সকাল ১১টা।
বিজয়স্বরনীর সিগন্যালে একটা গাড়ি দাড়িয়ে আছে। সেটার মাথায় সাইরেন বাজে; শব্দ হয়। মৃত্যুর শব্দ। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া তিনজন মানুষ। অসীম, অসীমের মা আর তার বাবা। অসীমের বাবার রাজীব দাস। অ্যাম্বুলেন্সের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ডানপাশে অসীম আর বা'পাশে অসীমের মা। চোখের সামনে নিজের স্বামীর এমন অবস্থা দেখে নিঃস্তব্ধতা যেন অসীমের মাকে প্রতি সেকেন্ডে হত্যা করছে।
এমন তাগড়া দেহযুক্ত মানুষটাকে বিধাতা হঠাৎ এমন নিস্তেজ করে দিবেন! এটা তো কল্পনাতীত। অসীম পাশে বসে অপলক বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে। বাবার চোখের কোনায় জমে থাকা একফোটা শিশিরকণা যেন তার চোখে কান্না হয়ে ঝরতে চায়। তবে পুরুষ বলেই বোধহয় পারছে না! জীবনে কোনদিন কাঁদেনি অসীম। তবে আজকে চোখের সামনে বাবার নিথর দেহটা দেখে চোখে যেন বর্ষা জমেছে।
অসীমের বাবা স্ট্রোক করেছে আজকে সকালে। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। তবে আজকে অবস্থা একটু বেশিই খারাপ। গতবার যখন করেছিল, যথা সময়ে হাসপাতালে নিতে পেরেছিল বলেই সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিল। আজকে দশটার দিকে অবস্থা খারাপ দেখে অ্যাম্বুলেন্স ফোন করে সাথে সাথে হাসপাতালের জন্যে বের হইছে। তবে জীবন যেন সভ্যতার প্রতিটা মোড়ে আটকে গেছে। পরাধীনতা যেন গলাটিপে আকড়ে ধরেছে নাক, মুখ, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস সব।
আজকে রবিবার। সরকারি কার্যদিবস। রাস্তায় অনেক জ্যাম। বিজয়স্বরণীর জ্যামে বসে আছে অ্যাম্বুলেন্সটা। মৃত্যুর শব্দ বাজিয়ে কিছুক্ষণ পরপর লাল সাইরেনটা বেঁজে উঠছে। তের মিনিট হতে চললো৷ সিগন্যাল এখনো ছাড়েনি। সামনে পেছনে যতোদূর চোখে পড়ে কেবল গাড়ির সাড়ি। এই তের মিনিট যেন তেরো'শ আলোকবর্ষের চেয়েও দীর্ঘ! জীবনের কঠিন মূহুর্তে সময় বড়ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
রাজীব সাহেবের চোখদুটো বন্ধ। দেহের নড়াচড়া নেই। শুধু শ্বাস-প্রশ্বাস নিঃশব্দে এপার-ওপার করছে। মানুষটার মনের জোর অনেক। জোর থাকবেই না কেন! নিজের হাতে দেশের জন্যে লড়েছেন। বাবা-মাকে না জানিয়ে যুদ্ধে গিয়েছেন আরেক মাকে বাঁচানোর জন্যে। আর সেই দেশমাতা আজকে তাকে গলাটিপে মেরে ফেলছে।
সিগন্যাল এখনও ছাড়েনি। লোকটার অবস্থা শুধুই মৃত্যুর দিকে গমন করছে। অসীমের চোখ থেকে আবেগ গড়িয়ে পড়ছে বাবার দেহের কাছে। তার মায়ের অবস্থাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বারবার মূর্ছা যাচ্ছে; কিছুক্ষণ পরপর চোখে পানি ছিটিয়ে জাগানো হচ্ছে। অসীম আর না পেরে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দেখলো কোন ব্যবস্থা করা যায় কিনা।
লাভ নেই! অ্যাম্বুলেন্সকে এক পা সামনে পেছনে নেওয়ার ঠাঁই নেই। সামনে গিয়ে শুনতে পেল- কোন এক সম্মানিত ব্যাক্তি যাবে বলে এই রাস্তায় এখন সিগন্যাল দিয়ে রাখা হয়েছে। আরও কিছু সময় লাগবে সিগন্যাল ছাড়তে। অসীম প্রায় পাগলের মতো মানুষগুলোর কাছে মিনতি করছিল, অন্তত তার বাবার অ্যাম্বুলেন্সটা যেতে দেওয়ার জন্যে। তবে লাভ হলো না। সম্মানিত ব্যাক্তির সম্মান এতটাই যে তার জীবনের নিরাপত্তায় যে কারো জীবন বিসর্জন করতে হবে। অ্যাম্বুলেন্সও ছাড়া যাবেনা। অসীম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে অজস্র পানির কণা দেশমাতার বুকে গড়িয়ে পড়ছে। যে দেশকে তার বাবা স্বাধীনতা দিয়েছে, সে দেশের কাছে এখন তার বাবার জীবন তুচ্ছ তাসে পরিণত হয়েছে। বিধাতা কি করে এত অবিচার সহ্য করেন!
অ্যাম্বুলেন্সের লাল সাইরেনটা এখনও বেজে যাচ্ছে। তার গলার স্বর যেন বড়ই ক্লান্ত। যেন জীবনের অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে গেছে। আর শব্দ করার শক্তি নেই। অসীম এসে দেখে তার মা আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তার বাবার চোখদুটো বন্ধ। তবে অক্সিজেন থলেটা আর নড়াচড়া করছে না। ঠিক তার বাবার দেহের মতোই। শ্বাস-প্রশ্বাসও আর যুগলবন্দী করছে না এই দেশমাতাতে বাঁচার তাড়নায়।
রাজীব সাহেব মারা গেছেন। অসীম আর তার মা মৃত দেহটার পাশে বসে আছেন। দু'জনের হৃদযন্ত্র যেন পাথরখন্ড হয়ে গেছে! যেন জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে দুজন। অ্যাম্বুলেন্সের লাল সাইরেনটা এখন আর বাজছে না। জীবনের অবশিষ্টাংশ নিঃশেষ করে সে বড়ই ক্লান্ত!
সিগন্যাল ছাড়া হলো। অ্যাম্বুলেন্স আর হাসপাতালে গেল না। গঙ্গার তীরে শেষকৃত্যের আয়োজন করা হচ্ছে। ওখানেই যেতে হবে।
বিধাতার কাছে।
মৃত্যুর কাছে।