ইরানের নাস্তিক আলী দস্তির লেখা ‘নবি মুহাম্মদের ২৩ বছর’ বইটির কিছু অসঙ্গতির জবাব দানের জন্যে এবং নব্য নাস্তিক মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ, মুফাস্সিল ইসলামসহ বাংলার কিছু নাস্তিকদের প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যে ‘মহানবীর জীবনীর এক ঝলক’ নামে একটা বই লেখার সিদ্ধান্ত নিয়ে লেখার সুচনা করেছিলাম। ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশামসহ আদি উৎস গ্রন্থগুলোর অনুবাদ সংগ্রহ করলাম। বলা বাহুল্য, এসব থেকে কিছু খন্ডিত অংশ নিয়ে নাস্তিকেরা মহানবীর জীবনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। মহানবীর জীবনের এক ঝলক লিখতে গেলেও বইয়ের কলেরব ধারনার চাইতেও অনেক বেশী হয়ে যাবার উপক্রম হওয়ায় সে চিন্তা বাদ দিয়ে কেবল মহানবীর বিরুদ্ধে নাস্তিকদের কথিত অভিযোগগুলোর সামান্য জবাব দিয়েই লেখা ক্ষান্ত করার সিদ্ধান্তে আবদ্ধ রইলাম। বড় ভলিউমের লেখা কিম্বা বিস্তারিত লেখা অনেকেই পছন্দ করেন না। আজকালকার বাস্তবতায় সারসংক্ষেপই যথেষ্ট।
প্রথমেই একটা কথা বলে নিই, এখানে যা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তা আদি ও উৎস গ্রন্থ থেকেই নেয়া। ঐ সম্পর্কে কিছু স্কলারের তফসির বা ব্যাখ্যা আমি সংযোজন করেছি মাত্র। নির্মোহভাবেই এটা রচিত হয়েছে, কোন অন্ধবিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে নয়। এ লেখাগুলোর বিশাল অংশটা নেয়া হয়েছে ইবনে ইসহাকের লেখা সীরাতে রাসুলুল্লাহ (স)-গ্রন্থ থেকে। মহানবীর মৃত্যুর মাত্র একশত বৎসরের মধ্যে এ বই লেখা হয়েছে। ইবনে হিশামও একই রকম আদি গ্রন্থ। যদিও তাদের এসব লেখা নিয়েও আছে অনেক আপত্তি আর সন্দেহ। কেননা তারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন না, শুনে শুনেই ইতিহাস লিখেছেন। কাজেই এসব লেখাতেও রয়েছে নানা ফাঁকফোকর।
মহানবী(সঃ)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচনায় ইসলামের অনুসারীরা তার উচ্চ মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ধর্মীয় ভাবাবেগের কারনে কতকক্ষেত্রে যেমন অতিরঞ্জনের আশ্রয় নেন, তেমনি নাস্তিকেরা মহানবীর জীবনের অনেক যুক্তিপূর্ণ ঘটনাকেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যাখ্যা করে মহানবীর চরিত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপপ্রয়াস চালিয়ে আসছেন সেই সুদীর্ঘকাল থেকেই। আমরা অত্র প্রবন্ধে আদিগ্রন্থ তথা কোরআন, হাদিস, সীরাত এবং অথেনটিক ইতিহাসগ্রন্থ থেকে মহানবীর জীবনের চম্বুক অংশটুকু তুলে ধরবো। সম্পূর্ণ নির্মোহভাবেই এখানে আলোচনা হবে। মহানবীর জীবনী জানতে আদি গ্রন্থের অনুসরন না করে উপায় নেই। মহানবীর ওফাতের এক বছরের মধ্যেই তৎকালীন ইতিহাসপ্রণেতা ইবনে ইসহাক মহানবীর জীবনী রচনা করেন। ইতিহাস রচনা করা ইবনে ইসহাকের পারিবারিক পেশা ছিল। তার লিখিত সীরাতে রাসুলুল্লাহ মহানবীর প্রথম জীবনী গ্রন্থ। মহানবীর স্মৃতি সজীব থাকাকালীন সময়ে এটা রচিত হয়েছিল বলে পৃথিবীর মানুষেরা মহানবীর জীবনী জানতে বারবার এর দিকেই ফিরে ফিরে এসেছেন। ইবনে ইসহাকের এই গ্রন্থটি হারিয়ে গিয়েছিল, সৌভাগ্যক্রমে তার দুই শিষ্যের কাছে এর দুটো ছিন্ন কপি ছিল। বহু পরে ইবনে হিসাম এই পান্ডুলিপি পরিমার্জন করেন। আরেক ঐতিহাসিক তাবারি উদ্ধার করেন এর আরো কিছু লুপ্ত অংশ। বইটি আরবী থেকে প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয় জামার্নীতে ১৮৬৪ সালে। পরে এর বাংলা অনুবাদ ইসলামী ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি ২০১৭ সালে প্রথমা প্রকাশনি থেকে একখন্ডে এটি প্রকাশিত হয়। যেহেতু এটা আদি গ্রন্থ তাই এখান থেকে অনেক উদ্ধৃতি আমরা অত্র প্রবন্ধে টেনে এনেছি। তাবারি, ইবনে হিশাম, ইবনে কাছিরের আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, থেকেই যথাসাধ্য সাহায্য নিয়ে লিখার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ। তবে লেখাগুলোকে আদি গ্রন্থ ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের সংক্ষেপিত রূপও বলতে পারেন। মহানবীর উন্নত চরিত্র নিয়ে সীরাত রচনাকারী কারোরই কোন দ্বিমত পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু কতকক্ষেত্রে এমন কিছু হাদিস এবং সীরাতেরও হদিস পাওয়া যায়, যাতে মহানবীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিপরীত বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছে। আমরা এই লেখায় সেইসবও বাদ দেব না। কেননা মহানবীর জীবনের বিভিন্ন দিক জানতে আমাদের এসবের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায়ও নেই। তবে প্রকৃত মুসলমানেরা সীরাত এবং হাদীস গ্রন্থ থেকে বেছে নেবেন কেবল ঐটুকুই যা পবিত্র কোরআনের সাথে মেলে এবং মুসলমানেরা বরাবরেই মধ্যপন্থার জীবন অনুসরন করেন।
গোটা দুনিয়ার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় ৫৭১ খৃষ্টাব্দে আরবের গোত্র ভিত্তিক সমাজের কুরাইশ গোত্রের হাশিমী পরিবারে জন্ম নেয়া নবী মুহাম্মদের স্থানই যে শীর্ষে, এটা শত্রুমিত্র সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। মহানবী নতুন কোন ধর্ম নিয়ে আর্বিভূত হননি। বরং তিনি ইব্রাহিমীয় ধর্মের ধারাবাহিকতায় মহান আল্লাহর বানীকে মানুষের সামনে পেশ করেছেন চরম এক বৈরী পরিবেশে। আব্রাহামিক ধর্মের ধারাবাহিকতায় ইহুদী এবং খৃষ্টান ধর্ম আরবে প্রচলিত ছিল। এদের মধ্যে ইহুদী হলো আদি ধর্ম, যার নবী ছিলেন মোজেজ বা মুসা নবী (আ)। এরপর আসে খৃষ্টান ধর্ম,যার নবী যিশু বা ইসা নবী(আ)। সর্বশেষ ধর্ম ইসলামের অনুসারীরা আগের সকল নবীকে মেনে নেন এবং সম্মান করেন। খৃষ্টানরা ইহুদীদের পূর্বের ধর্ম হিসাবে মেনে নিলেও, ইহুদীরা নেয়নি। আবার মুসলমানেরা ইহুদী এবং খৃষ্টানদের পূর্ব ধর্মের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের নবীকে মেনে নিলেও তারা নেয়নি। ইহুদী এবং খৃষ্টানরা নিজেদের ধর্মকেই চূড়ান্ত ধর্ম বলে মনে করে। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, প্রত্যেকে পূর্বের ধর্মকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু পরেরটা মানেননি। যদিও ইহুদী এবং খৃষ্টান ধর্মের আদি গ্রন্থে কিন্তু ইসলামের নবী আসার সংকেত রয়েছে। আমরা সেটাও অথেনটিক গ্রন্থ থেকেই আলোচনা করবো। অন্যদিকে ইসলাম তথা মুহম্মদ প্রচারিত ধর্মে আর কোন নবী আসবে না মর্মে বলা হয়েছে। মুহাম্মদই শেষ নবী। একে বলা হয় খাতামুন নবী। ইহুদী ও খৃষ্টানরা সেটা অস্বীকার না করলেও প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্মকেই আঁকড়ে রয়েছেন। মুহাম্মদ (স)-এর মৃত্যুর পর পরই অনেক ভন্ড নবীর আবির্ভাব হয়। অনেকেই নিজেদের আব্রাহামীয় ধর্মের সর্বশেষ নবী বলে প্রচার করেন এবং তাদের বেশ অনুসারীও হয়, যদিও কালক্রমে সেসব ধর্মের অবলুপ্তি ঘটেছে। আধুনিক যুগে ইরানে বাহা উল্লাহ নামের এক ব্যক্তি নানা ধ্যান জ্ঞান লাভ করে নিজেকে নবী হিসাবে দাবী করেন। তিনি নারী-পুরুষের সমান অধিকার ঘোষনাসহ বিজ্ঞানকে ধর্মের অংশ বর্ণনা করে ইসলাম ধর্মকে খানিকটা মোডিফাই করে প্রচার করলে তার অনুসারীও জুটে যায়, যারা বাহাই নামে পরিচিত। মহানবীর পরে যেসব লোকেরা নবী দাবী করেছিল, একমাত্র এই বাহা উল্লাহর বাহাইরাই এখনো টিকে আছে, যদিও ইরানে তারা খুবই নিগ্রহের মধ্যে কালাতিপাত করছেন।
মহানবী তার জীবন সংগ্রামে অনেক জটিল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অনেক যুদ্ধ করেছেন, প্রয়োজনের তাগিদে তাকে অনেক বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হতে হয়েছে। তৎকালীন আরব সমাজের অবস্থা আলোচনা না করলে এ যুগে বসে সেই সময়কার পরিস্থিতি ও ঘটনা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। আরবে বিভিন্ন গোত্র ভিত্তিক সমাজে বাস করত ইহুদী, খৃষ্টান ও পেগানরা। প্যাগানরা মুর্তি পুঁজা করতো। ইহুদী খৃষ্টানরাও নিজ ধর্মের কিছু বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন। তবে নিজ নিজ ধর্ম বিশ্বাসে তারা অটল ছিলেন। কাবাগৃহে প্রত্যের গোত্রের নিজ বিশ্বাসের মুর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। কাবার বাইরেও ছিল প্রচুর মুর্তি। পুঁজা করতে করতে কয়েক পুরুষ পর তারা তাদের আদি ধর্ম ভুলেই গেল একেবারে। ইব্রাহিম (আ) আর ইসমাইল (আ)-এর ধর্মের বদলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধর্ম তারা অনুসরন করতে লাগলো। তারা মুর্তি পূঁজা শুরু করল। তাদের আগে মানুষ যে ভুল করত, তারা সেই একই ভুল করতে লাগল এবং এ সত্বেও ইব্রাহিম (আ)-এর সময়কার কিছু কিছু ধর্মীয় আচার অত্যন্ত নিষ্ঠাভরে পালন করে যেতে থাকল। ওই প্রাচীন আচারাদির মধ্যে ছিল উপাসন-গৃহকে সম্মান করা ও তার চারপাশে তওয়াফ করা, ছোট হ্জ, বড় হজ, আরাফা ও মুজদালিফায় অবস্থান, কোরবানি, ছোট হ্জ ও বড় হজে উচ্চস্বরে হজের দোয়া পড়া। সঙ্গে সঙ্গে আবার এমন আচারেরও প্রচলন ঘটাল, যার সঙ্গে ইবরাহিম (আ)-এর ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই।(ইবনে ইসহাকের সীরাতে রাসুলুল্লাহ (সা), পৃষ্ঠা-৫৭) মোদ্দা কথায় বলা যায়, তারা সবাই এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী থাকলেও, মাধ্যম হিসাবে বিভিন্ন মুর্তি পুঁজার আশ্রয় নিতেন। ঈশ্বরকে তারা আল্লাহ নামেই অভিহিত করতো। তাই আরব সমাজের অনেকের নাম ছিল আব্দুল্লাহ বা আল্লাহর দাস। মহানবীর পিতার নামও ছিল আবদুল্লাহ। সমাজে প্রচলিত ছিল দাস ব্যবসা এবং নানাবিধ ব্যভিচার। সামান্য কারনে কথায় কথায় গলা কেটে ফেলা, প্রচুর নারীকে বিয়ে করা, দাসীর সাথে সেক্স করা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। দাস ব্যবসার উপর সমাজের অর্থনীতি দাড়িয়ে ছিল। মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম প্রতিষ্ঠা হলেও দাস ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করা সত্বেও সাথে সাথে বন্ধ করার কোন আদেশ জারি হয়নি। কেননা তেমনটা হলে সমাজের অর্থনীতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়তো। মহানবীর অনেক সাহাবী ছিলেন যারা দাসীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন।
তবে সে সমাজকে একেবারে অন্ধকারাচ্ছন্ন আখ্যা দেয়াও সম্ভব নয়। নারী নির্যাতন, হত্যা, নারীদের জ্যান্ত পুতে ফেলা, ধর্ষণ ইত্যাদি থাকলেও, উচ্চ সমাজের কিছু নারী স্বাধীনতাও ভোগ করতেন। উদাহরন স্বরূপ আমরা মহানবীর প্রথম স্ত্রী বিবি খাদিজার কথা বলতে পারি। তিনি ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী ছিলেন। কবিতা ছিল সেই সমাজের প্রধান ও শক্তিশালী এক মাধ্যম। কবিরা অন্যের শানে নিজেদের আবেগ মিশিয়ে কবিতা রচনা করতেন। শক্তিশালী মিডিয়া বলতে সেই সময় কবি ও কবিতাকেই বুঝাতো। ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের পাতা ভরে আছে এরকম অনেক কালজয়ী কবিতার পংতিতে। অনেক নৃশংসতা আর অবিচার অনাচারের মধ্যেও কিছু ব্যতিক্রম থাকে। সেই ব্যতিক্রম অবশ্যই মুহাম্মদ (স)। তিনি বাল্যকাল থেকেই ছিলেন সত্যবাদী এবং আমানতদার। লোকেরা তাকে বিশ্বাস করতেন এবং তাকে আল-আমিন আখ্যা দেয়া হয়েছিল। মুহাম্মদ (স) বাল্যকালেই পিতৃ মাতৃহারা এতিমে পরিণত হয়েছিলেন। চাচা আবু তালিবের কাছে বড় হতে থাকলেন। অশিক্ষিত বালক উট চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে করতে সমাজের মানুষের কল্যাণের কথা ভাবতেন। হেরা গুহায় তিনি একান্তে মগ্ন থাকতেন। তার বয়স যখন চল্লিশ তখন তিনি প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত হন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহর দুত জিবরাইল (আ) যখন তাকে পড়তে বললেন, তখন তিনি এক অদ্ভূদ অনুভূতি লাভ করলেন এবং মহান আল্লাহর ম্যাসেন্জারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হলেন। এরপর নিয়মিতভাবেই জিবরাইলের মাধ্যমে তিনি অহি প্রাপ্ত হতে থাকলেন। মহানবীর প্রথম ৪০ বৎসর কেটেছে মক্কায়। সেখানে তিনি অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে ইসলামের বানী প্রচারে ব্রত হলে কুরাইশদের রোষানলের শিকার হলেন। তবে মক্কী জীবনে যুদ্ধের কোন আয়াত নাজিল না হওয়ায় তিনি কুরাইশদের সকল অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যেতে থাকলেও পরিস্থিতি এমন দাড়ালো যে জীবন বাঁচানোর জন্যে তাকে মদীনায় হিজরত করতেই হলো। মদিনার ২৩ বছরের নবুয়তি জীবনে তাকে আরো বেশী বাধাঁর সম্মূখীণ হতে হয়েছে। হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে হয়েছে।
তার মৃত্যুর ১০০ বৎসর পর তার জীবনী লেখা শুরু হয়। সময়টা অনুকুল ছিল না। ইসলাম তখন একেবারেই নতুন একটি ধর্ম, যাকে মুনাফিকেরা মনেপ্রানে মেনে নিতে পারেনি। সমাজে বিরাজ করতো অনেক সংশয়বাদী মুনাফিক। বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে শুনে আসা কথাগুলোই সীরাতগ্রন্থে লিখিত হয়েছে। সত্যের সাথে মিথ্যাও যে মিশ্রিত হয়নি, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। পৃথিবীর আদি গ্রন্থগুলোর মধ্যে একমাত্র অথেনটিক গ্রন্থ হলো ‘কোরআন’, যা নাজিল হওয়ার সাথে সাথেই মুখস্থ এবং লিখে রাখা হয়েছে। কিন্তুহাদিস বর্ণনার ক্ষেত্রে ছিল নানা অসংগতি। কেননামহানবি হাদিস লিখে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। তার মৃত্যুর ২৫০-৩০০ বছর পরে হাদীস লিখিতভাবে সংরক্ষণ করার কাজ শুরু হয়। যার কারনে সহি হাদীসের সাথে অনেক জাল, জঈফ এবং বিকৃত হাদীস সংরক্ষিত হয়ে গেছে স্বাভাবিক কারনেই। হাদিস দিয়ে কোরআনকে তফসির করতে গিয়ে বিভিন্ন তফসিরকারক মতভিন্নতার পরিচয় দিয়েছেন স্বভাবিক কারনেই।
সুন্নিরা যে হাদীস মানেন, শিয়ারা তা মানেন না। আবার শিয়াদের হাদীস সুন্নিরা মানেন না। সুন্নিদের সিহা সিত্তার মধ্যে প্রধানতম হাদীস গ্রন্থ বুখারী এবং মুসলিম শরীফ। এই সিহা সিত্তা আবার আবু হুরাইরার বর্ণিত হাদীস দ্বারা পরিপূর্ণ। অথচ এই আবু হুরাইরাকে উম্মুল মুমেনীন আয়শা ‘মিথ্যাবাদী’ বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপরও এই আবু হুরাইরার বর্ণিত হাদিসই সুন্নিরা মেনে আসছেন যে কারনে তা হলো, আবু হুরাইরা মুসলিম বিশ্বের প্রথম বাদশাহ হযরত মুয়াবিয়ার রাজপ্রাসাদের আনুকুল্যপেয়েছিলেন হযরতআলী বিরোধি মনোভাবের কারনে। আবু হুরাইরা এই সাহাবীর আসল নাম নয়। তার স্বভাব বিড়াল জাতীয় ছিল বলে মহানবি তাকে আবু হুরাইরা বা বিড়ালের বাবা নামে ডাকতেন।রাসুলের সময় আবু হোরায়রা (রা) সংসার বিরাগী চরম দারিদ্র্যে দিন কাটালেও পরবর্তী জীবনে তিনি বিয়ে করে সংসারী হন। সন্তান-সন্ততির পিতা এবং ধনসম্পদের অধিকারী হন। ইছলামী শরিয়তে তার ব্যুৎপত্তি, বিদ্যা-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞায় ওমরের (রা) গভীর আস্থা ছিল। তিনি তাঁকে বাহরায়ন প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু অর্থ সঞ্চয়ের অপবাদে তাকে বরখাস্ত করেন। যথাবিহিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সন্দেহ দূর হলে পরে তাকে পুনরায় উক্ত পদ গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু আবু হুরায়রা (রা)-এর আহত আত্ম সম্ভ্রমবোধ উক্ত পদ পুনঃ গ্রহণে তাঁকে নিরুৎসাহ করে তোলে। আবু হোরায়রা থেকে বর্ণিত হাদিছের সংখ্যাধিক্যের জন্য তার হাদিছ সাধারণত অগ্রাহ্য মনে করেন। কিন্তু এর পশ্চাতে কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি নেই।” [দ্র: সংক্ষিপ্ত ইছলামী বিশ্বকোষ; ১ম খ. ৩য় মুদ্রণ, আবু হোরায়রা অধ্যায়; পৃ: ৫৭; ই. ফা.]
ঘটনা তদন্তের পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় ওমর তাকে পুনরায় ঐ পদে বহাল রাখার অনুরোধ করেন বলে মুহাদ্দেসগণ ইতিহাস রচনা করেছেন বটে; কিন্তু যে ওমর আপন সন্তানকে অভিযুক্ত প্রমাণে মৃত্যুদণ্ড দেন; সেই ওমর অভিযোগের তদন্ত না করেই তাঁকে পদচ্যুত করেন; অতঃপর তদন্ত করেন। অতঃপর মিথ্যা অভিযোগের ফলে কোনো ছাহাবাকে দণ্ডিত করেছেন এমন কোনো হাদিছ-ইতিহাস রচিত হয়নি; অতএব মোহাদ্দেছদের মন্তব্য বিশ্বাস করার অর্থ ওমরকে খলিফা হিসেবে অযোগ্য ও হেয় প্রতিপন্ন করা। সম্ভবত ওমরের ওপর পূর্ব থেকেই ইমামগণ নাখোস ছিলেন কারণ হয়ত ওমর জনসাধারণের কাছে হাদিছ লেখার কথা দিয়েও তা পূরণ করেননি, বরং প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
প্রথম খলিফা আবু বকরের সময় আবু হোরায়রার কোনো খোঁজ খবরই ছিল না কিন্তু ওমরের সময় তিনি বাহরাইনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এখানেও তিনি অর্থ আত্মস্বাদের দায়ে ওমর কর্তৃক অভিযুক্ত হয়ে পদ থেকে বহিষ্কৃত হন।
কথিত হয় তিনি দুর্দান্ত কপর্দকহীন চূড়ান্ত অলস ভিখারী ছিলেন; কিন্তু ওমরের আমলে শাসনকর্তা হওয়ার পরেই হঠাৎ করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে যান। অতএব প্রশ্ন জাগে যে, কপর্দকহীন, ভবঘুরে, অন্যের ঘরের ঘি-এর শূন্য পাত্র চেটে খাওয়া আবু হোরায়রা এত ধনসম্পত্তি কিভাবে, কোথা থেকে পেলেন তার কোনো ইতিহাস রচিত হয়নি।
তিনি মহানবী সম্বন্ধে অতিরিক্ত কথা বলতেন, বাংলায় যাকে ‘বাচাল’ বলে; সে কারণে সাহাবীগণই প্রতিবাদ করতেন। মোহাদ্দেছগণ লিখেছেন, ‘বেশি হাদিস বলতেন বলেই অন্য সাহাবীগণ প্রতিবাদ করতেন।’ মূলত এ যুক্তির কোনো ভিত্তি নেই; কারণ বেশি বেশি হোক বা কমই হোক সত্য [?] কথা [হাদিস] বলতেন, অথচ সাহাবীগণ প্রতিবাদ করতেন বা ক্ষোভ প্রকাশ করতেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
এই আবু হুরাইরা মাত্র তিন বছরে মহানবীর (সা.) সাহচার্যে থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হাদিছ বয়ান করেছেন! পক্ষান্তরে, খোলাফায়ে রাশেদ্বীনগণ সারাজীবন রাসুলের সাহচর্যে থেকে মাত্র পাঁচ শত হাদিস রচনা করতেও সাহসী হননি!
সুন্নিদের জন্যে অধিক হাদিস বর্ণনাকারী আবু হুরাইরা সম্পর্কে এ সামান্য আলোচনা থেকেই পাঠক একটা ধারনা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন।
যাক, হযরত আলীর খেলাফত শেষ হলে মুসলিম বিশ্বে আর খেলাফত ব্যবস্থাকে স্থান দেয়া হয়নি। শুরু হয় হযরত মুয়াবিয়া প্রতিষ্ঠিত উমাইয়া রাজবংশের শাসন। সূদীর্ঘকাল ধরে তারা ক্ষমতায় থাকায় সবকিছু উমাইয়াদের অনুকুলে চলে যায়। তাদের ব্যাখ্যাই সর্বাধিক প্রাধান্য পাওয়া শুরু হয়। ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, তিরমিজি, ইবনে মাজা প্রত্যেকেই হয় সরাসরি রাজতন্ত্রের আনুকুল্য পেয়েছেন, নয়তো কোন না কোনভাবে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। যে কারনে আবু হুরাইরার বর্নিত হাদীস দ্বারা সুন্নিদের হাদীসগ্রন্থ পরিপূরর্ণ হলেও, তাতে আলী, ফাতেমা, হাসান, হুসাইনের রেওয়াত নেই বললেই চলে। নিরপেক্ষতার খাতিরে সামান্য কিছু রেওয়াত নেয়া হয়েছে মাত্র। সবচেয়ে অথেনটিক হাদিস গ্রন্থও যে অথেনটিক নয়, তা ঐ হাদিসগ্রস্থ নিজেই প্রমাণ করে। কন্ট্রাডিকশনে ভরা অনেক হাদিস রয়েছে, তথাপি কট্টরপন্থীরা তা মানতে নারাজ। বুখারীর কিছু হাদিস রয়েছে যা মহানবির চরিত্রে কলংক লেপন করে। যেমন একটি হাদীস রয়েছে, মহানবি ৬ বছর বয়সের আয়শাকে বিয়ে করেছিলেন। অথচ ঐ হাদিস গ্রন্থেই আরেকটি হাদীস রয়েছে যা প্রমাণ করে আয়েশার বিয়ের বয়স সংক্রান্ত হাদীসটি ভুল। কেননা ঐ হাদীসে আয়েশা সুরা ৫৪ নাজিল হওয়ার সময় কিশোরী ‘যারিয়াহ’ (শিশু ‘সিবিয়াহ’ নয়) হিসাবে দাবী করেছেন। ৫৪তম উক্ত অধ্যায় নাযিল হয় হিজরীপূর্ব ৯ সালে মক্কায় ৬১২ খৃষ্টাব্দের দিকে। সে হিসাবে হযরত আয়েশার বয়স তখন কমপক্ষে ৫ বছর (কেননা তার মনে আছে) হলেও ৬২৩-৬২৪ খৃষ্টাব্দ সালে তাঁর বয়স কোনভাবেই ১৫/১৬ বছরের নিচে নয়। দাম্পত্য জীবন শুরু হয় আরো ২ বছর পর। (Sahih Bukhari, kitabu'l-tafsir, Arabic, Bab Qaulihi Bal al-sa`atu Maw`iduhum wa'l-sa`atu adha' wa amarr) Volume 6, Book 60, Number 399)
এছাড়া মোনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর জন্য রাসূল (সা.)-এর দোয়া করার ব্যাপারে বুখারীতে যে হাদীস আছে সুরা তওবার এই আয়াত (“আত্মীয় স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী এবং মু’মিনদের জন্য সংগত নয়” -৯:১১৩) বর্তমান থাকতে, রাসুলের (স) পক্ষে আব্দুল্লাহর জন্য জানাজার নামাজ পড়া বা ক্ষমা প্রার্থনা সম্পূর্ণ অসম্ভব। অতএব এ হাদীসটি অবিশ্বাস্য। (বোখারী, ফৎহুল বারী, ১৯ খন্ড ২০৩ হতে ২০৬ পৃষ্ঠা) [উদ্বৃত: মাওলানা আকরাম খা রচিত “মোস্তফা চরিত”, পৃষ্ঠা-৫৪]
আবার দেখুন, “আনাছ, আয়েশা ও এবনে-আব্বাছ বলছেন:- ‘হযরত ৪০ বৎসর বয়সে নবী হয়ে, ১০ বৎসর মক্কায় অবস্থান করে হিজরত করেন; এবং মদিনায় আর দশ বৎসর অবস্থান করার পর, নবুয়তের ২০শ সনে, ৬০ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন।’ (বুখারী ১৮-১০৯,মুসলিম ২-২০৬ পৃষ্ঠা) হযরতের ২০ বৎসর নবুয়ত, মক্কায় ১০ বৎসর অবস্থান এবং ৬০ বৎসর বয়সে পরলোক গমন - এই তিনটি কথাই ভুল। তিনি মক্কায় ১৩ বৎসর অবস্থান করে হিজরত করেন এবং ২৩ বৎসর নবী-জীবন অতিবাহিত করার পর ৬৩ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন। এটা ঐতিহাসিক সত্য; বুখারী ও মুসলিমের কথিত রাবিগণ কর্তৃকই এটা বর্ণিত হয়েছে। এ-সম্বন্ধে অধিক প্রমাণের আবশ্যকতা নেই। কারণ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত এ দুটি পরস্পর বিপরীত বিবরণ উভয়ই সত্য হতে পারে না-সুতরাং একটা বিবরণ যে ভুল - তা সকলেই স্বীকার করবেন। অত্এব আমরা দেখছি হাদিসের সনদ সহী, অথচ হাদীসটি অগ্রাহ্য” [মাওলানা আকরাম খা রচিত “মোস্তফা চরিত”, পৃষ্ঠা - ৪৫]
এরকম আরো অসংখ্য হাদিস রয়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, হাদিসপ্রেমের নামে কতিপয় কট্টরপন্থী মুসলমান নামধারীরা হাদিসের নামে মানুষের জীবনকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছেন। অথচ কোনআনে বলা হয়েছে, আমি তোমার উপর কুরআন এ জন্য নাযিল করিনি যে তুমি দু:খ-কষ্ট ভোগ করবে। (সূরা ত্বা-হা, আয়াত: ১-২)
তোমাদের পক্ষে যা সহজ আল্লাহ্ তাই চান ও তোমাদের পক্ষে যা কষ্টকর তা তিনি চান না...”[সূরা বাকারাহ্; ০২:১৮৫]
আল্লাহ তোমাদের উপর কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে চান না। (সূরা আল মায়েদা, আয়াত ৬)
“তিনি (আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন) দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের উপর কোন কঠোরতা আরোপ করেননি’ ”[সূরা হজ্ব; ২২:৭৮]
‘আমি আপনার প্রতি গ্রন্থ নাজিল করেছি; সেটি এমন যে, প্রত্যেক বস্তুর সত্য ও সুস্পষ্ট বর্ণনা; হেদায়াত, রহমত এবং মুসলমানদের জন্য সুসংবাদ (সূরা নাহল, আয়াত ৮৯)।
আল্লাহতালা সহজ করে দিলেও, গোমরাহীতে লিপ্ত লোকেরা কঠোরতার পথ বেছে নিয়েছে। আল্লাহপাক বলেন, ‘একদল লোককে তিনি সঠিক পথ দেখিয়েছেন, আর দ্বিতীয় দলটির উপর গোমরাহী ও বিদ্রোহ ভালোভাবেই চেপে বসেছে; এরাই (পরবর্তী পর্যায়ে) আল্লাহ তালাকে বাদ দিয়ে শয়তানদের নিজেদের অভিভাবক বানিয়ে নিয়েছে, (এ সত্বেও) তারা নিজেদের হেদায়াতপ্রাপ্ত মনে করে। (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩০)
জীবনকে শরীয়ত সম্মতভাবে উপভোগ করার জন্যে আল্লাহপাক বরং তাগিদ দিয়েছেন, একই সুরার পরবর্তী আয়াতে আল্লাহপাক বলেন, হে আদম সন্তানেরা, তোমরা প্রতিটি এবাদতের সময়ই তোমাদের সৌন্দর্য গ্রহন করো, তোমরা খাও এবং পান করো, তবে কোন অবস্থাতেই অপচয় করো না। আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩১)
‘(হে নবী)তুমি বলো, আল্লাহতালার (দেয়া) সেসব সৌন্দর্য এবং পবিত্র খাবার তোমাদের জন্যে কে হারাম করেছে? যেগুলোকে তোমাদের জন্যে আল্লাহতালা স্বয়ং উদ্ভাবন করেছেন ; তুমি বলো এগুলো হচ্ছে যারা ঈমান এনেছে তাদের জন্যে পার্থিব পাওনা, (অবশ্য) কেয়ামতের দিনও এগুলো ঈমানদারদের জন্যেই (নির্দ্দিষ্ট থাকবে); এভাবেই আমি জ্ঞানী সমাজের জন্যে আমার আয়াতসমুহ খুলে খুলে বর্ণনা করি।’ (সুরা আল আ’রাফ ৭: ৩২)
কোরআনের এতো এতো আয়াত থাকা সত্বেও হাদিসের নামে নানা বিধি নিষেধ দ্বারা মুসলমানের জীবনকে বিষিয়ে তোলার কাজ থেমে নেই। আপনি কোরআনের একটি আয়াত বলবেন হাদিসপ্রেমীরা তা খন্ডাতে হাজারটা হাদিস এনে হাজির করবেন। অনলাইনেই এরকম প্রচুর উদাহরন ছড়িয়ে আছে। আগ্রহী পাঠক, https://www.amarblog.com/blogs/mjbashar?page=25 সাইট ঘুরে আসতে পারেন। পরিস্থিতি এমন যে, এই সব হাদিস মেনে চলতে গেলে সত্যিকার অর্থে কোন মুসলমানের পক্ষে জীবনটা একেবারেই জাহান্নামে পরিণত হয়ে যাবে। জীবন ধারন তো দুরের কথা, এক পা-ও এগুনো সম্ভব হবে না। উপরন্তু এমন অনেকগুলো হাদিসও রয়েছে যা মহানবির চরিত্রে কালিমা লেপন করে। অথচ পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, মহানবি মানুষের জন্যে অনুকরনীয় চরিত্র। হাদিস রচয়িতারা এই দিকটি ঐসময়ে লক্ষ্য করেছেন বলে মনে হয় না। কাজেই অনেক মুসলমানই অপরাধবোধ বুকে চেপে মানসিক কষ্টে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন। আবার বিপরীতে দুর্বল ঈমানের অনেকে এতো কাঠিন্যের কারনেধর্মকেই অস্বীকার করে বসেন। তারা নাস্তিকতা গ্রহন করে মুক্তির স্বাদ লাভ করেন। এমন একজন ব্যক্তি হচ্ছেন সম্প্রতি ইসলাম ত্যাগ করা মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ও মুফাস্সিল ইসলামরা। তারা হাদিস থেকে মহানবির চরিত্রে কলংক লেপন করে চলেছেন। আর হাদিসের আলোকে কোরআনের অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়েছেন।
আমাদের দেশের প্রায় ৯০শতাংশ ইসলামী স্কলাররাই লেখাপড়া করেছেন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় বা অনুরূপ কোন রাজতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে ঐতিহাসিকভাবেই রাজতন্ত্রের অনুকুলে ইসলামকে ব্যাখ্যা করা মতাদর্শ ‘সালাফী মতবাদকে’ অনুসরন করে। স্বাভাবিকভাবেই তারা হাদিসের অন্ধ অনুসারী। হাদিসের বানী আর কোরআনের বানী তাদের কাছে একই। একথার দ্বিমত বা ব্যতিক্রম থাকতেও পারে, আমি কেবল বেশীরভাগ বা এভারেজটাই বললাম। কতেকক্ষেত্রে তারা এতোই বুখারীর ভক্ত যে, অনেক মুসলমানই তাদেরকে ‘বুখারীর ধর্মের অনুসারী’ বা ‘বুখারীর উম্মত’ বলতেও ছাড়েন না। কিছুহাদিসপ্রেমী নিজেদের দলের নামই রেখেছেন ‘আহলে হাদিস’। নাস্তিক মুফতি আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ও মুফাস্সিল ইসলামরা যখন হাদিস বর্ণনা করে মহানবির চরিত্র হনন করেন, তখন এইসব তথাকথিত ইসলামীস্কলারদের চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। কেননা তারা আন্তরিকভাবেই বিশ্বাস করেন সিহাসিত্তার হাদিসে কোন ভুল নেই। একারনে আবদুল্লাহ আল মাসুদ নামীয় এই ব্যক্তি বলেছেন, এই স্কলাররাও যখন হাদিসগুলো অনুধাবন করতে শুরু করেন (কেননা তিনি চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন) তারাও মনে মনে নাস্তিক হয়ে যান। মহান আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত। আমরা বলছি না সব হাদিস দুর্বল বা জঈফ। আমরা বলছি, কোরআনের সাথে কন্ট্রাডিক্ট হলেই সেটা বাতিল। হোক সেটা বুখারী বা মুসলিম। কোরআনের বাইরে কোনকিছুকে অন্ধভাবে অনুসরন করা যায় না। কোরআন নাজিল হওয়ার সাথে সাথেই প্রতিটি আয়াত মুখস্ত করা হয়েছে এবং লিখে রাখা হয়েছে। কাজেই তা একেবারেই বিশুদ্ধ এবং অকাট্য। কিন্তু হাদিসের ক্ষেত্রে অনুরূপ মনে করা নিরেট মূর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। বিশেষতঃ তা যখন খোদ কোরআনকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
[এই লেখাটা মহানবির বিরুদ্ধে করা প্রতিটি অভিযোগের জবাব দেবার আগে সুচনা পর্ব মাত্র। পরবর্তী সব লেখার জন্যেই একথাগুলো প্রযোজ্য হবে বিধায় তা প্রথমে প্রকাশ করলাম।]
[চলবে]
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৩:০৭