বাংলার নাস্তিকেরা Martin Lings এর লিখিত “Muhammad his life based on the earliest sources,” (Inner Traditions International, One Park Street, Rochester, Vermont 05767, USA, 1983) কল্পকাহিনীর অনুসরনে তাদের দেশীয় মস্তিকে সার্বক্ষণিক চলমান সেই চিরাচরিত নোংরা অনুমানের রসালো কাহিনী ব্লগ-অন লাইনে ইতোমধ্যে পুনঃ পুনঃ উগড়ে চলেছেন। তাদের সেইসব নোংরা লেখার কোন জবাব দেয়ার ইচ্ছে নিয়ে এটা লিখছি না। লিখছি বিশ্বাসীরা যাতে বিভ্রান্ত হয়ে না পড়েন সেটা মাথায় রেখে। নাস্তিকেরা বগলের তলায় তালগাছ নিয়ে লেখালেখি করেন। প্রকৃত যুক্তিকে পাশ কাটিয়ে মুক্তমনে কল্পনা করে ঘটনা সাজিয়ে নেন, তা নাহলে কি আর মুক্তমনা? এইসব নোংরা মানসিকতার লোকজন কোন মানদন্ডেই মুক্তমনা নন, আসলে তারা মুত্রমনা।
এবার আসি Martin Lings তার “Muhammad his life based on the earliest sources,”গ্রন্থে আসলে কি লিখেছেন সেটা দেখি। তিনি earliest sources বলতে মুলতঃ ওয়াকেদী, তাবারি, ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশাম-এদেরকে বুঝিয়েছেন। এইসব ঐতিহাসিকেরা তাদের গ্রন্থের শুরুতে এটা স্বীকার করে নিয়েছেন যে, তারা নানা লোকজন থেকে শুনে শুনে এইসব লিখেছেন। সত্যমিথ্যা যাচাই করার কোন সুযোগ তাদের ছিল না। ঐতিহাসিক ও সীরাতবিদরা এটাও স্বীকার করেছেন যে, ওয়াকেদী এবং তারারির অনেক বক্তব্যই চরম মিথ্যা। ইবনে ইসহাক কতেক ঘটনা শুনেছেন ইহুদিদের কাছ থেকে, যারা নব্য ইসলামকে একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তার কিছু বক্তব্য সে কারনে ইবনে হিশাম বাদ দিয়েছেন। এদের প্রত্যেকের লেখার ভাবার্থ নিয়ে Martin Lings গং মনগড়া কাহিনী সাজিয়েছেন। মুল আরবী থেকে ইংরেজী, ইংরেজী থেকে বাংলায় রূপান্তরেও আছে বিশাল তারতম্য। তথাপি যুক্তির খাতিরে আমরা সে সবকেও সত্য হিসাবে ধরে নিচ্ছি। কেননা আদি গ্রন্থ বলে কথা।
চলুন দেখে আসি কি সেই কাহিনী।
মিরাজের রাতে মহানবি উম্মে হানির ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। খাদিজাকে বিয়ে করার আগে তিনি উম্মে হানিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাচা আবু তালিব রাজি না হওয়ায় তা হয়নি। কিন্তু খাদিজা ও আবু তালিব মারা যাওয়ায় উম্মে হানির সাথে নবির পুরানো প্রেম জেগে উঠে। তিনি প্রায়ই তার ঘরে যেতেন। মিরাজের রাতে তার সাহাবীরা তাকে না পেয়ে খুঁজতে যান এবং উম্মে হানির ঘরে তাকে আবিস্কার করেন। নবি তার মান ইজ্জত রক্ষার জন্যে মেরাজের কাহিনী ফাঁদেন (নাউজুবিল্লাহ) এবং তা লোকজনকে শুনিয়ে বুঝাতে চান, ঐ রাতে আসলে তিনি উম্মে হানির ঘরে ছিলেন না। মুসনাদে আহমদ হাদিসগ্রন্থে আছে, রাসূলাল্লাহর প্রতি ছিল উম্মে হানীর দারুন সম্মানবোধ ও ভালবাসা। মক্কা বিজয়ের সময় কালে একদিন রাসূলাল্লাহ উম্মে হানির গৃহে যান। উম্মে হানি রাসূলাল্লাহকে শরবত পান করতে দিলে তিনি কিছু পান করে উম্মে হানির দিকে এগিয়ে দেন। উম্মে হানি সেইদিন নফল রোযা রেখেছিলেন। তিনি রোযা ভেঙ্গে রাসূলাল্লাহর পানকৃত অবশিষ্ট শরবত পান করেন। রাসূলাল্লাহ তাকে এইভাবে রোযা ভাঙ্গার কারন জানতে চাইলে জবাবে উম্মে হানি বলেনঃ আমি আপনার মুখ লাগানো শরবত পানের সুযোগ ছাড়তে পারি না। [মুসনাদে আহমদ]
ব্যস। আর যায় কোথায়। কথিত প্রেম কাহিনী রচনার নাট্যকাররা মুল রসদ এখান থেকেই পেয়ে গেলেন। আর মনের মাধুরী মিশিয়ে রচিত হতে থাকলো একের পর এর জঘন্য মিথ্যার কল্প নাট্য। ইহুদীদের তৈরী ইসলাম-ওয়াচ, ফেইথ ফ্রিডম নামীয় ব্লগগুলো নানা উদ্ভট কাহিনী রচনা করে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। আর বাংলার ইন্টারপাশ নাস্তিকেরা তা গিলে নানাভাবে উগরাতে থাকেন। তাদের সাথে কাঁধ মিলিয়েছেন সদ্য নাস্তিক মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ ও প্রৌঢ় নাস্তিক মুফাস্সিল ইসলাম গং।
এবার আসুন প্রকৃত সত্যটা জানি।
পবিত্র কোরআনের ১৭ নং সুরা বনি ইসরাইলে ও ৫৩ নং সুরায় আল্লাহপাক মহানবিকে উর্ধ্বকাশে ভ্রমন করিয়েছেন মর্মে উল্লেখ থাকলেও কখন, কিভাবে তার কোন উল্লেখ নেই। হাদিস এবং সীরাতগ্রন্থগুলো থেকেও মেরাজের কোন সন তারিখ বা মাসের কোন হদিস পাওয়া যায় না। একেকটি বর্ণনা একেক রকম। কিন্তু তাতে কি, নাস্তিকেরা তো মহানবি আর উম্মে হানির প্রেম কাহিনী পেয়ে গেছেন। উপরোক্ত হাদিস দ্বারা এই কাহিনী তারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণও করে ফেলেছেন। কেননা নাস্তিক মানেই তো মহাপন্ডিত।
কতেক হাদিস এবং সীরাতগ্রন্থে মহানবি তার চাচাতো বোন উম্মে হানিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন মর্মে উল্লেখ আছে। চাচা আবু তালিব রাজি না হওয়াতে সেটা হয়নি। উম্মে হানির ঘর ছিল কাবার একেবারে সংলগ্ন। এতোটাই সংলগ্ন যে নামাজের কেরাতও তার ঘর থেকে শুনা যেতো। চাচাতো বোন উম্মে হানির ঘরে মহানবির স্বাভাবিকভাবে যাওয়া আসা ছিল। মহানবি আবু তালিবের ঘরেই মানুষ হয়েছেন। কাজেই বোনের ঘরে যাওয়াকে প্রেমের উপাদান ভাবা কোন সুস্থ মানুষের আওতায় পড়ে না।
মহানবি কাবা থেকে মেরাজে গমন করেছেন, এ তথ্যই সর্বাধিক গ্রহনযোগ্য।“আল্লাহর নবী ইসরার রাতের ঘটনা প্রসেঙ্গে বলেন: আমি তখন হাতীমে কাবা অথবা বলেছেন, হিজরে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ একজন আগন্তুক আসল…”। [সহীহ বুখারী, অনুচ্ছেদ মিরাজ]
আর সুনান তিরমিযীতে বর্ণিত হয়েছে:
“আমি তখন (ইসরার সময়) বাইতুল্লাহ তথা কাবা শরীফের নিকট ঘুমন্ত ও জাগ্রত অবস্থার মাঝে অবস্থান করছিলাম…।” (হাদীস নং ৩৬৬৯)
কিন্তু কন্ট্রাডিকশনে ভরা কতেক হাদিস ও কতেক সীরাতে বলা হয়েছে, মেরাজের রাতে তিনি উম্মে হানির ঘরে ছিলেন। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম তিনি উম্মে হানির ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন। নাস্তিকেরা বলছেন, ঐদিন উম্মে হানির স্বামী বাড়িতে ছিলেন না। ধরে নিলাম ছিলেন না। কিন্তু বাড়িতে দাস-দাসীসহ অন্যান্যরা তো ছিলেন। তাদের নিজেদের দেয়া রেফারেন্সও তো তা-ই বলছে।
সীরাতে ইবনে হিশাম আস-সীরাহ আন-নাবাবিয়্যাহ এই গ্রন্থগুলিতে উম্মে হানির নামে বর্ণিত বক্তব্য পড়লে বুঝা যায় রাসূলাল্লাহ মেরাজের রাত্রিতে উম্মে হানীর গৃহে অবস্থান করলেও রাতের বেলায় কাবা শরীফে চলে গিয়েছিলেন। কাবা শরীফ থেকেই তিনি মেরাজে গমন করেন। উম্মে হানী বলেনঃ রাসূলাল্লাহর মেরাজ আমার ঘর থেকেই হয়। সে রাতে তিনি এশার নামায আদায় করে আমার ঘরে ঘুমান। আমরাও ঘুমিয়ে পড়ি। ফজরের অব্যবহিতের পূর্বে তিনি ‘আমাদেরকে’ ঘুম থেকে জাগান। তারপর তিনি ফজরের নামায পড়েন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায পড়ি। তারপর তিনি বলেনঃ উম্মে হানী! তুমি দেখেছিলে, গতরাতে আমি এই উপত্যকায় এশার নামায আদায় করেছিলাম। তারপর আমি বায়তুল মোকাদ্দাসে যাই এবং সেখানে নামায আদায় করি। আর এখন আমি ফজরের নামায তোমাদের সাথে আদায় করলাম, যা তোমরা দেখতে পেলে। তারপর তিনি বাইরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। আমি তাঁর চাদরের এক কোণা টেনে ধরলাম। ফলে তাঁর পেটের একাংশ বেরিয়ে যায়। তখন তা মিসরীয় কিবতী ভাঁজ করা কাতান বস্ত্রের মত দেখাচ্ছিল। আমি বললামঃ হে আল্লাহ্র নবী! একথা আর কাউকে বলবেন না। এমন কথা তারা বিশ্বাস করবে না এবং তারা আপনাকে কষ্ট দিবে। তিনি বললেনঃ আল্লাহ্র কসম! একথা আমি তাদেরকে বলবই।’
এখানে খেয়াল করুন, উম্মে হানি যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন তাহলো, ‘আমরা’। তিনি ‘আমাদেরকে’ ঘুম থেকে জাগান। তার মানে কি দাড়ালো? মহানবি আর উম্মে হানি ছাড়া ঘরে কেউ ছিল না? আর চাচাতো বোনের ঘরে রাত কাটানো মানেই কি চাচাতো বোনের সাথে যৌন-সম্পর্ক? আর যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে তখন মহানবি এবং উম্মে হানি উভয়ের বয়সই ৫০-এর উপরে। উম্মে হানির স্বামী সন্তান বিদ্যমান ছিল।
উম্মে হানি রাসূলাল্লাহর কাপড় ধরে টেনে ধরার প্রসঙ্গটা টেনে নাস্তিকেরা অশ্লীলতার অনেক ঢোল তবলা বাজান। উম্মে হানি মহানবির পেটের একাংশ দেখেছে মানে তাদের মধ্যে প্রেম ছিল। শরীর দেখাদেখি হয়েছে। কি উদ্ভট চিন্তা ভেবে দেখুন। অথচ কাপড় ধরে টানার ঘটনাটা ঘটেছে নামাজ পড়ার পর। আর বাড়ির সব লোকের সামনেই সেটা ঘটেছিল। অবিশ্বাস করে ইসলাম ত্যাগ করবে এই ভয়ে মেরাজের কথা অন্যদের বলতে নিষেধ করার মধ্যেও নাস্তিকেরা অশ্লীল প্রেম ও অনৈতিকতা খুঁজে পেয়েছেন। সীরাতকার ইবনে ইসহাক লিখেছেন, উম্মে হানি বলেন, “হে আল্লাহর নবী, আপনি এই সংবাদ কাউকে জানাবেন না। কারণ এই সংবাদ জানলে তারা আপনাকে মিথ্যুক বলবে এবং অপমান করবে।“ নবি বললেন: “আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে জানাবই।’ উম্মে হানি তার ক্রীতদাসীকে নির্দেশ দিলেন: “তুমি নবিকে অনুসরণ কর আর শ্রবণ কর উনি কি বলেন, আর তারা কি বলে।“ (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ১৮৪)।
পাঠক, সীরাতের এই বর্ণনায় মহানবির উম্মে হানি ঘরে রাত কাটানোর বিষয় ধামাচাপা দেবার কোন উদ্দেশ্য খুঁজে পেলেন? আপনারা না পেলেও, মহা আবিস্কারকেরা সেটা পেয়ে গেছেন। কেননা অতি কামুকেরা তাদের মা-বোনের শরীরেও কেবল কামই দেখতে পান।
উম্মে হানির এই ঘটনা কোন কালেই কোন আলোচ্য বিষয় ছিল না। Martin Lings নামীয় ঐ ইহুদী ভদ্রলোকের মস্তিষ্ক প্রসুত লেখাটি দেখে আমাদের দেশীয় নাস্তিকেরা এই মহা আবিস্কারটি করে ফেলেছেন। কায়দা মতো কিছু সীরাত এবং হাদিসের রেফারেন্স ব্যবহার করে বগল দাবাচ্ছেন, যদিও সীরাত-হাদিস দ্বারা নাস্তিকদের কথিত বক্তব্যের দুর দুরতম কোন সম্পর্কও প্রমাণিত হয় না।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:১২