পিএসসি-২০০৮ ও কনোকোফিলিপস-এর সঙ্গে সর্বনাশা চুক্তি বাতিল কর।
পিএসসি ২০১১ প্রক্রিয়া বন্ধ করে সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র থেকে অবিলম্বে গ্যাস উত্তোলন কর।
ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন করে জাতীয় সংস্থা গঠন কর।
‘খনিজসম্পদ রফতানি নিষিদ্ধ’ আইন পাশ কর।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে জাতীয় কমিটির ৭ দফা দাবি বাস্তবায়নে কর্মসূচি ঘোষণা।
গত ১৬ জুন শতকরা ৮০ ভাগ কোম্পানির মালিকানা ও শতভাগ গ্যাস রফতানির বিধান রেখে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপস এর সঙ্গে সর্বনাশা চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। উল্লেখ্য যে, স্থলভাগে ও অগভীর সমুদ্রে পিএসসি স্বাক্ষরের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের রয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ থেকে শুরু করে সম্পাদিত চুক্তিগুলোর ফলাফল এখন আমাদের সামনে পরিষ্কার। পুঁজির ও সক্ষমতার অভাবের কথা বলে বিদেশি কোম্পানির হাতে একের পর এক গ্যাসব্লক তুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু যে পরিমাণ পুঁজি হলে জাতীয় সংস্থা এক দশমাংশ দামে গ্যাস সরবরাহ করতে পারতো সেই পুঁজির সংস্থান করা হয়নি কিন্তু তার দশগুণ বেশি অর্থ এখন প্রতিবছর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। প্রযুক্তির অভাবের কথা বলে বিদেশি কোম্পানির হাতে গ্যাসব্লক তুলে দেয়া হলেও তাদের কারণে মাগুড়ছড়া ও টেংরাটিলা ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে, আমাদের প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম ক্রমান্বয়ে বাড়ছে, সেখান থেকে এই গ্যাস কিনতে এখন ৫০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হবে। ন্যূনতম এই পরিমাণ টাকা শেভ্রন ও নাইকোর কাছে আমাদের পাওনা। যা আদায়ে কোন উদ্যোগ এ যাবৎ কোন সরকার নেয়নি।
বেশি দামে গ্যাস কেনার কারণে ভর্তুকি বাড়ছে। ভর্তুকির টাকা যোগান দেয়ার জন্য জাতির উপর ঋণের বোঝা বাড়ছে, বাড়ছে করের বোঝা। অন্যদিকে ভর্তুকির চাপ কমানোর জন্য বারবার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এর কারণে সকল দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতি তৈরি হচ্ছে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, প্রকৃত আয় কমছে। দারিদ্র্য বাড়ছে। শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে ব্যয়বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। কমিশনভোগী দুর্নীতিবাজদের সর্বক্ষেত্রে দাপট বাংলাদেশকে ভয়ঙ্কর সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
এরকম অভিজ্ঞতার মুখেই পিএসসি ২০০৮-এর অধীনে কনোকোফিলিপস এর সঙ্গে রফতানিমুখি চুক্তি করা হলো। এই চুক্তির কারণে বাংলাদেশ কেন ও কীভাবে আরও ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখিন হবে তা আমরা বিস্তারিত আগে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছি। এ বিষয়ে গত দু’বছরে জাতীয় কমিটি ও স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের উপস্থাপিত সকল যুক্তি, তর্ক, জনমত অগ্রাহ্য করে সরকার যখন ১৬ জুন চুক্তি স্বাক্ষর করে তখন আমরা এর প্রতিবাদে হরতালসহ অন্যান্য কর্মসূচি দিতে বাধ্য হই। প্রথম থেকেই সরকার যুক্তি তথ্যের মোকাবিলা করতে না পেরে বলপ্রয়োগের নীতি গ্রহণ করে। যার চরম রূপ আমরা দেখেছি গত ৩ জুলাই আমাদের হরতালকালীন সময়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পুলিশী গ্রেফতার, হামলা, ভয়ঙ্কর নির্যাতন ও মামলার মধ্যে। আমরা বারবার বলেছি দমন-পীড়ন করে এই আন্দোলন থামানো যাবে না।
কনোকোফিলিপস এর সঙ্গে চুক্তির সময় যুক্তি হিসেবে বারবার বলা হয়েছে এবং হচ্ছে যে, স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের যোগ্যতা থাকলেও আমাদের তা সমুদ্রবক্ষে নেই। এখন আবার সুনেত্রসহ স্থলভাগে অবশিষ্ট গ্যাসব্লকসমূহ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেবার জন্য ‘পিএসসি ২০১১’ করবার প্রক্রিয়া চলছে। স্থলভাগে দক্ষতা ও যোগ্যতার বারবার প্রমাণ দেয়া সত্ত্বেও কেন ‘পিএসসি ২০১১’ করে অবশিষ্ট সকল ব্লক বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার আয়োজন হচ্ছে? স্পষ্টতই এই কারণে যে, দক্ষতা বা পুঁজির অভাব এগুলো সবসময়ই বাহানা। প্রকৃত উদ্দেশ্য কমিশন, দুর্নীতি বা অন্য কোন দায়বদ্ধতার কারণে জাতীয় সম্পদে বিদেশি কোম্পানির দখলদারিত্ব নিশ্চিত করা।
সুনেত্র গ্যাস ক্ষেত্র গতবছর বাংলাদেশেরই বাপেক্স আবিষ্কার করেছে। অবিলম্বে এই গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের জন্য বাপেক্সকে সুযোগ দিলে চার বছরের মাথায় এখান থেকে গ্যাস পাওয়া সম্ভব। যাতে আর কোন গ্যাস সংকট তথা বিদ্যুৎ সংকট থাকবে না। এই কাজের জন্য আগামী চার বছরে ৫০০ কোটি টাকার বেশি লাগার কথা নয়। উল্লেখ্য যে, পেট্রোবাংলা এখন প্রতি বছরেই ভ্যাট এবং অন্যান্য বাবদ প্রতিবছর এর কয়েকগুণ সরকারকে জমা দেয়। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গত অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩,২৬৩ কোটি টাকা। সরকারকে পেট্রোবাংলা প্রতিবছর যে পরিমাণ অর্থ জমা দেয় তা সমুদ্র ও স্থলভাগ দু’ক্ষেত্রের গ্যাস অনুসন্ধানের জন্যই যথেষ্ট।
বিবেচনা করুন, পুঁজির অভাবের কথা বলে কনোকোফিলিপস এর সাথে চুক্তি করা হলো অথচ কনোকোফিলিপস আগামী ৫ বছরে যে বিনিয়োগ করবে তার পরিমাণ মাত্র ১১০ মিলিয়ন ডলার বা বছরে গড়ে ২২ মিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী এর পরিমাণ ১৬৫ কোটি টাকা প্রতি বছর। সরকার এক বছরের বিলাসিতা, নতুন গাড়ি কেনার বরাদ্দ বাতিল করলেই এই টাকা পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থায় এই পরিমাণ অর্থ প্রয়োজনের নিরিখে অতিশয় তুচ্ছ। উপরন্তু দক্ষতা-প্রযুক্তির অভাবের যুক্তিও দেয়া হয়। কিন্তু কনোকোফিলিপস বর্তমানে বিশ্বের ১৪টি স্থানে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান করছে যেখানে রিগ ভাড়াসহ নানা কাজে নানা প্রতিষ্ঠানকে সাবকন্ট্রাক্ট দিয়ে কাজ চলছে। বঙ্গোপসাগরেও তারা তাই করবে। এই একই কাজ বাংলাদেশ নিজের মালিকানা রেখে করতে পারতো।
জাতীয় সংস্থার কর্তৃত্বে প্রয়োজনে সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে এই গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত হলে যে পার্থক্যটি দেখা দিত তা বিশাল:
-গ্যাসসহ সকল সম্পদের পূর্ণ তথ্য জনগণের কাছে থাকতো এবং তার উপর শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত হত।
-দেশের অর্থনীতির প্রয়োজন অনুযায়ী গ্যাস উত্তোলন নিশ্চিত হত।
-অনেক কম দামে গ্যাস প্রাপ্তি অর্থাৎ শিল্প কৃষিতে সুলভে গ্যাসের ব্যবহার নিশ্চিত হত।
-রফতানির ঝুঁকি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা যেত।
-মুনাফার তাড়নায় যেসব দুর্ঘটনা করছে কনোকোফিলিপস সেসবের ঝুঁকি অনেক কমে যেতো।
-বঙ্গোপসাগরের বিশাল সমুদ্রের উপর জাতীয় কর্তৃত্বের উপর হুমকি সৃষ্টি হত না। অর্থাৎ
-জ্বালানী নিরাপত্তা ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত হত।
বলা দরকার যে, কনোকোফিলিপস ইতিমধ্যে ‘দুর্ঘটনার রাজা’ বলে কুখ্যাতি অর্জন করেছে এবং সর্বশেষ জুন মাসে ও পরে ১৩ জুলাই চীনের বোহাই উপসাগরে তেল উত্তোলন কার্যক্রমে যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে তার জন্য কনোকোফিলিসের সকল কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে।
জাতীয় সম্পদের উপর শতভাগ জাতীয় মালিকানা ও জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের এই আন্দোলন বিদেশি কোম্পানির কমিশনভোগী, দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত ছাড়া সকল মানুষের স্বার্থের আন্দোলন। এই আন্দোলনের সাফল্যের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশের মানুষ আর সম্পদের মালিকানা উদ্ধার করতে পারবেন কি না, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের টেকসই সমাধান করে শিল্প ও কৃষির বিকাশ নিশ্চিত করতে পারবেন কি না, বিদেশি কোম্পানিকে ভর্তুকি না দিয়ে সেই টাকায় শিক্ষা চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারবেন কি না, সর্বোপরি দেশের সম্পদ দেশের কাজে শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভিত্তি নির্মাণ করা যাবে কি না। এই আন্দোলনের ব্যর্থতার তাই কোন সুযোগ নেই। অস্তিত্বের জন্যই বাংলাদেশের মানুষকে এই আন্দোলনে বিজয় অর্জন করতে হবে।
আমাদের পরবর্তী কর্মসূচিঃ
২৭-৩১ জুলাইঃ পাঁচটি দলে বিভক্ত হয়ে দেশের পাঁচটি প্রান্ত পর্যন্ত (ঢাকা-পঞ্চগড়, ঢাকা-মংলা, ঢাকা-সুনামগঞ্জ, ঢাকা- কক্সবাজার, ঢাকা-বরগুনা) জনসংযোগ কর্মসূচি।
১৯ আগস্টঃ কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি সভা।
২৬ আগস্টঃ দেশব্যাপী ফুলবাড়ী দিবস পালন। উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধ, এশিয়া এনার্জি নিষিদ্ধসহ ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন এবং বড়পুকুরিয়ায় হামলা-মামলা-ভূমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে উন্মুক্ত খনির চক্রান্ত বন্ধের দাবিতে দেশব্যাপী সভা-সমাবেশ।
২৪-২৬ সেপ্টেম্বরঃ পিএসসি ২০০৮ ও কনোকোফিলিপস এর সঙ্গে চুক্তি বাতিলসহ ৭ দফা দাবিতে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে প্রচারযাত্রা। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডমার্চ।
২২-২৫ অক্টোবরঃ পিএসসি ২০১১ এর প্রক্রিয়া বন্ধ এবং জাতীয় সংস্থার মাধমে অবিলম্বে সুনেত্র গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলনের কাজ শুরুসহ ৭ দফা দাবিতে ঢাকা-সুনেত্র (সুনামাগঞ্জ-নেত্রকোনা) লংমার্চ।
২৬ নভেম্বরঃ ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচির শেষে জাতীয় সম্পদের উপর জনগণের কর্তৃত্বনিশ্চিত করতে জাতীয় কমিটির ৭ দফা দাবিতে ঢাকায় মহাসমাবেশ।
এসব কর্মসূচী সফল করতে দেশের সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।
(তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির আজকের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য
১৫ জুলাই ২০১১, মুক্তি ভবন, মৈত্রী মিলনায়তন, ঢাকা।)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১১:০২