ আদায়, সারাদিন জিকির ও কুরআন পাঠে অভ্যস্ত হওয়ায় তাদেরকে 'কুররা' বা কুরআন পাঠকারি বলা হত। ধার্মিকতায় তারা ছিলেন সর্বোচ্চে। তারা সব ফয়সালা কোরআন থেকেই করতেন। তবে নিজে যা বোঝেন, সেভাবেই। তাদের মতে মুয়াবিয়া ছিলেন সীমালংঘনকারী, আর সীমালঙ্ঘনকারি মুয়াবিয়া আত্মসম্পর্ন না করা পর্যন্ত তারা হযরত আলীকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বললেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা কোরআন উচিয়ে ধরায় আলী আপোষ ফয়সালা করতে রাজি হন, যা খারিজীরা মেনে নিতে পারেননি। খারিজীদের দাবি ছিল 'একমাত্র কুরআনের আইন ও আল্লাহর হুকুম ছাড়া কিছুই চলবে না।' আল্লাহর আদেশ হল অবাধ্যদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে যতক্ষণ ফিতনা শেষ না হয়। সুতরাং সুরা হুজুরাতের ৯ নং আয়াত অনুযায়ী যুদ্ধ চালিয়ে যেতে তারা আলীকে বাধ্য করতে চাইলেন। আলী হিকমতের আশ্রয় নিয়ে মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়ায় খারিজীরা 'আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তা অনুযায়ী যারা বিধান দেয় না তারা কাফির' আয়াতের আলোকে আলী এবং মুয়াবিয়া উভয়কেই কাফির ফতোয়া দিয়ে হত্যার চেষ্টা চালালে ইসলামের সর্বশ্রেষ্ট সিপাহসালার হযরত আলী নির্মম হত্যার শিকার হন। খারেজী আব্দুর রহমান ইবনু মুলজিম ৪০ হিজরিতে বিষাক্ত তরবারি দ্বারা আলীকে আঘাত করে হত্যার পর উত্তেজিত সৈন্যরা যখন ইবনু মুলজিমের হাত কর্তন করেন তখন তিনি মোটেও কষ্ট বা আফসোস প্রকাশ করেননি বরং আনন্দ প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু সৈন্যরা যখন তার জিহ্বা কর্তন করতে উদ্যত হলেন, তখন মুলজিম অত্যন্ত আপত্তি ও বেদনা প্রকাশ করে বললেন, 'আমি চাই যে, আল্লাহর জিকির করতে করতে আমি শহীদ হব!' তার কিছুদিন পর এক খারেজী কবি ইবনু হিত্তান লিখেন, 'কত মহান ছিলেন সেই নেককার মুত্তাকী মানুষটি যিনি ‘মহান আঘাতটি’ করেছিলেন। তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছুই তিনি চাননি। আমি প্রায়ই তাকে স্মরণ করি এবং মনে করি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি সওয়াবের অধিকারী মানুষ তিনিই' (অর্থাৎ আলীর হত্যাকারী!)। খারিজীরা অমুসলিম ছিলেন না, মূর্খও ছিলেন না, ছিলেন ধর্মান্ধ, চরমপন্থী। খারেজীরা ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষ যারা মহানবির ইন্তেকালের পর ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত আলী (রা) ও অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবীরা খারেজীদের নিষ্ঠা ও ধার্মিকতার জন্য তাদের প্রতি অত্যন্ত দরদ অনুভব করতেন। উগ্রতার পথ থেকে ফিরিয়ে নিতে তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন। খারেজীরা কোরআনকে যেভাবে বুঝেছেন, সেভাবেই ব্যাখ্যা করেন। অন্যের কোনকিছুই মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। খারিজী সম্পর্কে হযরত আলীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, 'এরা কি কাফির?' তিনি বলেন, 'এরা তো কুফরি থেকে বাচার জন্যই পালিয়ে বেড়াচ্ছে।' প্রশ্ন করা হয়, 'এরা কি মুনাফিক?' তিনি বলেন, 'মুনাফিকরা খুব কমই আল্লাহর জিকির করে। আর এরা তো দিনরাত আল্লাহর জিকির করছে।' জিজ্ঞাসা করা হয়, 'তাহলে এরা কি?' আলী বলেন, 'এরা বিভ্রান্তি ও ‘নিজ-মত’ পূঁজার ফিতনায় লিপ্ত হয়ে অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছে!' খারিজীরা কোরআন-হাদীস অক্ষরে অক্ষরে মানতেন। এসব পালনে তারা চরমপন্থা অবলম্বন করতেন। কোরআন নির্দেশিত মধ্যপন্থাকে তারা চরমপন্থার কারণে ভুলে গিয়েছিলেন। কোরআনের আয়াতের আলোকেই তারা আলী এবং মুয়াবিয়া উভয়কে ‘কাফির’ বানিয়ে ফেলেছিলেন। কোরআনের অন্য আয়াতের ধার ধারেননি। আলীর মতে তারা নিজে যা বুঝেছে তাতেই অটল ছিলেন। খারেজীরা হিকমত, আল্লাহ প্রদত্ত বুদ্ধি বিবেচনার ধার ধারতেন না। আলী এবং মুয়াবিয়া উভয়ই উচ্চমাপের সাহাবি। তাদের দ্ন্দ্ব থেকেও মুসলমানদের মধ্যপন্থা শেখার মত উপাদান রয়েছে। সাহাবিরা ফেরেস্তা ছিলেন না। ছিলেন রক্ত মাংসের মানুষই। স্বাভাবিক কারনেই দন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে এবং ইসলামের আলোকে তারা নিজ নিজ ভিত্তির উপর দাড়িয়ে ছিলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাটা এখানে বলার কারন হলো, কোরআন-হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা মানুষকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তা স্মরন করিয়ে দেয়া।
তাই বলে কেউ ভেবে নেবেন না যে আমি ‘কোরআন অনলি’ বা আহলে কোরআন জাতীয় মানুষ। আমি আহলে কোরআন বা আহলে হাদিস কোনটাই নই। আমি কেবলই ‘মুসলিম’। কোরআন আমাকে সে পরিচয়ই দিতে বলে। আমি হাদিস মানি ততটুকু, যা কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কোরআনের সাথে সাংঘর্ষিক হলেই তা বাদ, হোক সেটা বুখারী বা মুসলিম। অমুক তমুকের থেকে, সেই তমুক আরেক তমুকের থেকে শুনেছেন মর্মে মহানবির নামে চালিয়ে দিলেই তাতে আমল করতে আমি বাধ্য নেই। রাজনৈতিক কারনে অনেক জাল হাদিসের জন্ম হয়েছে। সিহাসিত্তাতে আবু হুরাইরার প্রাধান্য মূলতঃ রাজনৈতিক কারনে, তিনি অর্থ আত্মসাতের দায়ে খলিফা ওমর কর্তৃক বহিস্কৃত হলেও আলী বিরোধী মনোভাবের জন্যে মুয়াবিয়ার আস্থাভাজন ছিলেন এবং রাজতন্ত্রের একজন বড় সমর্থক ছিলেন। আর রাজতন্ত্রের ছায়াতলেই সূদীর্ঘ সময় পর হাদিস রচনার কাজ হয়েছে। এই একই কারনে সিহাসিত্তাতে হযরত আলী, ফাতেমা, হাসান, হুসাইনকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
নাস্তিকেরা ইসলাম নিয়ে চরম গবেষনায় মত্ত। উদ্দেশ্য একটাই, খুজে খুজে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আয়াত বের করে তার ভুল ব্যাখ্যা পেশ করে ইসলামকে দুনিয়ার বুক থেকে বিতারিত করা। নিদেনপক্ষে ইসলামী ইমেজকে ভোঁতা করে দেয়া। আমার নাস্তিক বন্ধুর অনুরোধে বাংলার প্রায় সব নাস্তিকের লেখা পড়েছি এবং ভিডিও দেখেছি। মোট ৪টা যুক্তি বা পদ্ধতিতে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচারনা চালানো হয়। তা হলো-
১। এ মহাবিশ্বের উৎপত্তি হয়েছে পদার্থ বিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়মে, এত স্রষ্টার কোন হাত নেই। বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়েছে, বিগব্যাং-এর আগে কোন স্থান বা সময় বলে কিছু ছিল না। কাজেই সৃষ্টিকর্তা থাকাও সম্ভব নয়।
২। প্রানীজগতের সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়ে এককোষী এমিবা সৃষ্টির পর তা থেকে কোটি কোটি বৎসরের নানা এলোমেলো বিবর্তনের মাধ্যমে। যে বিবর্তন এখনো চলছে। কাজেই এতেও সৃষ্টিকর্তার কোন হাত নেই।
৩। সৃষ্টিকর্তার গ্রন্থ নানা অসংগতি, ভুল ও অবৈজ্ঞানিক তথ্যে ভরপুর। কাজেই সৃষ্টিকর্তার ধারনা মানুষের সৃষ্টি। ধর্ম মিথ্যা, ধর্মের কোন প্রয়োজন নেই। সৃষ্টিকর্তা মানুষ সৃষ্টি করেননি, বরং মানুষই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি করেছে মনের ভয় থেকে।
৪। কোরআন-হাদিস এবং সীরাতগ্রন্থের আলোকে মহানবিকে একজন বর্বর, নারীলোভী, প্রতারক, জুলুমকারী, মানসিকরোগী, শিশুকামী, যুদ্ধবাজ, লুটেরা এবং ধর্ষক প্রমাণ করে প্রতিনিয়ত মহানবির চরিত্র হনন করা।
প্রথম ৩টা ইতিমধ্যে ফ্লপ মেরেছে। আধুনিক কালের ইসলামী স্কলাররা তাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। যারা সেসবের খবর রাখেননি, সেই পুরানো ক্যাচক্যাচানি এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। রইল বাকি এক।
এবার সব নাস্তিকই এই একটা পয়েন্টে মনোনিবেশ করেছেন। তাহলো, যেভাবেই হোক মহানবিকে যুদ্ধবাজ, ধর্ষক, শিশুকামী, নারীলোভী, মানসিকরোগী প্রমাণ করা। ইরানের নাস্তিক আলী দস্তি তার নিজের মত করে মহানবিকে বর্বর আর মানসিক রোগী প্রমাণ করার জন্যে ‘নবি জীবনের ২৩ বছর’ নামে বইটি লিখেছিলেন। সে বইকে অনুকরন করে অনেক কিছুই লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। আমাদের দেশের নাস্তিক্যবাদ প্রচারকারী ধর্মকারী এবং ইষ্টিশন ব্লগে উক্ত বইটির বাংলা অনুবাদ ই-বুক আকারে দেয়া হয়েছে। ইশ্টিশন ব্লগ থেকে আবার নবির জীবনী প্রচার করা হচ্ছে। কি যে প্রচার করা হবে তা নিশ্চয়ই সহজেই অনুমেয়। কেননা, এগুলো আবার নাস্তিক চ্যানেলগুলো থেকে শেয়ার করা হচ্ছে।
তাবারি, সাদ, ওয়াকেদির বরাত দিয়ে মহানবির জীবনের ২৭ টি যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে মহানবিকে যুদ্ধবাজ এবং ইসলাম তরবারির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মর্মে তারা নানা শোরগোল তুলেছেন। অথচ ইতিহাস পড়ে দেখলাম, সেকালের নানা হানাহানি, নৃশংসতা, জুলুম নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যেই মহানবি যুদ্ধে নেমেছিলেন। এই ২৭টি যুদ্ধের সব আবার যুদ্ধ ছিল না। হজ্বে গমনকেও কেউ কেউ যুদ্ধ যাত্রা হিসাবে ধরে নিয়েছেন। যুদ্ধের সংখ্যা ২৭টি হলেও এতে উভয়পক্ষের হতাহতের সংখ্যা মাত্র দেড় হাজার থেকে দুই হাজার। এই অল্প স্ংখ্যক মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বিনিময়ে আরবে স্থায়ী শান্তি ফিরে এসেছিল। প্রাত্যাহিক হানাহানি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আরবরা প্রতিশোধ ও ক্রোধ দমন করে শান্তির মিছিলে শরিক হয়েছিলেন। ইনসাফ এবং ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে যুদ্ধ হয়েছিল। কারন ছাড়া কোন যুদ্ধই সংঘটিত হয়নি। এইসব যুদ্ধের ফলে দশ বছরেরও কম সময়ে দশ লাখ বর্গমাইলের মত এলাকা ইসলামের পতাকাতলে সামিল হয়েছিল। সীরাতে যুদ্ধের বর্ণনা পেলেই মহানবিকে ‘যুদ্ধবাজ, যুদ্ধবাজ’ আখ্যা দিয়ে নাস্তিকেরা চরম প্রশান্তি লাভ করলেও, প্রকৃত সত্য অনুধাবনের চেষ্টা তারা কখনোই করেননি।
ইসলাম সম্পর্কে যাদের ভাল জ্ঞান আছে, তারা নাস্তিকদের এইসব অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হন না, আবার কথিত মোল্লাদের অতি কথনেও বিশ্বাস করেন না। মহানবি হাদিস লিখে রাখতে নিষেধ করা সত্বেও হাদিসের নামে অতি বাড়াবাড়ি ইসলামের ক্ষতিই করেছে কেবল। অজ্ঞ মোল্লাদের ইসলাম নিয়ে বাড়াবাড়ি নাস্তিকতার পালে হাওয়া দিয়েছে এবং এখনো দিচ্ছে।
একবার নাস্তিক্যবাদ গ্রহন করার পর আর ইসলামে ফিরে আসার পথ খোলা থাকে না। কাজেই যারা প্রকাশ্যে নাস্তিকতা গ্রহন করেছেন, তারা মরিয়া হয়েই ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে আসছেন, যা প্রচার করছেন তারা নিজেরা যে তার সবটা বিশ্বাস করছেন তা-ও নয়। তবুও মিশন বলে কথা।
নাস্তিক বন্ধুরা আরেকটা যুতসই যুক্তি পেশ করেন, তাহলো অনিশ্চিত পরকালের লোভে কেন বর্তমান জীবনকে বঞ্চিত করে চলেছো? আসলে কি তাই? একটু খেয়াল করলেই দেখবেন ভোগ-বিলাস এবং জীবন যাপনে নাস্তিক আর আস্তিকদের মধ্যে তেমন বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। সুখ দুখের পারসেন্টেজও একই। নাস্তিকদের হিসাবে (প্রবাবিলিটির সুত্র ব্যবহার করে) পরকাল থাকার সম্ভাবনা ১০-২০%। যদি সেটা ১%-ও হয়, তাহলে নাস্তিকেরা তো পরকাল হারালো। অপরপক্ষে আস্তিকেরা দুনিয়া আখেরাত সবক্ষেত্রেই সফল।
আমার নাস্তিক বন্ধু মাঝেমধ্যেই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তার উপরও অন্যায় অত্যাচার হয়। সেও অনাচার-অবিচারের শিকার হয়। নাস্তিক হলেই এসবকে এড়ানো যায় না। তাকে বললাম, আমি যখন কোন অন্যায়ের শিকার হই, (যেমন গরীব ঘরে আমার জন্ম হয়েছে বলে আমি অনেক সুখ স্বাচ্ছন্দ থেকেই বঞ্চিত) যখন কোন পথ খুঁজে পাই না, তখন আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে নালিশ জানাই। যা এই পৃথিবীতে পাইনি তা পরকালে পাবার আশা করি। কিন্তু তোমার তো সেই জো নেই। তুমি বিশ্বাসও করো না। এই পৃথিবীতে তুমি তো অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত। কাকে দোষ দেবে? প্রকৃতি? প্রকৃতি তোমাকে অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত করেছে, কিন্তু এর কোন প্রতিকার তুমি কখনোই পাবে না। প্রকৃতি তোমাকে সেসব ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু আমি এই দুনিয়ায় বঞ্চিত হলেও, পরকালে তা পুষিয়ে নেবার আশা আছে। আমি মুসলমান হিসাবে বেহেস্তের আশা করতেই পারি।
এই মহাবিশ্বের মহাজগতের মহাকালের খবর আমরা আস্তিকদের চাইতেও তোমরা নাস্তিকেরা বেশী রাখো। আমাদের এই পৃথিবী মহাবিশ্বের তুলনায় সমুদ্রের একটা বালুকনা মাত্র। আর আমাদের জীবনকাল এক সেকেন্ডের কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগেরও কম। মহাজগতের এই মহাসমুদ্রে এই ক্ষণিতের জীবনে তাহলে কেন এতো মিথ্যা আস্ফালন? কেন কোন ঘটনার পজিটিভ দিক বাদ দিয়ে তাকে নেগেটিভভাবে বর্ণনা করে মহানবির অবমাননায় লিপ্ত? বন্ধু এর কোন জবাব দিতে পারে না। তবে বন্ধু আমার ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত করাতে আমি অনেক বই পড়ে অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। নাস্তিকদের মুল প্রশ্নের জবাব আমার জানা হয়ে গেছে। তাই তাদের কোন প্রশ্নকেই ভয় করি না। বরং নাস্তিকেরাই আমার ঈমানকে দৃঢ় করায় অবদান রেখেছে বলে আমার মনে হয়। এ কারনে আমি তাদের কাছেও কৃতজ্ঞ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১:৩৪