আগের পর্বে ইসলামে দাসপ্রথা নিয়ে কিঞ্চিত আলোচনা করেছি।
নিজ স্ত্রীর সাথে যেমন, ঠিক তেমনি যুদ্ধবন্দি দাসীদের সাথে সেক্স করা ইসলামে বৈধ। তবে সেক্ষেত্রেও প্রচুর নিয়ম বিধি রয়েছে।
মহানবির মৃত্যুর ১০০ বৎসরের মধ্যে ইবনে ইসহাকের লেখা সীরাতগ্রন্থ, হাদীসগ্রন্থ এবং পরবর্তী কোন গ্রন্থেও এমন এটি কথাও নেই যে, যুদ্ধ বন্দিদের ধর্ষন করা হয়েছে। হ্যা এটা ঠিক যে যুদ্ধবন্দিদের দাসীতে পরিণত করা হতো। কেননা তৎকালে কোন কারাগার ছিল না। নারী যুদ্ধবন্দিদের দাসীতে পরিণত করে তাদের সাথে সেক্স করা বৈধ ছিল। বিয়ের প্রয়োজন হতো না, কেননা দাসীর সাথে সেটা করা একটা অলিখিত কন্ট্রাক্টই বলা যায়। আজকের যুগে যেমনটা কল্পনা করা হয়, সে যুগটা আদপেই সেরকম ছিল না। তৎকালে নারীরাও যোদ্ধা ছিল। তারা এটাও জানতো যুদ্ধে হারলে বা বন্দি হলে দাসীতে পরিণত হতে হবে।
ইতিহাসবিদ স্যামুয়েল বার্ডার লেখেন- প্রাচীনকালে যেসব নারীরা তাদের পিতা কিংবা স্বামীর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতো, তারা খুব সুন্দর জামা আর অলঙ্কার পড়তো। যাতে বন্দী হলে তারা বিজিতের দৃষ্টি খুব সহজেই কাড়তে পারে।[Oriental Customs Or, an Illustration of the Sacred Scripture, Williams and Smith, London, 1807 vol.2 p.79, no. 753]
ক্রীতদাসি ও যুদ্ধবন্দিনী সংক্রান্ত কিছু কুরআনের আয়াতঃ
তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। [প্রাসঙ্গিক অংশ, ২৪:৩৩]
আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বাধীন মুসলমান নারীকে বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে না, সে তোমাদের অধিকারভুক্ত মুসলিম ক্রীতদাসীদেরকে বিয়ে করবে। আল্লাহ তোমাদের ঈমান সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞাত রয়েছেন। তোমরা পরস্পর এক, অতএব, তাদেরকে তাদের মালিকের অনুমতিক্রমে বিয়ে কর এবং নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে মোহরানা প্রদান কর এমতাবস্থায় যে, তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে-ব্যভিচারিণী কিংবা উপ-পতি গ্রহণকারিণী হবে না। [প্রাসঙ্গিক অংশ, ৪:২৫]
তবে তাদের স্ত্রী ও ডান হাতের মালিকানাভুক্তদের (দাসীদের) ক্ষেত্রে [যৌনাঙ্গকে] সংযত না রাখলে তারা তিরস্কৃত হবে না। [প্রাসঙ্গিক অংশ২৩:৬]
তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। [প্রাসঙ্গিক অংশ, ২৪:৩২]
সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদিসঃ
ইসহাক ইবনু ইবরাহীম (রহঃ) ... আবূ মূসা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কারো যদি একটি বাঁদী থাকে আর সে তাকে প্রতিপালন করে, তার সাথে ভাল আচরণ করে এবং তাকে মুক্তি দিয়ে বিয়ে করে, তাহলে সে দ্বিগুন সাওয়াব লাভ করবে।(সহি বুখারী-২৩৭৬)
আবু সাঈদ আল খুদরি (রা.) আওতাসে ধৃত যুদ্ধবন্দিদের সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিম্নোক্ত এরশাদ বর্ণনা করেন: গর্ভবতী নারীর সাথে সঙ্গম করো না যতক্ষণ না সে সন্তান প্রসব করে এবং যে নারী গর্ভবতী নয় তার সাথে (সঙ্গম) করো না যতক্ষণ না তার একটি ঋতুচক্র সম্পন্ন হয়। [ সূত্র: সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ২১৫৭ ]
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যখন কোন ব্যক্তির ক্রীতদাসি তার সন্তান ধারণ করে, সে তার(মুনিবের) মৃত্যুর পর স্বাধীন হয়ে যায়।” [সূত্র: তিরমিযি, হাদিস নং- ৩৩৯৪]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমরা তোমাদের সন্তান গর্ভধারিণী ক্রীতদাসিকে বিক্রয় করো না।” [তাবারানি’র মু’যাম আল কাবির, হাদিস নং-৪১৪৭]
কোরআন ও হাদিসের আয়াতগুলো সুষ্পষ্ট। ইসলাম গ্রহন করলেই কাউকে আর দাসী বানানো যাবে না। দাসীদের বিয়ে করতে বলা হয়েছে, শর্তসাপেক্ষে কৃত দাসীর সাথে সহবাসের কথা বলা হয়েছে। দাসীদের যৌন চাহিদা মেটানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক রাখা ফরয, কিন্তু দাসীর সাথে তা করা ফরয তো নয়ই, কোন কিছুই নয়, তবে যায়েজ। কেননা যাদের দাসী বাসানো হয়েছিল, তারা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল।
দাসীকে বিয়ে করা সুন্নাহ। দাসীর গর্ভের সন্তান আর স্ত্রী গর্ভের সন্তান একই মর্যাদার। দাসী গর্ভবতী হওয়ার সাথে সাথে তাকে বিক্রয় করা নিষিদ্ধ। দাসীদের কোনরকম ব্যভিচারে নিয়োজিত করা যাবে না। বন্দি দাসীর সাথে অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচারকে ইসলাম নিষিদ্ধ করেছে। বন্দিকে কোনভাবেই ধর্ষণ করা যাবে না। ইসলাম ধীরে ধীরে সমস্ত আইন কানুন প্রণয়ন করেছে। ইসলামী আইনের কারনে দাস প্রথা বিলুপ্ত হতে খুব বেশী সময় লাগেনি, উমাইয়া বংশের সময়েই এই প্রথা ইসলামী বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
স্ত্রীর সাথে চুক্তি থাকার কারনে তার সাথে সেক্স করা যায়, ঠিক তেমনি দাসীর সাথেও থাকে অলিখিত চুক্তি। তাদের সাথেও সেক্স করা যায়। স্ত্রীর সাথে সেক্স করা যেমন ধর্ষন নয়, তেমনি দাসীর সাথে।
এমন কোন গ্রন্থ বা প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না যে, মহানবি আমলে কোন যুদ্ধবন্দিকে ধর্ষন করা হয়েছে। সেই আমলেও অনেক মুনাফিক এবং নবি বিদ্বেষীরা এ সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেছেন, নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। মহানবির মৃত্যুর শত বৎসর পর সীরাতের নামে এবং হাদিসের নামে (অমুক তমুকের থেকে, তমুক তমুকের থেকে, তিনি আবার আরেক তমুকের থেকে) শুনে শুনে অনেক কল্পকাহিনী লিখা হয়েছে। তাদের সেই আধা সত্য আধা মিথ্যার কল্প কাহিনীতে ধর্ষনের অভিযোগ না থাকলেও, নব্য নাস্তিকেরা ধর্ষণের আলামত আবিস্কার করে বাজিমাৎ করে ফেলেছেন। এর জন্যে তারা বুখারীর হাদিস এবং তাবারির সীরাতগ্রন্থকে প্রমাণ হিসাবে হাজির করছেন। মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ নামীয় এক নব্য নাস্তিক এবং মুফাস্সিল ইসলাম নামীয় আরেক আধপাগলা বয়স্ক নাস্তিক ইদানীং সত্যমিথ্যার আশ্রয়ে নানা কল্পকাহিনী ফেঁদে মানুষের ঈমান-আকিদায় আঘাত হানার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রসঙ্গক্রমে তার খানিকটা আজকে আলোচনা করা যায়। এইসব নাস্তিকেরা বনু কুরাইযা অভিযানে সাফিয়া (র)কে ঐদিনই বিয়ে করে ধর্ষন করেছিলেন মর্মে ইতিহাস শেখান আদি গ্রন্থ ইবনে ইসহাক থেকে। আমরাও এখানে সেই ইবনে ইসহাক থেকেই হুবহু ঘটনা তুলে ধরবো। বনু কুরাইজা অভিযানে সাফিয়াকে নয়, মহানবি বন্দি করে দাসী করেছিলেন রায়হানা বিনতে আমর বিন খুনাফা নামীয় কুরাইযা নারীকে। তিনি আমৃত্য তার কর্তৃত্বাধীনে ছিলেন। [দেখুন, ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলুল্লাহ (স), ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশনীর, পৃষ্ঠা-৫০৬]
এবার আসি সাফিয়ার কথায়। ‘খাইবার অথবা পথিমধ্যে রাসুল (স) সাফিয়াকে বিয়ে করলেন। সাফিয়া ছিলেন পরমা সুন্দরী। আনাস ইবনে মালিকের মা উম্মে সুলায়ম বিনতে মিলহান তার কেশ চর্চা সহ সাজিয়ে দিয়েছিল। তার তাবুতে রাসুল রাত্রি যাপন করলেন। বনু আল নাজ্জারের ভাই আবু আইউব খালিদ ইবনে জায়েদ কটিতে তরবারি ঝুলিয়ে সারারাত জেগে তাবুর চারিদিক পাহারা দিলেন। সকালে রাসুল (স) তাকে দেখে তার এহেন আচরণের হেতু জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘ এই মহিলার বাবা, স্বামী, আত্মীয়-কুটম্ব সবাইকে আপনি হত্যা করেছেন। এই কয়দিন আগেও সে অবিশ্বাসী ছিল। ওকে নিয়ে আমার ভয় ছিল।’ [দেখুন, ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলুল্লাহ (স), ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশনীর, পৃষ্ঠা-৫৫৮]
যদিও ইবনে ইসহাক সবকিছু শুনে শুনে এসব কাহিনী লিখেছিলেন, তা-ও মহানবির ওফাতের ১০০ বৎসর পর। ১০০ বৎসর পর কেউ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কি ইতিহাস লিখতে পারেন একটু ভেবে দেখুন। আবার সেই লেখক যদি রাজাকার পরিবারের কেউ হয়। পুথিবীতে একমাত্র কোরআনই সাথে সাথে লিখে রাখা হয়েছিল। মহানবির সময়ে আর কিছুই লিখে রাখা ছিল না। অমুক তমুকের থেকে, তমুক তমুকের থেকে শুনেছেন মর্মে নানা কিচ্ছা কাহিনী লিখা হয়েছে শতাধিক বৎসর পর। তথাপি নাস্তিকেরা এবং অভিযোগকারিরা যেহেতু এইসব গ্রন্থকেই অথেনটিক মনে করেন তাই সেই গ্রন্থ থেকেই হুবহু তুলে ধরলাম। এখানে খেয়াল করুন, আবু আইউব খালিদ ইবনে জায়েদ বলেছিলেন, ‘এই কয়দিন আগেও সে অবিশ্বাসী ছিল।’ তার মানে তখন সাফিয়া বিশ্বাসী তথা মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন। ‘কয়দিন আগে’ বলতে কি ঐদিনই বুঝায়? মিথ্যাবাদীরা চাতুর্য্যের সাথে মিথ্যা বর্ণনা করে মানুষকে ধোঁকা দেবার এমন কৌশল ফেঁদেছেন যে, কিছু মানুষ আগপিছ যাচাই না করেই এইসব ছাইপাশ বিশ্বাস করে ঈমানহারা হচ্ছেন। বিশ্বাসী নামের কতেক মুনাফিকের বর্ণনা কিম্বা অবিশ্বাসীদের লেখা এমন কোন গ্রন্থও তারা দেখাতে পারবেন না, যাতে মহানবি কোন যুদ্ধবিন্দকে ধর্ষন তো দুরের কথা, সামান্যতম খারাপ ব্যবহারও করেছেন। যুদ্ধের ময়দান তো যুদ্ধের ময়দানই। সেখানে কেউ কাউকে ছাড় দেন না। সামান্যতম ছাড় দিলেও কল্লা ধর থেকে আলাদা হয়ে মাটিতে পড়তে থাকে। সেই যুগটা এবং সে সময়ের পরিস্থিতিটা আগে বুঝতে হবে। নাহলে বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
নাস্তিক মুফাস্সিল ইসলাম ও নব্য নাস্তিক মুফতি আবদুল্লাহ আল মাসুদ ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক ও তাবারির বর্ণনার সামান্য এদিক সেদিক করে তিলকে তালে পরিণত করছেন, প্রকৃত ঘটনার সাথে যার দুর দুরতম কোন সম্পর্কও নেই।
তথ্য সুত্র: সিরাতে ইবনে ইসহাক এবং তা হতে সম্পাদিত সিরাতে ইবনে হিশাম, আল তাবারি রচিত “সিরাতে রাসুলাল্লাহ” ও অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধ থেকে সংকলিত।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:৪৩