মহানবির সময় ‘আইয়ামে জাহেলিয়াতের’ যুগটা কি রকম ছিল, আমাদেরকে আগে সেটা অনুধাবন করতে হবে। সেই যুগে বহু বিবাহ, উপপত্নী রাখা, দাসী রাখা, একসাথে ২০/৫০টা স্ত্রী থাকা এগুলো ছিল একান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার-স্যাপার। আজকের যুগের মানসিকতা দিয়ে সে সময়কে বিচার করা যাবে না। যুগের ও সময়ের চাহিদায় ঘটনার প্রেক্ষাপটে এবং ইসলাম প্রচারের স্বার্থে মহানবি বহু বিয়ে করেছেন। তার এই বহু বিবাহ মুসলমানদের জন্যে সুন্নত নয়, আদর্শ নয়। তিনি বিধবা বিয়ে করলেও, সাহাবীদের কুমারী বিয়ে করতে উদ্ভূদ্ধ করে গেছেন। তিনি ঘটনার প্রেক্ষিতে বিধবা বিয়ে করেছেন, তাই বলে সেটা মুসলমানদের অনুসরনীয় করে যাননি। তিনি মাটির পাত্রে খেয়েছেন, চাটাইয়ের বিছানায় ঘুমিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো কোন সুন্নত বা আদর্শ নয়। সেই যুগ আর পরিস্থিতির আলোকে তাকে বহু বিবাহ, যুদ্ধ বিগ্রহসহ অনেক কিছুই করতে হয়েছে। সেইযুগে বহু বিবাহ স্বাভাবিক ছিল বলে এতোকাল কোন কথা উঠেনি। ধীরে ধীরে তা লোপ পেয়ে আসায় এবং যুগের পরিবর্তনে মানসিকতার পরিবর্তণ ঘটায় বহু বিবাহকে ঘৃনার চোখে দেখা শুরু হয়।
কোন একজন ব্যক্তি কোন একটি বক্তব্য বা বিষয়কে কিভাবে বুঝবেন সেটা নির্ভর করে তার মানসিকতকার উপর। কোন কোন পরিবার আছে, যারা মা বাবা তো বটেই, সহদর ভাইয়েরা নিজেদের মধ্যে অনেক দুরত্ব বজায় রাখেন। নিজ ভাইয়ের সাথে কোন পারসোনাল বিষয় বা প্রেম ভালবাসার বিষয় শেয়ার করার কথা তারা ভাবতেও পারেন না। আপনজনের মধ্যে এমন আলাপচারিতাকে তারা অশ্লিল মনে করেন। আবর বিপরীত চিত্রও আছে। অনেক পরিবারের আপন ভাইবোনেরা নিজেদের প্রেম ভালবাসার কথা একে অন্যের কাছে শেয়ার করেন। এরকম সম্পর্ক কতেক পিতা-পুত্রের মধ্যেও রয়েছে। কোন কোন পিতা তার যৌবনকালের প্রেমের গণ্প তার পুত্রকে শুনান। পুত্রও পিতাকে শুনান কোন একটা বিশেষ মেয়েকে তার ভাল লাগার কথা। মোদ্দা কথা হলো, এখানে এইসব বিষয় কে কিভাবে নিলো সেটাই মূখ্য। কোন একটা বিষয় কারো কাছে অশ্লিল বা অস্বাভাবিক আর কারো কাছে শ্লীল বা স্বাভাবিক।
মুমীনরা যেমন শুকরের মাংস খাওয়ার কথা কল্পনাও করেন না, তেমনি হিন্দুরা গরুর মাংস। যেটা এক সম্প্রদায়ের কাছে স্বাভাবিক, সেটা অন্য সম্প্রদায়ের কাছে অস্বাভাবিক। একেক ব্যক্তি একেক মানসিকতায় বেড়ে উঠেছেন, স্বাভাবিক কারনে তাদের ব্যক্তিত্ব ও মানসিকতায়ও ভিন্নতা রয়েছে। আজকালকার সমাজে বহু বিবাহ একটা ঘৃণিত ব্যাপার। এক সময়ের সমাজে সেটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার ছিল। আজকে আমরা যে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি, তা ১৪৫০ বছরেরও আগের প্রেক্ষাপট। উপরন্তু সীরাত গ্রন্থকাররা এগুলো শুনে শুনে লিখেছেন, তা-ও ঘটনার ১০০ বৎসর পর। আমাদের আধুনিক এই যুগের ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাই যেখানে ২০ বছর যেতে না যেতে বিকৃত হতে শুরু করেছে, কত রাজাকার যে ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছেন তা থেকেই আমরা ১৪০০ বছর আগের ঘটনার ইতিহাস অনুমান করে নিতে পারি। একটা কথা মনে রাখুন, কোরআন ব্যতীত আর কোন কিছুই সাথে সাথে লিখে রাখা হয়নি। পৃথিবীতে একমাত্র কোরআনই সর্বশ্রেষ্ট অথেনটিক ঐষীগ্রন্থ। কোরআন ছাড়া বাকি সবগুলোই একশত, দুইশত কিম্বা তিনশত বছর পরে শুনে শুনে লিখা হয়েছে। কাজেই কতেক বই আর হাদীসের রেফারেন্স দিলেই তা সত্য ও শুদ্ধ হয়ে যায় না। মুসলমানেরা মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন বিধায় যে বিষয়টা কোরআনের সাথে মিলে না তা বাতিল করে দেন, হোক সেটা বুখারি কিম্বা মুসলিম।
কট্টরপন্থী কতেক হাদিসপ্রেমী এবং নাস্তিকেরা সিরাত এবং হাদিস থেকে রেফারেন্স দিয়ে মহানবির চরিত্র হননের চেষ্টা করে আসছেন। কট্টরপন্থী-হাদিসপ্রেমীদের নাস্তিকদের সাথে গুলিয়ে ফেললাম এই কারনে যে, উভয়েই একই রেফারেন্সকে সহি মনে করেন। যদিও বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে দুজনের অবস্থান বিপরীত দুই মেরুতে।
কোরআনের বানীগুলোই আসলে হাদীস। মানব রচিত অমুক তমুক থেকে, তমুক আরেক তমুকের কাছে থেকে শুনা কথার গ্রন্থকে সহি মনে করার কোন কারন নেই। রাবি, সনদ দিয়েও সহি প্রমানের চেষ্টা অবান্তর। যা কোরআনের মুল বানীকে আঘাত করে তা কোনভা্বেই গ্রহনযোগ্য নয়। যেখানে মহানবি নিজেই হাদীস লিখে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। মহানবি ও তার সাহাবাদের জীবন ছিল সহজ সরল এবং ইমান দীপ্ত জ্যোতির্ম্য় জীবন। কোরআন এবং মহানবির দেখানো সুন্নাহর আলোকে তারা সহজ জীবন যাপন করতেন। যেদিন থেকে মহানবির বানীকে উপেক্ষা করে হাদীস লেখা শুরু হয়, সেদিন থেকেই মুসলমানদের জীবনকে নানা বাধাঁ নিষেধের নিগড়ে কঠিন থেকে কঠিনতর করার মাধ্যমে জাহান্নামে পরিণত করে ছেড়েছে। যেসব ধর্মবেত্তা বিশ্বাস করেছেন হাদিস লিখে না রাখলে ইসলাম ধ্বংস হয়ে যাবে, তারা প্রকারান্তরে মহানবির ইসলামকেই অস্বীকার করেছেন। হাদিসের নামে নানা বিধি নিষেধের খড়গ তো আছেই, কতেকক্ষেত্রে মহানবির নামে মানব রচিত এইসব হাদিস মহানবির চরিত্রকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে ছেড়েছে। আর এর পুরোপুরি ফায়দা তুলে নিয়েছেন নাস্তিক ও ইসলাম-বিদ্বেষীরা।
এবার যয়নাব প্রসঙ্গে ফিরে আসি। মহানবি ও যয়নাবকে নিয়ে আদিকাল থেকেই অনেক কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে। এতে ঘি ঢেলেছেন মুসলিম ঐতিহাসি আল-ওয়াকেদী (৭৮৪-৮২২ খৃঃ) এবং তৎ সময়কালের ঐতিহাসিক ইবনে জারীর তাবারি (The History of al-Tabari, vol. 8, page 2-4) । এরা ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহের নামে সনদবিহীন শুনা কথার ইতিহাস, মনগড়া তফসির এবং কেচ্ছাকাহিনী রচনা করায় কোন স্কলারই তাদের সকল বক্তব্য গ্রহন করেননি। তাবারি অবশ্য তার বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন,
‘আমি পাঠকদের সতর্ক করতে চাই যে, এই বইয়ে আমি কিছু মানুষ আমার নিকট যে খবর বর্ণনা করেছে তার উপর নির্ভর করে সবকিছু লিখেছি। আমি কোন যাচাই-বাছাই ছাড়াই গল্পগুলোর উৎস হিসেবে বর্ণনাকারীদেরকে (ধরে) নিয়েছি………। যদি কেউ আমার বইয়ে বর্ণিত কোন ঘটনা পড়ে ভয় পেয়ে যান, তাহলে তার জানা উচিৎ যে, এই ঘটনা আমাদের কাছ থেকে আসেনি। আমরা শুধুমাত্র তাইই লিখেছি যা বর্ণনাকারীদের কাছ থেকে পেয়েছি।’ [The history of Al Tabari- The victim of Islam, Translated by Michael Fishbein [State University of New York Press, Albany, 1997]
আল-ওয়াকেদী সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী (র) বলেন, তার রেওয়ায়াৎ ‘পুঞ্জিভূত মিথ্যা’, ইমাম আহমদ তাকে ‘ঘোর মিথ্যাবাদী’ বলেছেন। ওয়াকেদীর জন্মের ১২২ বছর আগে মহানবির সাথে যয়নাবের বিয়ের ঘটনা ঘটেছিল। তবে ওয়াকেদী ও তাবারির গ্রন্থে গ্রহনীয় ও বর্জনীয় উভয় বিষয়ের সমাহার থাকায় কোরআনের আলোকে এগিয়ে যাওয়াই সমীচিন বলে স্কলাররা অভিমত দিয়েছেন। এরা কেউই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নন। কিন্তু ইসলাম-বিদ্বেষীরা ওয়াকেদী এবং তাবারির দূর্বল দিকগুলোকেই রেফারেন্স হিসাবে গ্রহন করে কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ ছাড়াই মনগড়া কাহিনীর মাধ্যমে ‘এতিহাসিক নাট্য’ রচনা করে ক্রমাগত অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছেন।
সীরাত ও অথেনটিক গ্রন্থের আলোকে দেখা যায়, মহানবি তার কৃত দাস যায়েদ বিন হারেশকে নিজ পুত্রের ন্যায় লালন পালন করেছিলেন। একসময় যায়েদ ইসলাম গ্রহন করেন। সুরা আহযাবের ৩৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন; আপনিও যাকে অনুগ্রহ করেছেন: এ আয়াতে যায়েদ-এর কথা বলা হয়েছে। যায়েদ-এর প্রতি আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ ছিল। যায়েদ যখন খাদিজার ক্রীতদাস ছিলেন, তখন তার চাল-চলন রাসূলকে মুগ্ধ করে এবং তিনি তাকে মুক্ত করে দেন। তিনি ছিলেন রাসূলের(স)পালকপুত্র আর সবাই তাকে ‘যায়েদ বিন মুহম্মদ’ ডাকত। এটা ছিল যায়েদ(র) এর প্রতি রাসূলের (স) বিশেষ অনুগ্রহ। যায়েদের শাহাদাত লাভের পূর্ব ও পরবর্তী সময়েও এ অনুগ্রহ স্থিত ছিল। মহানবি কখনোই তাকে ত্যাগ করেননি এবং তিনিও না। মহানবির একান্ত অনুগত সম্মানিত সাহাবি ছিলেন যায়েদ।
মহানবি তার ফুফাতো বোন যয়নাবকে যায়েদের সাথে বিয়ে দিতে চাইলেন। সে যুগে আরবে বংশ গৌরব খুবই প্রকট ছিল। সেখানে ভাল বংশের কোন মেয়েকে কোন গোলাম বা আযাদকৃত গোলামের কাছে বিয়ে দেয়াকে খুবই অপছন্দ করা হতো।এ কারণে প্রথমে যয়নব ও তার পরিবার এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না।
জীবন পথের বিভিন্ন ক্ষণে এবং উপস্থিত নানা সমস্যার সমাধানে মহানবি যখন আল্লাহর মুখাপেক্ষী হতেন, তখনই অহি দ্বারা আল্লাহ তা জানিয়ে দিতেন।
তখন সূরা আহযাবের আয়াত নাজিল হয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন কাজের আদেশ করলে কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়। [সূরা আহযাব ৩৩: ৩৬]
এ আয়াত নাজিল হবার পর যয়নব ও তার পরিবার আল্লাহর ভয়ে উক্ত বিয়েতে রাজি হয়ে যান। বিয়ে তো হলো কিন্তু যয়নাবের দৃষ্টিতে যায়েদ নীচ ও হীনই রয়ে গেলেনে। তিনি নিজেকে অপমাণিত বোধ করছিলেন। স্বাভাবিক কারনেই বনিবনা হচ্ছিল না। অশান্তি এবং বিবাদ লেগেই রইল। এই অশান্তির জেরে যায়েদ(র) রাসূলের(স) কাছে ক্রমাগত তালাকের অনুমতি প্রদানের জন্য আবেদন করছিলেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল(স) তালাক দিতে বারণ করে যাচ্ছিলেন। কারণ বিয়ের পর তালাক প্রদান করা অনুত্তম কাজ। কিন্তু যায়েদের পক্ষে এ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।
ইতোমধ্যে আল্লাহ রাসূলকে(স)অহীর মাধ্যমে জানিয়ে দেন যে, যায়েদ এ বিয়ে বন্ধন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। বরং সে তালাক দিবেই। আর এরপর যয়নবের মনকে খুশি করতে খোদ রাসূলকেই(স) বিয়ে করতে হবে। এটাই আল্লাহর ফায়সালা। যা অহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দেন।
কিন্তু রাসূল(স) উক্ত বিষয়টিকে প্রকাশ করতে আরবের মুশরিকদের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির ভয় পাচ্ছিলেন। কারণ, আরবে পোষ্যপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করাকে অবৈধ মনে করা হতো।কেবল অবৈধই নয়, খুবই অশোভন মনে করা হতো। লোক লজ্জার ভয়ে রাসূল(স) উক্ত বিষয়টিকে জনসম্মুখে বলতে ভয় পাচ্ছিলেন। তাই তা মনের মাঝেই গোপন করে রাখেন। এরই মাঝে একদিন যায়েদ এসে জানান যে, তিনি অশান্তির চূড়ান্ত সীমায় এসে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দিয়েছেন। তখন রাসূল(স) চুপ করে রইলেন। কোন কোন গ্রন্থে এসেছে, যয়নাবের ইচ্ছে ছিল উম্মুল মুমেনীন হবার। যখন যয়নবের ইদ্দত সম্পন্ন হয়ে যায়, তখন রাসূল(স) হযরত যায়েদের মাধ্যমেই যয়নব-এর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। কারন এর দ্বারা সমাজে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে যা কিছুই হয়েছে যায়েদের রেজামন্দী সাপেক্ষেই হয়েছে। যয়নাব প্রস্তাব শুনেই আল্লাহর সিদ্ধান্ত জানার জন্যে ইস্তেখারা করলেন, আল্লাহর পরামর্শ চাইলেন। সেসময় সুরা আহযাবের ৩৭ নং আয়াত নাজিল হয়। ‘যখন যায়েদ যয়নাবের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করলো, আমি তাকে তোমার সাথে পরিণয় সুত্রে আবদ্ধ করলাম।’ আল্লাহ তাআলা পরিস্কার ভাষায় আরো জানিয়ে দিলেন যে, পোষ্যপুত্রের তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকে বিবাহ করা এটি সম্পূর্ণই বৈধ। এতে দোষের কিছু নেই। আর যায়েদ জয়নবকে তালাক দিবে, পোষ্যপুত্রের তালাকপ্রাপ্তাকেই রাসূল(স)-এর বিবাহ করতে হবে, একথা আল্লাহর বিধান হওয়ার পরও রাসূল(স)লোকলজ্জার ভয়ে তা প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। অথচ আল্লাহ তাআলাই অধিক ভয় পাবার যোগ্য। পোষ্যপুত্রের স্ত্রী ঔরষজাত স্ত্রীর সমতুল্য নয়, একের বিধান অপরের জন্যে প্রযোজ্য নয়।
অবশেষে অহীর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তা প্রকাশ করে দিলেন। "আপনি যা নিজ অন্তরে গোপন রাখছেন আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন" আয়াতের নাজিল হয়।
আরবে প্রচলিত একটি কুপ্রথা বিলুপ্তকরণের জন্য হোক বা আল্লাহর অন্য কোন ইচ্ছেতে হোক পোষ্যপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী যয়নাবকে বিয়ে করার ফয়সালা আল্লাহই নিয়েছিলেন। আর মহানবির ফুফাতো বোন সেই তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী জয়নাব লাভ করেছিলেন উম্মুল মুমেনীন হবার মহা সম্মান। ইসলাম বিদ্বেষী ও নাস্তিকেরা এখানে নারী লোলুপতা এবং অনৈতিকতা উপাদান খুঁজে পায়, যা প্রকৃত ঘটনার সর্ম্পর্ণ বিপরীত।
ইসলাম বিদ্বেষীরা যুক্তি দিয়ে থাকেন, যায়েদ যখন যয়নাবকে বিয়ে করেছিলেন, তখন যয়নাব মহানবিকে ‘আব্বা’ ডাকতেন। আরবীয় কালচারে সেরকম ডাকার কোন অবকাশ নেই। তাছাড়া যয়নাব ছিলেন মহানবির ফাফাতো বোন। মহানবিকে তার জমানার সবাই ‘রাসুলুল্লাহ’ বলেই
ডাকতেন। আব্বা হুজুর, শ্বশুর হুজুর ডাকার প্রচলন সেযুগেও ছিল না এ যুগেও নেই।
আল্লাহর বিধান আসার পর পালকপুত্র বলে ইসলামে কিছুই নেই। তাই বলে পালকপুত্র গ্রহন করা ইসলামে অবৈধ নয়। উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়শা তার ভাইয়ের ছেলেকে পালক বা দত্তক নিয়েছিলেন। কতেক নাস্তিক বলে থাকেন মহানবির(স) একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারনে আজো মুসলমানেরা দত্তক গ্রহনে অস্বীকার করেন এবং তার দরুন অনেক অসহায় মানুষ এ মহান সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যদিও দত্তক নেয়াটা একটা মানবীয় গুন। বিষয়টা যে কত বড় মিথ্যা তা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন। অন্যের সন্তানকে নিজের সন্তানের মত লালনপালন করা সত্যি এক মহৎ হৃদয়ের কাজ। ইসলাম কখনোই দত্তক নেয়াকে অস্বীকার করেনি, বরং কিছু শর্ত দিয়েছে মাত্র। দত্তক পুত্র বা কন্যাকে বলে দিতে হবে তার প্রকৃত পিতা কে। তার কাছে কোন কিছুই লুকানো যাবে না। একটিবার খেয়াল করুন, আপনি প্রধানমন্ত্রীর পালিত পুত্র। সব ধরনের সুযোগ সুবিধা আপনি ভোগ করছেন। তথাপি আপনার সমস্ত মানসিক শান্তি কিন্তু বিলোপ পাবে স্বাভাবিক কারনেই। আপনার সর্বক্ষণই মনে হবে নিজ সন্তান বললেও প্রকৃত সত্য তা নয়। মিথ্যার উপর দাড়িয়ে আছেন আপনি। যদি তা না হয়ে আপনি আপনার সঠিক অবস্থানে থাকতেন, তাহলে আপনি যত হতদরিদ্রই হোন না কেন অন্ততঃ এ রকম মানসিক যন্ত্রনায় ভুগতেন না। আর এই দত্তক পুত্র যদি না-ই জানে কে তার প্রকৃত পিতা বা মাতা তাহলে হবে আরো কঠিন পরিস্থিতি। বেঁচে থাকার ইচ্ছেই উবে যাবে। কাজেই ইসলামের সিদ্ধান্তই আখেরে সঠিক বিবেচিত হয়েছে।
যয়নাব ও মহানবির এই বিয়ে নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীরা নানা চটকদার গল্প ফেঁদেছেন এবং এখনো তা অব্যাহত রেখেছেন। তাদের গল্পের সাথে মিলিয়ে কোরআনের আয়াত এবং হাদিসের রেফারেন্স কোড করে মুসলমানদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করে আসছেন। তারা যে দু’টি মুখরোচক গল্প বানিয়েছেন তা হলো,
এক, মহানবি কোন এক সময় ‘বিনা অনুমতিতে’ যয়নাবের ঘরে ঢুকে তাকে অনাবৃত অবস্থায় দেখতে পেয়ে মহানবির লোভ জেগে উঠে। তার এই মনোভাব যায়েদ বুঝতে পেরে স্ত্রীকে তালাক দিতে চান। মহানবির কাছে তালাকের অনুমতি চান। জবাবে মহানবি বলেন, তালাক দিও না, আল্লাহকে ভয় কর। মহানবির ভয়ে বাধ্য হয়ে যায়েদ যয়নাবকে তালাক দেন। সাথে সাথে মহানবি তাকে বিয়ে করে ফেলেন।
দুই, মহানবি বিয়ের প্রস্তাব দেবার জন্যে যয়নাবের ঘরে প্রবেশ করেন, যায়েদ অনুপস্থিত ছিলেন। বাতাসে পর্দা উড়ে যাওয়াতে যয়নাবের পা দেখা যাচ্ছিল, তা মহানবির নজর কাড়ে। উভয়েই বিয়ের জন্যে অস্থির হয়ে উঠেন। কিন্তু পালকপুত্রের বিবাহিত স্ত্রী হওয়ায় মহানবি মনের ভেতর তা গোপন রাখেন। যা আল্লাহ নিজে ফাঁস করে দেন। [কায়দামত এখানে কোরআনের "আপনি যা নিজ অন্তরে গোপন রাখছেন আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেবেন" আয়াতটা ফিট করে দেন।] এরকমটা ঐতিহাসিক ওয়াকেদী এবং ইবনে জারির তাবারিও করেছেন, যা নাস্তিকদের জন্যে এক মহামূল্যবান রেফারেন্স বটে। যয়না্ব ও মহানবির এই গল্পগুলো ঐতিহাসিক ওয়াকেদী এবং ইবনে জারির তাবারির অনুসরনে সাজানো হয়েছে, সত্যিকার অর্থে যার কোন ভিত্তিই নেই। কোথাও বলা আছে যয়নাব রাতের পোশাক পরে বের হয়েছিলেন, কোথাও বলা আছে, বাতাসে পর্দা উড়ে যাওয়াতে যয়নাব-এর পা দেখা গিয়েছিল। আবার ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় যায়েদ অসুস্থ ছিলেন অপরদিকে তাবারির বর্ণনায়, যায়েদ বাসার বাইরে ছিলেন। কিভাবে একজন মানুষ একইসাথে অসুস্থ হয়ে বিছানায় আবার বাসার বাইরে থাকেন?
অন্তরের কোন কথা আল্লাহপাক প্রকাশ করে দেবেন, সেটা আগেই আলোচনা করেছি।
এ ব্যাপারে হাদিসে উল্লেখ হয়েছে,
ইমাম বায়হাকী (রঃ).. হাম্মাদ ইবনে যায়দ.. আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, যাইদ (রাঃ) যয়নাব (রাঃ) এর ব্যাপারে অভিযোগ নিয়ে এলে রাসূল(স) তাকে বলেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার স্ত্রীর সাথে বিবাহ সম্পর্ক বজায় রাখ। আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল(স) আদৌ কোন কিছু গোপন করে থাকলে অবশ্যই তিনি এই আয়াতটি (যায়েদের সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং তার সাথে যয়নাব এর বিবাহ হবে) গোপন করতেন। যয়নাব (রাঃ) তো অন্যান্য স্ত্রীদের উপর গৌরব করে বলতেন, তোমাদের অভিভাবকরা তোমাদের সাথে রাসূল(স) এর বিবাহ প্রদান করেছেন, আর মহান আল্লাহ স্বয়ং সপ্ত আসমানের উপর থেকে আমার সাথে রাসূল(স) এর বিবাহ প্রদান করেছেন। [বুখারী: ৪৭৮৭/৭৪২০, মুসলিম: ৮৩, ১৪২৮, তিরমীযী: ৩২১২, ৩২১৭-৩২১৯]
কাজেই বোঝা গেলো, মহানবি অন্তরে যা গোপন করেছিলেন, তা ওহির জ্ঞান।
মহান আল্লাহ তাকে বলছেন, "আপনি মানুষকে ভয় পাচ্ছেন, অথচ মহান আল্লাহই হচ্ছেন সবচেয়ে উপযুক্ত সত্তা যাকে আপনার ভয় করা উচিত।" [সুরা আহযাব: ৩৭]
অনেক ইসলাম বিদ্বেষী যায়েদের জীবন ধ্বংস হয়ে গেছিলো বলে মিথ্যার ফুলঝুরি ছড়ান। পাঠক একটা কথা জেনে রাখুন, যয়নাবই যায়েদের প্রথম ও একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। বারাকা নামের এক মুক্ত দাসীও যায়েদের স্ত্রী ছিলেন। সেই বারাকার গর্ভের সন্তানাদিও ছিল।
সেই যুগে নারী ছিল খুবই সহজলভ্য। আর যয়নাব ৩৭ বছর বয়স্কা একজন সাধারণ নারী ছিলেন, তিনি আহামরি সুন্দরী তো ছিলেনই না, উপরন্তু ইতিপূর্বে আরো দুজন পুরুষের সাথে তার সংসার জীবন কেটেছে। তিনি মহানবির ফুফাতো বোন ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই মহানবি তাকে দেখে এসেছেন। কাজেই তাকে বিয়ে করার জন্যে মহানবি পাগল হয়ে উঠার নাস্তিকীয় কেচ্ছাকাহিনী যুক্তির কষ্টিপাথরেই ধোপে টেকে না। আবার এমনও নয় যে, যায়েদের সাথে বিচ্ছেদের সাথে সাথেই মহানবি তাকে বিয়ে করে ফেলেছেন। তার ইদ্দতকাল অতিবাহিত হবার পরই মহানবি আল্লাহর ইচ্ছায় তাকে বিয়ে করেছিলেন। পাঠক বুঝতেই পারছেন, ইসলাম বিদ্বেষীদের ‘বিনা অনুমতিতে’ যয়নাবের ঘরে মহানবির প্রবেশ ও যয়নাবকে বিবস্ত্র অবস্থা দেখে লোভী হওয়ার চটকদার গল্প তাদের নিজেদের বানানো। এইসব জঘন্য মিথ্যাচার থেকে আল্লাহপাক আমাদের হেফাজত করুন।
অনেকেই ভাবতে পারেন, কিছু একটা তো ঘটেছিল, না হলে সীরাতগ্রন্থে এগুলো এলো কেমন করে? বিশ্লেষকেরা এর কারনও বের করেছেন। তা হলো, বাইবেলে বর্ণিত রাজা দাউদ ও বাতসেবার গল্প পড়ে কেউ এই গল্পটি তৈরি করেছে।[Holy Bible, 2 Samuel, Chapter 11] গল্পটিতে রাজা দাউদ, সুন্দর দেহের অধিকারী বাতসেবাকে নগ্ন অবস্থায় গোসল করতে দেখে তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন এবং পরবর্তীতে বাতসেবার স্বামীকে হত্যা করে বাতসেবাকে নিজের কাছে নিয়ে নেন।
বাইবেলের আদলে যয়নাবের কাহিনী সাজিয়ে তৈরী করা গালগল্প মিথ্যাবাদী ওয়াকেদী কোন রকম যাচাইবাছাই ছাড়াই তার সীরাতগ্রন্থে উল্লেখ করায় এবং পরবর্তীতে এটাকে অনুসরন করে তাবারি ও অন্যান্যরা এগিয়ে যাওয়ায় ইসলাম বিদ্বেষীরা মহানবির ব্যক্তিজীবনে কলংক লেপনের মওকা পেয়ে গেছেন।
যয়নাব মহানবির পুত্রবধু ছিলেন না। মহানবির কোন পুত্র সন্তান ছিল না। আর আল্লাহর বিধান আসার পর পালক পুত্র বলে ইসলামে কিছু ছিল না। পালকপুত্রের সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়ে ‘বন্ধু’-তে পরিণত হয়েছিল। যয়নাব মহানবির পুত্রবধু নন, বরং তার ক্রীতদাস যায়েদ-এর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী, মহানবির ফুফাতো বোন। যায়েদ নিজেই বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছিলেন-এটা ঐতিহাসিক সত্য। যায়েদ এই বিচ্ছেদের কারনে বা যয়নাবের সাথে মহানবির বিয়ের কারনে কোনরূপ ক্ষতির সম্মূখিন হওয়ার প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। বরং পালিতপুত্রের প্রথা বিলুপ্ত হওয়ায় তিনি লাভ করেছিলেন ধর্ম ভাই-এর মর্যাদা। মহানবির বন্ধু তথা সম্মানিত সাহাবি। ক্রীতদাস থেকে তিনি পৌছে যান নেতৃত্বদানকারী সাহাবির স্তরে। সাহাবিদের মধ্যে একমাত্র তার নামই পবিত্র কোরআনে স্থান পেয়েছে।
আর যয়নাব সম্পর্কে উম্মুল মুমেনীন আয়েশা (র) বলেন, ‘রাসূল-এর স্ত্রীগণের মাঝে একমাত্র যয়নাব নিজেকে আমার সমতুল্য বলে দাবি করতেন। তিনি সর্বদা গর্ব করে বলতেন, আমি হলাম রাসূল-এর ফুফাত বোন, তোমাদের বিয়ে তো দিয়েছে তোমাদের অভিভাবকরা, পক্ষান্তরে আমার বিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ সপ্ত আকাশের উপর থেকে। দীনের ক্ষেত্রে উৎকর্ষে, তাকওয়ায়, সত্যবাদিতায়, আত্বীয়তার সম্পর্ক অটুট রাখার ব্যাপারে, আমানতদারী ও দান-খয়রাতের ক্ষেত্রে যয়নাব বিনতে জাহাশের চাইতে উত্তম কোন নারীকে আমি দেখিনি।’ রাসূল(স)বলতেন, তোমাদের মাঝে সেই আমার সাথে সবার আগে মিলিত হবে (পরকালে) যার হাত অধিক লম্বা। আমরা (উম্মুল মুমিনীনগণ) সবাই একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে দেখতাম কার হাত বেশি লম্বা। অবশেষে আমরা বুঝলাম যয়নাব-এর হাত বেশি লম্বা। তিনি নিজ হাতে নিজের সকল কাজ করতেন এবং প্রচুর পরিমাণ দান-খয়রাত করতেন। [বুখারী-মুসলিম, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ৪র্থ খন্ড, ৫ম হিজরীর ঘটনাসমূহ অধ্যায়]
যয়নাব ছিলেন কুরআনের হাফেজ, তাকে কেন্দ্র করেই পর্দার আয়াত নাজিল হয়। কেবল যয়নাবই নয়, মহানবির প্রতিটি বিয়েতেই কোন না কোন হেকমত ছিল। নাস্তিক এবং ইসলাম বিদ্বেষীদের মিথ্যা সমালোচনার ও কল্প কাহিনী বানানোর অনেক খোরাক এতে থাকলেও, বিশ্বাসীদের জন্যে রয়েছে ঈমানের পরীক্ষা। আগেই বলেছি, ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, শতাধিক বিয়ে করাও সেযুগে একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মহানবির জন্যে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তিনি কেবল তা-ই করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, হে নবী! আপনার জন্য আপনার স্ত্রীগণকে হালাল করেছি, যাদেরকে আপনি মোহরানা প্রদান করেন। আর দাসীদেরকে হালাল করেছি,যাদেরকে আল্লাহ আপনার করায়ত্ব করে দেন এবং বিবাহের জন্য বৈধ করেছি আপনার চাচাতো ভগ্নি, ফুফাতো ভগ্নি, মামাতো ভগ্নি, খালাতো ভগ্নিকে যারা আপনার সাথে হিজরত করেছে। কোন মুমিন নারী যদি নিজেকে নবীর কাছে সমর্পন করে, নবী তাকে বিবাহ করতে চাইলে সেও হালাল। এটা বিশেষ করে আপনারই জন্য-অন্য মুমিনদের জন্য নয়। আপনার অসুবিধা দূরীকরণের উদ্দেশে। মুমিনগণের স্ত্রী ও দাসীদের ব্যাপারে যা নির্ধারিত করেছি আমার জানা আছে। আল্লাহ ক্ষমাশীল,দয়ালু। [সূরা আহযাব ৩৩: ৫০]
মহানবি নারীলোভী হলে পঁচিশ বছরের টগবগে যৌবনকালে চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা (তৎকালের প্রেক্ষাপটে) মহিলা হযরত খাদিজাকে বিয়ে করতেন না, এবং ভরা যৌবনের শেষাব্ধি তার সাথেই অতিবাহিত করতেন না। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে এটাই যে, তিনি পঁচিশ বছর বয়সে চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা হযরত খাদিজাকে বিয়ে করে তার সাথে যৌবনের মূল সময় তথা পঞ্চাশতম বছর পর্যন্ত অতিবাহিত করেছিলেন। এরপর একান্নতম বছর থেকে শুরু করে জীবনের অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত তথা তেষট্টিতম বছর পর্যন্ত সময়ে (মোট তের বছর) বাকি স্ত্রীদেরকে বিয়ে করেছিলেন নানা ঘটনার প্রেক্ষাপটে। তারা আবার একজন তথা্ হযরত আয়েশা(র) ছাড়া সকলেই ছিলেন বিধবা। অনেকে ছিলেন বৃদ্ধা। অথচ তিনি হযরত যাবের বিন আব্দুল্লাহকে(র)সুগন্ধিযুক্ত ও সজীব চেহারার মেয়ে দেখে বিয়ে করেছেন কিনা প্রশ্নের উত্তরে বিধবা বিয়ের কথা শুনে কুমারী বিয়ে করা উচিৎ বলে মনোভাব প্রকাশ করে বলেন কুমারী বিয়ে বরলে না কেন? তাতে তোমরা দু’জনে মিলে আনন্দ করতে পারতে![বোখারী শরীফ-কিতাবুন নিকাহ-২-৭৬০]
এ হাদীসে মহানবী হযরত যাবেরকে(র) কুমারী বিয়ে করার দিকে ইশারা করেছেন। কুমারী বিয়ে করা কামনা পুরণের বড় উপায় জানা সত্ত্বেও তিনি বিধবা বিয়ে করতেন কি, যদি তিনি নারী লোভী হতেন!
এটাই ঐতিহাসিক সত্য যে, নবী কারীম (স) একাধিক বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন পবিত্র জীবনের পঞ্চাশটি বসন্ত কেটে যাওয়ার পর। তাহলে কি তিনি যৌবনের মূল সময় তথা পঞ্চাশতম বছর পর্যন্ত ছিলেন চরিত্রবান, আর জীবনের শেষ বয়সে এসে হয়ে গেলেন চরিত্রহীন? এটা কি কোন বিবেক প্রসূত কথা? অথচ তিনি চাইলে সে সময় মক্কার শ্রেষ্ট সুন্দরী আর ধনী কুমারীদের বিয়ে করতে পারতেন। অনেকেই তাকে এমন উপটৌকনও দিতে চেয়েছেন। যেমন-মক্কী জীবনে কাফিররা রাসূলুল্লাহকে(সঃ) বহুবারই বলেছিলো যে, ‘আপনি চাইলে আরবের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদেরকে আপনার সামনে নিয়ে এসে হাজির করি’। তখন রাসূলুল্লাহ(স) বলেছিলেন,- আমার এক হাতে সূর্য আর অপর হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি ইসলাম প্রচার থেকে একটুও পিছপা হবো না (ইনশাআল্লাহ)। সুন্দরী নারীদের প্রতি যদি রাসূলুল্লাহর(সঃ) লোভই থাকত (নাউযু বিল্লাহ), তাহলে রাসূলুল্লাহ(স) ঐ সময় মক্কার কাফিরদের কথা মেনে নিয়ে সুন্দরী নারীদের হস্তগত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি সে দিকে চোখ তুলেই তাকাননি; বরং নিজ দায়িত্বেই ছিলেন অটল্। এ থেকে কি প্রমানিত হয়?
বহু বিবাহে রাসূলুল্লাহর(স) ব্যক্তিগত নূন্যতম স্বার্থও ছিলো না; বরং তাতে কেবল দ্বীনের স্বার্থ সংরক্ষনই নিহিত ছিলো। তার এসব বিয়ের মাধ্যমে আরবের শ্রেষ্ট ও প্রভাবশালী গোত্র ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবিশেষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলে নব্য ইসলামকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। সেটা যুগের ও পরিস্থিতির চাহিদা ছিল। মহিলাদের নানা রীতিনীতি মহিলাদের মাঝে প্রচারও সহজ হয়েছে। ইসলাম ম্যানুয়ালী প্রসার লাভ করেছে, কোন ভেল্কিবাজি বা তন্ত্র মন্ত্রের মাধ্যমে নয়। মহানবির বহু বিবাহ করা দরকার ছিল সেজন্যেই তিনি তা করেছেন। এর দ্বারা অনৈতিকতা হয়েছে বলে যারা মনে করেন, তারা সাদা চোখে সেটা বিশ্লেষন করেন না বা সেই সময়টাকেও বুঝতে চান না। কাজেই তাদের নৈতিকতা আর ইসলামের নৈতিকতা এক করে চিন্তা করাটা বোকামী বৈ আর কিছু নয়।
পাঠক, এতক্ষনে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, মহানবি বহু বিবাহ এবং পালকপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে বিয়ে করেছিলেন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। এসব ঘটনা একেবারেই সাদামাটা। বিশেষতঃ ঐ যুগ এবং ঘটনার প্রেক্ষাপটে।
আল্লাহপাক তার বানী প্রচারের জন্যে যাকে বেছে নিয়েছেন, তার জন্যে নিয়ম বা শরিয়ত অবশ্যই কিছুটা ব্যতিক্রমী নির্ধারন করেছেন। সেই যুগে তিনি শত শত বছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গে দিলেও ঈমানদাররা তাকে আঁকড়ে ছিলেন, বিভ্রান্ত হননি। কাজেই ইসলাম বিদ্বেষীরা প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে তাবারি আর ওয়াকেদীর মিথ্যা বর্ণনার সাথে বুখারি মুসলিমের কিছু দূর্বল হাদিস কোড করে রং চং দিয়ে নানা কল্পকাহিনী ফেঁদে অন-লাইন ও প্রচার জগতে বগল দাবালেও, ঈমানদাররা বিভ্রান্ত হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
তথ্য সুত্র: তাবারি, ইবনে ইসহাক, ইবনে হিশামের সীরাতে রাসুলুল্লাহ গ্রন্থ, ইদ্রিস কান্ধলভীর সীরাতে মুস্তফা, সদালাপ ও সামহোয়াইন ব্লগসহ অনলাইনে প্রকাশিত প্রবন্ধ নিবন্ধ।
[চরম ইসলাম বিদ্বেষী সাইট http://www.islam-watch.org -এ প্রকাশিত Mumin Salih-এর লেখা Zaynab and the Beast: Zaynab’s Divine Marriage to Muhammad & Zaid’s Life-shattering Loss-শিরোনামের নিবন্ধটির অনুকরনে বাংলার নাস্তিকদের নানা কুরুচিপূর্ণ প্রবন্ধ নিবন্ধ ও সদ্য নাস্তিক মুফতি আবদুল্লাহ মাসুদের বিদ্বেষপূর্ন ভিডিও জবাবে লেখা]
আরো বিস্তারিত: www.anwarali.net
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:২৯