গ্রীক পূরাণের স্ফিংস!!
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
একটি পৌরাণিক ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক।গ্রীক পুরাণের থিবস্ নগরীর নাম হ্য়ত অনেকেই শুনে থাকবেন।তো এই থিবস্ এর নবম সম্রাট লেয়্যাস এর পূত্র ছিলো ইডিপাস। অনেক দিন নিঃসন্তান থাকার কারনে একদিন সম্রাট লেয়্যাস তার সম্রাজ্ঞী জ্যাকোস্টাকে নিয়ে ডেল্ফি রাজ্যের একজন পুরোহিতের সাথে দেখা করতে যান। পুরোহিত জ্যাকোস্টাকে বলেন ''যদি তোমার কোন পূত্র সন্তান হয়, তাহলে সে তার পিতাকে হত্যা করে তোমাকেই একদিন বিয়ে করবে'' কিন্তু তার কিছুদিন পরেই জ্যাকোস্টার একটি পূত্র সন্তান হয়। পুরোহিতের ভবিষ্যত বানী যেন সত্যি না হতে পারে সে জন্য রাজা লেয়্যাস ইডিপাসকে একজন সৈন্যের হাতে তুলে দিয়ে তাকে পাহার থেকে ফেলে দিতে বলে। কিন্তু সৈন্য তাকে পাহার থেকে ফেলে না দিয়ে ক্রোরিন্থ রাজ্য থেকে আসা এক মেষ পালকের হাতে তুলে দেয়। এভাবে একদিন শিশুটি ক্রোরিন্থের রাণী মেরোফের কাছে চলে যায়। তার কোন সন্তান না থাকায় তিনি শিশুটিকে বড় করে তোলেন।
তারও অনেক বছর পরে ইডিপাস একদিন এক মাতালের কাছে জানতে পারে মেরোফ তার আসল মা না। সে কথার সত্যতা যাচাই করার জন্য ইডিপাস সেই একই পুরোহিতের কাছে যায়। পুরোহিত তাকে তার আসল বাবা-মার পরিচয় না জানালেও সেই ভবিষ্যত বানীটা জানিয়ে দেয়। পুরোহিতের ভবিষ্যতবানী যেন সত্য না হতে পারে তাই ইডিপাস আর ক্রোরিন্থে ফিরে না গিয়ে ডেল্ফির কাছের থিবস্ রাজ্যের দিকে যাত্রা করে।
যাত্রা পথে সে একটি তিনরাস্তার সন্ধিতে এসে দাড়ায়, যেখানে সে একটি ঘোড়ার গাড়ি দেখতে পায় যেটা ছিলো তার আসল পিতা রাজা লেয়্যাসের গাড়ি। কিন্তু আগে যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে গেলে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে রাজা লেয়্যাসকে মেরে ফেলে, যেটার কারনে ভবিষ্যত বানীর অর্ধেক পূরণ হয়ে যায়। সেখান থেকে রাজার একটি সৈন্য রাজার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে ফিরে যেতে পারে।
আরো কিছু পথ সামনে এগিয়ে গেলে ইডিপাস একটি স্ফিংস এর মুখোমুখি হয়। স্ফিংস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের থিব্স নগরীর রক্ষক। নগরীতে প্রবেশকারী আগন্তুককে ধাঁধার জটিল জালে বন্দি করার কৌশল ছিল স্ফিংসের একচেটিয়া রণনীতি। সেইসব কূট প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না কোনও মানুষের। ধাঁধার সমাধান না করতে পারলে থিব্স-এ প্রবেশ করা তো যেতই না, উপরন্তু খোয়া যেত প্রাণটাও। উত্তর দিতে অপারগ সেইসব হতভাগ্য মানুষকে বধ করে উদরপূর্তি হত স্ফিংসের। একমাত্র ব্যতিক্রম ইডিপাস। স্ফিংস এই গ্রিক বীরকে প্রশ্ন করেন: ‘কোন সেই জন্তু যে সকালে চতুষ্পদ, মধ্যাহ্নে দ্বি-পদ আর সন্ধ্যায় তিন পদের সাহায্যে চলে?’
প্রত্যুত্তরে ইডিপাস জানান, তার নাম মানুষ। শৈশবে সে চার হাত-পায়ের সাহায্যে হামাগুড়ি দেয়, যৌবনে দু’পায়ের ওপর ঋজু হয়ে চলে আবার বার্ধ্যক্যে হাতের লাঠির ওপর ভর করে হাটে। কথিত আছে, এই উত্তর শোনার পরই ধ্বংস হয়ে যায় স্ফিংস ও তার সঙ্গের বিভীষিকা।
আসুন জানা যাক কি এই স্ফিংস!! যুগে যুগে পৌরাণিক ইতিহাসের নানা কাহিনীতে আমরা অনেক দেবতার সন্ধান পাই। আবার এ নিয়ে রাক্ষস আর দানব-দানবীর ইতিহাসও নেহাতই কম নয়। স্ফিংস তেমনি এক পৌরাণিক দানবী। প্রাচীন মিসর এবং গ্রিক পুরাণ থেকে এর উদ্ভব। পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী স্ফিংস হচ্ছে একটি সিংহ, যার মাথা মানবীর। এর ব্যতিক্রম বর্ণনাও রয়েছে কোথাও কোথাও। তবে মূল বক্তব্য এটিই। এখনো প্রাচীন বিভিন্ন নিদর্শনে এই দানবীর অস্তিত্বের প্রমাণ মিলে।
মিসরের বিখ্যাত পিরামিড গ্রেট স্ফিংসের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মানুষের মাথা আর সিংহের শরীরের আদলে গড়া এই পিরামিড বিশ্বের বিস্ময় জাগানিয়া স্থাপত্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বৃহত্তম ও বিখ্যাত স্ফিংস ভাস্কর্য মিসরের নীলনদের তীরে গিজা মালভূমিতে অবস্থিত। মনে করা হয়, সে স্ফিংসের চেহারা রাজা ফারাহ খাফরা অথবা সম্ভবত তার ছেলের।মিশরীয় প্রাচীন ইতিহাসে একাধিক স্ফিংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। এরা প্রধানত মিন্দর রক্ষক ছিলেন। তবে শুধু মিন্দরই নয়, পিরামিড, অর্থাৎ রাজকীয় সমাধির দ্বার-প্রান্তেও স্ফিংসের উপিস্থতি ছিল। ঐতিহাসিক মিশরীয় চিওস্ নগরের প্রতীক ছিলেন স্ফিংস। সে যুগের বহু সিলমোহর ও মুদ্রার পিঠেও খোদাই করা থাকত স্ফিংসের অবয়ব।
গ্রীক পুরাণে কথিত আছে স্ফিংস উঁচু থেকে পাথরে আছড়ে পড়ে মারা যায়। আবার অন্য কাহিনী মতে, সে নিজেই নিজেকে খেয়ে ফেলে। ভয়ঙ্কর এ দানবীর নাম স্ফিংস। যার শরীরের মাথার দিকটা মানবীর মতো আর শরীরের বাকি অংশ সিংহের মতো। তবে এ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকে আবার একে মতভেদ না বলে প্রকারভেদ বলার পক্ষপাতী। নানা পৌরাণিক কাহিনী ঘেঁটে দানবী স্ফিংসের তিনটি নাম এবং চেহারা খুঁজে পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে 'অ্যান্ড্রোস্ফিংস' (Androsphinx)। এ ধরনের স্ফিংসের দেহ সিংহের, মাথা মানবীর। অধিকাংশ বর্ণনায় এ ধরনের স্ফিংসের কথাই জানা গেছে। আরেকটি হচ্ছে ক্রায়োস্ফিংস (Criosphinx)। এ ধরনের স্ফিংসের দেহ সিংহের, মাথা ভেড়ার। শেষটি হচ্ছে হেইরোকোস্ফিংস (Hierocosphinx)। যেটির দেহ সিংহের আর মাথাটি হচ্ছে বাজপাখির। স্ফিংস শব্দটি মূলত গ্রিক ক্রিয়াপদ ‘স্ফিংগো’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ শ্বাসরোধ করে হত্যা করা। লক্ষ্যণীয় এই যে স্বয়ং পশুরাজদের শিকার ধরার প্রক্রিয়াও ঠিক এমনই। সিংহ শৌর্যের প্রতীক। তাই মানবদেহের সঙ্গে তার গঠনের মিশেল ঘটিয়ে প্রাচীন কথক-স্থপতিরা হয়তো মানুষের বুদ্ধি ও সিংহের বিক্রমের মিশ্রণ তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে স্ফিংস চিত্রশিল্পী এবং ভাস্করশিল্পীদের কাছে প্রেমের প্রতীক হিসেবে ধরা দেয়। গ্রিক ও মিসরীয় পৌরাণিক কাহিনীতে ভিন্ন ভিন্ন স্ফিংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। গ্রিকরা অবশ্য স্ফিংসের দেহে নারীর সৌষ্ঠব প্রয়োগ করেছিলেন। গ্রিসে স্ফিংসের পরিচয় ধ্বংস ও দুর্ভাগ্যের বাহক এক দানবী হিসেবে। পৃথিবীর বৃহত্তম স্ফিংস ভাস্কর্যটির নির্মাতা মনে করা হয় রাজা ফারাও খাফরাকে। রাজা ফারাও খাফরা তার রাজবংশের চতুর্থ রাজা ছিলেন (২৭২৩-২৫৬৩ BC)। এ স্ফিংস ভাস্কর্যকে বলা হয় Khepri-Re-Atum, আরবি নাম Abual Hoi, যা অনুবাদ করলে হয় 'ফাদার অব টেরর' (Father of terror)। তবে গ্রিক নাম স্ফিংসই প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তবে গ্রিক পুরাণের স্ফিংস এবং মিসরীয় স্ফিংসের মধ্যে পার্থক্যের কথা না বললেই নয়। মিসরে স্ফিংসকে মানব হিসেবে দেখালেও গ্রিক পুরাণে এটা মানবী। গ্রিক কবি হেসিউডের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই স্ফিংস হচ্ছেন ইচিদনা এবং অথ্রুসের কন্যা। আর অন্য মতে তাইফুন এবং ইচিদনার কন্যা। এখানেও একে ভয়ঙ্কর দানবী হিসেবেই পরিচিত করা হয়েছে।
যত যাই হোক না কেন, কল্পনা কিংবা পুরাণের এই দানবী আজো শত শত মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
কাঁঠালের আমসত্ত্ব
কাঁঠালের কি আমসত্ত্ব হয় ? হয় ভাই এ দেশে সবই হয়। কুটিল বুদ্ধি , বাগ্মিতা আর কিছু জারি জুরি জানলে আপনি সহজেই কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানাতে পারবেন।
কাঁঠালের আমসত্ত্ব বানানের জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অ্যাকসিডেন্ট আরও বাড়বে
এরকম সুন্দরী বালিকাকে ট্র্যাফিক দায়িত্বে দিলে চালকদের মাথা ঘুরে আরেক গাড়ির সাথে লাগিয়ে দিয়ে পুরো রাস্তাই বন্দ হয়ে যাবে । ...বাকিটুকু পড়ুন
শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!
সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন
কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?
জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী
ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)
সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন