কক্সবাজারের স্মৃতি ১
লেখার শিরোনাম দেখেই হয়তো অনেকের শিরপীড়া দেখা দিয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মানুষ মাত্রই কক্সবাজারকে ভালবাসে। বর্তমানের কক্সবাজার যতই ইটপাথরের জঙ্গলে পরিনত হোক আর সমুদ্র সৈকত যতই জনসমুদ্রে পরিনত হোক, সব কিছুর পরেও জায়গাটা সেই কক্সবাজার ই। না থাকুক সৈকত জুড়ে লাল কাঁকড়াদের ছুটোছুটি বা কলমীসদৃস বেগুনী ফুলের সমারোহ বা সামুক ঝিনুকের ছড়াছড়ি অথবা তারা মাছেদের মৃতদেহের রোদ্র স্নান। তারপরেও সেটা আমাদের ছোটকালের স্বপ্নের জায়গা, কক্সবাজার। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ অবিছিন্ন সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার (যদিও এখন অবিছিন্ন বলা যাবে কিনা আমার সন্দেহ আছে, অনেক জায়গাতেই সমুদ্র রাস্তার সাথে চলে এসেছে)। প্রথম সমুদ্র দেখার স্মৃতি কক্সবাজারে। যারা সমুদ্র দেখেছে, তাদের মাথার মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দের যে রেকর্ড থাকে, বাংলাদেশী মাত্রই কক্সবাজারের সমুদ্রের শব্দই রেফারেন্স হিসাবে রেকর্ড করা থাকে সবার মাথায়।
তারপরও কক্সবাজার আমার আর ভালোলাগেনা। কারন খুব ভালো লাগতো যে এক সময়। জায়গাগুলো আর আগের মত নেই, তাই আর ভালোলাগেনা। সেই আদিগন্ত প্রশস্ত সমুদ্র সৈকত আর নেই। নেই কক্সবাজার ঘুরতে আসা মানুষের সেই অবাক চোখের চাহনী। এখন বিচে জেট স্কির নাচানাচি আর প্রচন্ড শব্দে ডিজে গানের তালে তালে চলা তান্ডব। হোটেল মোটেলে ভীর, খাবার দোকানে নাই বসার জায়গা। একবার ঘুরতে গেলে মধ্যবিত্তের সারা বছরের বাজেটে টান পরার কথা নাইবা বললাম।
হা, কক্সবাজার এখন আমার ভালো লাগেনা। কারন আমি অনেকবার কক্সবাজার গিয়েছি। কক্সবাজারের পরিবর্তন গুলো দেখেছি। যেটা মোটেও কোন পজেটিভ পরিবর্তন না। আর মানুষ যেসব জায়গায় যেতে পছন্দ করে আমি সেসব জায়গায় যেতে চাই না। কারন ভীর থাকে। পর্যটকের ভীর আমার ভালো লাগেনা। গত ৮, ৯ আর ১০ সেপ্টেম্বর যে কক্সবাজার ট্যুরটা দিয়ে আসলাম, সেটা বোধহয় আমার ১১তম ট্যুর। অনেকেই আমার চেয়ে ঢের বেশি গিয়েছেন হয়তো কক্সবাজার। তবে আমি একটা জায়গায় ১১ বার যাওয়ার লোক না। জানি, বেঁচে থাকলে আমাকে আরও যেতে হবে। কারন, কক্সবাজারের দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার উপায় নেই।
আজ আমার মনে পড়ছে আমার প্রথম কক্সবাজার যাওয়ার স্মৃতি। এইচএসসি বা ইন্টারমিডিয়েট পরিক্ষার পর আমরা কয়েক বন্ধু মিলে পকেটে কিছু টাকা নিয়ে বেড়িয়েছিলাম ঢাকা থেকে। কয়জন বন্ধু ছিলো তাও মনে নেই। কারন সবাই আগে থেকে বন্ধু ছিলোনা। তবে সম্ভবত ৭ জন। সার্কেলের বন্ধু। আমি আর রিপন দুই প্রানের বন্ধু আর রিপনের জমজ ভাই লিটনের কলেজের ক্লাশমেট ৪ জন। ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার বাসে। আমাদের সাথে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাহেবের ছেলে ছিলো। তার দায়িত্ব ছিলো কক্সবাজারে আমাদের থাকার ব্যাবস্থা করার। পর্যটন কমপ্লেক্সের মধ্যে তখন শৈবাল, উপল, প্রবাল ও একটা ৩০ বেডের ডর্মিটরী ছিলো। আমরা চট্টগ্রাম থেকে ডর্মিটরীতে ৭টা বেডের বুকিং দিয়ে রওনা দেই। বাইচান্স যদি আসিক, মানে মেয়রের ছেলে যদি কোন ব্যাবস্থা না করতে পারে তবে চিৎকাইত করে সেই ডির্মিটরিতে থাকা যাবে। আমরা কক্সবাজার পৌছাই রাত আটটার দিকে। পর্যটনের মোটেল থেকে খুলনায় ফোন করে চেষ্টা করা হলো, কিন্ত নো রেজাল্ট। ডর্মিটরীর বেড টেড দেখে আমাদের সাথে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিশনাল আইজির ছেলে দেখালো পুলিশের ক্ষমতার খেলা। টিএনটি থেকে কোথায় যেন ফোনটোন করতেই থানা থেকে পুলিশ এসে আমাদের সবাইকে নিয়ে গেলো পুরাতন ঝিনুক মার্কেটের সাথের নতুন একটা হোটেলে। প্রতি দুজনের জন্য ডাবল বেড রুম বরাদ্ধ হয়ে গেলো ম্যাজিকের মতো। ৩ ফিটের খাটের বদলে ঝা চকচকে হোটেল রুমে আমরা হইচই করতে করতে দখল নিলাম। শুরুতেই হোটেলে ব্যাগ রেখে রেস্টুরেন্টে খেতে ছুটলাম। সাথে দু’জন পুলিশ। সদ্য কৈশর উত্তীন্ন আমরা খুব উত্তেজিত ছিলাম। স্বপ্নের কক্সবাজারে পৌছে গেছি, আহা। আর মেঘ না চাইতেই বাপ্পির বাপ সাইক্লোন পাঠিয়ে দেয়ায়। ঝাউবণ কাশবন বা পৌষী কোন একটা পুরোনো রেস্টোরেস্টে খেয়ে হোটেলে ফিরলাম। সবাই বাপ্পিকে শাসালো, তোর বাপের পুলিশ সারাদিন সাথে থাকলে তো সাড়ে সর্বনাশ ! হাউকাউ করার বিরাট সমস্যা হবে। রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে ফিরে পুলিশ দুজনকে বিদায় করা হলো। পুলিশ আংকেলরা আমাদের খুব সাবধান করলো রাতে যেন কোথায়ও না যাই। উনারা চলে যেতেই রাত এগারোটার দিকে আমরা আমাদের প্রথম সমুদ্র অনুধাবন অভিযানে নেমে গেলাম। অন্ধকার পথ ধরে সমুদ্রের দিকে হাটতে থাকলাম। সম্ভবত অমাবস্যা ছিলো ঐদিন। পিচ ঢালা অন্ধকার। এয়ারপোর্টের রানওয়ের পিছন দিয়ে একটা বিকল্প রাস্তা আছে ঐদিক দিয়ে সোজা সমুদ্রে যাওয়া যায়। এখন বাসগুলো শহরের যেখান থেকে ছাড়ে তার আগে। কোথায় যাচ্ছি, পথের অবস্থা কেমন কিছুই জানিনা। দুর থেকে ছায়া ছায়া ঝাউগাছের দেয়ালের দিক থেকে সমুদ্রের গর্জন কানে আসছিলো। ঐ শব্দের দিকেই আমরা মুগ্ধ হয়ে হাটছিলাম। পিছনের পুরোদিনের যাত্রার ক্লান্তি, টেনশন কিছুই মনে ছিলোনা। সাথের সবাই ঢাকার আদুরে বাবা মায়ের ভিতু ছেলে পেলে। এই সাপ, ঐ দেখ কালা কি যেন দাড়ায়ে আছে, এসব মজা করতে করতে হাটা। হাসাহাসি, আর নিজের অজান্তে গা শিওরে ওঠা। কিছু জায়গায় ঝাউ গাছের মধ্যে দিয়ে হাটতে হয়েছিলো। তখন এতকাছে সমুদ্রের শব্দে বুকের মধ্যে উত্তেজনা। হৃদপিন্ডের ধ্রিমধ্রিম শব্দ পাশের জনেরও শুনতে পাওয়ার কথা। কিন্তু সবার অবস্থা এক। হঠাৎ কে যেন চিৎকার করে উঠলো। পায়ে পানি লেগেছে। আকাশে আলো নাই তাই ফসফরাসের আলোও কম। একটু একটু করে ঢেউয়ের সাদা মাথাগুলো পরিস্কার হতে থাকলো আমাদের চোখের সামেনে। কি যে অদ্ভুত সেই অনুভুতি, বলে বোঝানো যাবে না কাউকে। হঠাৎ কে যেন প্রথম উপর দিকে তাকিয়ে চিৎকার, ‘আরে শালা আকাশে তাঁকা’। আমরা সবাই উপরে তাকিয়ে হা করে আছি। কে যেন বললো, শালা কক্সবাজারের আকাশে এতো তারা কেন রে? আমাদের ঢাকা দোষ করলো কি? আরও একচোট হাসাহাসি, এস্ট্রোনমিক্যাল জ্ঞান চালাচালি। একটা সময় পুলিশ আংকেলদের কথা মনে পড়লো, রাতে কোথাও যেতে মানা করেছিলো। একটু যেন অপরাধবোধ এসে গেলো আমাদের মাঝে। ঘুমও পাচ্ছিলো অনেকের। প্রাথমিক উত্তেজনা প্রশমিত হওয়ার পর আবার হোটেলের পথ ধরে ফেরা। হোটেলে ফিরে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরলাম। ঘুমানোর সময়ও উত্তেজনা কাজ করছিলো, রাতে দেখা আবছা সমুদ্রকে দিনের আলোয় দেখার অনুভূতি কি হতে পারে, সেটা ভেবে। রাতেই কি অদ্ভুত লাগলো, দিনে না জানি কেমন লাগবে!
পরের দিন নাস্তা খেয়ে সকাল ৯টার মধ্যে হোটেলে এসে হাফপ্যান্ট পড়ে রওনা দিলাম আগের রাতের পথ ধরে। রাতেই ভয়ংকর রাস্তাটা দিনে দেখে হাসি লাগলো। রাস্তাই বলা যায়না। পায়ে চলা কাঁচা পথ। ঝাউগাছের সাড়ি পেরিয়ে সমুদ্র সৈকতে আসতেই জীবনের সবচেয়ে আকর্ষনীয়টি দৃশ্য দেখা গেলো। তিন স্তরের বিশাল বিশাল ঢেউ এসে ভেঙ্গে পড়ছে সমুদ্র সৈকতে। কি তার শব্দ আর কি তার সৌন্দর্য। স্যান্ডেল আর গেঞ্জিটা খুলেই দৌড় দিয়ে লাফিয়ে পড়লাম বিশাল এক ঢেউয়ের উপর। আমার দেখা দেখি রিপনও দৌড়ে আসলো, কিন্তু বাকিরা আস্তে আস্তে। কারণ আমরা দু’জন ছাড়া কেউ সাঁতার পারেনা। দানি, মামুন সাবধানী মানুষ। বাপ্পি বডি বিল্ডার তবে পানি দেখলে পা দেখলাম কেমন কাঁপাকাপি করছে। তারপরেও চিৎকার চেঁচামেচির কমতি নাই। আসেপাশের দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন মানুষ নাই। দুরে, লাবনী বিচে অল্প কিছু মানুষ দেখা যাচ্ছিলো। আমরা বোধহয় ৩-৪ ঘন্টা সমুদ্রে ছিলাম। একটা বিপদজনক কাজ আমি খুব করছিলাম, যেটা এখন চিন্তা করলে গায়ে কাঁটা দেয়। সব ঢেউ সাঁতরে পার হয়ে মুল সমুদ্রে যেয়ে পড়লে আর পারের কিছু দেখা যায় না। বিশাল টেউ সব কিছুকে আড়াল করে দেয়। পিছনের গভীর সমুদ্র, ভয়ংকর একটা অনুভুতি হচ্ছিলো। তখন বেশ একটা এডভেঞ্চার এডভেঞ্চার মনে হচ্ছিলো। সবাই ঢাকা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত আমাকে আর রিপনকে নিয়ে কোন উচ্ছাস না দেখালেও আমাদের সাঁতার আর সাহসের কারিশমা দেখে ট্যুরে মধ্যমনি বানিয়ে দিলো।
তারপর দিন চাঁদের গাড়িতে করে হিমছড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতাটাও এখন পাওয়া মুস্কিল। মেরিন ড্রাইভ বলে কোন রাস্তা ছিলোনা। সমুদের পানির পাশে পাশে ভাটার সময় জীপে করে যেতে হতো হিমছড়ি। আমরা যখন চাঁদের গাড়ির পিছনের রডে ঝুলছিলাম তখন টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিলো। যারা বুঝার তারাই বুঝবে। কেমন ছিলো দৃশ্যগুলো। হিমছড়ি ছিলো বিরান একটা জায়গা। পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানি সমুদ্রে মিলছে। পানির পাশে কলমিটাইপ লতায় ভরা। পানি পেরিয়ে ঝর্নায় গেলাম। ছোট ঝর্না, কিন্তু পুরো জংলা। আমরা ঝর্ণার উপরে উঠে ভিতরের দিকে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গাড়ির ড্রাইভার বললো ভিতরে শাপ থাকতে পারে। সেই হিমছড়িকে এখন আর খুজে পাইনা। আসলে আর খুজিও না। হিমছড়িরা হারিয়ে গেছে অনেক অনেক আগে।
তাই এখনকার কক্সবাজার আমার ভালোলাগেনা। লাগবেওনা কখনও।
* আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু রিপন ২৭ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেছিলো অল্প দিনের জ্বরে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ৩:০৭