আলোকচিত্রঃ লেখক
গত কয়েক বছর ধরেই ট্রাভেলিং আমার প্রধান শখ। সাথে ছবি তোলা। আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গাতেই ঘুরতে যেতাম। ইদানিং ঘুরাঘুরির পরিধি বাড়িয়ে আশেপাশের দেশগুলোতে ভ্রমণ করা শুরু করেছি। ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া হয়ে আমার ভ্রমনের দেশের দুরত্ব ক্রমশ বেড়েছে, তবে হঠাৎ অস্ট্রেলিয়া ভ্রমন করতে যাওয়া হবে ভাবিনি। বরং বেড়ানোর পরিকল্পনায় ইউরোপের দেশগুলোই মাথায় ছিলো। কিন্তু গত বছর আগে আমাদের পরিবারে একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে। আমার বড় ভাই হঠাৎ করেই অস্ট্রেলিয়াতে শিফট্ করেছে। মেলবোর্নে। বেশ কয়েক বছর ধরেই পত্রিকায় খেয়াল করছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহরের তালিকার ১ নাম্বারে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের নাম আসছিলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলের ছাত্র ছিলাম। আমার জানা আছে পৃথিবীতে হাজার হাজার শহরের মধ্যে ১ নম্বরে নাম আসা চাট্টিখানি কথা না। তাই মেলবোর্ন শহর সম্পর্কে একটা আগ্রহ আগে থেকেই ছিলো। ভাগ্যের খেলায় ইউরোপের আগে অস্ট্রেলিয়াতেই বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ চলে আসলো।
বড় ভাইয়ের সহায়তায় ভিসা করে এপ্রিলের শেষ দিকে মেলবোর্নে রওনা দিলাম কোন পরিকল্পনা ছাড়াই। যাওয়া আসার ব্যবস্থা মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসে। বিশেষ অফারে ৬১ হাজার টাকায় টিকেট পাওয়াতে ৩ দিনের নোটিসে অস্ট্রেলিয়া যাত্রা করেছিলাম। সময়ের অভাবে মেলবোর্নের বন্ধু বান্ধবকে আগে থেকে জানানো হয়নি। ভাবলাম আগে আমি দেখে শুনে আসি, পরে বউ বাচ্চাসহ চরকি ঘোরা দেয়া যাবে আগামী বছর।
অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের ১০ দিন কোথায় ঘুরবো আগে থেকে কিছুই ঠিক করা ছিলোনা। শহর বলতে শুধু মেলবোর্ন দেখা হবে নাকি সাথে সিডনিতে যাওয়া হবে সেটাও ভেবে দেখা হয়নি। যদিও বড় ভাইয়ের বন্ধু রতন ভাই পই পই করে বলে দিয়েছিলো মেলবোর্নে ঘুরে সময় নষ্ট না করে সিডনির জন্য বেশি সময় রেখে দিও। আমার মাথায় এই ভ্রমনে অবশ্য দ্রষ্টব্য একটা জায়গাই নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম, সেটা হলো মেলবোর্নের নিকটে দ্যা গ্রেট ওসান রোড। বিশেষ করে টুয়েল্ভ এপোস্টেলস। প্রকৃতির এক নান্দনিক সৃষ্টি। সুমদ্রের পাড় ঘেঁেস ২০০ কিলোমিটার রাস্তা। রাস্তার পাশে অপূর্ব সুন্দর সমুদ্র তট। লক্ষ লক্ষ বছর সুমুদ্র আর পাহাড়ের ঠুকা ঠুকিতে তৈরী হয়েছে অদ্ভূত সুন্দর সব প্রাকৃতিক ভাস্কর্য। সমুদ্রের পানি পাথর ক্ষয় হয়ে তৈরী হয়েছে সামুদ্রিক গুহা আর মোটা মোটা কলাম আকৃতির পাহাড়ের। দেখতে খুব সুন্দর। মনে মনে ঠিক করেছিলাম কোন এক ফাঁকে যদি ভাইকে নিয়ে গ্রেট ওসান রোডে ঘুরে আসতে পারি ভালো, আর ভাইয়া না পারলে টুরিস্ট বাসে করে ঘুরে আসবো। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে, কেননা এই ভ্রমণে আমি শুধু গ্রেট ওসান রোড নয়, বরং মেলবোর্নের বেশ কিছু দ্রষ্টব্য জায়গা ছাড়াও সিডনি শহরের অপেরা হাউস, হারবার ব্রিজসহ আশে পাশের সুন্দর কিছু জায়গায় ঘোরাফেরা করতে পেরেছিলাম।
এপ্রিলের ২৬ তারিখের মেলবোর্ন সময় রাত আটটায় যখন মেলবোর্ন এয়ারপোর্টে পৌছালাম তখন থেকেই এবারের ভ্রমনটা আমার জন্য একটু অন্যরকম সেটা বুঝতে শুরু করছিলাম। সাধারনত বিদেশে কখনও আমাকে কেউ রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে আসেনা। এবার যখন এয়ারপোর্টে আমার নিজের ভাই আমাকে রিসিভ করতে আসলো তখন একটু অদ্ভুতই লাগছিলো। আরও মজা লাগলো যখন ভাইয়ার চালিত গাড়িতে করে বাসায় রওনা দিলাম। কারন ভাইয়া ঢাকাতে জীবনেও নিজে ড্রাইভ করেনাই, ড্রাইভার ছাড়া এক পা ও চলেনা। আর উনিই কিনা ধুমধাম করে এয়ারপোর্টের পার্কিং থেকে গাড়ী বের করে আমাকে নিয়ে ১০০ কিলোমিটার গতিতে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছে! জীবনের প্রয়োজনে ড্রাইভিং শিখে নিজের গাড়ি নিজেই চালাতে হয় এখানে। শুনলাম এতোদিন আসে পাসে চালাচ্ছিলো, এখন একটু দুরের জায়গায়ও নিজে থেকে গাড়ি চালানো শুরু করলো আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনার মধ্যে দিয়ে। অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের প্রথমেই সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজ বলা যায়। দুই দেশের জীবন যাত্রার মধ্যে কতটা তফাত সেটা যেন প্রথমেই টের পেয়ে গেলাম। সাই সাই করে ছুটে চলা গাড়ীর জানালা দিয়ে তাকিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ডুবে যেতে থাকলাম।
মেলবোর্নের শীতকালের আবহাওয়াটা বিচ্ছিরি হয়। ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে মেঘের ছায়ায় ঢাকা দিন। সাথে ঝোড়ো বাতাস। আর আমি যেদিন মেলবোর্নে প্রবেশ করলাম সেদিন থেকেই নাকি ঠান্ডা পড়তে শুরু করলো। এয়ারপোর্ট থেকে আসার পথেই টুকটুক বৃষ্টি পড়ছিলো। বড় ভাইয়ের বাসায় পৌছাতেই বেশ বৃষ্টি শুরু হলো। বাবু ভাইয়ের বাসা শহর থেকে বেশ কিছুটা দুরের ওয়ারীবি নামের শহরতলীতে, শহরতলীকে ওরা বলে সাবার্ব (সাব আরবান এরিয়া)। বাসাতে ভাবি আর ভাস্তির সাথে অনেকদিন পর দেখা হওয়ার হইচই শেষে খাওয়া দাওয়া করে টেলিফোনে আর ফেসবুকে আমার নিরাপদে অস্ট্রেলিয়া পৌছানোর সংবাদ দিয়ে ভাইয়ের সাথে অস্ট্রেলিয়া ভ্রমন বিষয়ে আলাপ করে নিলাম।
মেলবোর্ন পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহর হওয়ার অনেক কারনের মধ্যে বোধহয় সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থাটা একটা অন্যতম কারন। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ভিক্টোরিয়া বা পিটি(ভি) কার্ড থাকলে আপনি ২৪ ঘন্টা মেলবোর্নে নিরাপদে ঘুরাঘুরি করতে পারবেন। যেকোন ষ্টেশনে বা ডিপার্টমেন্ট ষ্টোরে পিটি কার্ড কিনতে পাওয়া যায়। প্রতিটি ষ্টেশনে বা বাস স্টপেজে এটিএম কার্ডের মতো মেশিন দিয়ে কার্ডে কিছু ডলার টপ-আপ করে নিলে পুরো মেলবোর্ন আপনার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। আর বাস বা ট্রেনের নাম্বার ও অন্যান্য তথ্যের জন্য একটু মোবাইল এপস্ ডাউনলোড করে নিতে হয়। এই এপস্ টিই আপনাকে বলে দিবে অমুক যায়গায় যাওয়ার জন্য আপনাকে সবচেয়ে কাছের কোন বাস ষ্টপ বা ট্রেন স্টেশনে যেতে হবে, কত নাম্বার বাস বা ট্রেন ধরতে হবে। আমি আমার পিটি কার্ড হাতে পেলাম।
বাংলাদেশ থেকে আট নয় হাজার মাইল দুরে কবরের মতো নিস্তব্ধ একটা জায়গায় হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় হালকা কাঁপতে কাঁপতে বউ বাচ্চার কথা মনে পড়ে গেলো। আর মনে মনে বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহর থেকেও নিজ দেশে বসবাস করা আমার জন্য বেশি আরামের।
আমার অস্ট্রেলিয়া সফরের মোট সময় ছিলো ১০ দিন। এই ১০ দিনের মধ্যে সিডনি শহরে থেকেছি ৩ দিন। মেলবোর্ন থেকে সিডনি ১ ঘন্টা ১৫ মিনিটের প্লেন জার্নি। পুরো ১০টি দিন দেখতে দেখতে কেটে গিয়েছিলো কিছু বোঝার আগেই। অসংখ্য কিছু না দেখার হতাসার চেয়েও অনেক কিছু দেখা ও জানা হয়েছে দেখে খুশি মনেই দেশে ফিরেছি।
অস্ট্রেলিয়া ভ্রমনের প্রথম দিন বিকালে ট্রেনে করে মেলবোর্নের ফ্লিন্ডারস্ স্টেশনে নেমে ফেডারেশন স্কয়ার দেখে ইয়ারা নদীর পাড় দিয়ে হাটাহাটি করলাম। আমাদের প্রথম দিনের ঘুরাঘুরিতে পাশে পেয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণরত বড় ভাই ওয়াদুদ ভাইকে। মেলবোর্নকে কেন অস্ট্রেলিয়ার খেলাধুলার রাজধানী বলা হয়, তার অনেক নজির প্রথম দিনই দেখতে পেলাম। দুর থেকে দেখা হলো ইতিহাদ স্টেডিয়াম, মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড (এমসিজি) ও অস্ট্রেলিয়া ওপেনের স্টেডিয়াম (এরিয়ান্স এরিনা)। ইয়ারা নদীর পাড় দিয়ে হাটার সময় অস্ট্রেলিয়া তথা পৃথিবীর দক্ষিন গোলার্ধের সবচেয়ে উচু বিল্ডিং ইউরেকা স্কাই ডেকটা খুব চোখে পড়ছিলো। সময় না থাকাতে ওটার উপরে আর উঠা হয়নি প্রথম দিন। ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে মেলবোর্ন শহরের ফ্লেভার বোঝার চেষ্টা করলাম শুধু। চারদিকে চলমান ট্রামগুলোকে খুব ভালো লাগছিলো। আমরাও ঘরে ফেরার আগে ট্রামে করেই ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত গেলাম। ঘরে ফেরার ট্রেন ধরতে সাউদার্ন ক্রশ স্টেশনে যেতে হলো। তারপর আমরা ট্রেনে করে বড় ভাইয়ের বাসায় ফিরলাম। ওয়াদুদ ভাইকে মাঝ পথেই বিদায় জানিয়েছিলাম।
দ্বিতীয় দিনে বড় ভাইকে নিয়ে দ্যা গ্রেট ওশান রোডের ভ্রমণটা ছিলো মনে রাখার মতো। জিপিএস চালিয়ে ২০০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে আবার বহাল তবিয়তে যে ফিরতে পারবো সেটা আমাদের নিজেদেরও বিশ্বাস হচ্ছিলো না। ভাইয়ের আগের সবচেয়ে দুরের যাত্রা ছিলো মেলবোর্ন এয়ারপোর্ট যেটা উনি আগের রাত্রে আমাকে আনতে গিয়ে করেছে। তাই সাহস করে যে আমরা ২০০ কিলোমিটার চলে যাবো সেটা বেশ একটা এডভেঞ্চার টাইপ ব্যাপার বলা যায়। ভাবিকে না বলেই আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম দ্যা গ্রেট ওশান রোড অভিমুখে। ভাইয়া পরিচিত অনেকের সাথেই কথা বলছিলো কিন্তু পরিচিত বেশিরভাগ মানুষই আমাদের নিরুতসাহিত করার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু ভাইয়া সাহস করে রওনা দিয়ে দিলো। সাহস করা যে ভুল ছিলোনা সেটা আমরা পুরো রাস্তাতেই অনুভব করেছিলাম। অসাধারন সেই ড্রাইভিং এক্সপেরিয়েন্সটা উপভোগ করতে করতে অস্ট্রেলিয়ার হাইওয়ের সৌন্দর্যর প্রশংসা করতে করতে আমাদের গন্তব্যের দিকে এগোতে লাগলাম। রাস্তায় দুই তিনবার গাড়ি থামিয়ে হালকা নাস্তা আর কফি খেয়ে নিলাম কেএফসি আর ম্যাকডোনাল্ডস্ থেকে। পুরো রাস্তাতেই মেঘ বৃষ্টির খেলা চলছিলো, কিন্তু গন্তব্যে পৌছাতেই শুরু হলো বৃষ্টির ফাইনাল এ্যাটাক। প্রবল বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যেই টুয়েলভ্ এ্যাপোষ্টেলস্ দেখতে দেখতে মুগ্ধতার চুড়ান্ত জায়গায় পৌছে যাচ্ছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম এই জায়গা এতো অল্প সময়ের জন্য দেখাটা ঠিক না। বেশ সময় নিয়ে দেখতে আসবো বউ বাচ্চা নিয়ে। কালো মেঘে ঢাকা সমুদ্রের প্রবল বাতাসে বড় বড় ঢেউয়ে সমদ্রের সেকি মাতামাতি আর ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড়ের স্তম্ভগুলো দেখে বৃষ্টি আর ঠান্ডার কথা মাথা থেকে সরিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে ছবি তুলে নিলাম বেশ কিছু।
আরো আসছে।
অস্ট্রেলিয়া ভ্রমনের জন্য ১০ দিন বেশ কম সময়। বিশাল একটি দেশের খুব অল্প কিছু অংশই হয়তো দেখেছি। তবে যেটুকু দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে খুব চমৎকার একটি দেশ। প্রাকৃতিক ভাবে সুন্দর এবং অসম্ভব নিয়মতান্ত্রীক আধুনিক দেশ। বেশ কিছু ছবি এই লেখাটির সাথে দেয়া হলো যার মাধ্যমে আপনারা মেলবোর্ন ও সিডনি শহরের সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পেতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ ভোর ৪:৩৬