কলকাতার ব্যান্ড দোহার মাতিয়ে দিয়ে গেল এই ঈদ। বলা উচিৎ ঈদের খুশিতে বাংলাদেশের মানুষকে একধাপ ভাসিয়েও দিয়ে গেল। একারণে আমাদের দেশ টেলিভিশনের ধন্যবাদ পাওনা হলো দর্শকদের কাছ থেকে। আমরা তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এই পুরো বিশেষ অনুষ্ঠানটির উদ্যোগ ভালো লেগেছে। মনে হলো টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বুদ্ধি খুলেছে। তবে উপস্থাপনা যাচ্ছেতাই হয়েছে। শিল্পীদের গানের পরিবেশনার কল্যানে অবশ্য তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া যায়। যাইহোক, আমরা খুশি।
প্রথম দিন দুই বাংলার বাউল শিল্পীদের গানের আসর মন মাতালো। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন যথাক্রমে দোহার আর চন্দ্রবিন্দু। তারাও মন মাতালো, উদ্বেলিত করলো। এবং সাধারণ দর্শকরা আনন্দিত হলো।
বাউল আর চন্দ্রবিন্দুর গান বিষয়ে আলোচনা না করে আমার বরং দোহারের কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যা দেখেছি, শুনেছি সেখান থেকেই লেখার চেষ্টা করেছি কোন কারণ ছাড়াই।
দোহার দেশীয় গান করে- চলতি অর্থে যাকে আমরা লোকসংগীত বলে ডাকি। অসাধারণ কথা আর সুরের মায়াজালে আবদ্ধ এইসব গান আবহমান কালের। দীর্ঘ দিনের সঞ্চিত বাংলা গানের ভাণ্ডার থেকে পুরাতনী এইসব গান মুঠো মুঠো তুলে এনে আধুনিক নাগরিকদের সামনে তুলে ধরার প্রতিভা সত্যি বিরল; তাও আবার দেশীয় যন্ত্রানুষঙ্গে। খুব অবাক লাগে, একটি গানের দল, যারা নাকি নিজেরা গান লেখে না, পুরনো গায়েন আর কবিদের গান করে দেশীয় যন্ত্র বাজিয়ে, সেই দলটা কলকাতার মতো নগরে এখনো কী করে টিকে আছে? কীসের জোরে? গানের কথা, সুর, কম্পোজিশন, নাকি অন্যকিছু? গবেষণার বিষয়ই বটে।
অসাধারণ টিম স্পিরিট। পুরোদস্তুর প্রোফেশনাল। দীর্ঘদিন গানের পেছনে ছোটা আর চর্চার কারণেই এটা সম্ভব। আমাদের বড় বড় ব্যান্ডগুলোর ভেঙ্গে যাবার খবর যেখানে আমাদের কষ্ট দেয় সেখানে দোহার পুরো উল্টে পিঠ দেখালো। শ্রদ্ধাবোধ, বিনয় আর পারষ্পরিক সহযোগিতা থেকে এটা অর্জন করা সম্ভব বলে আমাদের ধারনা।
মুগ্ধ করেছে গানের পেছন পেছন দোহারের ছুটে বেড়ানো। আক্ষরিক অর্থেই চষে বেড়ানো। কোথায় গানের কোন ধারা আছে, সেটা খুঁজে দেখা আর যাই হোক সাহস না থাকলে করা যায় না। বিষয়টা শ্রমসাপেক্ষ, সময়সাপেক্ষ এবং অভিনিবেশ সাপেক্ষও বটে। অর্থনৈতিক দিকটা বাদ দিলাম। কারণ, অর্থ দিয়ে আর যাইহোক এসব কাজ হয় না। অন্তত আমার অভিজ্ঞতা সেটা বলে। দোহারকে নিয়ে লেখার এটা বড় একটা কারণ। যেসব জনপ্রিয় দেশীয় গান আমরা শুনি সেগুলোর শানেনুজুল জানা মানুষের সংখ্যা খুবই কম আমাদের দেশে। দোহার সেটা জানার চেষ্টা করেছে দীর্ঘদিন। গান করে এমন একজনের কাছে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে এটা দোহারের প্রথম টেলিভিশন পারফর্মেন্স হলেও গান খোঁজার জন্য এদেশে তাদের আনাগোনা ছিলো বেশ আগে থেকেই। তাছাড়া সিলেটে তারা ঢাকার আগেই প্রোগ্রাম করে গেছে। সুতরাং সেখানকার গানের খোঁজ খবর তাদের কাছে আছে। তখন শাহ্ আবদুল করিম জীবিত ছিলেন। তাছাড়া ভাওয়াইয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক গান সম্পর্কেও তাদের জানাশোনা আছে বলেই ধারনা করা যায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ন অঞ্চলের গান সম্পর্কে তাদের ধারনা যে অনেক সমৃদ্ধ সেটা না বললেও বোঝা গেছে তাদের কথাবার্তা থেকে। তাদের বলার যে ভঙ্গি যথেষ্ট তথ্য না থাকলে সেভাবে বলা যায় না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। মলআ সম্পর্কে আমাদের হাতে তথ্য আছে কি? এশিয়াটিক সোসাইটির লোকসংস্কৃতি (৭ম খণ্ড) খুঁজলাম, পেলাম না (বাংলাপিডিয়ায় পাওয়া যেতে পারে। কেউ কিছু পেলে জানাবেন দয়া করে। আমি যতটুকু তথ্য জানি তা নিতান্তই অপ্রতুল। তাই উল্লেখ করা উচিৎ হবে না)। অথচ এই মলআর তিনজন আমাদের গানের জগতে একেকটি নক্ষত্র। দেশী শিল্পী এবং গবেষকদের কাছ থেকে মলআর কথা শোনা যায় না খুব একটা। দোহার আমাদের গানের ফাঁকে ফাঁকে কথার ছলে জানিয়ে দেয় মলআর কথা। আমরা যে কত আত্মবিস্মৃত জাতি এই ছোট্ট তথ্যটি তার প্রমাণ। এছাড়া সোহাগ চাঁদ শিরোনামের জনপ্রিয় গানটির ভদ্রসংস্করণ আর অমার্জিত সংস্করণের কথা আমরা জানি তাদের কাছ থেকেই। এবং দোহার খুব দৃঢ়ভাবে বলে, ভদ্র লোকের হাতে পড়লে লোকগানের এরকম দশাই হয়। আমি খোঁজ খবর করে দেখেছি খুব অল্প মানুষই এই তথ্যটা জানে আমাদের দেশে। নতুন প্রজন্মে তরুণ তুর্কিরা যে এসব তথ্যের অনেক উর্ধ্বে সেটাও আকিষ্কার করেছি ইতিমধ্যে। লোকসাহিত্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গের ভদ্রসংস্করণের উদাহরণ আমাদের কাছে বিরল ঘটনা অবশ্য নয়। তবে ভদ্রলোকদের কেউ এটা স্বীকার করেছেন (যেমন, রবীন্দ্রনাথ), কেউ স্বীকার করেননি।
দোহারের আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য দেশীয় যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার। অদ্ভূত বিষয়ই বটে। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র যেখানে বিলুপ্ত প্রায় সেখানে দোহার সেটাই ব্যবহার করছে মেধাবী আর বুদ্ধিদীপ্তভাবে। ধামসার ব্যবহার কি আছে আমাদের দেশে? ভাওয়াইয়া গানে এখন কি ঢোলের ব্যবহার হয়? আমিতো তবলা, এমনকী অক্টোপ্যাড বাজাতেও দেখেছি। দোহার ঢোলের বোলের সাথে ভাওয়াইয়া পরিবেশন করে জানালো, ঢোল ছাড়া ভাওয়াইয়ার অর্ধেকও পূর্ণ হয় না। সারিন্দার ব্যবহার আমাদের দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। হাতে গোনা কিছু শিল্পী (লোকশিল্পীই বটে) অবশ্য এখনো ধরে রেখেছে এটা। দোহার এটা ব্যবহার করে। যাইহোক, আমি বলতে চাইছি দেশীয় গানের সাথে দেশীয় যন্ত্রের ব্যবহার কতোটা চমকপ্রদ হতে পারে এটা না দেখলে বোঝা যায় না। অবশ্য আমরা করিম শাহর গান স্টুডিওর ভেতর জন্মাতে দেখেই তো অভ্যস্ত। যে গানের টানে আবার যান্ত্রিক কণ্ঠও যোগ দেয়।
আমাদের দেশে অনেকেই বলেন, লোকসংগীত নিয়ে কান্না করার সময় শেষ। নাগরিক বাউলদের কল্যাণে এই যুগে তবুও যে ছেলে-মেয়েরা এসব গান শুনছে তাই তো যথেষ্ট। হাসি পায় বটে। কারণ দোহারের পরিবেশনার পরে আমরা অনুমান করতে পারি, বাংলাদেশের নাগরিক গায়েনদের লোকসংগীতের চর্চা এখনো শুরু হয়নি। শেষ হওয়া তাই সুদূর পরাহত।
একটি প্রশ্ন বেশ ঘুরপাক খায়। বাংলাদেশে লোকগান করার অনেক লোক দেখি। কিন্তু দোহারের মতো ধারা কেউ গড়ে তুলতে পারলো না কেন? ফিউশন-টিউশন থাকতে পারে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু মূলধারা কী থাকবে না? মূল ধারার উপরেই না ফিউশন করার, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার চেষ্টা হতে পারে। ধারাটাই তো নাই, ফিউশন হবে কোথায়? ফলে লোকসঙ্গীত নিয়ে যা হয়েছে এবং হচ্ছে সেটাকেই আমরা তার ভবিতব্য মানতে পারি/ বাধ্য। আমরা যারা ‘আম শ্রোতা’, আমাদের যেভাবে গেলানো হবে সেভাবেই আমরা গিলবো। এসব করে ধনী পিতার ফকির সন্তানগণ দেশের গণ্ডী পেরিয়ে সাতসমুদ্দুর তের নদীর ওপারে মিউজিক্যাল এক্টিভিস্ট হিসেবে পরিচিতি পাবে তাতেও কোন খেদ নেই। খেদ শুধু একটাই, আমাদের একটা দোহার নেই। যারা শুধুই আমাদের গান করবে, আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো করে নয়। আমাদের মতো করে। কিন্তু তাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকবে মনের ভেতর।