দার্জিলিং ভ্রমণ: প্রথম পর্ব
দার্জিলিং ভ্রমণ ৩য় পর্ব
(পুরো ভ্রমণ কাহিনীটি লিখা হয়েছে ব্লগ ষ্টাইলে। এ লিখাটি পড়লে দার্জিলিং ও তার আসে পাশের জায়গা সম্পর্কে স্বচ্ছ একটি ধারনা হবে আমি আশাকরি।)
দার্জিলিং ভ্রমণের এটি দ্বিতীয় পর্ব। তবে যারা আগের পর্বটি পড়েননি, তাদের বোঝার জন্য আমাদের ট্যুর নিয়ে ছোট্ট একটি ভূমিকা প্রথমেই দিয়ে নিচ্ছি।
গত ২৯শে মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল ২০১৩ এই সাত দিন আমরা চার বন্ধু মিলে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের পার্বত্য শহর দার্জিলিং ও এর আশে পাশের কিছু জায়গা ভ্রমণ করেছি। ট্যুরটি ছিলো ব্যচেরল ট্রিপ, অর্থাৎ বৌ বাচ্চা ছাড়াই আমরা ৬-৭ দিন দার্জিলিং ও তার আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমাদের চারজনের টিম। টিম মেম্বারা হচ্ছে - আমি আনিসুল কবীর খোকন, আমানউল্লাহ বিন মাহমুদ আমান, তৌফিক আখতার লিটন ও মোঃ গোলাম মুকিত জুয়েল। আমরা সবাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র।
২৯শে মার্চ রাত ৯ টায় কল্যাণপুর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। বিআরটিসি এবং শ্যামলী এস আর পরিবহণের বাসে করে ঢাকা থেকে লালমনিরহাট জেলার বুড়িমারী সীমান্ত পেড়িয়ে ভারতের চেংড়াবান্ধা হয়ে পশ্চিম বঙ্গের শিলিগুড়ি শহরে আমাদের বাস জার্নি শেষ হয়। শিলিগুড়ি থেকে পাবলিক জিপে করে দার্জিলিং জেলার ছোট্ট শহর মিরিক ভ্রমণে আসি ৩০শে মার্চ। মিরিক ভ্রমণের আদ্যপান্ত ট্রাভেল এন্ড ফ্যাশন এপ্রিল-মে সংখ্যায় আলোচনা করা হয়েছে। মিরিক ভ্রমণ শেষে আমাদের পরবর্তি লক্ষ্য ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম মানেভঞ্জন।
১০-১৫ বছর আগে সমরেশ মজুমদারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘‘গর্ভধারিনী” পড়েছিলাম। উপন্যাসটিতে দার্জিলিংয়ের কাছাকাছি ভারত নেপাল সীমান্ত এলাকার সান্দাক্ফু ও ফালুট নামের পাহাড়ী এলাকার অদ্ভুত সুন্দর বর্ননা আছে বিশেষত কাঞ্চনজঙ্ঘা শৃঙ্গের দৃশ্যপট লেখক যেভাবে তুলে ধরেছেন তা আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায় এখনও গেঁথে আছে। সেটা ছিলো উপন্যাসের একটি খন্ডিত অংশ। কিন্তু আমাদের এবারের দার্জিলিং ট্যুর যেন বাস্তবে থেকেও নিজেদের উপন্যাসের চরিত্রে পরিনত করার মতো। সান্দাকফু না গেলেও সান্দাকফুর কাছাকাছি ঘুরে আসাটা বর্তমান ছেলে পেলেদের ভাষায় যাকে বলে ‘‘অসাম্” টাইপের কিছু।
আমাদের এবারের ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিলো দার্জিলিং ও তার আশপাশের সুন্দর জায়গাগুলো ভ্রমণ ও সাথে সাথে মাউন্টেন ট্রেকিংয়ের ছোটখাট অভিজ্ঞতা অর্জন। পুরো ভ্রমণ আইটেনারী যেভাবে সাজানো ছিলো : ঢাকা থেকে বুড়িমারি/চেংড়াবান্ধা বর্ডার (ভারত) - শিলিগুড়ি - মিরিক - মানেভঞ্জন - চিত্রি - মানেভঞ্জন - দার্জিলিং - কালিম্পং - শিলিগুড়ি - ঢাকা। বেশ বড় ভ্রমণসূচি। আগেই বলেছি সান্দাকফু ট্রেক শুরু হয় মানেভঞ্জন থেকে। পূর্বহিমালয়ের ট্রেকিংয়ের উল্লেখযোগ্য একটি পথ হচ্ছে সান্দাকফু ট্রেক। ট্রেকটির মোট দূরত্ব ২৯ কিলোমিটার (মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত)। সর্বোচ্চ স্থান সান্দাকফুর উচ্চতা ৩৬৫৮ মিটার বা ১২০০০ ফুট। মানেভঞ্জনের উচ্চতা ৬৮০০ ফুট। এটা একটি উপত্যকা। দুপাশে বিশাল পর্বত খাড়া দেয়ালের মতো দাড়িয়ে আছে। শীতকালে মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু পর্যন্ত সব জায়গায় বরফ পড়ে। বেশীরভাগ মানুষ নেপালী বংশদ্ভূত।
মানেভঞ্জনের প্রকৃতিক দৃশ্য।
মিরিক ভ্রমণশেষে ৩১শে মার্চ দুপরের খাবারের পর মানেভঞ্জনের দিকে রওনা করি। উল্লেখ্য মিরিক লেকের পাড় থেকেই সব ধরনের যানবাহন বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। প্রধানত দার্জিলিংগামী যানবাহনের সংখ্যাই বেশী, তবে উল্টা পথে শিলিগুড়ির দিকেও অনেক জিপ ও ছোট গাড়ীকে যেতে দেখা যায়। দুপুরে খাওয়া শেষ করে আমরা চারজন হোটেল থেকে ব্যাগ বোঁচকা পিঠে ঝুলিয়ে মিরিক লেকের পাড়ে পৌছে যাই। আমরা প্রথমেই রিজার্ভ ট্যাক্সি বা জিপ নিয়ে মানেভঞ্জনে যাওয়ার চেষ্টা করি। বলে নেয়া ভালো মানেভঞ্জনের অবস্থান দার্জিলিংয়ের উত্তর পশ্চিমে যা মিরিক দার্জিলিং রোডের মাঝামাঝি সুখিয়াপোখড়ি নামে একটি জায়গায় নেমে অন্য পথ ধরে ৭ কিলোমিটার দূরত্বে যেতে হয়। যেহেতু মানেভঞ্জন একটি ছোট্ট শহর বা বলা যায় পাহাড়ী বর্ধিষ্ণু গ্রাম ফলে মিরিক থেকে খুব বেশী মানুষ ওখানে যাতায়াত করে না। মাত্র দুই আড়াই ঘন্টার রাস্তা হলেও দেখা গেলো ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আমাদের কাছে মিরিক থেকে মানেভঞ্জনের ভাড়া চেয়ে বসলো আড়াই হাজার রূপি, কারন তাদেরকে ফেরার সময় মানেভঞ্জন থেকে খালি ফিরতে হবে। আড়াই হাজার রূপী আমাদের চার জনের জন্য খুব বড় কিছু না হলেও আমাদের আগে থেকে নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অর্থাৎ ’যথা সম্ভব পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের’ সিদ্ধান্তের কারনে মিরিক দার্জিলিং বাসের টিকেট কেটে ফেললাম। মিরিক থেকে দার্জিলিংয়ের টিকেট কাটা হলো যদিও আমরা পুরো পথের তিনভাগের দুভাগ যাবার পরেই নেমে যাব। বাস ভাড়া পড়লো জনপ্রতি ৭০ রূপি। আড়াই হাজার রূপী থেকে ২৪০ রূপীতে খরচ নেমে আসায় আমাদের ভিতরেও একটা আত্মবিশ্বাসী ভাব এসে গেলো। যদিও মনে মনে আফসোস করলাম; রিজার্ভ গাড়ী থাকলে রাস্তার মাঝে ভালো কোন দৃশ্য দেখলে গাড়ী থামিয়ে ছবি তোলার সুযোগ পাওয়া যেতো। দার্জিলিং ভ্রমণের প্রথম থেকেই সুন্দর দৃশ্যের অভাব ছিলোনা তাই মনের ভিতরের আফসোসকে কান ধরে বের করে দিতে বেশী কষ্ট হলোনা। শুরু হলো আমাদের বাস যাত্রা। মিরিক টু মানেভঞ্জন ভায়া সুখিয়াপোখরি। আমরা নামবো সুখিয়াতে। ওখান থেকে মানেভঞ্জন আলাদা ভাবে যেতে হবে।
মানেভঞ্জনে আমাদের ছবি তোলা
মিরিক থেকে মানেভঞ্জনের পথটি ছিলো মনে রাখার মতো। প্রথম থেকেই পাহাড়ী পথটি পাহাড়ের গা বেড়ে যেভাবে ওঠা নামা শুরু করলো, প্রথম দিন হলে বেশ ভয় পেয়ে যেতাম। পাবলিক বাস হওয়াতে অন্যান্য যাত্রীদের নিরুদিগ্ন চেহারা আমাদের সাহস যোগাতে লাগলো। আমরাও বাসের জানালা দিয়ে রাস্তার পাশের ৫০০ বা ১০০০ ফুট নিচু খাদের দিকে তাকিয়ে ঘুম ঘুম চেহারায় হাই তুলতে লাগলাম। জুয়েল যথারীতি নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে লাগলো। মিরিক থেকে কিছুদুর যাবার পর বাস চড়াই ভেঙ্গে শুধুই উপরের দিকে উঠতে থাকলো। পাহাড়ের গা পেচিয়ে পেচিয়ে উপরে উঠে চললো এক নাগাড়ে। একপাশে পাহাড়ের দেয়াল আরেক পাশে খাদ। পাহাড়ের উপরে সমতল কোন জায়গা নেই বললেই চলে। কিছুক্ষণ আগে যে রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম সেটাকেই ২০০ ফুট নিচে দেখতে পাচ্ছিলাম কয়েক মিনিট যেতে না যেতেই। ফেলে আসা রাস্তাকে খুব অচেনা লাগছিলো অনেক উপর থেকে দেখে। পেছনের মিরিক শহর আমাদের কাছ থেকে ধীরে ধীরে দুরে সরে যাচ্ছিলো। এক দেড় ঘন্টা যাবার পর আমার মনে হলো আমরা অনেক বেশী ওপরে উঠে গেছি। কারন প্রায় এক ঘন্টা সময় ধরে আমাদের বাস শুধু চড়াই ভেঙ্গে উঠেই গেছে। নিচের দিকে আর নামেনি। সীমানা বাজার বলে একটা জায়গা যেটা নেপাল সীমান্ত পশুপতি দরজার খুব কাছে। সবচেয়ে উচু জায়গা বলে মনে হলো আমার। ওখান থেকে বাস আবার উৎরাইয়ের পথে অর্থাৎ নিচ দিকে নামতে লাগলো। আমাদের বাসটিকে এতটা খাঁড়া পথ বেয়ে সাবলীল ভাবে নেমে আসতে দেখে ভারতীয় যানবাহনের প্রতি মনে মনে যতো হাস্যরস ছিলো তার জায়গায় বেশ শ্রদ্ধা বোধ তৈরী হতে লাগলো। এসব এলাকার ড্রাইভাররা খুব ভালো ড্রাইভিং করে। একজন আরেক জনকে সাইড দিতে সময় ব্যয় করেনা বা অতিরিক্ত জোরে গাড়ি চালায় না। রাস্তার মধ্যে একটি ইন্টারেস্টিং বিষয় দেখলাম। পাহাড়ের গায়ে অনেক সুন্দর সুন্দর দোতালা একতালা বাড়ী। আর প্রায় বাড়ীর সামনেই টাটা ন্যানো গাড়ী দাড়িয়ে আছে। এতো উচু পাহাড়ে টাটা ন্যানো নিয়ে ওরা ভালোই ঘোরাফেরা করে। অসুবিধা হয়না।
বাস কন্ডাক্টারকে বলা ছিলো তাই মনে করে আমাদের সুখিয়াপোখরি নামিয়ে দিলো। মিরিক থেকে বাস ছেড়েছিলো ২.১৫তে। আমরা সুখিয়াতে নেমে ৪টার সময় একটি মারুতি কার ভাড়া করলাম মানেভঞ্জন পর্যন্ত। সুখিয়া থেকে মানেভঞ্জনের রাস্তা বেশ ভাঙ্গাচোরা। অপেক্ষাকৃত কম মানুষ যাতায়াত করে বলে হয়তো সব সময় ঠিকঠাক করা হয়না। জিপিএস ম্যাপ অনুযায়ী মানেভঞ্জন মাত্র ৭ কিলোমিটার দেখালেও আমাদের পৌছাতে পৌছাতে প্রায় ৩০ মিনিট লেগে গেলো। বিকেল হয়ে গেলো পৌছাতে পৌছাতে। গাড়ি থেকে নামতেই স্থানীয় লোকদের মধ্যে দু’তিন জন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো হোটেল লাগবে কিনা? চারজনের জন্য থাকার জায়গা লাগবে শুনে নিজেদের ভিতরে কথা বার্তা খোঁজ খবর করে এসে একজন জানালো যে কোন হোটেলে যায়গা নাই, আমরা চাইলে হোম ষ্টের অর্থ্যাৎ মানুষের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করা যাবে। আমরা বাসায় থাকতে রাজি হয়ে যাই। গাড়ী ভাড়া মিটিয়ে এক নেপালী যে আমাদের হোম ষ্টের ব্যবস্থা করলো, ওর পিছে পিছে রওনা দেই। মানেভঞ্জন খুবই ছোট একটি জায়গা। একটি রাস্তার দু’পাশে কিছু ঘরবাড়ী নিয়ে গড়ে ওঠা পাহাড়ী লোকালয়। অধিকাংশ মানুষ নেপালী বংশদ্ভূত। মজার ব্যপার আমরা যে বাসায় উঠেছিলাম সেই বাসাটার ভৌগোলিক অবস্থান নেপালের ভিতরে। মানেভঞ্জন শহরের মধ্যেই নেপাল বর্ডার। পরবর্তীতে চলাফেরা করার সময় প্রায়ই জিজ্ঞেস করে নিচ্ছিলাম আমরা কোথায় আছি, নেপালে নাকি ভারতে? নেপাল ভারত সীমান্ত নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে কোন দন্দ নেই, দুদেশের মানুষ একত্ম হয়ে বসবাস করছে। কোন চোরাকারবারী বা সীমান্ত সংঘাত নেই। উপত্যকা হওয়ায় এখানে প্রচন্ড বাতাস থাকে। আবহাওয়া দার্জিলিংয়ের মতোই। মার্চ মাসে বাংলাদেশের ডিসেম্বর মাসের মতো তাপমাত্রা, তবে রাতে তাপমাত্রা অনেক কমে আসে। সকালবেলা হাতমুখ ধোয়া ও ওয়াসরুমে যাওয়াটা কষ্টকর।
চিত্রির পথে অসাধারন দৃশ্য
আগেই বলেছি হোটেল না পেয়ে একটি নেপালি বাসায় উঠেছি আমরা। বাসায় আপাতত দু’জন মানুষ - স্বামী ও স্ত্রী, তাদের দুই মেয়ে দার্জিলিংয়ে পড়ালেখা করে। দুজনেই ছোটখাট, তবে স্বামী ভদ্রলোকের চেহারা কম বয়স্ক বালকের মতো। একরাত থাকার পরে বুঝলাম স্বামীর চেয়ে স্ত্রী কাজে কর্মে অনেক দক্ষ। আমাদের সমস্ত রান্না বান্না, চা, গরম পানি যখন যা চেয়েছি ভদ্রমহিলা সাথে সাথে করে দিয়েছে। স্বামী ভদ্রলোক কোন কাজ না করলেও আমাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসি দিয়ে হাত জোর করে প্রনাম করেছে যখনই দেখা হয়েছে। বাসায় তিনটি রুম ছিলো। প্রথমটি বাহিরের ঘর, সাথে রান্না ও ডাইনিং। মাঝে আমাদের জন্য থাকার ঘর। দোতালা খাটে চারজন থাকার ব্যবস্থা। একসেট সোফা ও টেলিভিশন। একটা ছোট চৌকিও ছিলো। ছিমছাম। আরেকটি ঘরে স্বামী স্ত্রী থাকেন। ঝটপট চা খেয়ে আমরা বের হয়ে পড়লাম আশপাশে ঘুরে দেখার জন্য এবং আগামী কালের এডভেঞ্চার ট্রিপ কোথা থেকে শুরু করবো তা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। আসার পথে আমাদের বাসার (চমকে যাবার কিছু নেই, আমাদের বাসা মানে যে বাসায় আমরা আশ্রয় নিয়েছি সেটা) খুব কাছেই একটি হিন্দু মন্দির ও বৌদ্ধ প্যাগোডা দেখেছিলাম। সন্ধা পর্যন্ত হিন্দু মন্দির ও প্যাগোডা দর্শন করলাম। দু’পাশের বিশাল পর্বতের ঢালের অনেক ছবি তুললাম আমরা। প্রচন্ড ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো মানেভঞ্জন দিয়ে। ঠান্ডা মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতির কমতি ছিলো না। ফলে ভালোই লাগছিলো। আরেকটি বিষয়। মানেভঞ্জনে আগত সব বিদেশী টুরিষ্টকেই ওখানের সরকারী অফিসে পাসপোর্ট এন্ট্রি করে নিতে হয়। আমরাও এক ফাঁকে পাসপোর্ট জমা দিয়ে এন্ট্রি করিয়ে নিলাম। মানেভঞ্জন উপত্যকাটা কিছুটা ইংরেজী অক্ষর ভি এর মতো দেখতে। উত্তর দক্ষিণে বিশাল দুটি পাহাড়। পূর্ব পশ্চিমে খোলা। একটি পাহাড়ের দিকে থেকে আমরা এসেছি। তার পরের দিন আরেকটি পাহাড় ধরে আমরা প্রায় ২০০০ ফুট উচ্চতা অতিক্রম করে চিত্রি পর্যন্ত যাবো।
সেদিন সন্ধাবেলায় হিন্দুমন্দির ও বৌদ্ধ প্যাগোডায় ঘুরাফেরা করে আর বাজারের চায়ের দোকানে চা রসগোল্লা খেয়ে নেপালী বাসায় ফিরে আসি ৭.৩০ এর দিকে। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিলো যখন চিন্তা করছিলাম বাংলাদেশ থেকে কতো দূরে আর প্রায় ৭০০০ ফুট উচু উপত্যকায় এক নেপালি বাসায় রাত কাটাচ্ছি আমরা। রাতে ডিম, সালাদ, সব্জি আর ডাল দিয়ে খাওয়াটা ভালোই লাগলো। জুয়েল যথারীতি খাওয়া দাওয়ার প্রচুর প্রশংসা করলো। জুয়েলের সাথে আমরাও সহমত পোষন করলাম। কারন খাওয়া দাওয়ায় সেদিন জুয়েলের সাথে আমরাও কম যায়নি। খাওয়া দাওয়ার পর আরও বেশ কিছুক্ষন আড্ডা মেরে শুতে গেলাম। দোতালা খাটের উপরতালায় আমি ও আমান। নিচে লিটন ও জুয়েল। রাতে বুঝতে পারছিলাম বাহিরে প্রচন্ড ঠান্ডা। শোয়ার সময় প্যান্ট ও জ্যাকেট চেন্জ না করেই লেপের ভিতরে শুয়েছি। ঠান্ডায় অসুবিধা হয়নি।
১লা এপ্রিল, ২০১৩। সকাল বেলা উঠে দেখি জুয়েল আর লিটন আগেই উঠে বসে আছে। ওরা দুজন ভয়ার্ত মুখে জানালো গতকাল রাতে কি যেন একটা জন্তু আমাদের রুমের পাশে এসেছিলো। মোবাইল বের করে দিলো রেকর্ড করা শব্দ শোনানোর জন্য। মোবাইল থেকে যে শব্দ শোনা গেল তাতে আমরা বেশ ভয়ই পেয়ে গেলাম। কিন্তু মুখে বললাম ‘ধুর, আজাইরা কি না কি?’ ওদেও মুখ বেশিক্ষন গ¤ী¢র থাকলোনা দেখলাম হাঃহাঃ শব্দে হেসে একজন আরেক জনের উপর গিয়ে পড়ছে লিটন জুয়েল। ‘শালা তোদের নাক ডাকার জন্য আমাদের বাড়িওয়ালা ও বাড়িওয়ালী পর্যন্ত ঘুমাতে পারে নাই’ আমাদের কথা বাদই দিলাম জুয়েল হাসতে হাসতে চিৎকার করলো। যাক, নিজেদের ঘুমের কোনো বেঘাত হয়নি দেখে আমি আর আমান ওদের হৈ চৈ বেশি পাত্তা দিলাম না। সবাইকে হাত মুখ ধোবার জন্য ও বাথরুম সারার জন্য তাড়া দিলাম। যথারীতি সবচেয়ে প্রথমে মুখ ধুতে গেলো জুয়েল। যখন ফিরলো দেখলাম ওর মুখ শুকনা। বললো বদনা দিয়ে পানি নারে ছুরি বেড় হচ্ছে, এত্তো ঠান্ডা। যাক একে একে মুখে পিছে ছুরির আঘাত সহ্য করে হাতমুখ ধোয়া হলো। ডিম রুটি সব্জি ও চা দিয়ে নাস্তা করে সবাই রেডি হয়ে গেলাম পরবর্তী এডভেঞ্চারের জন্য। ঠিক হলো মানেভঞ্জন থেকে চিত্রী ৩ কিলো রাস্তা যা প্রায় ২০০০ ফিট উচ্চতা পর্যন্ত উঠতে হবে। দুপুর ১২টার মধ্যে চিত্রী পর্যন্ত ঘুরে এসে মানেভঞ্জন পাট চুকিয়ে আমরা দার্জিলিংয়ের দিকে রওনা হবো।
মানেভঞ্জন থেকে চিত্রীর পথ মাত্র ৩ কিলোমিটার কিন্তু উচ্চতা ২০০০ ফিট। বুঝতেই পারছেন এতো কম রাস্তা যখন এতটা উচুতে যায় তখন কতোটা খাড়া হতে পারে। প্রায় ৬০ ডিগ্রি কোনে রাস্তাটি পাহাড়ের গা বেড়ে উঠে গেছে। রাস্তার চেহারা দেখে সবার মুখ শুকনা ছিলো। আমান চাচ্ছিলো গাড়ী রাস্তা ধরে যেতে। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। ট্রেকিং করতে এসেছি, ট্রেকিংয়ের পথ ধরে যাওয়াই ভালো। স্থানীয় মানুষরাও গাড়ীর রাস্তা ব্যবহার করতে মানা করছিলো। আর আমরা মনে করছিলাম গাড়ী রাস্তা অনেক ঘুরে যাবে। সময় বেশী লাগার চান্স বেশী থাকবে। ভাগ্যিস আমাদের ব্যাগ বোচ্কা নেপালি বাসায় রেখে চিত্রি রওয়ানা দিয়েছিলাম। ব্যাগ নিয়ে এতোটা উপরে ওঠা আমাদের জন্য সম্ভব ছিলোনা। যাক বিসমিল্লাহ বলে চিত্রীর পথে রওনা দিয়ে দিলাম। খাড়া রাস্তায় প্রথমেই খুব কষ্ট হয়। শরীরের নিজস্ব ওজন ছাড়াও মনে হয় আরও আধামন ওজন অদৃশ্য ভাবে পায়ের সাথে আটকে আছে। ৫০-৬০ ফিট পর পরই আমরা থেমে জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। যাত্রা পথে প্রচুর ছবি তুলেছি আমরা। চারিদিকের অসাধারন দৃশ্য আমাদের শক্তি যোগাচ্ছিলো। আকাশের নীলে ডুবে ডুবে পাহাড়ের সবুজ গা বেয়ে উঠতে খারাপ লাগছিলো না। নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগছিলো যে আমরা এমন বন্ধুর পথ দিয়ে হেটে চলেছি দেখে। পাহাড়ের গায়ে পাথর দিয়ে সিঁড়ির মতো করে দেয়া ছিলো তাই সুবিধা হচ্ছিলো। প্রথম ৫০০ ফিট পথে বড় কোন গাছপালা ছিলো না। শুধু ঝোপঝাড়। তারপর শুরু হলো পাইন বন। পাইনের ছায়ায় ভালো লাগছিলো কিন্তু দৃশ্য দেখতে ব্যঘাত তৈরী করছিলো। ঘন্টা খানেক হাটার পর হাটা রাস্তা গাড়ীর রাস্তার সাথে মিশে গেলো। ফলে গাড়ীর রাস্তা দিয়ে উঠতে হচ্ছিলো। সকাল থেকে আমরা কোন পর্যটক বা ট্রেকারকে রাস্তায় পায়নি। কিন্তু আমাদের অতিরিক্ত বিশ্রাম ও ছবি তোলা নিয়ে সময় ব্যয় করার কারনে দেখলাম অনেক ট্রেকার আমাদের পার হয়ে চলে গেল। আসামের একজন পর্যটকের সাথে কিছুক্ষন হাটলাম। বেশী কিছু ইউরোপীয় পর্যটক আমাদের অভিবাদন জানিয়ে দ্রুতলয়ে হেটে পাহারের ভাজে অদৃশ্য হয়ে গেলো। মাঝামাঝি রাস্তায় আমাদের গতি আরও কমে গেলো। কিন্তু আমরা ঠিক করলাম পুরোটা শেষ না করে ফিরে যাব না। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম চিত্রী মনাস্টেরীর মন্ত্রপূত পতাকা গুলো পত পত করে উড়ছে। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার রওনা হয়ে যাই। ধীরে ধীরে পৌছে যাই চিত্রীতে। আমাদের ধারনা ছিলো চিত্রীতে হয়তো কোন বাজার বা লোকালয় থাকবে। কিন্তু পাহাড়ের মাথায় উঠে মনে হলো আমরা বোধহয় পৃথিবীর ছাদে উঠে গেছি। মাথার উপরে শুধুই আকাশ। গাড়ীর রাস্তাটা পাহাড়ের উপর দিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। পাশে একটি ছোট্ট রেষ্টহাউস ও রেষ্টুরেন্ট আরেকটু নিচে চিত্রি প্যাগোডা বা মনাস্টেরী। সত্যিই খুব অদ্ভুত একটি জায়গা। আমরা মনাস্টেরীর সামনে গিয়ে প্রচুর ছবি তুলি। নিজেদের গ্রুপছবি তোলার জন্য কিছু সময় ব্যয় করি। কারন আমরা জানি এই ছবি গুলো সারা জীবন মনে রাখার মতো হবে। রেষ্টহাউসটির নাম হকস্ নেষ্ট।
ছবি তোলা শেষ হলে আমরা হকস্ নেষ্টটে আসি চা নাস্তা খাওয়ার জন্য। হকস্ নেষ্টটের মালিক একজন তিব্বতি নাম ফুংসুক (থ্রি ইডিয়ট সিনেমায় আমির খানের নামও ফুংসুক ছিলো)। ২০ রুপির ওমলেট ১৫ রুপির চা সাথে চিপস। ফুংসুকের সাথে ওর বাপ দাদারা তিব্বত থেকে কিভাবে ভারতে আসলো, ফুংসুকের বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ইত্যাদি গল্প করতে করতে ওর সাথে বেশ ভাব জমে গেলো। পরে ওর সাথে গ্রুপ ছবি তুলি ও থ্রি ইডিয়টের ব্যাপারটা জানে কিনা জিজ্ঞেস করি। ও বেশ মজা পায় যখন জানতে পারে থ্রি-ইডিওটে আমির খানের নাম ওর নামে ছিলো। মানেভঞ্জন আর চিত্রীর অভিজ্ঞতা আমাদের ভিতরে অদ্ভুত অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিলো। দেখলাম এখানে দেশ, জাতি বা ধর্মের চেয়ে মানুষ পরিচয়টিই সবচেয়ে বড়। চিন্তা করে দেখুন আমরা এসেছি বাংলাদেশ থেকে ভারতে, অফিসিয়ালি বেড়াচ্ছি ভারতে, ফুংসুকের হোটেলে খাচ্ছি নেপালে বসে, আর ফুংসুকের বাড়ি মূলত তিব্বতে। এতো জটিল ইকুয়েশন আমাদের মধ্যে আন্তরিকতায় বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনাই। এটাই বোধ হয় মানবতা।
চা নাস্তা শেষ করে ফুংসুকের সাথে সবাই তার রেষ্টহাউসের সাইন বোর্ডের সামনে ছবি তুললাম। তারপর ওকে বিদায় জানিয়ে মানেভঞ্জনের দিকে না ফিরে সান্দাকফু ট্রেকের আরও একটু ভিতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। জুয়েলের ভিতর ততক্ষণে গিয়ার চলে এসেছে। সে হাউকাউ লাগিয়ে দিলো চল আমরা সান্দাকফু পর্যন্ত যাই। ওর মাথায় নাই যে সান্দাকফু যেতে মিনিমাম ৫-৭ দিন লাগবে। আর এবারে আমাদের সেই প্রস্তুতি নেই। ওর নিজেরই ছুটি নির্দিষ্ট। ওকে সবাই মিলে বুঝিয়ে (পড়–ন ঝাড়ি মেরে) থামানো হলো। চিত্রীর পরের ষ্টপেজ বা লোকালয়ের নাম লামেধুড়া। আমরা লামেধুড়ার দিকে কিছুটা হেটে গেলাম। যাওয়ার পথে আর্মিদের ক্যাম্প দেখতে পেলাম। এখানে সৌর বিদ্যুৎ দিয়েই বৈদ্যূতিক চাহিদা মেটানো হয়। লামেধুড়া ও চিত্রির মাঝামাঝি জায়গায় দেখলাম যে এখান থেকে দিনে দিনে দার্জিলিং যেতে হলে আর বেশী দুর আগানো উচিৎ হবেনা। মানেভঞ্জনে ফিরে যাওয়াই বুদ্ধিমানের লক্ষণ হবে। আল্লাহ্ বোধহয় আমাদের মনের কথায় সায় দিলো। দেখলাম মানেভঞ্জনের দিকে একটি খালি ল্যান্ডরোভার জিপ ফিরে যাচ্ছে। সবাই মিলে হিন্দিতে হইচই করে জিপটিকে থামানো হলো। অনেক দরাদরি করে ৩ কিলোমিটার রাস্তা ১৫০ রুপিতে রফা করা হলো। আমান, লিটন ও জুয়েল ড্রাইভারের সাথে সামনে বসলো। আমি পিছনে বস্তার উপর বসে ভিডিও করতে লাগলাম। আড়াই ঘন্টা হেটে যে কষ্ট হয়েছিলো চিত্রী থেকে ফেরার পথে গাড়িতে বসেই আমার সেই কষ্টকে অনেক কম মনে হলো। ঝালমুড়িওয়ালা মুড়ি মাখানোর সময় মুড়ি গুলোকে কত কষ্ট দেয় সেটা বেশ টের পেলাম। মোড় নেবার সময় প্রচন্ড ঝাঁকিতে একবার গাড়ীর এক দেয়াল থেকে আরেক দেখালে বাড়ি খেতে খেতে ১০ মিনিটে পৌছে গেলাম মানেভঞ্জন। বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে জামাকাপড় পাল্টে দার্জিলিং যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ি। দুপুরের রান্নার কথা আগেই বলে গেছিলাম। খাওয়া দাওয়া করে বাড়িওয়ালী ও বাড়িওয়ালার সাথে ছবি তুলি। বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। তখন বাজে দুপুর ২টার মতন। বাসার বাহিরে বের হতেই রিজার্ভ গাড়ি পাওয়া গেলো। মারুতি ওমনি। সুখিয়া পর্যন্ত অন্য প্যসেঞ্জার থাকবে কিন্তু সুখিয়া থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত আমাদের রিজার্ভ নিয়ে যাবে। যাত্রীদের মধ্যে ছোট্ট একটি ছেলে তার পোষা কুকুর নিয়ে আমাদের উল্টা দিকের সিটে বসেছিলো। আমান ও লিটন ওর বেশ কিছু ছবি তুললো।
সব মিলিয়ে দার্জিলিং ভ্রমণের মানেভঞ্জন অংশ আমাদের জন্য বিশাল এক অভিজ্ঞতা। সময় ও সাহস থাকলে এমন অভিজ্ঞতা আপনারও হতে পারে। কি বলেন?
মানেভঞ্জন যাবার জন্য যা যা লাগবে ঃ
১. মানেভঞ্জন ও সান্দাকফু ভ্রমনের জন্য মানসিক ও শারিরিক সামর্থ থাকতে হবে।
২. ভারতের ভিসা লাগবে।
৩. শীতের জামাকাপড় ও পাহাড়ে চলাফেরা জন্য উপযোগী জুতা
৪. ফাস্টএইডের ঔষধপত্র
৫. ম্যাপ
৬. মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যাবার জন্য অবশ্যই গাইড নিতে হবে।
৭. দুর্গম এলাকায় থাকা খাওয়ার জন্য টাকা পয়সা বেশী লাগে তাই প্রয়োজনীয় টাকার থেকে বেশী টাকা সাথে থাকলে ভালো।
৮. পারলে সান্দাকফু নিয়ে লিখা অনলাইন ব্লগ পড়ে আসবেন
যেভাবে যাবেনঃ
১. শ্যামলী বাসে করে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি
২. শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং
৩. দার্জিলিং থেকে গাড়ি রিজার্ভ করে সরাসরি মানেভঞ্জন অথবা মিরিকের বাসে করে সুখিয়াপোখরি নেমে গাড়ি রিজার্ভ করে মানেভঞ্জন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৪