কবে শুরু হবে আহমদ ছফা চর্চা’ শিরোনামে আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে গত বছরের ১৩ জুলাই। প্রতিক্রিয়ায় অনলাইন-ছাপা পত্রিকাসহ নানা মাধ্যমে নানা প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্ন শুনতে পাই। তবে সাত সকালে প্রথম ফোনটা পাই একজন বিখ্যাত লেখক-সাংবাদিকের। তিনি মনীষী লেখক ছফার ও তাঁর লেখার একজন ভক্ত অনুরাগী, আবার কবি ফরহাদ মজহারেরও বন্ধুস্থানীয়। কৌতুহলী এ পাঠক আমার লেখা নিবন্ধের একটি বিষয় সবিস্তার জানতে প্রশ্ন করেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটির জবাব আমি ইত্তেফাকের ওই লেখার মধ্যে নানা কারণে খোলাসা করিনি। ইঙ্গিত দিয়েছিলাম মাত্র।
আলোচনার সুবিধার্থে পাঠকের জন্য ইত্তেফাকে ছাপা হওয়া লেখার ক’টি লাইন তুলে ধরছি: ‘একজন কবি ও কলামিস্ট ছফার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এ কবির সাথে প্রতিদিন খুব সকালে ছফার অন্তত আধা ঘণ্টা টেলিকথন হতো। এই কবি ও কলামিস্টের লেখা কেন পাঠককে টানে না সে বিষয়ে ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ এক সকালবেলা ছফাকে আমি একটি প্রশ্ন করি। জবাবে ছফা বলেন “তিনি [লুঙ্গিপরা কবি] সব সময় অসৎ চিন্তা করেন তাই তাই লেখাগুলো সুপঠিত হয় না। উৎকৃষ্ট রচনা লেখা একজন লেখকের প্রধান কাজ। কিন্তু এ লেখকের লেখা পাঠককে কামড়াতে আসে বলে মনে হয়। একলাইন পড়লে আরেকলাইন পড়তে আর ইচ্ছে হয় না। তাদের লেখায় তেমন সার পর্দাথ থাকে না। গুটিকয় শিষ্য আছে যারা তার লেখা কষ্ট করে পাঠোদ্ধার করে মাত্র।”
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে পাদুয়া-রৌমারির বহুল আলোচিত সীমান্ত সংঘর্ষ নিয়ে একটা তথ্য জানার পর ওই কবি সম্পর্কে আহমদ ছফা তাঁর বহুবছরের ধারণা পাল্টেছিলেন। তারপর আমৃত্যু অন্যরকমভাবে দেখেছেন এ কবিকে। কিন্তু ছফার মৃত্যুর পর যতগুলো আলোচনাসভা হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতে এ কবি প্রতিবেশী একটি রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে ছফাকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। একথা সবার জানা যে আহমদ ছফা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারত গিয়েছেন, ট্রেনিং নিয়েছেন, সেখানকার পত্রিকায় কলাম লিখে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে জনমত তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। ভারতে বসেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর প্রথম বই/উপন্যাস ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’ লিখেছিলেন ছফা। পরবর্তীকালে অনেক লেখায়-আলোচনায় ছফা ভাই ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
সীমান্ত সংঘর্ষ সংক্রান্ত যে তথ্যটি আমি ওই লেখায় খোলাসা করিনি সে তথ্যটিই জানতে চেয়েছেন লেখক-সাংবাদিক। ইত্তেফাকের নিবন্ধের অনেক পাঠকের সাথে পরবর্তী কয়েকমাসে যখনই আমার দেখা হয়েছে তখনই অনেকে একই প্রশ্ন করেছেন। অনেককে বলেওছিলাম। আজ সে কথাটি কিছুটা খোলাসা করতে চাই। তবে তার আগে মাত্র কয়েকটি কথা বলবো।
ফরহাদ মজহার ছফার বন্ধু ছিলেন। এ বিষয়ে নানাজন নানা কথা বলেন, কেউ কেউ হিসেব মেলাতে পারে না। কীভাবে হয়? দুয়েটি আপত্তিকর মন্তব্যও করেন অনেকে। মনে মনে স্মরণ করি ছফার কয়েকটি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ। ছফা আমাকে একাধিকবার বলেছেন, ফরহাদ ভাইয়ের এনজিওতে যত ছেলেমেয়েকে চাকরি দিয়েছি বছরের পর বছর কারো বেতন বাড়ে না। তাই ওরা একটা দুটা শার্ট দিয়ে বছর চালিয়ে নেয়, নতুন শার্ট কেনার টাকা থাকে না। ছেলেমেয়েগুলোকে ফরহাদ ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন, খুশি কবীরের স্বামীর এনজিও ধানমন্ডির আরবান, ড. হোসেন জিল্লুরের পিপিআরসি ইত্যাদি জায়গায় সেটেলড করাবেন। ফরহাদ মজহারের সাথে ছফার বন্ধুত্ব নিয়ে মন্তব্যকারীদের মনে করিয়ে দেই জাতীয় পতাকার শিব নারায়ণ দাশ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ছফার আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন। ইত্তেফাকের সাবেক প্রধান প্রতিবেদক নাজীমউদ্দীন মোস্তান ও অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ছফার অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আমৃত্যু। তাদের আরো মনে করিয়ে দেই ছফা ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ও লিখেছেন আবার ‘শতবর্ষের ফেরারী বঙ্কিম’ও লিখেছেন, ‘গাভী বিত্তান্ত’ লিখেছেন আবার ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিঙ্গপুরাণ’ও লিখেছেন। এসব বাদ প্রতিবাদ থেকেই গত বছর ছফার জন্মবার্ষিকীর আগে মনে করলাম ফরহাদ মজহারের সাথে ছফার বন্ধুত্ব যে শেষ পর্যন্ত টেকেনি তার অন্তর্নিহিত কথাটি খোলাসা করে দেই ছফার অগনিত ভক্তকূলের কাছে। আর তাই লেখা হয়েছিল ইত্তেফাকে প্রকাশিত ওই লেখাটি।
শাহবাগ আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ, সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব ইত্যাদি বিষয়ে কবি ফরহাদ মজহারের টিভি টকশোতে বক্তব্য, পত্রিকার কলাম নিয়ে নতুন করে আমি আজ আর কিছু বলছি না। এ বিষয়ে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকমে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাঈদ ফেরদৌস স্যার কয়েকটি মৌলিক প্রশ্ন তুলেছেন ফরহাদ মজহারের অবস্থানের বিষয়ে।
আমি ফরহাদ মজহার অথবা তার মতামত সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবো না। ছফা ভাই আমাকে ওই প্রশ্নগুলোর সমাধান দিয়েছেন। সীমান্ত সংঘর্ষের অব্যবহিত পরে একটা লিফলেট খুব আলোচনার উদ্রেক ও শীর্ষ মহলে উদ্বেগ ছড়িয়েছিল। ফরহাদ মজহারের চিন্তা নামক একটা ম্যাগাজিন ছিল [এখনও আছে কী না জানি না] । ওই ম্যাগাজিনটা যেখানে ছাপা হতো সেখানেই ছাপা হয়েছিল ওই লিফলেটগুলো, কঠোর গোপনীয়তায় বিলি হয়েছিল, এমন একটা খবর ছফা ভাই জেনেছিলেন।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে উত্তেজনা ও বিশৃংঙ্খলা বাড়াতে ফরহাদ মজহারের ৯৯ সালের লিফলেট ও আজকের এ ডিজিটাল যুগের টকশো-কলাম-মন্তব্য একই সূত্রে গাথা। তাই বলেছি, ফেরদৌস স্যারের মতো আমার কোনো প্রশ্ন নেই মজহারের কাছে। যেমনটা হয়তো ছিল না ছফা ভাইয়েরও।
জয়বাংলা। জয় হোক ছফাভক্তদের।
সিদ্দিকুর রহমান খান: ছফার শ্রুতিলেখক। নিউ এইজ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৩২