লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে ভাবলাম কাটাবনে নতুন ওঠা বই এর দোকান গুলো থেকে কোন বই কিনে নিয়ে আসি। ভাবা মত নীলখেত এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। কিন্তু নীলক্ষেত মোড় এ আসার পর মনে হল বলাকা গিয়ে হুমায়ুন আহমেদের ঘেটু পুত্র কমলাটাই দেখে আসা দরকার। বহু দিন দেশীয় সিনেমাকে প্রমোট করিনা! হুমায়ুন আহমেদের প্রতি একধরণের শ্রদ্ধা ও নিবেদন হয়ে যাবে একই সাথে। সেই সাথে যদি কিছু বিনোদনও পাওয়া যায়! সমস্যা হল একা আছি।নিজের এখন পর্যন্ত না দেখা গার্লফ্রেন্ড কে খুব মিস করলাম কিছুক্ষন। একা একা হলে যাওয়া ঠিক হবে নাকি চিন্তা করলাম। এভেঞ্জার্স আর মোস্ট ওয়েলকাম দেখার জন্য এতো মুখ খরচ করতে হয়নাই যতটা এই ঘেটু পুত্রের পিছনে খরচ করেছি! তারপরও কাউকে হলে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারলাম না। অভিযোগ আছে, বাংলার ম্যাক্সিমাম মানুষ কম শিক্ষিত হওয়ায় মেসেজ টেসেজ ওয়ালা মুভি এইদেশে চলেনা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজের পার্শ্বে অবস্থিত বলাকার দর্শক সংখ্যা এই ধারণার পক্ষে কোন প্রমাণ দেয়না। এই খানেও মোস্ট ওয়েলকাম বাম্পার হিট হয় আর কমন জেন্ডার এর মত ভালো মুভি দর্শক শুন্য থাকে। মুভি দর্শকের মেন্টালিটি নিয়ে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের আরো ভাবতে হবে বলে মনে হল।
যাই হোক যদি ডাক শুনে কেউ না আসে একলা চলো নীতি গ্রহণ করলাম। সাড়ে ছ’টার ডিসি টিকেট এর সিনেমা শুরু হল ছটা চল্লিশে।
এবার সিরিয়াস কথায় আসি। মুভির প্লট প্রসংগে হুমায়ুন আহমেদ যা বলেছেন তা হলঃ
‘প্রায় দেড়শ বছর আগে হবিগঞ্জ জেলার জলসুখা গ্রামের এক বৈষ্ণব আখড়ায় ঘেটুগান নামে নতুন সঙ্গীত ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। মেয়ের পোশাক পরে কিছু রূপবান কিশোর নাচগান করত। এদের নামই ঘেটু। গান হতো প্রচলিত সুরে, কিন্তু সেখানে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রভাব ছিল স্পষ্ট। অতি জনপ্রিয় এই সঙ্গীতধারায় নারী বেশধারী কিশোরদের উপস্থিতির কারণেই এর মধ্যে অশ্লীলতা ঢুকে পড়ে। বিত্তবানরা এইসব কিশোরকে যৌনসঙ্গী হিসেবে পাবার জন্যে লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় সামাজিকভাবে বিষয়টা স্বীকৃতি পেয়ে যায়। হাওর অঞ্চলের শৌখিন মানুষ জলবন্দি সময়টায় কিছুদিনের জন্যে হলেও ঘেটুপুত্র নিজের কাছে রাখবেন এই বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে বিবেচিত হতে থাকে। শৌখিনদার মানুষের স্ত্রীরা ঘেটুপুত্রকে দেখতেন সতীন হিসেবে।। এমন এক ঘেটুপুত্রই আমার এবারের চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র।’

মুভির শুরুতেই এই লেখাটা দর্শকদের মুভির পটভূমির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র গুলো হল শৌখিনদার চোধুরী সাহেব (তারিক আনাম খান), তার স্ত্রী (মুনমুন আহমেদ), তরুণ শিল্পী শাহ আলম (আগুন), ঘেটু দলের ওস্তাদ ফজলু (জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়), দলের ড্যান্স মাস্টার (প্রাণ রায়) আর ঘেটু পুত্র কমলা (মামুন)।
কাহিনীসংক্ষেপ
হাওর অঞ্চলের কোন এক এলাকার জমিদার চোধুরী সাহেব। সিনেমার শুরুতেই আমরা দেখতে পাই তরুণ চিত্র শিল্পী শাহ আলম এই রাশভারী জমিদার এর পোট্রেইট আঁকছেন। তার কিছুক্ষণ পরেই হাওড়ের জলে বজরায় করে আসতে দেখা যায় ঘেটু গানের দলকে। হাওড়ের পানি বন্দী তিনমাসে আনন্দ ফুর্তি করার জন্য চৌধুরী আনিয়েছেন তাদের। ঘেটু দলের ওস্তাদ ফজলু, তার নিজের ছেলে জহির যার ঘেটু নাম কমলা, দলের ড্যান্স মাস্টার আর অন্যান্য যন্ত্রীরা, এই হল ঘেটু দল। সিনেমাটি আবর্তিত হয়েছে ঘাটু কমলার প্রতি চোধুরীর শারীরিক আকর্ষণ, কমলাকে নিয়ে নিজের স্ত্রীর সাথে মনোমালিন্য, সেসময়ের ঐ অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থা আর গরীব মানুষের করুণ পরিণতি ঘিরে।
অন্যান্য
চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার আগে থেকেই নানা আলোচনা আর সমালোচনায় পরিবেশ মুখর ছিলো, যার প্রধান কারণ দেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ, তাঁর মৃত্যু এবং চলচ্চিত্রটির ব্যতিক্রমী এবং সাহসী বিষয়বস্তু। নয়া দিগন্ত পত্রিকা সহ কিছু উজবুক চলচ্চিত্রটিকে অতি সাহসিকতার দোষে দুষ্ট করেছে দেখেছিলাম। মুভিটি সমকামিতা কে প্রমোট করেছে, হিমু চরিত্রটির মত মানুষ জন কমলা হতে উৎসাহী হয়ে উঠবে, দেশ থেকে ধর্ম কর্ম উঠে যাবে এই রকম নানা অভিযোগ দেখলাম। মুভিটি দেখে আসার পর এই কথা জোর দিয়েই বলতে পারি এইসব সমালোচনার কোন ভিত্তি নেই। এখানে মোটেই সমকামিতাকে প্রমোট করা হয়নি বরং পুরো সিনেমা দেখলে শিশুদের প্রতি এহেন প্রকার নির্যাতঙ্কারীর প্রতি আপনার মন বিষিয়ে উঠবে। কমলার প্রতি আপনার সহানুভূতি জন্মাবে ঠিকই কিন্তু আপনি চাইবেন আর কোন কমলা যাতে সৃষ্টি না হয়, মানুষের কমলাইজেশন হওয়ার কোন সম্ভাবনা আমার চোখে পড়ে নাই। চরিত্রটি মোটেও হিমুর মত নয়। আর ধর্ম কর্ম উঠে যাওয়ার ব্যাপারে আর কি বলবো। পান থেকে চুন খসলেই আজকাল ধর্ম গেলো গেলো বলে রব উঠে।
মুভির সবচেয়ে সুন্দর দিক হল মুভির লোকেশন। হাওর অঞ্চলের সোন্দর্য্য, পানিবন্দী হাওড় অঞ্চল, পানি সরে যাওয়ার সময়কার অবস্থা চোখে পড়ার মত সুন্দর। সেটও অসাধারণ ছিলো। জমিদার বাড়ি, বাড়ির অন্দরমহল দেড়শ বছর আগের পরিবেশ ভালো ভাবেই ফুটিয়ে তুলেছে। সঠিক পরিবেশ ফুটিয়ে তুলতে বাড়ির অন্দরমহলে মূর্তির ব্যবহার বিশেষ বিশেষ সিনের উদ্দ্যেশ্যের পরিপূর্ণতা দান করে। কমলা চোধুরী সাহেবের রুমে ঢোকার আগে ভয়ংকর সিংহ মূর্তি, শাহ আলমের বানানো বাঘ আর হরিণের পুতুল রুপকের মাধ্যমে পরিবেশের ভংকরতাকে তুলে ধরেছে। কিছু কিছু জায়গায় হালকা রসের আবহ সৃষ্টি করেছেন ডিরেক্টর। প্রাণ রায়ের ডায়লগ দর্শককে ভালোই আনন্দ দেবে। কিন্তু মুনমুন আহমেদ যখন তার স্বামী কে কমলার কাছে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেন না তখন বাচ্চা মেয়ের মত হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে কান্না করার একটি সিন আছে যা হলে হাস্য রসের সৃষ্টি করেছে, কিন্তু ঐ মুহুর্তের পরিস্থিতির সাথে তা ঠিক যায়না।
হুমায়ুন আহমেদের আর সব ফিল্ম এর মত এই মুভির কুশিলবরাও সবাই ভালো অভিনয় করেছেন। মামুন এর অভিনয় চোখে পড়ার মত।

কিক অফ নাটকে মামুন এর অভিনয় বিরক্তি উৎপাদন করেছিলো। কিন্তু এখানে বেশ পরিপূর্ণ লেগেছে। বোধ করি এখানে পরিচালকেরো কিছু মুন্সিয়ানা আছে। তবে কিছু জায়গাতে এক্সপ্রেশনে ঘাটতি ছিলো বলে মনে হয়েছে। জয়ন্ত চট্টোপধ্যায় বরাবরের মতোনই অসাধারণ। আর তারিক আনাম খান এর চেহারাই জমিদারের মত। বেশ ভালো মানিয়ে গেছেন। গুলশান এভিনিউ এর মতো অখাদ্য কুখাদ্য টিভি মেগাসিরিয়ালে অভিনয় করে এই লোক নিজের প্রতি অবিচার করেছেন।

মুভির নাচ গান আকর্ষনীয়। এই ধরণের দলীয় সংগীত হূমায়ূন আহমেদের নাটক সিনেমাতে প্রায় সময়েই দেখা যায় কিন্তু এই মুভিতে কেনো জানি একটু আলাদা মনে হলো গানের পরিবেশনা গুলোকে।
চোধুরী সাহেবের চরিত্রটি বেশ ইন্টারেস্টিং। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়েন। প্রচুর দান খয়রাত করেন। ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এমন কোন কাজ করেন না। তার বাড়িতে নিয়মিত ধর্মের চর্চা হয়। কিন্তু সেই তিনিই আবার কমলার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করছেন, বেদাতি কাজ জেনেও নিজের ছবি আকাচ্ছেন। বস্তুত একটা সময় মনে হয় তার মত চরিত্র এখন কার সময়েও বর্তমান। আপনার আশে পাশে তাকালে এমন অনেক কেই পাবেন যারা ধর্মকে নিজের সুবিধা মত পালন করছেন। একটা সময় মনে হতে পারে কমলার প্রতি চৌধুরী সাহেবের কিছু ভালোবাসাও হয়তো আছে। কিন্তু সময়ের সাথে বোঝা যায়, যদি কোন আকর্ষণ কমলার প্রতি তার থেকে থাকে তা নিছকই ওই তিন চার মাসের সম্পর্কের জন্য এক ধরণের মায়া বাদে আর কিছু নয়। তাই সব কিছু জানার পরেও চৌধুরী সাহেব শেষ পর্যন্ত কমলার প্রতি সুবিচার করেননা।
মুভির কিছু বিষয় আরো ভালো ভাবে দেখানো যেতো। কমলাকে চৌধুরী সাহেবের রুমে হঠাত করেই যেন ঢুকিয়ে দেয়া হল। চৌধুরঈ তার লালসা পুরণ করার আগে কমলা রূপী জহির আর তার বাবার মানসিক অবস্থা আলাদা আবেদনের সৃষ্টি করতো বলে মনে হয়। যদিও পরে ফ্ল্যাশব্যাকে ঘেটু পরিবারের দারিদ্র্য আর আসহায় অবস্থা দেখানো হয়েছে কিন্তু সেটা কেমন যেন অসামঞ্জস্যপূর্ণ লেগেছে।
সব কিছু মিলিয়ে এই মুভিটি হয়তো শ্রাবণ মেঘের দিনে কে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। তবে ঘেটু পুত্র কমলার অবস্থান শ্রাবণ মেঘের দিনে থেকে বেশি দূরে নয় বলেই মনে করি। ব্যতিক্রমী কাহিনীই এই মুভির স্ট্রং পয়েন্ট। কিন্তু সামগ্রিক দেশীয় সিনেমা বাজারকে এই মুভি কিছু দিলো বলে মনে হয়নি। হুমায়ুন আহমেদের ফ্যানদের ভিড়ে শো গুলো হাউজফুল হয়েছে। হুমায়ুন আহমেদ বাদে অন্য কারো মুভি হলে এতোটা আলোড়ন সৃষ্টি করতোনা এই মুভি। অন্তত বাংলাদেশের দর্শকদের বর্তমান আবস্থা থেকে এ কথা বলা যায়। তবে বাংলাদেশের সিনেমায় এই বিষয়বস্তুর ফিল্ম এক নতুন সংযোজনই বটে।
ডাউনলোড লিংক
নিজ দায়িত্বে হলে গিয়ে দেখে আসেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৪:৪৫