দুনিয়ার সবচাইতে ঘৃণ্য একটি প্রথা হলো দাসপ্রথা। বরাবরের মতই ইসলামপূর্ব জাহিলিয়াত যুগেও এই প্রথা আরবে ভালভাবেই প্রচলিত ছিল। প্রাচীন রোম কিম্বা গ্রীস, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সব জায়গায় একই দৃশ্য বিরাজমান ছিল। হাটে বাজারে গরু ছাগলের মত দাস দাসী বেচাকেনা হতো। আরবের সাধারণ পরিবারেও কয়েকটা করে দাসদাসী থাকতো। খাদিজার (রা) মত ব্যতিক্রমী বিত্তবান ব্যবসায়ী মহিলা সেযুগে হাতেগোনা কয়েকজন ছিলেন মাত্র। শুধুমাত্র একজন খাদিজা (রা) বা একজন দাস বা দাসী দিয়ে সে যুগকে বোঝা যাবে না। কেননা ব্যতিক্রম সর্বকালে সবখানেই থাকে এবং ছিল। ইবনে ইসহাক কিম্বা ইবনে হিশাম যখন ইতিহাস রচনা করেন, সে সময় তারা দাসপ্রথাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবেই ধরে নিয়েছেন, কেননা ঐ সময়ে দাসপ্রথা সহনীয় পর্যায়ে চলে এলেও একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি।
মহানবী যখন ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে নানা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তখন যুদ্ধ জয়ের পর প্রচুর যোদ্ধা ও তাদের পরিবার পরিজনরা যুদ্ধবন্দী হিসাবে বন্দী হতেন। এই যুদ্ধ বন্দীরা দাসদাসী হিসাবে বন্টিত হতো। এর মুল কারণ ছিল, ঐ যুগে একালের মত কোন জেলখানা বা কারাগার ছিল না। এদেরকে দাসদাসী হিসাবেই নব্য মুসলমানেরা ভাগ করে নিয়ে গিয়ে তাদের অধীনে রাখতেন। আজকের যুগের মানসিকতা দিয়ে সেযুগকে বিচার করা যাবে না। দাসকে দিয়ে নানা কাজ করানো হতো। দাসীর সাথে সেক্স করা যেতো, এর জন্যে বিয়ে করার কোন প্রয়োজন হতো না। কেননা দাসীদের সাথে সেরকম একটা অলিখিত কন্ট্রাক্ট বিদ্যমান ছিলই। দাসী মানেই তা বোঝাতো। এটা বংশপরম্পরায় চলে আসছিলো।
মহানবির আমলে দাসপ্রথা চালু থাকার বিষয়টা ইসলাম বিদ্বেষীদের টপ লিষ্টেট হট ইস্যু। কিন্তু ইসলামে দাসপ্রথা-এই টার্মটাই কি ভুল নয়? ইসলাম কি দাসপ্রথার সৃষ্টি করেছে? নাকি দাসপ্রথাকে উৎসাহিত করেছে? দাসপ্রথাকে ফরজ, ওয়াযিব, সুন্নত, নফল বা মোস্তাহাব বা এই জাতীয় কোন কিছুর অন্তর্ভূক্ত করেছে? প্রকৃত সত্য হলো এর কোনটাই নয়। সমসাময়িক বিশ্বে তো বটেই, ব্যতিক্রম বাদে বিংশ শতাব্দির শেষ দিকেও পৃথিবীর কতেক সভ্য দেশেও দাসপ্রথার প্রচলন ছিল।
হাজার বছর ধরে চলে আসা এই প্রথা মহানবির আমলের অনেক আগে থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। মহানবির সময়ে ইসলাম ব্যতীত অন্য সব স্থানে দাসমুক্তির পরিমাণ ছিল শূণ্যের কোঠায়। কেননা দাসপ্রথার বিলুপ্তি মানেই তো চরম লোকসান। ইসলামই সর্বপ্রথম দাস মুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছে। ইসলামের কোথাও বলা নেই যে, যারা যুদ্ধে বন্দি হবে তাদের দাস দাসী বানিয়ে রাখতে হবে। মহানবির আমলে আজকের যুগের মত কোন কারাগার ছিল না। তাই যুদ্ধ বন্দীদের দাস দাসীতে পরিণত করে তাদের ভরন পোষন যেমন করা হতো, তেমনি তাদের সার্বিক দেখভালও করা হতো। সেটা পরিস্থিতির আলোকে খুবই স্বাভাবিক ছিল। আর কোরআন হাদীসের ভাষ্য এমনই ছিল যে, পান থেকে চুন খসলেই দাস দাসী মুক্ত করে দেয়া বাধ্যতামূলক। এ কারনে পরবর্তীকালে দেখা যায় যুদ্ধে বন্দি হলেই তাদের দাসে পরিণত করা হয়নি। খলিফা ওমর সিরিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ক ইত্যাদি দেশ জয় করেছিলেন। কিন্তু সেসব দেশের প্রজাদের কাউকেই দাস দাসী বানাননি। উল্টো দাস মুক্ত করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কোন স্বাধীন ব্যক্তির ক্রয় বিক্রয় ইসলামে সরাসরি নিষিদ্ধ। কোরআনে দাস মুক্তির কথা থাকায় নতুন করে দাসপ্রথা চালু রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কিন্তু প্রকৃত সত্যকে আড়াল করে যুগে যুগে ইসলাম বিদ্বেষীরা এ নিয়ে নানা হৈচৈ করেছেন। অথচ ইসলাম দাসপ্রথাকে জন্মও দেয়নি, উৎসাহিতও করেনি। বরং এটাকে চিরতরে উৎপাটনের ব্যবস্থা করেছে। মদকে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল মহানবির মৃত্যুর মাত্র তিন বৎসর আগে। ইসলাম ধীরে ধীরে তা নিষিদ্ধ করার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। ইসলামের শাশ্বত নিয়মও এটাই। মদকে ইসলাম নিষিদ্ধ করে দিতে পারলেও ঐ সময়ে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করা সম্ভব ছিল না এই কারনে যে, ঐ সময়ে গোত্র ভিত্তিক সমাজের অর্থনীতির ভিত্তি এই দাসপ্রথার উপর নির্ভর ছিল। এটা বন্ধ করে দিলে সমাজের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যেতো। অর্থনীতি ছাড়াও সামাজিক ও রাজনৈতিক কারন তো ছিলই। মুসলমানেরা যুদ্ধে বন্দি হলে অন্যরাও তাদের দাস বানিয়ে রাখতো। শত্রুপক্ষ থেকে এমন কোন নিশ্চয়তা ছিল না যে, মুসলমানেরা বন্দি হলে তাদের দাস বানানো হবে না। মুসলমানদের মুক্ত করতে হলে দাস ক্রয় করতে হবে, আর ক্রয় যদি যায়েয হয়, তাহলে বিক্রয়কেও যায়েয রাখতেই হতো। কাজেই রাজনৈতিক ও সামরিক কারনেও দাস প্রথা বন্ধ করা বাস্তবসম্মত ছিল না। তবে ভবিষ্যতে দাসপ্রথা বন্ধ করার সমস্ত আয়োজনই ইসলাম করে রেখেছে। যুদ্ধবন্দিদের ব্যবস্থাপনা যখন ক্ষুদ্র জনগোষ্টি থেকে রাষ্ট্রের হাতে চলে যায়, তখন রাষ্ট্রই তার ব্যবস্থা করে। ব্যক্তি বা গোষ্টি পর্যায়ের দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে যায়।
যে কয়টি কারনে মানুষকে দাসে পরিণত করা হতো তা ছিল-
১। অভাবের তাড়নায় পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের বিক্রী করে দাস-দাসীতে পরিণত করতো।
২। ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে দাসে পরিণত হতো।
৩। অভাবী লোকেরা অভাবের তাড়নায় ধনী ব্যক্তিদের দাস-দাসীতে পরিণত হয়ে যেতো।
৪। শক্তিশালীরা অপহরনের মাধ্যমে কাউকে বন্দি করে দাস-দাসীতে পরিণত করতো।
৫। যুদ্ধ-বিগ্রহের মাধ্যমে বন্দিরা দাস-দাসীতে পরিণত হতো।
ইসলাম এসে কেবলমাত্র যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে বন্দিদের দাসে পরিণত করার বিধানটি চালু রেখে বাকি সবগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আবার সেই যুদ্ধ বিগ্রহও কিন্তু ইসলামকে রক্ষার জন্যে শরীয়ত সম্মত যুদ্ধ। ইসলামী জেহাদ যে কয়টি উদ্দেশ্যে করা হয়, তাহলো,
১। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা জন্যে।
২। আগ্রাসন রোধের জন্য ( আল-কোরআন,২:১৯০)
৩। মজলুম মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সাহায্য করার জন্যে। (আল-কোরআন, ৪:৭৫)
৪। তাগুত অথবা জালিমের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর জন্যে (আল-কোরআন, ৪:৭৬)
৫। ফিতনা দূরীভূত করা এবং দ্বীনকে পরিপূর্ণ করার জন্যে (আল-কোরআন,৮: ৩৯)
ইসলামে দাসপ্রথাটা চালু রয়েছে মুলতঃ যুদ্ধ বন্দি থেকে।যুদ্ধ বন্দিদের সম্পর্কে ইসলামের বিধান হলো,
১। বন্দীকে দাস-দাসী বানানো যাবে।
২। বন্দিকে অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া যাবে।
৩। বন্দিরা ঈমান আনলে তাদের মুক্ত করে দিতে হবে।
দাস প্রথা সংক্রান্তে কোরআনের কিছু আয়াত তুলে ধরছি এ থেকেই আপনারা দাসপ্রথা বিষয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারবেন।
অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান- এতীম আত্মীয়কে অথবা ধুলি-ধুসরিত মিসকীনকে, অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার। [৯০:১১-১৭]
যাকাত (সদকা) হচ্ছে ফকির মিছকিনদের জন্যে, এর উপর নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্যে, যাদের অন্তকরন (দ্বীনের প্রতি) অনুরাগী (করা প্রয়োজন) তাদের জন্যে, (এটা কোন ব্যক্তিকে) দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করার মধ্যে, ঋণগ্রস্থ ব্যক্তিদের (ঋণ মুক্তির) মধ্যে, আল্লাহতালার পথে (সংগ্রামী) ও মোসাফিরদের জন্যে (এ অর্থ ব্যয় করা যাবে); এটা আল্লাহতালার নির্ধারিত ফরয; নিঃসন্দেহে আল্লাহতালা (সবকিছু) জানেন এবং তিনিই হচ্ছেন বিজ্ঞ, কুশলী। [৯: ৬০]
তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। [২৪:৩২]
যাদের বিয়ে করার সামর্থ নেই, আল্লাহতালা তাদের নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে; তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস দাসীদের ভেতর যারা (মুক্তির কোন অগ্রিম লিখিত) চুক্তি লিখিয়ে নিতে চায় তোমরা তাদের তা লিখে দাও যদি তোমরা তাদের মধ্যে কোন ভাল (সম্ভাবনা) বুঝতে পারো, (তাহলে) আল্লাহতালা তোমাদের যে সম্পদ দান করেছেন তা থেকে তাদের মুক্তির সময় (মুক্তহস্তে) দান করবে; তোমাদের দাসীদের যারা সতী সাধ্বি থাকতে চায় নিছক পার্থিব ধন সম্পদের আশায় কখনো তাদের ব্যভিচারের জন্যে বাধ্য করো না; যদি তোমাদের মধ্যে কেউ তাদের (এ ব্যাপারে) বাধ্য করে তারা যেন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। [২৪: ৩৩]
যারা তাদের স্ত্রীদের সাথে ‘যেহার’ করে, অতপর (অনুতপ্ত হয়ে) যা কিছু বলে ফেলেছে তা থেকে ফিরে আসতে চায় (তাদের জন্যে বিধান হচ্ছে) তাদের একে অপরকে স্পর্শ করার পূর্বে একটি একজন দাসের মুক্তি দান করা। [৫৮:৩]
কসম করলে তার কাফফারা হিসেবে দাস মুক্ত করে দাও। [৫:৮৯]
অনিচ্ছাকৃত হত্যাকান্ডের জন্যে ক্ষতিপুরন স্বরূপ নিহতের পরিবারকে রক্তমূল্য পরিশোধ করো এবং দাস মুক্ত করে দাও। [৪:৯২]
দাস-দাসি নিজের সমান হয়ে যাবে এমন আশঙ্কায় যারা তাদের দান করা থেকে বিরত থাকে তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। [১৬:৭১]
সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক আর মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। [২:১৭৭]
‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোন কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না; এবং পিতামাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম অভাবগ্রস্থ, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকার ভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয় আল্লাহ্ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।” [৪ :৩৬]
কোরআনের এইসব আয়াতকে সাপোর্ট করে এমন কিছু হাদিস, যা সহি হিসাবে স্বীকৃত তার কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো,
আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত:
নবী(সা) বলেছেন, আল্লাহ[তায়ালা] বলেন:
আমি কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরূদ্ধে হবো, (১) যে আমার নামে শপথ করে অত:পর বিশ্বাসঘাতকতা করে,
(২) যে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে (ক্রীতদাস হিসেবে) বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে, (৩) যে কোন মজুরকে নিযুক্ত করে তার থেকে পরিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করে অথচ তার পারশ্রমিক প্রদান করে না। [সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২২২৭; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৩৪, নম্বর ৪৩০; http://sunnah.com/urn/20920]
আল-মা’রুর বিন সুওয়াইদ(রা.) হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন:
তোমাদের দাসেরা তোমারদের ভাই যাদের ওপর আল্লাহ তোমাদের ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই কারো নিয়ন্ত্রণে যদি তার ভাই থাকে, তবে সে যা খাবে তাকেও তাই খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তাই পরাবে। তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপাবে না যা তারা বহন করতে অক্ষম। যদি তা করো, তবে তাদেরকে সাহায্য কর।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৪৫ (প্রাসঙ্গিক অংশ); ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২১; http://sunnah.com/bukhari/49#2]
সামুরাহ(রা.) হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন: যদি কেউ তার ক্রীতদাসকে হত্যা করে আমরা তাঁকে হত্যা করবো, আর কেউ যদি তার ক্রীতদাসের নাক কেটে দেয়, আমরাও তার নাক কেটে দেবো।
[সুনান আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪৫১৫; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ৩৯, নম্বর ৪৫০১; http://sunnah.com/abudawud/41#22]
আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত: আমি আবুল ক্বসিম (সা)কে বলতে শুনেছি, কেউ যদি তার ক্রীতদাসকে অপবাদ দেয় আর সেই ক্রীতদাস যদি সে যা বলছে তা হতে মুক্ত হয়, তবে তাকে (অপবাদ আরোপকারিকে) কিয়ামতের দিনে বেত্রাঘাত করা হতে থাকবে যতক্ষণ না সেই ক্রীতদাস তাই হয় যা সে বর্ণনা করেছে।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৯৪৩, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৮, বুক ৮২, নম্বর ৮৪১; http://sunnah.com/urn/64520]
মুআবিয়া বিন সুওয়াইদ হতে বর্ণিত: আমি আমাদের এক ক্রীতদাসকে চপেটাঘাত করি, অত:পর পলায়ন করি। আমি ঠিক মধ্যাহ্নের আগে ফিরে এলাম এবং আমার পিতার পেছনে সালাত আদায় করলাম। তিনি তাকে (ঐ ক্রীতদাসকে) এবং আমাকে ডাকলেন এবং বললেন: সে তোমার প্রতি যা করেছে, তুমিও তেমন করো. সে [ক্রীতদাস] আমাকে মাফ করে দিল। তখন তিনি (আমার পিতা) বললেন, রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশায় আমরা মুকাররিনের পরিবারভুক্ত ছিলাম এবং আমাদের একজন মাত্র ক্রীতদাসি ছিল। আমাদের একজন তাকে চড় মারলো। এই খবর রাসূলুল্লাহ(সা) এর কাছে পৌঁছল এবং তিনি বললেন: তাকে মুক্ত করে দাও। তারা (পরিবারের লোকজন) বললেন: সে ছাড়া আমাদের আর কোন সাহায্যকারি নেই। কাজেই তিনি বললেন: তাহলে তাকে কাজে নিযুক্ত করো, আর যখনই তোমরা তাকে কাজ হতে অব্যাহতি দিতে সমর্থ হও, তাকে মুক্ত করে দাও।
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৪৩৯১; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৫, নম্বর ৪০৮১; http://sunnah.com/urn/240810]
আবু মুসা(রা.) হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন:
যার একটি ক্রীসদাসি আছে আর সে তাকে শিক্ষাদীক্ষা দান করে, তার সাথে সদয় ব্যবহার করে, অত:পর তাকে মুক্ত করে বিবাহ করে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৮৪; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি. ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২০; http://sunnah.com/urn/23840]
ইসলামে দাসও আমীর হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাকে মান্য করা সকলের জন্য জরুরি। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭২২৯; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৯, নম্বর ২৫৬; http://sunnah.com/urn/67120]
কোন মুনিব তার ক্রীতদাসির সাথে আলোচনা না করে তাকে কারো সাথে বিবাহ দিতে পারবে না। [দ্রষ্টব্য: বুখারি, হাদিস নম্বর ৭০৫৬; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৬, নম্বর ১০০; http://sunnah.com/urn/65560]
কোন ক্রীতদাসীকে ভিন্ন কোথাও বিক্রি করে তার থেকে তার শিশুকে বিচ্ছিন্ন করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই, এবং এই ধরণের বেচাকেনা নিষিদ্ধ। [দ্রষ্টব্য: সুনান আবু দাউদ, ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৪, নম্বর ২৬৯০]
ইসলামে একজন দাসের ধর্মীয় মর্যাদা একজন স্বাধীন মুসলিমের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি। কেননা, যদি কোন দাস তার মালিকের প্রতি সৎ এবং বিশ্বস্ত থাকে এবং তার প্রভুর (আল্লাহর) ইবাদতও যথাযথভাবে করে তবে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২২]
মালিকের অধিক পছন্দনীয় এবং অধিক দামী দাস-দাসীর মুক্তিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবে কম থাকে। তাই ঘোষণা করা হয়েছে যে, সর্বোত্তম দাসমুক্তি হচ্ছে সবচেয়ে দামী এবং মালিকের অধিক পছন্দনীয় দাসকে মুক্ত করা। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৪]
কোন ক্রীতদাস যদি একাধিক মালিকের আয়ত্বাধীনে থাকে এবং কোন একজন মালিক তার অংশ হতে ঐ দাসকে মুক্ত করে দেয় তবে উক্ত মালিকের জন্য ঐ ক্রীতদাসকে অপর অংশীদারদের হতেও মুক্ত করে দেওয়াকে জরুরী করে দেওয়া হয়েছে। মালিক তাতে অসমর্থ হলে, উক্ত ক্রীতদাসকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করার নিমিত্তে কাজ করার অনুমতি দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি. ৩, বুক ৪৪, নম্বর ৬৭২]
সাহাবী আবু মাসউদ (রা.) একবার এক দাসকে প্রহার করছিলেন। হঠাৎ পিছন থেকে একটি কণ্ঠ বলে উঠলো, “হে আবু মাসউদ! মনে রেখো তোমার এই দাসের উপর যতোটা না কর্তৃত্ব রয়েছে, আল্লাহ্র তোমার উপরে তার চেয়ে অনেক বেশী কর্তৃত্ব রয়েছে।” আবু মাসউদ (রা.) পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন কণ্ঠটি রাসূল (সা.) এর। তিনি ভীত হয়ে বললেন, “আমি আল্লাহ্র জন্য তাকে মুক্ত করে দিলাম।” তখন রাসূল (সা.) বললেন, “তুমি যদি তা না করতে তবে জাহান্নামের আগুন তোমার জন্য উন্মুক্ত হয়ে যেতো।”[ সহীহ মুসলিম, হাদীস নংঃ ৪০৮৮]
আল্লাহর রাসূল সাঃ বলেন, তোমাদের দাস-দাসীরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে তোমাদের অধীন করেছেন। কাজেই কারো ভাই যদি তার অধীনে থাকে তা হলে সে যা খায় তা হতে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে তা হতে যেন পরিধান করতে দেয়। তাদেরকে সাধ্যাতীত কোন কাজে বাধ্য করবে না। যদি তোমরা তাদেরকে তাদের সাধ্যের বাইরে কোন কাজ দাও, তাহলে তাদেরকে তোমরা সহযোগিতা করো।’ [ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৬]
হযরত আবু হুরাইরা (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘দাস-দাসীদের জন্য যথাযথভাবে খানা পিনা ও পোশাক পরিচ্ছেদের ব্যবস্থা করা মনিবের একান্ত কর্তব্য। এবং তার সাধ্যতীত কোন কাজের জন্য তাকে কষ্ট দেওয়া যাবে না।’ [ইমাম বুখারী, আস-সহীহ, ২৫তম খণ্ড, পৃ. ৫২]
রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন, ‘যখন তোমাদের কোন গোলাম কিছু রান্না করে তার মনিবের কাছে নিয়ে আসে যার তাপ ও ধোঁয়া সে সহ্য করেছে, তখন তার উচিত হবে সেই গোলামকে কাছে বসিয়ে তা থেকে কিছু খাদ্য প্রদান করা। আর যদি খাদ্যের পরিমাণ কম হয়, তাহলে সে যেন তার হাতে এক গ্রাস অথবা দুই গ্রাস খাবার প্রদান করে।’ [ইমাম মুসলিম, আস্-সহীহ, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৯০]
একবার এক সাহাবী এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমার দাসকে প্রতিদিন কতবার মাফ করবো? উত্তর এলো, প্রতিদিন ৭০ টা ভুল মাফ করবে। [বুখারী, ই,ফা, ৪র্থ খন্ড, হাদিস নং-২৩৮৪]
এবার আসুন আদি গ্রন্থ ইবনে ইসহাকে দাসপ্রথার কি বর্ণনা রয়েছে তা একটু দেখি-
‘ বনু আদি ইবনে কাব গোত্রের বনু মুয়াম্মিলের এক ক্রীতদাসী মুসলমান হয়েছিল। ওদিক দিয়ে আবু বকর (রা) যাচ্ছিলেন। ইসলাম ত্যাগ করার জন্যে উমর-বিন-আল-খাত্তাব (রা) শাস্তি দিচ্ছিলেন তাকে। উমর তখন বহু-ঈশ্বরবাদী। মেয়েটাকে মারতে মারতে নিজেই ক্লান্ত হয়ে গেলেন। বললেন, ‘তোমাকে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে গেছি বলে তোমাকে রেহাই দিলাম।’ মেয়েটা বলল, আল্লাহ যেন আপনাকে ঠিক এমনি করে শাস্তি দেন।’ আবু বকর (রা) তখনই তাকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দিলেন। আপন পরিবার সুত্রে আমির ইবনে আল-জুবায়ের এবং সেই সুত্রে মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আল আতিক বলেছেন, আবু কুহাফা তার ছেলে আবু বকরকে (রা) বললেন, তুমি দেখছি খালি দূর্বল ক্রীতদাসদের মুক্ত করে যাচ্ছ। মুক্তই যদি করবে, তাহলে শক্ত-সমর্থ লোককে করো না কেন। আপদে-বিপদে তোমাকে রক্ষা করতে পারবে?’
আবু বকর(রা) বললেন, ‘আমি যা করছি, তা আল্লাহর ওয়াস্তে করছি।’ বলা হয়ে থাকে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিম্নোক্ত আয়াত আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেছিলেন: ‘কেউ দান করলে, সাবধান হলে, যা ভালো তা গ্রহন করলে’ এখান থেকে ‘এবং কারও প্রতি অনুগ্রহের প্রতিদান প্রত্যাশায় নয়, কেবল তার মহান প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের জন্য সে সন্তোষ লাভ করবেই’ [আল-কোরআন ৯২:৫] এই পর্যন্ত।’ [সিরাতে রাসুলুল্লাহ (সা), ইবনে ইসহাক, শহীদ আখন্দ অনুদিত, ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশিত, পৃষ্ঠা-১৭৪-১৭৫]
কোরআন, হাদীস এবং সীরাত থেকে জানা গেলো, দাস দাসী পূর্ন মানবাধিকার ভোগ করবে। ইসলামই দাসদাসীদের পূর্ন মযার্দা প্রদান করেছে। যদিও মনে রাখতে হবে যে, মুনিব আর দাসদাসী সমান মর্যাদার নয়, ঠিক যেমন সাধারণ মানুষজনও সমান মর্যাদার নন। আজকালকার যুগেও অফিসের বা প্রতিষ্ঠানের মালিক আর তার চাকর একই মর্যাদার হতে পারে না। প্রত্যেক মানুষ তার নিজ নিজ জায়গা থেকে আলাদা আলাদা মর্যাদা ভোগ করে, যদিও মানুষ হিসাবে উভয়ই সমান। ইসলাম দাসদাসীদের জন্যে বেশ কিছু ইতিবাচক নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। বন্দিরা তথা দাসেরা সামাজিক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেতে শুরু করলো। তারা শারিরীক চাহিদা পুরনের সুবিধাও লাভ করতো।
এতক্ষণের আলোচনায় এটা পরিস্কার হয়েছে যে, মহানবির আমলে তাৎক্ষণিক দাস প্রথা বন্ধের আদেশ দান করা বাস্তবানুগ ছিল না। কেননা ঐ সময় আধুনিক যুগের মত কারাগার ছিল না। আর্থ-সামজিক পরিবেশও ছিল প্রতিকুল। কিন্তু ইসলাম এমন কিছু বিধান রচনা করেছে যাতে দাসপ্রথা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় এবং মানুষ মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে পুরোপুরি আল্লাহর দাসত্বে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে।
তথ্য সুত্র: সিরাতে ইবনে ইসহাক এবং তা হতে সম্পাদিত সিরাতে ইবনে হিশাম, আল তাবারি রচিত “সিরাতে রাসুলাল্লাহ” ও অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ নিবন্ধ থেকে সংকলিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:১৭